কোন কাজগুলো ডান দিক থেকে এবং কোন কাজগুলো বাম দিক থেকে শুরু করা সুন্নাত

প্রশ্ন: কোন কাজগুলো ডান দিক থেকে এবং কোন কাজগুলো বাম দিক থেকে শুরু করা সুন্নাত? ঘরে প্রবেশ এবং ঘর থেকে বের হওয়ার সময় আগে কোন পা দিতে হবে এবং কোন দু’আ পাঠ করতে হবে?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: ইসলাম মানুষকে অনন্য শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়েছে। দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কাজে নানা নিয়ম-কানুন মেনে চলার জন্য ইসলামে যেমন নির্দেশনা রয়েছে। তেমনি কাজ কর্মে হাত-পায়ের ব্যবহার সম্পর্কে ইসলামী শরীয়তের বিধান হলো: قاعدة الشريعة : تقديم اليمين في كل ما كان من باب الكرامة ، وتقديم الشمال في كل ما كان من باب المهانة ، تنبيها على تعظيم اليمين ، وتميزها ، وزيادة لشرفها .অর্থাৎ ডান হাতকে কেবল সম্মানিত জিনিসগুলোর জন্য ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। আর বাম হাতকে এমন জিনিসগুলোর জন্য ব্যবহার করতে বলা হয়েছে, যা অশুচি বলে গণ্য। (ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৩৮৩৮২)।
.
আম্মাজান আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُعْجِبُهُ التَّيَمُّنُ فِيْ تَنَعُّلِهِ وَتَرَجُّلِهِ وَطُهُوْرِهِ وَفِيْ شَأْنِهِ كُلِّهِ ‘নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জুতা পরিধান, চুল আঁচড়ানো এবং পবিত্রতা অর্জন করা তথা প্রত্যেক কাজই ডান দিক হতে আরম্ভ করতে পছন্দ করতেন।’ (সহীহ বুখারী, হা/১৬৮)। তিনি আরো বলেন, كَانَتْ يَدُ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْيُمْنَى لِطُهُوْرِهِ وَطَعَامِهِ وَكَانَتْ يَدُهُ الْيُسْرَى لِخَلَائِهِ وَمَا كَانَ مِنْ أَذًى ‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ডান হাত ছিল পবিত্রতা অর্জন ও খাদ্য গ্রহণের জন্য। আর তাঁর বাম হাত ছিল শৌচ ও অন্যান্য নিকৃষ্ট বা কষ্টদায়ক কাজের জন্য। (আবু দাঊদ, হা/৩৩; মিশকাত, হা/৩৪৮, সনদ সহীহ)।
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন, باب استحباب تقديم اليمين في كل مَا هو من باب التكريم ؛ كالوضوءِ وَالغُسْلِ وَالتَّيَمُّمِ ، وَلُبْسِ الثَّوْبِ وَالنَّعْلِ وَالخُفِّ وَالسَّرَاوِيلِ وَدُخولِ الْمَسْجِدِ ، وَالسِّوَاكِ ، وَالاكْتِحَالِ ، وَتقليم الأظْفار ، وَقَصِّ الشَّارِبِ ، وَنَتْفِ الإبْطِ ، وَحلقِ الرَّأسِ ، وَالسّلامِ مِنَ الصَّلاَةِ ، وَالأكْلِ ، والشُّربِ ، وَالمُصافحَةِ ، وَاسْتِلاَمِ الحَجَرِ الأَسْوَدِ ، والخروجِ منَ الخلاءِ ، والأخذ والعطاء وغيرِ ذَلِكَ مِمَّا هُوَ في معناه . ويُسْتَحَبُّ تَقديمُ اليسارِ في ضدِ ذَلِكَ ، كالامْتِخَاطِ وَالبُصَاقِ عن اليسار ، ودخولِ الخَلاءِ ، والخروج من المَسْجِدِ ، وخَلْعِ الخُفِّ والنَّعْلِ والسراويلِ والثوبِ ، والاسْتِنْجَاءِ وفِعلِ المُسْتَقْذرَاتِ وأشْبَاه ذَلِكَ ” انتهى .‘শরী‘আতে এটি একটি চলমান রীতি যে, জামাকাপড়, ট্রাউজার এবং মোজা পরিধান করা, মসজিদে প্রবেশ করা, মিসওয়াক করা, চোখে সুরমা লাগানো, নখ কাটা, গোঁফ ছাঁটা, চুল আঁচড়ানো, বগলের চুল উপড়ানো, মাথা কামানো, সালাত শেষে সালাম ফিরানো, ওযুতে অঙ্গ ধুয়ে ফেলা, টয়লেট থেকে বেরিয়ে আসা, খাওয়া-দাওয়া, মুছাফাহ, হাজারে আসওয়াদকে চুম্বন দেয়া ইত্যাদিতে ডান ব্যবহার করা বা ডানদিক থেকে শুরু করা মুস্তাহাব। এর বিপরীত বিষয়গুলো যেমন, টয়লেটে প্রবেশ করা, মসজিদ থেকে বের হওয়া, নাক মুছা, টয়লেট ব্যবহারের পরে নিজেকে পরিষ্কার করা, কাপড়, ট্রাউজার এবং মোজা খুলে ফেলা ইত্যাদিতে বাম হাত ব্যবহার করা বা বাম দিক থেকে শুরু করা মুস্তাহাব। (ইমাম নববী, শারহু সহীহ মুসলিম, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১৬০; রিয়াদুস সালেহীন খন্ড: ১ পৃষ্ঠা:৪০৫, শামসুল হক আযীমাবাদী, ‘আওনুল মা‘বূদ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩৫)।
.
▪️দ্বিতীয়ত: ঘর থেকে বের হওয়া এবং ঘরে প্রবেশের সময় আগে কোন পা দেওয়া উত্তম:
.
গৃহে প্রবেশ করা এবং বের হওয়ার সময় দুই পায়ের কোন পা আগে দেওয়া মুস্তাহাব এই বিষয়ে কুরআন হাদীসে সুস্পষ্ট করে কোন নির্দিষ্ট দলিল পাওয়া যায়না। যেহেতু সুস্পষ্ট কোন দলিল নেই তাই আহালুল আলেমগণ এই বিষয়ে মতভেদ করেছেন। তাদের কেউ বলেছেন ডান দিক দিয়ে প্রবেশ করতে হবে অর্থাৎ ডান “পা” দিয়ে। আবার কেউ বলেছেন বাম “পা” দিয়ে প্রবেশ করতে হয়। আবার মসজিদে প্রবেশ সংক্রান্ত হাদিসের উপর কিয়াস করে কেউ কেউ বলেছেন ঘরে প্রবেশের সময় আগে ডান “পা” দেওয়া এবং ঘর থেকে বের হওয়ার সময় আগে বাম “পা” দেওয়া উত্তম। তবে সর্বাধিক বিশুদ্ধ কথা হলো উভয় অবস্থায় আগে ডান “পা” ব্যবহার করা। (এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে দেখুন রিয়াযুস সলিহিন; ৬/৭)।
.
খারাসী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: وَأَمَّا الْمَنْزِلُ فَيُقَدِّمُ يُمْنَاهُ دُخُولًا وَخُرُوجًا ، إذْ لَا أَذَى ، وَلَا عِبَادَةَ ” انتهى .অর্থাৎ বাড়িতে ডান পা দিয়ে বের হওয়া এবং প্রবেশ করা উচিত। কেননা এর মাঝে কোন কষ্ট কিংবা ইবাদত নাই। (শারহু মুখতাসার খলিল: ১/১৪৫)।
.
শায়খ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন; والظاهر إن الأمر في ذلك واسع ، إن شاء الله ، وأنه لا حرج في تقديم إحدى الرجلين أو تأخيرها ، عند دخول المنزل ، أو الخروج منه ؛ فعلة التكريم أو الإهانة غير ظاهرة في هذا الأمر ، ولم يرد فيه سنة بخصوصه ، ويوشك أن لو كان في الأمر استحباب لوردت به السنة ، كما وردت بغيره من الآداب والأذكار المتعلقة بدخول المنزل والخروج منه . মূল কথা হলো এ বিষয়টির মাঝে রয়েছে প্রশস্ততা। দুই পায়ের যেকোনো পা দিয়ে প্রবেশ করা এবং বের হওয়া যাবে। যেহেতু এখানে সম্মান কিংবা অপমানের বিষয়টি স্পষ্ট নয় এবং এ বিষয়ে কোন কিছু বর্ণিত হয়নি। যদি এটি সুন্নাত হতো; তাহলে অবশ্যই হাদিসের মাঝে বর্ণনা আসত। যেমনি ভাবে বাড়িতে প্রবেশ করা এবং বাড়ি থেকে বের হওয়ার আরো অন্যান্য বিধি-বিধান গুলো বর্ণিত হয়েছে। (আল্লাহ তাআলা সবচেয়ে ভালো জানেন)। (ইসলাম সুওয়াল জাওয়াব, ফাতাওয়া নং-১৩৮৩৮২) সুতরাং ঘর থেকে বের হওয়া বা ঘরে প্রবেশের সময় আগে ডান “পা” কিংবা বাম পায়ের কোন একটি ব্যবহার করতে কোন সমস্যা নেই ইনশাআল্লাহ। তবে যেহেতু ঘরে প্রবেশ কিংবা ঘর থেকে বাহিরে যাওয়া নিষিদ্ধ কিংবা খারাপ কাজ নয় সে হিসেবে উত্তম হচ্ছে আগে ডান পা দেওয়া।
.
▪️তৃতীয়ত: ঘর থেকে বের হওয়া এবং ঘরে প্রবেশের দু’আ:
.
আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, যে ব্যক্তি বাড়ী থেকে বের হওয়ার সময় বলবে, بِسْمِ اللهِ تَوَكَّلْتُ عَلَى اللهِ لاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِاللهِ উচ্চারণ: বিসমিল্লা-হি তাওয়াক্কালতু আলাল্লা-হি ওয়া লা হাওলা ওলা-লা কুউওয়াতা ইল্লা বিল্লা-হ। অর্থঃ ‘আল্লাহর নামে (বের হচ্ছি), তাঁর উপরে ভরসা করছি। আল্লাহ ব্যতীত কোন ক্ষমতা নেই, কোন শক্তি নেই।’ তাকে বলা হবে এটা তোমার জন্য যথেষ্ট হয়ে গেছে, তোমাকে বাঁচানো হয়েছে, তোমাকে সুপথ দেখিয়ে দেয়া হয়েছে। তখন শয়তান তার কাছ থেকে দূরে চলে যায়। এক শয়তান অপর শয়তানকে বলে, তুমি ঐ ব্যক্তির সাথে কি করতে পার? যাকে সুপথ দেখানো হয়েছে এবং সব রকমের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করা হয়েছে। (আবু দাউদ হা/৫০৯৫; তিরমিযী হা/৩৪২৬; মিশকাত হা/২৪৪৩, সহীহ আল জামি ৪৯৯, ইবনু হিব্বান ৮২২, সনদ সহীহ)।
.
আবু মালিক আল-আশ‘আরী (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; যখন কেউ নিজ ঘরে প্রবেশ কররে তখন সে যেন বলে- بِسْمِ اللّٰهِ وَلَجْنَا، وَبِسْمِ اللّٰهِ خَرَجْنَا، وَعَلَى اللّٰهِ رَبِّنَا تَوَكَّلْنَا অনুবাদ: বিসমিল্লাহি ওয়ালাজনা, ওয়াবিস্‌মিল্লাহি খারাজনা, ওয়া আলাল্লাহি রাব্বিনা তাওয়াক্কালনা। অর্থ: আল্লাহ্‌র নামে আমরা প্রবেশ করলাম, আল্লাহ্‌র নামেই আমরা বের হলাম এবং আমাদের রব আল্লাহ্‌র উপরই আমরা ভরসা করলাম। (আবূ দাউদ ৪/৩২৫, হা/ ৫০৯৬, সিলসিলা সহীহা হা/২২৫)। তাহক্বীক: হাদীসটির সনদে শুরাইহ বিন উবাইদ এবং আবু মালিকের মধ্যে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে এই হাদীসটি একদল আলেমদের মতে দুর্বল। তবে ইমাম বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) তার তুহফাতুল আখইয়ার গ্রন্থে পৃষ্ঠা: ২৮ এবং মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ: খন্ড: ২৬ পৃষ্ঠা: ৩৫ এ হাদীসটির সনদকে হাসান বলেছেন। অনেকের মতে হাদীসটি হাসান। (বিস্তারিত জানতে ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-২২২৮৭৫)।
.
অপর বর্ননায় জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছেনঃ কোনো ব্যক্তি তার ঘরে প্রবেশ ও খাদ্য গ্রহণের সময় আল্লাহর নাম নিলে অর্থাৎ, (‘বিসমিল্লাহ’’ বলে) তখন শয়তান (তার সঙ্গীদের) বলে, রাতে এখানে তোমাদের থাকা-খাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যখন কোনো ব্যক্তি ঘরে প্রবেশের সময় আল্লাহর নাম নেয় না, তখন শয়তান বলে, তোমরা রাতে থাকার স্থান পেলে। সে যখন খাবার সময় আল্লাহর নাম স্মরণ করে না তখন শয়তান বলে, তোমরা রাতে থাকার জায়গা ও খাওয়ার দুটোর সুযোগই পেলে। (সহীহ মুসলিম হা/ ২০১৮ আবু দাউদ হা/৩৭৬৫) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_____________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।