চেয়ারে বসে সালাত আদায়

প্রশ্ন: চেয়ারে বসে সালাত আদায় করা যাবে কি? জৈনক আলেম বলেন বসে ফরজ সালাত আদায়ের ইমামতি করা যাবেনা উক্ত বক্তব্য কতটুকু সঠিক?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: সালাত আদায়ের অবস্থা সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তোমরা সালাতসমূহ ও মধ্যবর্তী সালাতের হেফাযত কর এবং আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠচিত্তে দাঁড়িয়ে যাও’ (সূরা বাক্বারাহ ২/২৩৮)। এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, একজন সুস্থ মানুষ ফরয সালাত দাঁড়িয়ে আদায় করবে। কারণ এটি সালাতের রুকন,যা ইচ্ছাকৃত বা ভুলক্রমে পরিত্যাগ করলে সালাত বাতিল হয়ে যাবে। বসে সালাত আদায় করলে সালাত হবে না। তবে নফল সালাত বসে আদায় করাতে কোন বাধা নেই। কিন্তু বসে নফল সালাত আদায়কারী দাঁড়িয়ে সালাত আদায়কারীর অর্ধেক সওয়াব পাবে। (সহীহ বুখারী হা/১১১৫; মিশকাত হা/১২৪৯)।
.
কিন্তু শরীয়তী ওজর থাকলে অসুস্থ বা মা‘যূর ব্যক্তি অসুস্থতা, শরীর দুর্বলতা বা অন্য কোন কারণে ইমাম যদি দাঁড়িয়ে নামায পড়াতে অক্ষম হয় তাহলে তার জন্য বসে ইমামতি করা বৈধ। এ ব্যাপারে সম্মানিত ফকীহদের মাঝে কোন দ্বিমত নাই। সবাই একমত।তবে এ ক্ষেত্রে মুক্তাদিগণ দাঁড়িয়ে তার অনুসরণ করবে না কি বসে অনুসরণ করবে ইমামের অবস্থার আলোকে তা নির্ধারিত হবে। কারণ রাসূল (ﷺ) ওযরের কারণে বসে সালাতে ইমামতি করেছিলেন। আর আবুবকর (রাঃ) তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে এবং অন্যান্য সাহাবীগণ তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে ইকতেদা করেছিলেন (সহীহ বুখারী হা/৬৮৭; মুসলিম হা/৪১৮; মিশকাত হা/১১৪৭)।
.
হুমায়দী বলেন, যখন ইমাম বসে সালাত আদায় করবে তখন তোমরা বসে সালাত আদায় কর। এই অবস্থা ছিল রাসূল (ﷺ) এর পূর্বের রোগের কারণে। এরপর রাসূল( ﷺ) বসে সালাত আদায় করেছেন এবং সাহাবীগণ তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করেছেন। তিনি তাদেরকে বসার আদেশ দেননি (সহীহ বুখারী হা/৬৮৯-এর সাথে সংযুক্ত; মির‘আত ৪/৮৯)।
.
নবী করীম (ﷺ) মৃত্যু অবধি তাঁর অধিকাংশ (নফল) সালাত বসে আদায় করেছেন। (সহীহ মুসলিম হা/৭৩২; নাসাঈ হা/১৬৫৬)।
.
রাসূল (ﷺ) একদা ঘোড়া থেকে পড়ে আহত হ’লে ফরয সালাতও বসে আদায় করেছেন।(সহীহ বুখারী হা/১১১৪; মুসলিম হা/৪১১; মিশকাত হা/১১৩৯)।
.
রাসূল (ﷺ) শেষ বয়সে অসুস্থ হয়ে পড়লে ফরয সালাত বসে আদায় করতেন। (সুনানে নাসাঈ হা/৭৯৭; আহমাদ হা/২৬১৫৬)।
.
ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, ‘কোন অসুস্থ ব্যক্তি বসে সালাত আদায় করলে দাঁড়িয়ে সালাত আদায়কারীর ন্যায় সওয়াব পাবে’ (আল-মাজমূ‘ ৪/৩১০)।
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন, أجمع أهل العلم على أن من لا يطيق القيام له أن يصلي جالساً- ‘বিদ্বানগণ এ ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে, দাঁড়াতে অক্ষম ব্যক্তি বসে সালাত আদায় করবে’। (আল মুগনী ২/১০৬)।
.
ইমাম নববী (রহঃ) আরো বলেন, أجمعت الأمة على أن من عجز عن القيام في الفريضة صلاها قاعداً ولا إعادة عليه- ‘মুসলিম উম্মাহ এ ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেছে যে, ফরয সালাতে দাঁড়াতে অক্ষম ব্যক্তি বসে সালাত আদায় করবে এবং তাকে পুনরায় সালাত ঘুরিয়ে পড়তে হবে না’ (মাজমূ‘ ৪/৩১০; ছালেহ মুনাজ্জিদ, ফাতাওয়া ইসলাম ১/৫০০৯, প্রশ্ন নং ৫০৬৮৪)।
.
বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, সৌদি ফাতাওয়া বোর্ডের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতী, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেন, যে ব্যক্তি মাটি বা চেয়ারে বসে সালাত আদায় করবে তার জন্য আবশ্যক হ’ল- সে রুকূর তুলনায় সিজদায় বেশী মাথা নিচু করবে। আর তার জন্য সুন্নাত হ’ল রুকূ অবস্থায় তার দু’হাত হাঁটুতে রাখা। আর সিজদা অবস্থায় আবশ্যক হ’ল- সাধ্যমত হাত দু’টিকে মাটিতে রাখা। তাতে সক্ষম না হ’লে হাতদ্বয় হাঁটুর উপর রাখতে হবে। কারণ রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘আমি সাতটি অঙ্গের উপর সিজদা করতে আদিষ্ট হয়েছি- কপাল, দু’হাত, হাঁটুদ্বয় ও দু’পায়ের অগ্রভাগ।আর যে ব্যক্তি এতেও অপারগ হবে এবং চেয়ারে বসে সালাত আদায় করবে, তাতে কোন অসুবিধা নেই। (বুখারী হা/৮১২; মিশকাত হা/৮৮৭মাজমূ‘ ফাতাওয়া বিন বায ১২/২৪৫-২৪৬; ফাতাওয়া ইসলাম ১/৫০০৯, প্রশ্ন নং ৫০৬৮৪)।
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি ‘আরবের আরেক শ্রেষ্ঠ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন, অসুস্থ অবস্থায় চেয়ারে বসে সালাত আদায়ে কোন বাধা নেই। প্রথমতঃ দাঁড়িয়ে সালাত করতে হবে। না পারলে সালাতে বসার ন্যায় বসে আদায় করবে। তাতে অক্ষম হ’লে চারজানু হয়ে বসে। এতেও সক্ষম না হ’লে হাতে হেলান দিয়ে বসে সালাত আদায় করবে। আল্লাহকে সাধ্যমত ভয় করতে হবে। কারণ আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَاتَّقُوا اللهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ ‘সুতরাং তোমরা সাধ্যানুযায়ী আল্লাহকে ভয় কর’ (তাগাবুন ৬৪/১৬) । তাছাড়া আল্লাহ আরও বলেন, لاَ يُكَلِّفُ اللهُ نَفْساً إِلاَّ وُسْعَهَا ‘আল্লাহ কোন ব্যক্তিকে তার সাধ্যের বাইরে দায়িত্ব দেন না’ (বাক্বারাহ ০২/২৮৫; ফাতাওয়া নূরুন আলাদ-দারব ৩/১৮৪, ৫/১৮৪)।
.
উল্লেখ যে, ইমাম দাঁড়িয়ে সালাত শুরু করার পর যদি অসুস্থতার কারণে বসে সালাত আদায় করেন, তবে মুছল্লীরা বাকী সালাত দাঁড়িয়ে আদায় করবে।আর যদি এমন হয় যে, ইমাম প্রথম থেকেই বসে সালাত শুরু করেছে তাহল পেছনে মুক্তাদিগণও তার অনুসরণে প্রথম থেকে বসে সালাত আদায় করবে। (সহীহ বুখারী, হাদিস নম্বর ৬৫৩-৬৫৪)।
.
অতএব উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা প্রমানিত যে,অসুস্থ অবস্থায় ইমাম বসে সালাতে ইমামতি করতে পারবেন। জুতায় অপবিত্রতা না থাকলে জুতা পরিধান করে সালাত আদায় করা জায়েয। আনাস ইবনু মালেক (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, নবী করীম (ﷺ,) কি তাঁর জুতা পরে সালাত আদায় করতেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ (সহীহ বুখারী হা/৩৮৬)। সুতরাং উক্ত মুফতি সাহেবের বক্তব্য ভিত্তিহীন সেটাও প্রমানিত। আশা করি উত্তরটি পেয়েছেন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_____________________
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।