দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করার বিধান

প্রশ্ন: দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করার বিধান কি? বিস্তারিত জানতে চাই।
▬▬▬▬▬▬▬▬●◈●▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থার নাম। এর প্রতিটি বিধিবিধান নবী রাসূল (ﷺ) আমাদের শিক্ষা দিয়ে গেছেন। এমনকি প্রস্রাব-পায়খানার নিয়মও শিক্ষা দিয়েছেন।(সহীহ মুসলিম, হা/২৬২; মিশকাত,হা/৩৩৬)।প্রস্রাব সম্পর্কে হাদীসের কিতাবে ৫ টি হাদীস পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৩টি সহীহ। এর একটিতে আম্মাজান আয়িশা (রা.) রাসূল (ﷺ) এর দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করাকে অস্বীকার করেছেন। ২য়টিতে রাসূল (ﷺ) এর দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করার ঘটনা বিবৃত হয়েছে। আর ৩য়টিতে বসে প্রস্রাব করার ঘটনা বিবৃত হয়েছে। আর ২টি হাদীস যঈফ। তার একটিতে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করার নিষেধাজ্ঞা বর্ণিত হয়েছে। অপরটিতে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করাকে অহমিকার সাথে বিশেষিত করা হয়েছে। যেমন:

(১) আয়েশা (রাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি তোমাদের বলে যে, রাসূল (ﷺ) দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করেছেন, তোমরা তার কথা বিশ্বাস করবে না। (কেননা) তিনি বসেই প্রস্রাব করতেন।’ (নাসাঈ হা/২৯; ইবনু মাজাহ হা/৩০৭সিলসিলা সহীহাহ হা/২০১)।

(২) হুযায়ফাহ (রাঃ) বলেন, আমি (কোন এক সফরে) রাসূল (ﷺ)এর সঙ্গে ছিলাম। তিনি কোন এক সম্প্রদায়ের ময়লা-আবর্জনা ফেলার জায়গায় এসে পৌছলেন। অতঃপর সেখানে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করলেন, ‘আমি তখন দূরে সরে গেলাম। তিনি বললেন, কাছে এসো। আমি তার নিকটে গেলাম এমনকি একেবারে তার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি ওযু করলেন। অতঃপর তাঁর উভয় মোযার উপর মাসাহ করলেন। (সহীহ মুসলিম হা/৫১২ ‘ইঃ ফাঃ৫১৫ মোযার উপর মাসাহ করা’ অনুচ্ছেদ)।

(৩) আব্দুর রহমান ইবনে হাসানাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূল (ﷺ) একদা আমাদের কাছে আগমন করলেন। তাঁর হাতে চামড়ার তৈরি ঢালের মত একটি বস্ত্ত ছিল। তিনি তা স্থাপন করলেন। এরপর তার পেছনে বসলেন এবং সেদিকে ফিরে প্রস্রাব করলেন।(সহীহ : ইবনু মাজাহ্ ৩৪৬, আবূ দাঊদ, সহীহুত্ তারগীব ১৬২।মিশকাতুল মাসাবিহ, ৩৭১ সনদ সহীহ)।

(৪) উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃতিনি বলেন,নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করতে দেখে বললেন,‘উমার! (আইয়্যামে জাহিলিয়্যাতের ন্যায়) দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করো না। অতঃপর আমি আর কক্ষনো দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করিনি। (য‘ঈফ : ইবনু মাজাহ্ ৩০৮, য‘ঈফাহ্ ৯৩৪, তিরমিযী ১২)।কারণ এর সানাদে ‘আবদুল কারীম ইবনু আবুল মাখরিক্ব নামে একজন দুর্বল রাবী রয়েছে।(মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস নং ৩৬৩ হাদিসের মান: দুর্বল হাদিস)।

(৫) বুরাইদাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেন: তিনটি কাজ অহমিকার অন্তর্ভর্ুক্ত। দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করা, সালাত সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই কপাল মুছা ও সাজদার সময় ফুঁক দেয়া। (সনদ মুনকার; ইমাম বুখারী তারীখে,৪৯৬ উল্লেখ করেছেন, বায্যার (১/৫৪৭)।
.
উপরোক্ত হাদীসগুলোর কারণে বিদ্বানগণ দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করার হুকুমের ব্যাপারে মতভেদ করেছেন। এ ব্যাপারে তিনটি অভিমত পাওয়া যায়। (আল-মাজমূ (২/৯৮), ওয়াসত (১/৩৩৩)।

▪️১ম অভিমত: কোন ওযর ছাড়া দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করা মাকরূহ। এটা আয়িশা, ইবনে মাসউদ ও উমার এর দু’টি অভিমতের মধ্যে একটি অভিমত। আবু মূসা, শা’বী, ইবনে উয়াইনা, হানাফী ও শাফেঈগণ এ অভিমত পোষণ করেছেন।

▪️২য় অভিমত: এটা সাধারণভাবে জায়েয। উমার (রাঃ) অন্য এক বর্ণনা মতে এ অভিমত পোষণ করেছেন। আলী, যায়েদ বিন সাবিত, ইবনে উমার, সাহল ইবনে সাদ, আনাস, আবু হুরাইরা ও হুযাইফা (রাঃ) এ মতামত ব্যক্ত করেছেন। হাম্বলীগণ এ মতের অনুসারী।

▪️৩য় অভিমত: যদি এমন নরম জায়গায় প্রস্রাব করা হয় যেখান থেকে প্রস্রাব শরীরে ছিটকে আসা সম্ভব নয় তাহলে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করা যাবে। নচেৎ যাবে না। এটা ইমাম মালিকের অভিমত। ইবনে মুনযির এ মতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন।

উপরোক্ত তিনটি মতের মধ্যে বিশুদ্ধ মতামত হলো, যদি প্রস্রাব শরীরে ছিটা গায়ে এসে পড়ার সম্ভাবনা না থাকে, তাহলে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করা জায়েজ, মাকরূহ নয়। এর কয়েকটি কারণ নিম্নরূপ:

▪️(১) এর নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে মহানবী (ﷺ) থেকে কোন সহীহ বর্ণনা পাওয়া যায় না।
▪️(২) মহানাবী (ﷺ) এর বসে প্রস্রাব করাটা দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করা জায়েয হওয়াকে বাধা দেয় না। বরং উভয়টিই বৈধ হওয়াকেই সমর্থন করে।
▪️(৩) মহানাবী (ﷺ) থেকে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করার হাদীস সাব্যস্ত হয়েছে।
▪️(৪) মূলতঃ আয়িশা এর পক্ষ থেকে মহানবী (ﷺ) এর দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করার ব্যাপারে যে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা হয়েছে তা ছিল তাঁর বাড়িতে থাকা অবস্থায়। তাই তিনি শুধু দাঁড়িয়ে প্রস্রাব না করার ব্যাপারেই জানতেন। সুতরাং তা বাইরে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করার ঘটনাকে না বোধক করে না। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, কোন বিষয়ে জ্ঞান না থাকাটা কোন জ্ঞানকে না বোধক করে না। এ বিষয়ে হুযাইফাসহ অন্যরা জানতেন। সুতরাং, এটা যারা জানতেন না তাদের উপর প্রমাণ। আর হাঁ বোধক বিষয় না- বোধকের উপর প্রধান্য পায়। আল্লাহ্‌ই ভাল জানেন! (সহীহ ফিক্বহুস সুন্নাহ প্রথম খন্ড ইসতিনজা অধ্যায়)।
.
বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, সৌদি ফাতাওয়া বোর্ডের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতী, শাইখুল ইসলাম, ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] কে কোন ব্যক্তির জন্য কি দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করা জায়েয আছে কিনা এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, দাড়িয়ে প্রস্রাব করাতে কোন দোষ নেই।বিশেষ করে যখন প্রয়োজন হয়,যদি জায়গাটি এমনভাবে ঢেকে রাখা হয় যে কেউ আসলে তার গোপনাঙ্গ দেখতে না পারে এবং প্রস্রাবের ছিটা থেকে বাঁচতে হবে। অর্থাৎ প্রস্রাবের ছিটা যেন কাপড় বা শরীরে এসে না পড়ে। হুযাইফা (রাঃ) থেকে প্রমাণিত যে, রাসূল (ﷺ) একদল লোকের কাছে এসে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করতেন, তার সত্যতার উপর একমত, তবে বসে প্রস্রাব করা উত্তম কেননা এটি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রধান কাজ, এবং এটি গোপনাঙ্গকে আড়াল করে এবং প্রস্রাবের ছিটা দ্বারা আঘাত করা থেকে দূরে থাকে। (সহীহ বুখারী, মিশকাত হা/৩৬৪ শাইখ ইবনে বাযের মোট ফতোয়া ও প্রবন্ধ (৬/৪৪৫)। অনুরূপ বক্তব্য অপর শাইখ ইবনে উসাইমিন (রাহিমাহুল্লাহ) ও বলেছেন।
.
পরিশেষে, উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে, বসে প্রস্রাব করাই শরী‘আতের বিধান। তবে একান্ত অসুবিধায় দাঁড়িয়ে পেশাব করা জায়েজ। এক্ষেত্রে শর্ত হল, পেশাবের ছিটা যেন দেহে না লাগে। (সহীহ বুখারী,মিশকাত হা/৩৩৮) এবং নির্লজ্জতা প্রকাশ না পায়। (সহীহ বুখারী মিশকাত হা/৫)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬●◈●▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।