দুর থেকে টেলিফোনে কিংবা অন্য কোন মাধ্যমে অসুস্থ ব্যক্তির রুকিয়াহ করার বিধান

প্রশ্ন: কারো অনুপস্থিতিতে অর্থাৎ দুর থেকে টেলিফোনে কিংবা অন্য কোন মাধ্যমে অসুস্থ ব্যক্তির রুকিয়াহ করার বিধান কী?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: কুরআন হাদিসের দলীল, সাহাবায়ে কেরামের আমল এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের প্রসিদ্ধ আলেমগণের মতামত অনুযায়ী বিশুদ্ধ কথা হচ্ছে, দূর থেকে অর্থাৎ অনুপস্থিত ব্যক্তির জন্য টেলিফোনে, মাইক কিংবা ক্যাসেট ইত্যাদির মাধ্যমে রুকিয়াহ করার কোন দলিল ইসলামে নেই। বরং এটি দ্বীনের মধ্যে নতুন আবিষ্কার। কারণ দূর থেকে রুকিয়াহ করার বৈধতা সম্পর্কে কুরআন হাদিসে দলিল কিংবা প্রসিদ্ধ সালাফদের থেকে কোন বক্তব্য আসেনি সুতরাং যারা এমনটি করতেছেন তাদের এই প্রথা পরিত্যাজ্য। রুকিয়াহ করতে হবে সরাসরি অর্থাৎ রোগীর সামনা সামনি উপস্থিত থেকে এবং কুরআন হাদীসের আলোকে শরীয়তসম্মত ভাবে।
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেছেন:

الرقية لا بد أن تكون على المريض مباشرة ، ولا تكون بواسطة مكبر الصوت ، ولا بواسطة الهاتف ؛ لأن هذا يخالف ما فعله رسول الله صلى الله عليه وسلم وأصحابه رضي الله عنهم وأتباعهم بإحسان في الرقية ، وقد قال صلى الله عليه وسلم : (من أحدث في أمرنا هذا ما ليس منه فهو رد)”

রুকিয়াহ সরাসরি অসুস্থ ব্যক্তির উপর করতে হবে, এটি লাউডস্পিকারের মাধ্যমে বা ফোনের মাধ্যমে করা যাবে না, কারণ এটি আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম), তাঁর সাহাবীগণ এবং ন্যায় নিষ্ট সালাফদের আদর্শের পরিপন্থী যারা রুকিয়াহ করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন,‘যে ব্যক্তি আমাদের এই দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছুর উদ্ভব ঘটাল, যা তার মধ্যে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’ (সহীহ বুখারী হা/ ২৬৯৭,সহীহ মুসলিম হা/ ১৭১৮, আবূ দাঊদ হা/৪৬০৬, ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; গ্রুপ: ২; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৯২)
.
এমনকি রেডিও বা ক্যাসেট থেকে বেরিয়ে আসা কুরআন তেলোওয়াতের ধ্বনিকে বাজিয়ে ঘর থেকে শয়তান তাড়ানো কিংবা রুকিয়াহ হিসেবে গণ্য করা বৈধ হবেনা বরং অবশ্যই গৃহবাসীকে নিজেরা কুরআন তেলোওয়াত করতে হবে।
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল:নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত একটি হাদিস আছে যে, কোন ব্যক্তি যদি সূরা “বাক্বারা” পড়ে তার ঘরে শয়তান প্রবেশ করে না। কিন্তু সূরাটি যদি ক্যাসেটে রেকর্ড করে রাখা হয় তাহলে কি একই বিষয় হাছিল হবে?
.
জবাবে তিনি বলেন: না, না। ক্যাসেটের শব্দ কিছুই না। এটি কোন উপকার দিবে না। কেননা ক্যাসেট বাজিয়ে এ কথা বলা যায় না যে, “সে কুরআন পড়েছে”। বলা যায়: “সে পূর্বে তেলাওয়াতকৃত ক্বারীর কণ্ঠস্বর শুনেছে”। তাই আমরা যদি কোন এক মুয়াজ্জিনের আযান রেকর্ড করে রাখি এবং যখন ওয়াক্ত হয় তখন সেটাকে মাইক্রোফোনে চালু করে এটাকে আযান হিসেবে গ্রহণ করি এটা কি জায়েয হবে? জায়েয হবে না। অনুরূপভাবে আমরা যদি একটি হৃদয়াগ্রহী খোতবা রেকর্ড করে রাখি। এরপর যখন জুমার দিন আসবে তখন আমরা মাইক্রোফোনের সামনে ক্যাসেট-প্লেয়ারে এ রেকর্ডটি চালু করি। ক্যাসেট প্লেয়ার বলল: “আস্‌সালামু আলাইকুম”। এরপর মুয়াজ্জিন আযান দিল। তারপর ক্যাসেট-প্লেয়ার খোতবা দিল। এটা কি জায়েয হবে? জায়েয হবে না। কেন? কেননা এটি পূর্ববর্তী একটি কণ্ঠস্বরের রেকর্ড। যেমনিভাবে আপনি যদি কোন একটি কাগজে লিখেন কিংবা ঘরে একটি মুসহাফ (কুরআনগ্রন্থ) রাখেন পড়ার বদলে সেটা কি যথেষ্ট হবে? না; যথেষ্ট হবে না। (আসয়িলাতুল বাব আল-মাফতুহ প্রশ্ন নং-৯৮৬)
.
সরাসরি কুরআন তেলোয়াতের ক্যাসেট বাজিয়ে এবং তার মাধ্যমে রুকিয়াহ কিংবা শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনার জন্য চালু রাখা হয় তাহলে সেটি রুকিয়াহ কিংবা শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে না কিন্তু ঘরের লোকদের মধ্যে সূরা বাক্বারা পড়তে পারার মত কেউ যদি না থাকে এবং ঐ ঘরে এসে পড়ে দিবে এমন কেউ যদি না থাকে; সেক্ষেত্রে তারা যদি ক্যাসেট-প্লেয়ার ব্যবহার করে তাহলে অগ্রগণ্য মত হচ্ছে এতে করে তারা এ ফযিলত তথা ‘ঘর থেকে শয়তানের পলায়ন করা’র ফযিলত হাছিল করবে ইনশাআল্লাহ।বিশেষতঃ ঘরবাসীর মধ্যে কেউ যদি ক্যাসেট প্লেয়ারের এ পড়াটা শুনে। কেননা এই ক্ষেত্রে শরীয়তসম্মত অজর রয়েছে।শাইখ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ)- ফাতওয়া দিয়েছেন যে, রেডিও থেকে সূরা বাক্বারা পড়া হলে এটি বাড়ী থেকে শয়তানকে তাড়াবে। (মাজমুউ ফাতাওয়াস শাইখ বিন বায ২৪/৪১৩)
.
▪️তাহলে অনুপস্থিত অসুস্থ ব্যক্তিদের জন্য আমাদের করণীয় কী?
.
যে ব্যক্তি উপস্থিত নেই তার জন্য যা করনীয় তা হচ্ছে দু’আ করা। তাই আপনার নিকট আত্মীয় কেউ যদি অসুস্থ হয় তাহলে আপনি আল্লাহর কাছে তাদের রোগ মুক্তির জন্য, তাদের সুস্থতা দান করার জন্য, তাদের নিরাপদ ও সুস্থ রাখার জন্য এবং আরও অনেক কিছু করার জন্য প্রার্থনা করতে পারেন, এতে যারা উপস্থিত এবং যারা অনুপস্থিত উভয়ই উপকৃত হবে ইনশাআল্লাহ। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কারো অনুপস্থিতিতে তার জন্য দু‘আ করা সম্পর্কে বলেছেন; যখন কোন ব্যক্তি তার ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার জন্য দু’আ করে, তখন ফিরিশতাগণ বলেন, আমীন, এবং তোমার জন্যও অনুরূপ হবে।(সহীহ মুসলিম হা/২৭৩৩ আবু দাউদ হা /১৫৩৪)
.
উক্ত হাদীসের আলোকে শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন:

“وَفِي هَذَا فَضْل الدُّعَاء لِأَخِيهِ الْمُسْلِم بِظَهْرِ الْغَيْب , وَلَوْ دَعَا لِجَمَاعَةٍ مِنْ الْمُسْلِمِينَ حَصَلَتْ هَذِهِ الْفَضِيلَة , وَلَوْ دَعَا لِجُمْلَةِ الْمُسْلِمِينَ فَالظَّاهِر حُصُولهَا أَيْضًا , وَكَانَ بَعْض السَّلَف إِذَا أَرَادَ أَنْ يَدْعُو لِنَفْسِهِ يَدْعُو لِأَخِيهِ الْمُسْلِم بِتِلْكَ الدَّعْوَة ; لِأَنَّهَا تُسْتَجَاب , وَيَحْصُل لَهُ مِثْلهَا”

এই হাদীসটি একজন মুসলিম ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার জন্য দোয়া করার ফজিলতকে তুলে ধরে। সে যদি একদল মুসলমানের জন্য দুআ করে তাহলে এই নেকী তার অর্জিত হবে এবং সে যদি অনেক মুসলমানের জন্য দুআ করে তাহলে স্পষ্ট কথা হল এই নেকীও অর্জিত হবে। সালাফীদের মধ্যে কেউ কেউ যখন তিনি নিজের জন্য দোয়া করতে চাইতেন, তখন একই সাথে তার মুসলিম ভাইয়ের জন্যেও দোয়া করতেন, কারণ এটির (দু’আ কবুল হবে) উত্তর দেওয়া হবে এবং তার ক্ষেত্রেও তাই অর্থাৎ সে অনুরূপ পাবে।(ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৪০১৮৩)।
.
কাযী ইয়ায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:

” له من الأجر بمثل ما دعا به؛ لأنه وإن دعا لغيره فقد عمل عملين صالحين: أحدهما: ذكر الله تعالى مخلصًا له، وفازعا إليه بلسانه وقلبه. والثانى: محبته الخير لأخيه المسلم ودعاؤه له، وهو عمل خير لمسلم يؤجر عليه، وقد نص فيه أنها مستجابة كما نص فى الحديث

“সে ব্যক্তি যে যে দু’আ করেছে এর সমপরিমাণ সওয়াব সে পাবে। কেননা সে অন্যের জন্য দোয়া করার মাধ্যমে দুটো নেক আমল করেছে:

(১). খালিসভাবে (একনিষ্ঠভাবে) আল্লাহ্‌কে স্মরণ করা এবং মুখ ও মন দিয়ে আল্লাহ্‌র কাছে ধর্ণা দেয়া।

(২). অপর মুসলিম ভাইয়ের কল্যাণ করতে পছন্দ করা ও তার জন্য দু’আ করা। এটি এমন একটি নেক আমল যার জন্য মুসলিমকে সওয়াব দেয়া হয় এবং হাদিসে পরিস্কার ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে এমন দোয়া কবুলযোগ্য।”(ইকমালুল মু’লিম খন্ড: ৮ পৃষ্ঠা: ২২৮)
.
পরিশেষে প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে, দুর থেকে কিংবা ব্যক্তির অনুপস্থিত রুকিয়াহ করা জায়েজ নয়। রুকিয়াহ করতে হলে অবশ্যই রোগীর সামনাসামনি বসে করতে হবে। দুর থেকে যা করা যায় তা হচ্ছে দু’আ।তাই সবার প্রতি অনুরোধ থাকবে সুন্নতের অনুসরণ করুন, সুন্নত বিরোধী কার্যক্রম পরিহার করুন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
__________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।