নিশ্চয় আমার কওম এ কুরআনকে পরিত্যাজ্য গণ্য করেছে উক্ত আয়াতের সঠিক তাফসীর

প্রশ্ন: আল্লাহ বলেন: আর রাসূল বলবে, ‘হে আমার রব, নিশ্চয় আমার কওম এ কুরআনকে পরিত্যাজ্য গণ্য করেছে।”(সূরা আল-ফুরকান,২৫/৩০) উক্ত আয়াতের সঠিক তাফসীরে কি?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পবিত্র কুরআন বিশ্বমানবতার জন্য স্থায়ী ও চূড়ান্ত সংবিধান। আল-কুরআন আসমানের নিছে জমিনের উপরে যেমন সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ, ঠিক তেমনি সর্বার্ধিক সম্মানী ও মর্যাদাপূর্ণ কালাম। সর্বশ্রেষ্ঠ মু‘জিযা হিসাবে শব্দের গাঁথনি, ভাষার নৈপুন্য, ছন্দময় বাক্য এবং উন্নত বালাগাত-ফাসাহাত সমৃদ্ধ এক বিষ্ময়কর সংবিধান। এর প্রভাবেই পৃথিবী থেকে তমসাচ্ছন্ন জাহেলিয়াত বিদূরীত হয়েছিল। বঞ্চিত মানবতা ফিরে পেয়েছিল তাদের ন্যায্য অধিকার। ভ্রান্ত আক্বীদা, উদ্ভট চেতনা এবং বস্তাপচা সব মতবাদ বিতাড়িত হয়েছিল। তাই কুরআনের মত অতুলনীয় কিতাব আর দ্বিতীয়টি নেই। অথচ আজ জাতি এই কুরআন থেকে দুরে।
.
সমাজের অধিকাংশ মানুষই আজ কুরআন শিক্ষা থেকে উদাসীন। বড়রা ব্যস্ত দুনিয়া আর দুনিয়াদারি নিয়ে। ছোটরা ব্যস্ত স্কুলের রুটিন নিয়ে যেখানে কুরআন শিক্ষার জন্য পর্যাপ্ত সময় দেয়া হয় না। যথাযথ যত্নও নেয়া হয় না। শিক্ষকরাও তাদের প্রতি কাম্য দায়িত্ব পালন করেন না। আর তাদের অবশিষ্ট সময় অপচয় হয় রাস্তা-ঘাটে খেলাধুলার পেছনে। ফলে তারা কুরআন সম্পর্কে অজ্ঞ হয়ে বেড়ে উঠছে। তাই দেখা যায় বড় বড় ডিগ্রি নিয়ে বড় হচ্ছে অথচ শুদ্ধভাবে আল্লাহর কিতাবের একটি আয়াতও পড়তে পারে না। এজন্যই দেখা যায় গ্রামাঞ্চলের অনেক মসজিদেই এখনো শুদ্ধ তিলাওয়াত করতে পারে এমন ইমাম পাওয়া যায় না। আর এসবের প্রধান কারণ সন্তানদের কুরআন শিক্ষার ব্যাপারে পিতা মাতারদের অবহেলা। পিতা মাতারা জানেন না তাদের সন্তান কুরআন পড়তে পারে কি-না। এমনি আজ অধিকাংশ মুসলমানই কুরআনকে ছেড়েই দিয়েছে। দেখুন আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলার কাছে কীভাবে অভিযোগ করবেন মহান আল্লাহ বলেন: আর রাসূল বলবে, ‘হে আমার রব, নিশ্চয় আমার কওম এ কুরআনকে পরিত্যাজ্য গণ্য করেছে।” [সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ৩০]
.
উক্ত আয়াতের তাফসিরে ইমাম ইবনু কাসীর (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৭৪ হি.] বলেছেন: মক্কার কুরাইশরা কুরআন তিলাওয়াতের সময় শোরগোল ও হৈচৈ করত এবং তা শ্রবণ করত না—এটা কুরআন পরিত্যাগ।কুরআন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা না করা, কুরআন বুঝতে চেষ্টা না করাও কুরআন পরিত্যাগ করার মধ্যে গণ্য। কুরআনের আমল ছেড়ে দেয়া, এর নির্দেশ পালন না করা এবং নিষেধ উপেক্ষা করাও তা পরিত্যাগ করার মধ্যে গণ্য। এবং কুরআন ছেড়ে অন্য কথা-কাব্যে, অনর্থক বাক্যালাপ ও গান-বাজনায় ডুবে থাকাও পরিত্যাগ করার মধ্যে গণ্য।(তাফসিরুল কুরআনিল আযিম: খন্ড: ৬ পৃষ্ঠা: ১৮৮)
.
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৫১ হি.] বলেছেন,কুরআন ত্যাগ করার অনেক ধরণ রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে:
.
(১) প্রথমত: কুরআন শ্রবণ না করা, এর প্রতি ঈমান না আনা এবং কুরআনের প্রতি মনোযোগ না দেওয়া।
.
(২) দ্বিতীয়ত: কুরআন অনুযায়ী আমল ত্যাগ করা, কুরআনের হালাল ও হারামের কাছে অবস্থান না করা; যদিও সে কুরআন তিলাওয়াত করে এবং এর প্রতি ঈমান আনে।
.
(৩) তৃতীয়ত: কুরআন অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা না করা ও কুরআনের ফয়সালা না মানা।
.
(৪) চতুর্থত: কুরআন নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা ও বুঝে পড়া পরিত্যাগ করা এবং কুরআন থেকে আল্লাহর উদ্দেশ্য বুঝা বাদ দেওয়া।
.
(৫) পঞ্চমত: অন্তরের সব রোগ-ব্যাধির নিরাময়ে কুরআনকে ঔষধ হিসেবে গ্রহণ করা পরিত্যাগ করা। যার ফলে সে কুরআন ছেড়ে অন্য কিছু দ্বারা আরোগ্য লাভে চেষ্টা করে এবং কুরআন দ্বারা চিকিৎসা করানো না মানা। উপরোক্ত সব প্রকার নিম্নোক্ত আয়াতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,“আর রাসূল বলবে, ‘হে আমার রব, নিশ্চয় আমার কওম এ কুরআনকে পরিত্যাজ্য গণ্য করেছে।” [সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ৩০] যদিও কতিপয় পরিত্যাগ একটির তুলনায় অন্যটি বেশি জঘন্য।এ সব লোকদের অন্তরে কুরআনের দ্বারা সংকীর্ণতা সৃষ্টি হয়। আর তারা নিজেরা তা বুঝতে পারে এবং এ জটিলতা তারা অন্তরে অনুভব করে। দীনের মধ্যে বিদ‘আত সৃষ্টিকারী এমন কাউকে পাবে না, উক্ত বিদ‘আত করার সময় যার অন্তরে কিছু আয়াতের ব্যাপারে সংকীর্ণতা আসে না, বিশেষ করে যে সব আয়াত তাদের ও তাদের কাজের মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অতএব, এ বিষয়টি নিয়ে ভালোভাবে চিন্তা-গবেষণা করো। অতঃপর নিজের জন্য যেটা পছন্দ করো সেটি গ্রহণ করো।(ইবনুল ক্বাইয়িম,আল-ফাওয়ায়েদ বৈরূত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, ২য় সংস্করণ পৃষ্ঠা: ৮২)

পরিশেষ প্রিয় পাঠক! কুরআন হলো ওহির জ্ঞান। তাই,কুরআনকে গুরুত্ব দিন।এতে আপনার জীবন আলোকিত হবে,ইনশাআল্লাহ্। প্রতিদিন অন্তত ২০ মিনিট সময় তিলাওয়াত করুন এবং কিছু সময় অর্থসহ পড়ুন। সম্ভব হলে তাফসির পড়ুন। কিছু না পারলে অন্তত তিলাওয়াত শুনুন। যেকোনোভাবে কুরআনের সংস্পর্শে থাকুন। এই কুরআন হলো পরশ পাথর। এর সংস্পর্শে এলে সবকিছু বদলে যায়। কুরআন থেকে উপকৃত হওয়ার সুযোগ কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে কুরআনময় জীবন দান করুন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
____________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।