নামাযে কিবলা থেকে দৃষ্টি ফেরানোর বিধান কী

প্রশ্ন: নামাযে কিবলা থেকে দৃষ্টি ফেরানোর বিধান কী? কোন কোন ক্ষেত্রে কিবলামুখী হওয়ার শর্ত মওকুফ হয়? যে মুসাফির কিবলার দিক জানতে পারেনি তিনি কিভাবে নামায আদায় করবেন?
▬▬▬▬▬▬▬▬●◈●▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: নামাযে কিবলা থেকে মুখ ফেরানো কয়েক প্রকার বিশেষ করে তিন প্রকার হতে পারে,এর কোনোটি সালাত বাতিল করে এবং কোনোটি নেকি কমিয়ে দেয়। উক্ত বিধি-বিধান নারী পুরুষ উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য। যেমন:

(১)- বুক দিয়ে ফিরে তাকানো। তথা মুসল্লী কিবলার দিক থেকে বুক ফিরিয়ে দিয়ে শারীরিকভাবে মুখ ফিরিয়ে ফেলা। এভাবে ফিরলে নামায বাতিল হয়ে যাবে। কারণ কিবলামুখী থাকা নামায বিশুদ্ধ হওয়ার অন্যতম একটি শর্ত- এ ব্যাপারে আলেমদের মাঝে কোন মতভেদ নেই। সক্ষমতা থাকার পরেও এ শর্ত পূর্ণ না করলে নামায বাতিল হয়ে যাবে।তবে সামান্য ব্যতিক্রম হলে সেটা মার্জনীয়; বেশি নয়। আল্লাহ্‌ তাআলা কুরআনে সে নির্দেশ দিয়েছেন এবং সে নির্দেশের পুনরাবৃত্তি করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, আর আপনি যেখান থেকেই বের হন মসজিদুল হারামের দিকে চেহারা ফিরান এবং তোমরা যেখানেই থাক না কেন এর দিকে তোমাদের চেহারা ফিরাও।(সূরা বাকারা,২/১৫০) বিস্তারিত আলোচনা পোস্টের শেষ অংশে রয়েছে)
.
(২)- মাথা বা চোখ দিয়ে ফিরে তাকানো; তবে কাবাকে কিবলামুখী রেখে। এভাবে তাকানো মাকরূহ। তবে যদি কোনো মুসলিম প্রয়োজনে এমনটা করে, তাহলে বৈধ। প্রয়োজন ছাড়া করলে নামাযের নেকী কমে যাবে। তবে নামায সঠিক হবে; বাতিল হয়ে যাবে না।

আল-মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যা -তে এসেছে:

لاَ خِلاَفَ بَيْنَ الْفُقَهَاءِ فِي كَرَاهَةِ الاِلْتِفَاتِ فِي الصَّلاَةِ ؛ لِحَدِيثِ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ تَعَالَى عَنْهَا قَالَتْ : سَأَلْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ الاِلْتِفَاتِ فِي الصَّلاَةِ ؟ فَقَال : ( هُوَ اخْتِلاَسٌ يَخْتَلِسُهُ الشَّيْطَانُ مِنْ صَلاَةِ الْعَبْدِ ) وَالْكَرَاهَةُ مُقَيَّدَةٌ بِعَدَمِ الْحَاجَةِ أَوِ الْعُذْرِ ، أَمَّا إِنْ كَانَتْ هُنَاكَ حَاجَةٌ : كَخَوْفٍ عَلَى نَفْسِهِ أَوْ مَالِهِ لَمْ يُكْرَهْ ”

“নামাযে ভিন্ন দিকে তাকানো মাকরূহ হওয়ার ব্যাপারে ফকীহদের মাঝে কোনো মতভেদ নেই। কারণ আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন: আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নামাযে ভিন্ন দিকে তাকানোর ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন: “এটা এক ধরনের ছিনতাই, যার মাধ্যমে শয়তান বান্দার নামায থেকে অংশ বিশেষ ছিনিয়ে নেয়।”(সহীহ বুখারী হা/৭৫১) অপছন্দনীয় তথা মাকরূহ হওয়ার বিষয়টি প্রয়োজন কিংবা ওজর না থাকার সাথে সম্পৃক্ত। কিন্তু যদি প্রয়োজন থাকে; যেমন: নিজের জীবন বা সম্পদের ব্যাপারে শঙ্কিত থাকলে মাকরূহ হবে না।”(আল-মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যা,খন্ড:২৭ পৃষ্ঠা:১০৯)
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা)’ তে এসেছে:

” والالتفات مكروه في الصلاة وينقص ثوابها ، لكن لا تجب الإعادة على من التفت في صلاته ؛ لأنه قد ثبت في أحاديث أخرى ما يدل على جواز الالتفات إذا دعت إليه الحاجة ، فعلم بذلك أنه لا يبطل الصلاة ”

“নামাযে এদিক-ওদিক তাকানো মাকরূহ। এটি নামাযের নেকী কমিয়ে দেয়। তবে কেউ যদি নামাযে এদিক-সেদিক তাকায় তাহলে তার জন্য নামায পুনরায় পড়া আবশ্যক নয়। কারণ অন্যান্য হাদীসে প্রমাণিত হয়েছে যে প্রয়োজন পড়লে এদিক-ওদিক দৃষ্টিপাত করা বৈধ। সুতরাং জানা গেল যে এতে করে নামায বাতিল হবে না।”(ফাতাওয়াল-লাজনা আদ-দাইমাহ’,খন্ড: ৭ পৃষ্ঠা: ২৭)
.
কিছু হাদীসে প্রয়োজন থাকলে নামাযে এদিক-ওদিক তাকানোর বৈধতার কথা বলা হয়েছে। তন্মধ্যে একটা হল মুসলিমে বর্ণিত হাদীস, জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসুস্থ হওয়ার পর আমরা তার পেছনে নামায পড়লাম। তিনি তখন বসে নামায পড়ছিলেন। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু লোকদেরকে তার তাকবীর জোরে শুনিয়ে দিচ্ছিলেন। তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে আমাদেরকে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পেলেন। তখন তিনি আমাদেরকে ইশারা করলে আমরা বসে গেলাম। আমরাও তার সাথে বসে নামায পড়লাম।”(সহীহ মুসলিম হা/৪৩১) অপর বর্ননায় ইমাম আবু দাউদ বর্ণনা করেন, সাহল ইবনুল হানযালিয়্যা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: “একবার ফজরের নামাযের ইকামত দেওয়া হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায পড়া শুরু করলেন। নামাযরত অবস্থায় তিনি গিরিপথের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।” আবু দাউদ বলেন: “তিনি গিরিপথ পাহারা দেওয়ার জন্য রাতে এক অশ্বারোহীকে সেখানে পাঠিয়েছিলেন।” (আবু দাউদ হা/৯১৬) শাইখ আলবানী হাদীসটিকে ‘সহীহ আবু দাউদ’ বইয়ে সহীহ বলেছেন।
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন,”

الالتفات في الصلاة للتعوذ بالله من الشيطان الرجيم عند الوسوسة لا حرج فيه ، بل هو مستحب عند شدة الحاجة إليه بالرأس فقط

“ওয়াসওয়াসার কারণে বিতাড়িত শয়তান থেকে আশ্রয় লাভের জন্য নামাযে কোনো দিকে ফিরে তাকাতে সমস্যা নেই। বরং খুব প্রয়োজন হলে শুধু মাথা দিয়ে ফিরে তাকানো মুস্তাহাব।”(মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ খন্ড, ১১ পৃষ্ঠা: ১৩০)
.
(৩)- তৃতীয় আরেক প্রকার তাকানো আছে; সেটা হল নামাযে অন্তর দিয়ে কোন কিছু চিন্তা করায় ব্যস্ত হয়ে পড়া; নামাযে মনোযোগ না দেওয়া, এতে নেকি কমে যায়,
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন,

اعلم أن الالتفات نوعان :
1 ـ التفات حسي بالبدن ، وهو التفات الرأس .
2 ـ التفات معنوي بالقلب ، وهو الوساوس والهواجيس التي ترد على القلب ، فهذا هو العلة التي لا يخلو أحد منها ، وما أصعب معالجتها ! وما أقل السالم منها ! وهو منقص للصلاة ، ويا ليته التفات جزئي ! ولكنه التفات من أول الصلاة إلى آخرها ، وينطبق عليه أنه اختلاس يختلسه الشيطان من صلاة العبد ”

“জেনে রাখুন, ফিরে তাকানো দুই ধরনের:

(১)- ইন্দ্রিয়গত দৃষ্টি ফিরানো। এটা হলো মাথা ফিরানো।

(২)- অন্তর্দৃষ্টি ফিরানো। এটা হল মনের ভেতর আসা নানান ভাবনা ও সংশয়ে ডুবে যাওয়া। এটা থেকে কেউ বাঁচতে পারে না। এর নিরাময় কী যে কঠিন! খুব কম মানুষই এর থেকে নিরাপদ! এটা নামাযের সওয়াব হ্রাস করে। হায়! এটা যদি আংশিক হত! কিন্তু এটা নামাযের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চলতে থাকে। এটাকে এক ধরনের ছিনতাই বলা সাজে। শয়তান বান্দার নামাযের কিছু ছিনতাই করে নিয়ে যায়।(আশ-শারহুল মুমতি, খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ৭০ আরো বিস্তারিত জানতে দেখুন ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং ১৬০৬৪৭)
.
▪️যে অবস্থাগুলোতে কিবলামুখী হওয়ার শর্ত মওকুফ হয়:
.
আমরা প্রথমেই বলেছি নামায শুদ্ধ হওয়ার শর্তাবলির মধ্যে রয়েছে: কিবলামুখী হওয়া। কিবলামুখী হওয়া ব্যতীত নামায শুদ্ধ হয় না। কেননা আল্লাহ্‌ তাআলা কুরআনে সে নির্দেশ দিয়েছেন এবং সে নির্দেশের পুনরাবৃত্তি করেছেন। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: “তুমি যেখান থেকেই বের হও না কেন মসজিদে হারামের দিকে মুখ ফিরাও; আর তোমরাও যেখানেই থাক না কেন, এই মসজিদের দিকেই মুখ ফিরাও।”[সূরা বাক্বারা, ২: ১৫০]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথম যখন মদিনাতে এলেন তখন বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে ফিরে নামায আদায় করতেন, কাবাকে তাঁর পিঠের দিকে এবং শামকে (সিরিয়াকে) তাঁর সামনের দিকে রাখতেন। কিন্তু এরপরে তিনি অপেক্ষা করছিলেন যে, আল্লাহ্‌ তাআলা তাঁর জন্য এর বিপরীতটা করার বিধান নাযিল করবেন। সে কারণে তিনি আকাশের পানে বারবার মুখ ফেরাতেন কখন জিব্রাইল (আঃ) কাবার দিকে মুখ ফেরানোর ওহি নিয়ে নাযিল হবে। যেমনটি আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: “আমি আপনাকে বারবার আকাশের দিকে তাকাতে দেখি। তাই অবশ্যই আমি আপনাকে আপনার পছন্দের এক কিবলার দিকে ফেরাব। আপনি মসজিদে হারামের দিকে আপনার মুখ ফিরান।”[সূরা বাক্বারা, ২: ১৪৪]
তবে হা!এ ক্ষেত্রে মূল ক্বিবলা থেকে সামান্য সরে গেলে কোন অসুবিধা হবে না। এ কারণে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদ্বীনাবাসীদের বলেন,مَا بَيْنَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ قِبْلَةٌ“পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে ক্বিবলা।”(সুনানে তিরমিজি হা/৩৪২ ইবনে মাজা হা/১০১১) আল্লামা সান‘আনী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এ হাদীস ক্বিবলামুখী হওয়া প্রমাণ করে। তবে একেবারেই কা‘বার মাঝামাঝি হতে হবে তা নয়। বরং ক্বিবলামুখী হওয়াটা যরূরী’ (সুবুলুস সালাম, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৬০)। ইমাম উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) একই মন্তব্য করেছেন,তিনি বলেন, মদ্বীনার অধিবাসীগণ দক্ষিণ দিকে মুখ করে নামায আদায় করেন। সুতরাং তা যদি পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝামাঝি স্থানে হয়, তবেই ক্বিবলা ঠিক হয়ে যাবে। অনুরূপভাবে যারা পশ্চিম দিকে নামায পড়ে, তাদের ক্বিবলা হচ্ছে উত্তর ও দক্ষিণের মাঝামাঝি স্থানে।(আশ-শারহুল মুমতি‘ ‘আলা যাদিল মুসতাক্বনি‘, ২য় খণ্ড,পৃষ্ঠা: ২৭৩)।
.
সুতরাং কিবলামুখী হওয়া ব্যতীত নামায শুদ্ধ হয় না। তবে তিনটি মাসয়ালায় এর ব্যতিক্রম হবে,অর্থাৎ তিনটি ক্ষেত্রে কিবলামুখী না হলেও সালাত বাতিল হবেনা। সে তিনটি স্থান হচ্ছে,

(ক)। যদি কেউ অক্ষম হয়। যেমন অসুস্থ ব্যক্তি যার চেহারা কিবলার দিকে নয় এবং যার পক্ষে কিবলামুখী হওয়া সম্ভবপর নয়। এমতাবস্থায় তার কিবলামুখী হওয়ার বিধান মওকুফ হবে। দলিল হচ্ছে আল্লাহ্‌র বাণী: “অতএব যতটা পার আল্লাহ্‌কে ভয় কর।”[সূরা তাগাবুন, ৬৪: ১৬] এবং আল্লাহ্‌র বাণী: “আল্লাহ্‌ কাউকে তার সাধ্যের বাইরে দায়িত্ব আরোপ করেন না।”[সূরা বাক্বারা, ২: ২৮৬] এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “যদি আমি তোমাদেরকে কোন আদেশ করি তাহলে সাধ্যানুযায়ী সেটা পালন কর।”[সহিহ বুখারী হা/৭২৮৮ ও সহিহ মুসলিম হা/১৩৩৭)

(খ)। যদি কেউ তীব্র ভয়ের মধ্যে থাকে। যেমন: কোন মানুষ তার শত্রু থেকে পালাতে থাকে, কিংবা কোন হিংস্র প্রাণী থেকে পালাতে থাকে, কিংবা বন্যার পানি থেকে পালাতে থাকে। এক্ষেত্রে যে দিকে তার চেহারা থাকে সে দিকে ফিরে নামায পড়বে। দলিল হচ্ছে আল্লাহ্‌র বাণী: “আর যদি তোমাদের ভয় থাকে তাহলে হাঁটতে হাঁটতে অথবা আরোহী অবস্থায় (নামায আদায় করবে)। অতঃপর যখন তোমরা নিরাপদ হবে তখন আল্লাহ্‌কে সেভাবেই যিকির (স্মরণ) করবে যেভাবে তিনি তোমাদের শিখিয়েছেন, যা তোমরা (আগে) জানতে না।”[সূরা বাক্বারা, ২:২৩৯] আল্লাহ্‌র বাণী: “তোমাদের ভয় থাকে” যে কোন ধরণের ভয়কে শামিল করে এবং তাঁর বাণী: “অতঃপর যখন তোমরা নিরাপদ হবে তখন আল্লাহ্‌কে সেভাবেই যিকির (স্মরণ) করবে যেভাবে তিনি তোমাদের শিখিয়েছেন, যা তোমরা (আগে) জানতে না।” প্রমাণ করে যে, মানুষ ভয়বশতঃ কোন ধরণের যিকির বর্জন করলে তাতে কোন অসুবিধা নেই। কিবলামুখী হওয়াটাও যিকিরের অন্তর্ভুক্ত।ইতিপূর্বে উল্লেখিত আয়াতদ্বয় ও হাদিসও প্রমাণ করে যে, যে কোন আমল ওয়াজিব হওয়াটা সামর্থ্যের সাথে সম্পৃক্ত।
.
(গ)। সফর অবস্থায় নফল নামাযের ক্ষেত্রে; সেটা বিমানে হোক কিংবা গাড়ীতে হোক কিংবা উটের পিঠে হোক; এক্ষেত্রে তার চেহারা যে দিকেই থাকুক না কেন; যেমন: বিতিরের নামায, কিয়ামুল লাইল ও ইশরাকের নামায ইত্যাদি। মুকীম ব্যক্তির মত মুসাফিরেরও উচিত সকল নফল নামায আদায় করা; কেবল যোহর, মাগরিব ও এশার সুন্নত নামাযগুলো ব্যতীত। কারণ সফরে এ নামাযগুলো না-পড়াই সুন্নত। মুসাফির যখন চলন্ত অবস্থায় নফল নামায পড়তে চাইবেন তখন তার চেহারা যে দিকেই হোক না কেন তিনি নামায পড়তে পারবেন। সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এটাই সাব্যস্ত আছে। এ তিনটি মাসয়ালার ক্ষেত্রে কিবলামুখী হওয়া ওয়াজিব নয়।
.
পক্ষান্তরে, কেউ কিবলার দিক না জানলেও তার উপর কিবলামুখী হওয়া ওয়াজিব। তিনি যদি কিবলার দিক নির্দিষ্ট করার জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করেন এবং চেষ্টাপ্রচেষ্টা সত্ত্বেও পরবর্তীতে যদি তার ভুল প্রমাণিত হয় তাহলে তাকে সে নামায পুনরায় পড়তে হবে না। তবে, তার ক্ষেত্রে আমরা এ কথা বলব না যে, তার উপর কিবলামুখী হওয়া মওকুফ করা হয়েছে। বরং তার উপরেও কিবলামুখী হওয়া ওয়াজিব এবং সে তার সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করবে। সে যদি তার সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করার পর তার ভুল ধরা পড়ে তাহলে সে নামায পুনরায় পড়তে হবে না। এর দলিল হচ্ছে সাহাবায়ে কেরামদের মধ্যে যারা কিবলা পরিবর্তনের খবর পায়নি তারা একদিন ক্বুবা মসজিদে ফজরের নামায পড়ছিলেন। এমন সময় এক লোক এসে বলল: আজ রাতে রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর কুরআন নাযিল হয়েছে এবং তাঁকে কাবামুখী হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অতএব, তোমরা কাবার দিকে ফিরে যাও। সে সময় তাদের মুখ ছিল শামের দিকে। তখন তারা কাবার দিকে ঘুরে গেলেন।[সহিহ বুখারী হা/৪০৩ ও সহিহ মুসলিম হা/৫২৬) কাবাঘর ছিল তাদের পেছনের দিকে। তারা নামায অব্যাহত রেখে ঘুরে গেলেন এবং কাবাকে তাদের সামনে করলেন। এটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যামানায় ঘটেছে; কিন্তু এ আমলের কোন সমালোচনা করা হয়নি। অতএব, এটি শরিয়তঅনুমোদিত। অর্থাৎ কোন মানুষ যদি কিবলা চিনতে ভুল করে তাহলে সে নামায পুনরায় আদায় করা তার উপর ওয়াজিব নয়। কিন্তু যদি নামাযের মধ্যে তার ভুল প্রমাণিত হয় তাহলে তখনই কিবলামুখী হওয়া তার উপর ওয়াজিব। (বিস্তারিত জানতে দেখুন উসাইমীন “মাজমুউ ফাতাওয়া, খন্ড: ১২ পৃষ্ঠা: ৪৩৩-৪৩৫ ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৬৫৮৫৩)
.
▪️যে মুসাফির কিবলার দিক জানতে পারেনি তিনি কিভাবে নামায আদায় করবেন?
.
যদি কোন মুসলমান এমন কোন স্থানে থাকেন যে স্থান থেকে তিনি কিবলার দিক জানতে না পারেন তাহলে তিনি তাঁর প্রবল ধারণায় যে দিককে কিবলা মনে হয় সেদিকে ফিরে নামায আদায় করবেন। সেক্ষেত্রে উক্ত নামাযটি পুনরায় আদায় করা তার উপর আবশ্যক হবে না। বরং তার নামায শুদ্ধ; তাকে কোন কিছু করতে হবে না। এর সপক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায় জাবের (রাঃ) এর বর্ণিত হাদিসে, তিনি বলেন: “আমরা এক যুদ্ধাভিযানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে ছিলাম। সেদিন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল। আমরা কিবলা জানার চেষ্টা করলাম; কিন্তু নিজেরাই একমত হতে পারলাম না। তাই আমাদের মধ্যে প্রত্যেক ব্যক্তি আলাদা আলাদা নামায আদায় করল। আমাদের প্রত্যেকে তার সামনে একটি দাগ দিয়ে রাখল যেন পরবর্তীতে জায়গাগুলো চেনা যায়। যখন ভোর হল তখন আমরা সে দাগ দেখে বুঝতে পারলাম যে, আমরা কিবলার দিকে নয় অন্য দিকে ফিরে নামায আদায় করেছি। ফলে এ বিষয়টা আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে উল্লেখ করলাম। তিনি আমাদেরকে পুনরায় নামায আদায় করার নির্দেশ দেননি। বরং বললেন: তোমাদের নামায আদায় হয়েছে।[সুনানে দারাকুতনী, মুসতাদরাক হাকেম, সুনানে বাইহাকী; আলবানী ‘ইরওয়াউল গালিল’ হা/২৯১) অন্যান্য হাদিসের আলোকে এ হাদিসকে ‘হাসান’ ঘোষণা করেছেন]
.
যে ব্যক্তি কিবলা জানার চেষ্টা-প্রচেষ্টা করার পরেও কিবলা ভুল করে নামায আদায় করেছেন সে ব্যক্তি সম্পর্কে শাইখ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ)-কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন:

“إذا كان المسلم في السفر أو في بلاد لا يتيسر فيها من يرشده إلى القبلة فصلاته صحيحة ، إذا اجتهد في تحري القبلة ثم بان أنه صلى إلى غيرها . أما إذا كان في بلاد المسلمين فصلاته غير صحيحة؛ لأن في إمكانه أن يسأل من يرشده إلى القبلة ، كما أن في إمكانه معرفة القبلة من طريق المساجد”

“যদি কোন মুসলিম সফর অবস্থায় থাকেন কিংবা এমন কোন দেশে থাকেন যেখানে কিবলার দিক জানানোর মত কাউকে না পান তাহলে তার নামায শুদ্ধ; যদি তিনি নিজে কিবলা জানার আপ্রাণ চেষ্টা করে নিজে নিজে একটা সিদ্ধান্ত নেন; পরবর্তীতে জানা যায় যে, তিনি কিবলা ভুল করেছেন। আর যদি তিনি মুসলমান দেশে থাকেন তাহলে তার নামায সহিহ হবে না। কেননা, তার পক্ষে কিবলা সম্পর্কে কাউকে জিজ্ঞেস করা সম্ভব। অনুরূপভাবে মসজিদের কাঠামো দেখার মাধ্যমেও কিবলা জানা সম্ভব”(বিন বায মাজমুউল ফাতাওয়া, খন্ড: ১০ পৃষ্ঠা: ৪২০) অনুরুপ ফাতওয়া শাইখ উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) দিয়েছেন, দেখুন উসাইমীন আস শারহুল মুমতি খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ২৭৩) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
_________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।