কারো নাম বিকৃত করে ডাকা কি ঠিক এবং কাউকে কিভাবে ইসলাহ বা ইলমি খন্ডন করা উচিত

প্রশ্ন: কারো নাম বিকৃত করে ডাকা কি ঠিক?
একজন সালাফি মানহাজের আলেম বা দ্বীনি ভাইকে কিভাবে ইসলাহ বা ইলমি খন্ডন করা উচিত?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
▪️প্রথমত: কষ্ট দেওয়া বা উপহাস করার উদ্দেশ্যে কাউকে মন্দ নামে ডাকা জায়েজ নয়। এটি কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। কারণ শরীয়তের দলিল মানুষকে মন্দ নামে ডাকতে নিষেধ করে। যেমন: মহান আল্লাহ বলেন; এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। ঈমানের পর মন্দ নাম অতি নিকৃষ্ট। (সূরা হুযুরাত; ৪৯/১১) উক্ত আয়াতে মহান আল্লাহ কারো নাম বিকৃত করতে কিংবা কাউকে মন্দ নামে ডাকতে নিষেধ করেছেন।উক্ত আয়াতের তাফসিরে ইমাম ইবনু কাসীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: উক্ত আয়াতে وَ لَا تَنَابَزُوۡا بِالۡاَلۡقَابِ ‘আর তোমরা একে অপরকে মন্দ উপাধিতে ডেকো না’-এর ব্যাখ্যায় বলেন, لا تتداعوا بالألقاب ، وهي التي يسوء الشخص سماعها ‘তোমারা একে অপরকে এমন সব উপাধি দ্বারা ডাকাডাকি করো না, যা সে শুনতে অপছন্দ করে।’ (তাফসীরে ইবনু কাসীর খন্ড: ৭ পৃষ্ঠা: ৩৭৬)
.
সূরা হুযুরাতের উপরোক্ত ১১ নং আয়াত নাজিলের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে হাদীসে এসেছে- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদিনায় আগমন করেন, তখন সেখানকার অধিকাংশ লোকের দুই-তিনটি করে নাম ছিল। তন্মধ্যে কোনো কোনো নাম সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে লজ্জা দেয়া ও লাঞ্ছিত করার জন্য লোকেরা খ্যাত করেছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা জানতেন না। তাই মাঝে মাঝে সেই মন্দ নাম ধরে তিনিও সম্বোধন করতেন। তখন সাহাবায়ে কেরাম বলতেন; ইয়া রাসূলাল্লাহ্ সে এই নাম শুনলে অসন্তুষ্ট হয়। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আলোচ্য আয়াত অবতীর্ণ হয়। (আবু দাউদ হা/ ৪৯৬২, মুসনাদে আহমাদ: ৫/৩৮০)
.
তাছাড়া মুমিনকে কষ্ট দিতে নিষেধ করে রাসূল (ﷺ) বলেন, হে ঐ জামা‘আত! যারা মুখে ইসলাম কবুল করেছ, কিন্তু অন্তরে এখনো ঈমান মযবুত হয়নি। তোমরা মুসলমানদের কষ্ট দিবে না, তাদের লজ্জা দিবে না এবং তাদের গোপন দোষ অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হবে না। কেননা যে লোক তার মুসলিম ভাইয়ের গোপন দোষ অনুসন্ধানে নিয়োজিত হবে আল্লাহ তার গোপন দোষ প্রকাশ করে দিবেন। আর যে ব্যক্তির দোষ আল্লাহ প্রকাশ করে দিবেন তাকে অপমান করে ছাড়বেন। সে তার উটের হাওদার ভিতরে অবস্থান করে থাকলেও। (তিরমিযী হা/২০৩২; মিশকাত হা/৫০৪৪; সহীহুত তারগীব হা/২৩৩৯)।
.
অপর এক বর্ননায় আলা ইবনুল মুসাইয়েব তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তার পিতা (মুসাইয়েব) বলেছেন, তোমার সঙ্গী-সাথীকে হে গাধা, হে কুকুর, হে শুয়োর বলে সম্বোধন করবে না। অন্যথা ক্বিয়ামতের দিন সে তোমাকে বলবে, তুমি কি মনে করতে যে, আমাকে কুকুর, গাধা বা শুয়োর রূপে সৃষ্টি করা হয়েছিল’? (মুসান্নাফে ইবনু আবী শায়বাহ,হা/২৬৬২৪)। উক্ত হাদীসের আলোকে শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন, ‘নিন্দনীয় যে সব শব্দ সচরাচর ব্যবহৃত হয় সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, ঝগড়াঝাঁটিতে প্রতিপক্ষকে বলা, হে গাধা, হে পাঠা/ছাগল, কুকুর ইত্যাদি। তা দু’টি কারণে কুৎসিত। একটি হলো, তা মিথ্যা। অন্যটি হল কষ্টদায়ক। (আল-আযকার,পৃষ্ঠা: ৩৬৫ শাইখ সালেহ আল মুনাজ্জিদ; ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৫০৮৮৯)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] সূরা হুযরাতের ১১নং আয়াতের আলোকে বলেন, ‘কোন মুমিন ব্যক্তির জন্য কাউকে গাধা, কুকুর, শুয়োর, খচ্চর, গরু-ছাগল ইত্যাদি বলে ডাকা শোভনীয় নয়। বরং সবচেয়ে সুন্দর নামে সম্বোধন করা উচিত। এসব উপাধি দিয়ে মানুষকে সম্বোধন করা হলে পারস্পারিক বিদ্বেষ সৃষ্টি, মন-কষাকষি, ঝগড়াঝাঁটি বা মারামারি হতে পারে।’ (শায়খ ইবনু বাযের অফিসিয়াল ওয়েব সাইট) সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন, মানুষকে জীবজন্তু বা পশুর উপাধি দিয়ে ডাকা হারাম। (মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, খন্ড: ৬ পৃষ্ঠা: ২৩৩ ও ২৩/২৩৬ )। সুতরাং আমাদের উচিত কোন ব্যক্তির সমালোচনা না করে তার কৃত কর্মের সমালোচনা করা। এবং সেটাও হবে ইনসাফের সাথে নাম বিকৃতি করে নয়।

▪️দ্বিতীয়ত: একজন সালাফি মানহাজের আলেম অথবা একই মানহাজের কোন দ্বীনি ভাইয়ের মধ্যে আক্বীদা মানহাজ সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে ভুল ত্রুটি পরিলক্ষিত হলে (সেটা হতে পারে তার আলোচনায়, অথবা লেখনীতে) সে ক্ষেত্রে তাকে ইসলাহ করার সময় সম্ভব হলে প্রথমে তার সাথে যোগাযোগ করা (যদিও কাউকে ইলমি খণ্ডন করার পূর্বে তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে জানানো আবশ্যক নয়, তবুও কল্যাণকামী দ্বীনি ভাই হিসেবে তাকে তার ভুল সম্পর্কে অবহিত করা এবং উক্ত ভুল সংশোধনের জন্য অনুরোধ করা। এতে যদি তিনি সম্মত হন এবং ভুল থেকে ফিরে আসেন তাহলে আলহামদুলিল্লাহ। ইবনে হাযম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: যদি তুমি উপদেশ দিতে চাও তাহলে গোপনে দাও; প্রকাশ্যে নয়। ইঙ্গিতে দাও, সরাসরি নয়। যদি সে তোমার ইঙ্গিত না বুঝে তাহলে সরাসরি উপদেশ দেয়া ছাড়া উপায় নেই…। যদি তুমি এ দিকগুলো এড়িয়ে যাও তাহলে তুমি জালিম; তুমি হিতৈষী নও।(আল-আখলাক ওয়াস সিয়ার পৃষ্ঠা-৪৫)
.
অপরদিকে যদি ভুল কারী আলেম বা দ্বীনি ভাইকে তার ভুল সম্পর্কে জানানোর পরেও তিনি তার ভুলের মধ্যে অটল থাকতে চান,সঠিকটা গ্রহন করতে আপত্তি করেন তাহলে তার কৃত ভুলগুলো প্রকাশ্যে খন্ডন করতে কোন আপত্তি নেই ইনশাআল্লাহ। উদাহরণত যে ব্যক্তি কোন আক্বীদার মাসয়ালায় জনসম্মুখে ভুল করেছে; যাতে করে তার কথা দ্বারা মানুষ বিভ্রান্ত না হয় এবং তার ভুলের অনুসরণ না করে। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি সুদকে জায়েয বলে প্রকাশ্যে তার প্রত্যুত্তর দেয়া। কিংবা যে ব্যক্তি মানুষের মাঝে বিদআত ও পাপকর্মের প্রসার ঘটায়। এ ধরণের লোককে প্রকাশ্যে উপদেশ দেয়া শরিয়তসম্মত। বরং কখনও কখনও অগ্রগণ্য কল্যাণ হাছিল ও প্রবল সম্ভাবনাময় ক্ষতি প্রতিরোধার্থে ওয়াজিব।তবে এক্ষেত্রে ভুল কারী ব্যক্তিকে খন্ডন করার সময় কুরআন-সুন্নাহর আলোকে সন্মানের সাথে করতে হবে ব্যক্তি আক্রমণ করে নয়। ইবনে রজব হাম্ভলী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: যদি তার উদ্দেশ্য হয় নিছক সত্যকে তুলে ধরা এবং যাতে করে মানুষ বক্তার ভুল কথা দ্বারা প্রতারিত না হয় তাহলে নিঃসন্দেহে সে ব্যক্তি তার নিয়তের কারণে সওয়াব পাবে। তার এ কর্ম ও এ নিয়তের মাধ্যমে সে আল্লাহ্‌, তাঁর রাসূল, মুসলিম নেতৃবর্গ ও সাধারণ মুসলমানদের কল্যাণ কামনার অন্তর্ভুক্ত হবে।(আল-ফারকু বাইনান নাসীহা ওয়াত তা’য়ীর পৃষ্ঠা-৭)
.
আর সালাফদের আদর্শ এমনই ছিল। তারা কখনো অপর দ্বীনি ভাইকে কথা অথবা কোন কর্মধারা আঘাত দিতেন না। হাদীসে এসেছে: সা‘ঈদ ইবনু যায়দ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন; সবচেয়ে বড় সুদ হলো অন্যায়ভাবে কোন মুসলিমের মানহানি করা। (আবূ দাউদ হা/৪৮৭৬, সিলসিলা সহীহাহ হা/১৪৩৩, শু‘আবুল ঈমান হা/ ৬৭১০, সহীহুল জামি হা/২২০৩, সহীহ আত-তারগীব হা/২৮৩৩)। উক্ত হাদীসের বাক্য সবচেয়ে বড় সুদ অর্থাৎ ক্ষতির দিক দিয়ে মারাত্মক এবং হারামের দিক দিয়েও জঘন্যতম। হাদিসে الِاسْتِطَالَةُ শব্দের অর্থ- দীর্ঘায়িত করা, অতিরিক্ত করা ও বাড়াবাড়ি করা। এখানে অর্থ হচ্ছে, কোন মুসলিমের ইয্যত নষ্ট করার উদ্দেশে অহংকার ও গর্ব করে গালি দেয়া, গীবত ও মিথ্যা অপবাদ দেয়া। এটি সুদের চেয়েও মারাত্মক হারাম হওয়ার কারণ হলো, মুসলিমের মান-সম্মান ধন-সম্পদের চেয়ে অধিক মূল্যবান। (ইমাম শাওকানী আওনুল মা‘বূদ ৮ম খন্ড, হা/৪৮৬৮)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন, والواجب على المسلم، حمل أحوال إخوانه على أحسن المحامل “মুসলিমের জন্য আবশ্যক হলো– তার ভাইদের অবস্থাকে সবচেয়ে উত্তম ব্যাখ্যা অনুযায়ী ব্যাখ্যা করা।” [দেখুন: ইবনু কাসিম আন-নাজদি সংকলিত আদ-দুরারুস সানিয়্যা, খণ্ড: ১৬; পৃষ্ঠা: ১৪৬; প্রকাশকাল: ১৪১৭ হি./১৯৯৬ খ্রি. (ষষ্ঠ প্রকাশ)]
.
এজন্য সালাফদের থেকে এ বিষয়ক বর্ণনা উদ্ধৃত করার পরে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, ونحن لا نحمل كلامَ رجلٍ على ما لا يسوغ إذا وجدنا له مساغًا “যদি আমাদের কোনো সুযোগ থাকে, তাহলে আমরা কোনো ব্যক্তির কথাকে অশুদ্ধ বিষয় হিসেবে ব্যাখ্যা করব না।” [ইবনু তাইমিয়া কৃত আর-রাদ্দু আলাশ শাজিলি, পৃষ্ঠা: ২৩৯; তাহকিক: আলি আল-ইমরান; দারু আতাআতিল ইলম (রিয়াদ) কর্তৃক প্রকাশিত; প্রকাশকাল: ১৪৪০ হি./২০১৯ খ্রি. (৩য় প্রকাশ, লফাতওয়া অনুবাদক: আব্দুল্লাহ মৃধা হাফিঃ) মহান আল্লাহ আমাদেরকে কুরআন সুন্নার আলোকে সালাফদের মানহাজ আকড়ে ধরার তৌফিক দান করুন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_____________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।