কুনুতে নাযেলা সম্পর্কে বিস্তারিত

প্রশ্ন: কুনুতে নাযেলা কী? শারঈ দৃষ্টিকোণ থেকে জুমআর সালাতে কুনূত নাযেলা পড়ার বিধান কী?
▬▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: আরবি قُنُوْت কুনূত’ শব্দের অর্থ বিনম্র আনুগত্য। আরবি نَازِلَة নাযেলা শব্দের অর্থ: আকস্মিক দুর্ঘটনা, বিপদ-মুসিবত। পরিভাষায় কুনুতে নাজেলা হলো: মুসলমানদের উপর প্রাকৃতিক কিংবা কা*ফির*দের চাপিয়ে দেওয়া বিপদ-মুসিবত ও অত্যাচারের সময় আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে তাঁর আনুগত্য করা এবং তাঁর কাছে এই বিপদ থেকে মুক্তির জন্য দু‘আ করা।
.
শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে কুনূত দু’প্রকার। (১).কুনূতে রাতেবাহ ও (২).কুনূতে নাযেলাহ। প্রথমটি বিতর সালাতের শেষ রাকআতে রুকুর পূর্বে অথবা পরে পড়তে হয়। দ্বিতীয়টি মুসলিমদের উপর বিপদাপদ ও বিশেষ কোন যরূরী কারণে বিপদ থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনায় ফরয সালাতের শেষ রাক‘আতে পড়তে হয়।
.
❑ ইসলামী শরীয়তে কুনুতে নাজেলার প্রমাণ কী:
.
কুনুতে নাযেলা একটি প্রমাণিত আমল। সহীহ সূত্রে আনাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, একটি কাফের গোষ্ঠী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ৭০ জন (কুরআন হাফেজ) সাহাবীকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। অথচ তখন এদের সাথে মুসলিমদের সন্ধি ছিলো। এই ঘটনায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভীষণ কষ্ট পান। তাই তিনি এদের বিরুদ্ধে এক মাস পর্যন্ত কুনুত (নাজেলা) পড়েছেন।(সহীহ বুখারী হা/ ৩১৭০ সহীহ মুসলিম, হা/৬৭৭) শুধু এই ঘটনাই নয়, রাসূল (ﷺ) আরও বিভিন্ন সময়ে কুনুতে নাজেলা পড়েছেন। অতএব, মুসলিমদের বিপদ-মসীবতের সময় সালাতের মধ্যে কুনূত পড়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত এবং শরীয়তে এটি একটি প্রমাণিত গুরুত্বপূর্ণ আমল। এটি প্রয়োজনে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতে পড়া যায়। এই মর্মে ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, বিশুদ্ধ ও প্রসিদ্ধ বক্তব্য হ’ল, মুসলমানদের উপর শত্রু উপস্থিত হ’লে এবং দুর্ভিক্ষ, মহামারী, অনাবৃষ্টি, দুনিয়াবী ক্ষতি বা অনুরূপ যেকোন বিপদাপদের সময় পাঁচ ওয়াক্ত সালাতে কুনূতে নাযেলা পাঠ করা যাবে (নববী শরহ নববী: খন্ড: ৫ পৃষ্ঠা: ১৭৬) শাইখুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, যেকোন বিপদে কুনূতে নাযেলা পাঠ করা সুন্নাত, যা মুহাদ্দিছ ফক্বীহগণসহ খোলাফায়ে রাশেদীনের আমল দ্বারা প্রমাণিত। (মাজমূ‘উল ফাতাওয়া খন্ড: ২৩ পৃষ্ঠা: ১০৯-১১০)
.
❑ কুনুতে নাজেলার পদ্ধতি কী?
.
ফরজ নামাজের শেষ রাকাতে রুকু থেকে “সামি‘আল্লাহু লিমান হামিদাহ” বলে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর পর কুনুতে নাজেলা পড়তে হয়। কুনুত পড়া শেষ হলে দাঁড়ানো থেকে আল্লাহু আকবার বলে সিজদায় চলে যেতে হবে। এরপর নামাজের বাকি অংশ স্বাভাবিক নিয়মে সমাপ্ত করতে হবে। রাসূল ﷺ এমনটিই করতেন। দলিল হচ্ছে, ইবনু ‘আব্বাস রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুমা সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরো এক মাস যোহর, ‘আসর,মাগরিব, ‘ইশা ও ফজরের সালাতে শেষ রাক‘আতে ‘‘সামি‘আল্লাহু লিমান হামিদাহ’’ বলার পর কুনূত পাঠ করেছেন। এ সময় তিনি বনু সুলাইমের কয়েকটি গোত্র, যেমন রি‘ল, যাকওয়ান ও উসাইয়্যার উপর বদদু‘আ করেছেন এবং তাঁর পিছনের মুক্তাদীরা আমীন আমীন বলেছেন। (মুসনাদে আহমেদ হা/২৭৪৬ আবু দাউদ হা /১৪৪৩ এছাড়া ইমাম ইবনে খুজাইমাহ সাবিত ইবনু যায়িদ হতে বর্ননা করেছেন সহীহ ইবনু খুযাইমাহ হা/৬১৮ হাদিসটি হাসান)
.
❑.কুনুতে নাজেলার নিদিষ্ট কোন দু‘আ আছে কী?
.
ইসলামি শরীয়তে কুনুতে নাজেলার জন্য নির্দিষ্টভাবে একক কোনো দু‘আ ফিক্সড করা হয়নি। বরং নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর সাহাবিগণ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বাক্যে কুনুতে নাজেলা পড়েছেন। তাই, যখন যে বিপদ থাকবে, তখন সেটির উপর দু‘আ হবে। শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ), সঊদী আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটি বলেন, যেহেতু কুনূতে নাযিলার জন্য কোন নির্ধারিত দু‘আ কুরআন ও সহীহ হাদীসে সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়নি, রাসূল (ﷺ) প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দু‘আ করেছেন (সহীহ বুখারী, হা/৪০৭০; সহীহ মুসলিম, হা/৬৭৯; আবূ দাঊদ, হা/১৪৪৩)। তাই কুনূতে নাযিলাতে পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ যে কোন বৈধ দু‘আ পাঠ করা যেতে পারে। তবে বিতর-এর কুনূতের জন্য নির্ধারিত দু‘আ কুনূতে নাযিলায় পাঠ করা যাবে না। কেননা সেটি তার জন্যই নির্ধারিত (মাজমূঊল ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ, ২২/২৭১ পৃ.; ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ৯/৪৯ পৃ.; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৩৩৪১৫৮)।
.
❑.বিতিরের দু‘আ কুনূত কিংবা ফরজ সালাতে কুনুতে নাযেলা পড়ার সময় হাত তুলা যাবে কি?
.
বিশুদ্ধ মতে বিতর কিংবা ফরজ সালাতে উভয় কুনুতেই হাত তোলা যাবে। ইবনুল মুনযির (রাহিমাহুল্লাহ) ও ইবনু রজব (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, সালাফে সালিহীনের মধ্যে ওমর ইবনু খাত্তাব, আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ, আবূ হুরায়রা ও আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে, أنَّهم كانوا يرفعون أيديَهم في القنوت ‘তাঁরা কুনূতে হাত উত্তোলন করতেন। আর এই মতটিকেই ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল, ইসহাক্ব, নাখঈ, ছাওরী, মালিক, আওযায়ী, আবূ হানীফা (রাহিমাহুমুল্লাহ) গ্রহণ করেছেন’ (আল-ইশরাফ, ২/২৭৩; ফাৎহুল বারী, ৬/৪২৪-৪২৫ পৃ.)। অনুরূপভাবে শাফিঈ মাযহাব, হাম্বালী মাযহাব, ইমাম আবূ ইউসুফ, শায়খ ইবনু বায, শায়খ উসাইমীন ও ইমাম নাছিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুমুল্লাহ) বলেন,উভয় কুনূতের দু‘আতেই হাত উত্তোলন করা মুস্তাহাব। (সহীহ মুসলিম, হা/৯১৩; ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল আওসাত্ব, হা/৩৭৯৩; আল-মাজমূঊ, ৩/৫০০; রাওযাতুত ত্বলিবীন, ১/২৫৫; মাজমূঊ ফাতাওয়া ইবনে বায, ৩০/৫১; উসাইমীন মাজমূঊ ফাতাওয়া খন্ড: ১৪ পৃষ্ঠা: ১৩৬-১৩৭)।
.
❑.কুনুতে নাযেলা পড়ার সময় কোন কোন দু’আগুলো পড়া যায়?
.
আগেই উল্লেখ করেছি কুনুতে নাযেলার নিদিষ্ট কোন দু’আ বর্নিত হয়নি,এটি পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপট অনুযায়ী পড়া হবে,তবে হাদীসে বর্নিত কুনুতে নাজেলার কয়েকটি দু‘আ রয়েছে আর তা হচ্ছে:
.
(১) আবদুল্লাহ্ ইবনু আবি আউফা (রা.) বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আহযাবের যুদ্ধের দিনে মুশ*’রিকদের বিরু*দ্ধে দু‘আ করেছিলেন:
.
اللّٰهُمَّ مُنْزِلَ الْكِتَابِ، سَرِيْعَ الْحِسَابِ، اِهْزِمِ الْأَحْزَابَ، اَللّٰهُمَّ اهْزِمْهُمْ وَزَلْزِلْهُمْ (وَانْصُرْنَا عَلَيْهِمْ).
.
{আল্লা-হুম্মা মুনযিলাল কিতাব, সারি-‘আল হিসা-ব, ইহযিমিল আ‘হযা-ব; আল্লা-হুম্মাহযিমহুম ওয়া যালযিলহুম (ওয়ানসুরনা ‘আলাইহিম)}
.
অর্থ: হে আল্লাহ কিতাব নাজিলকারী, দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী! আপনি সম্মিলিত (শ*ত্রু)-বাহিনীকে পরাভূত করুন। হে আল্লাহ! আপনি তাদের পরাজিত করুন, তাদের কাঁপিয়ে (ভীত-স*ন্ত্র*স্ত করে) দিন এবং তাদের উপর আমাদের সাহায্য করুন। (ইমাম বুখারি, হা/২৯৩৩ ও ২৯৬৬)
.
(২) আবু মুসা আশ‘আরি (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো জনগোষ্ঠীর ব্যাপারে শঙ্কাবোধ করলে বলতেন:
.
ﺍَﻟﻠّٰﻬُﻢَّ ﺇِﻧَّﺎ ﻧَﺠْﻌَﻠُﻚَ ﻓِﻲْ ﻧُﺤُﻮْﺭِﻫِﻢ، ﻭَﻧَﻌُﻮْﺫُ ﺑِﻚَ ﻣِﻦْ ﺷُﺮُﻭْﺭِﻫِﻢْ
.
(আল্লা-হুম্মা ইন্না নাজ‘আলুকা ফি নু‘হু-রিহিম ওয়া না‘উ-যুবিকা মিন শুরু-রিহিম)
.
অর্থ: হে আল্লাহ! আমরা আপনাকে এদের (শত্রুদের) গলদেশে রাখছি (অর্থাৎ এদের বিরুদ্ধে আপনাকে সামনে রাখছি) এবং এদের অনিষ্ট থেকে আপনার নিকট আশ্রয় চাচ্ছি।(ইমাম আবু দাউদ, হা/১৫৩৭; হাদিসটি সহিহ)
.
(৩) উমর (রা.)-এর খিলাফতকালে মুসলমানগণ (সাহাবি ও তাবিঈন) রমাদানে বিতরের কুনুতে কাফি’*রদের বিরুদ্ধে এভাবে দু‘আ করতেন:
.
اَللّٰهُمَّ قَاتِلِ الْكَفَرَةَ الَّذِيْنَ يَصُدُّوْنَ عَنْ سَبِيْلِكَ وَيُكَذِّبُوْنَ رُسُلَكَ، وَأَلْقِ فِي قُلُوْبِهِمُ الرُّعْبَ، وَأَلْقِ عَلَيْهِمْ رِجْزَكَ وَعَذَابَكَ
.
(আল্লা-হুম্মা ক্বা-তিলিল কাফারাতাল্লাযি-না ইয়াসুদ্দু-না ‘আন সাবি-লিক, ওয়া য়ুকাযযিবু-না রুসুলাক, ওয়া আলক্বি ফি ক্বুলু-বিহিমুর রু‘ব, ওয়া আলক্বি ‘আলাইহিম রিজযাকা ওয়া ‘আযা-বাক)
.
অর্ধ: হে আল্লাহ, কাফি’*রদের ধ্বং’*স করুন—যারা আপনার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, আপনার রাসুলকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। তাদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার করুন এবং তাদের উপর আপনার ক্রোধ ও আজাব নিক্ষিপ্ত করুন। [ইমাম ইবনু খুযাইমাহ, আস-সহিহ: ১১০০; শায়খ আলবানি, কিয়ামু রমাদান, পৃষ্ঠা: ৩১; হাদিসটির সনদ সহিহ (পূর্ণাঙ্গ দু‘আ উল্লেখ করা হয়নি। কুনুতে নাজেলা পড়তে আগ্রহীগণ এর পুরোটা মুখস্থ করে নেবেন)
.
নোট: উক্ত দু’আগুলো পড়ার নিয়ম হচ্ছে,জামাআতে নামাজে পড়লে ইমাম ফরজ নামাজের শেষ রাকাআতে রুকুর পর “সামিআল্লাহু লিমান হামিদাহ” বলার পর কুনুত পড়বেন। কুনূতে শব্দে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বর্ণিত শব্দগুলি যোগ করার ক্ষেত্রে কোন দোষ নেই যা পরিস্থিতির সাথে উপযুক্ত হতে পারে, কারণ এটি দু’আ (দোয়া) এবং দু’আ’র সমস্যা। দু’আ’র বিষয়টির পরিধি বিস্তৃত এবং এর সাথে যোগ করা ইসলামে অনুমোদিত। উমর (রা) থেকে বর্ণিত দু’আ সম্পর্কে বলা হয়েছে: এবং তিনি মুসলমানদের জন্য যা কিছু কল্যাণ করতে পারেন তার জন্য প্রার্থনা করতেন, তারপর তিনি মুমিনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। (বিস্তারিত জানতে দেখুন ইমাম উসাইমীন আস শারহুল মুমতি: খন্ড: ৪ পৃষ্ঠা: ৫২) কুনূতে নাযিলাহ ও কুনূতে বিতর পড়ার সময় ইমামের পিছনে মুক্তাদীগণ আমীন আমীন বলতে পারবেন। (আবু দাঊদ হা/১৪৪৩, সনদ হাসান; আল-মাজমূঊ, ৩/৪৯৩-৫০২;উসাইমীন মাজমূঊ ফাতাওয়া খন্ড: ১৩ পৃষ্ঠা: ১৩৯; ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমা, ৭/৪৮; বিন বায মাজমূঊ ফাতাওয়া খন্ড: ১২ পৃষ্ঠা:৩৩৯; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-১১৮০২৩)।

❑.জুম’আর সালাতে কুনুতে নাযেলা পড়ার বিধান কী?
.
জুমআর নামাযে কুনেতে নাযেলা পড়া জায়েজ কিনা এব্যাপারে আহালুল আলেমগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। অধিকাংশ আলেমগণ মনে করেন যে খুতবার সময় কুনূত পড়া জায়েজ নয়।কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনে অনেক জুমার সালাত আদায় করেছেন কিন্তু তিনি কখনো জুমার সালাতে কুনুতে নাযেলা পড়েছেন কিংবা পড়তে বলেছেন এই মর্মে কুরআন হাদীসে বিশুদ্ধ কোন দলিল নেই।
.
তাবেঈ ইবনু তাউস,মাকহূল এবং ইবরাহীম আন নাখঈ (রহিমাহুল্লাহ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে,”জুমার সালাতে কুনুতে নাযেলা পড়া বিদআত”। আত্বা, হাসান বসরি এবং ক্বতাদা (রহিমাহুল্লাহ) এটিকে অস্বীকার করেছেন অর্থাৎ এটি শরীয়ত সম্মত নয়)। (মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাক:৩/১৯৪ , মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা: ২/৪৬)
.
ইমাম মালিক বিন আনাস আল-আসবাহী আল-মাদানী (রাহিমাহুল্লাহ) [জন্ম: ৯৩ হি: মৃত: ১৭৯ হি.] তিনি ইবনে শিহাবকে জুমার দিনে দোয়া কুনুত পড়া বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে ইবনে শিহাব উত্তরে বলেন,”এটি মুহদাস ও বিদআত”।(আল ইস্তেযকার: খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ২৯৩)
.
তিনি (ইবনে শিহাব) আরো বলেছেন,”বনী উমাইয়ার জামানাতে মানুষেরা জুম’আর দিনে দোয়া কুনুত পড়তো কিন্তু তা সঠিক ছিলনা”।(আল ইস্তেযকার খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ৭৬)
.
মারদাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন: ইমাম আহমাদ (রহিমাহুল্লাহ) জুম’আর নামাজ ব্যতীত সকল ফরজ নামাজে দোয়া কুনুত পাঠ করতেন। এই কথাটি সঠিক।এই কথাটি ইবনে তাইমিয়া (রহিমাহুল্লাহ) পছন্দ করেছেন, তবে কেউ কেউ বলেছেন জুম’আর দিনেও তিনি দোয়া কুনুত পড়েছেন এই মতটি কাজী ইযায (রহিমাহুল্লাহ) পছন্দ করেছেন।(আল ইনসাফ, খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ১৭৫)
.
ইবনে মুনযীর (রহিমাহুল্লাহ) বলেন:

” اختلف أهل العلم في القنوت في الجمعة ، فكرهت طائفة القنوت في الجمعة ، وممن كان لا يقنت في صلاة الجمعة : علي بن أبي طالب ، والمغيرة بن شعبة ، والنعمان بن بشير ، وبه قال عطاء ، والزهري ، وقتادة ، ومالك ، وسفيان الثوري ، والشافعي ، وإسحاق ، وقال أحمد : بنو أمية كانت تقنت . وروي عن محمد بن علي ، قال : القنوت في الفجر ، والجمعة ، والعيدين ، وكل صلاة يجهر فيها بالقراءة . قال ابن المنذر : بالقول الأول أقول

“জুম্মার দিনে দোয়া কুনুত পড়া বিষয়ে আলেমদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। যারা দুআ কুনুত পড়তেন না তারা হলেন আলি ইবনে আবু তালেব , মুগীরা ইবনে শু’বা, নোমান ইবনে বাশির আর আত্বা , জহুরী, মালেক, সুফিয়ান সাওরী , শাফীঈ ইসাহাক ও আহমাদ বলেন: বনু উমাইয়াগন দোয়া কুনুত পড়তো। মুহাম্মদ ইবনে আলী হতে বর্ণিত তিনি বলেন: দোয়া কুনুত ফজরে , জুমার নামাজে, দুই ঈদের নামাজে এবং প্রত্যেক জেহেরী সলাতেই পাঠ করা যায়”। (আওসাত্ব, খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ৪১-৪২)
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]- কে জিজ্ঞেসা করা হয়েছিলো: জুমার নামাজে দোয়া কুনুত পড়ার হুকুম কি?

তিনি উত্তরে বলেন:

“يقول العلماء : إن الإمام لا يقنُت في صلاة الجمعة ؛ لأن الخطبة فيها دعاء للمؤمنين ، فيُدعى لمن يُراد أن يُقْنَت لهم في أثناء الخطبة ، هكذا قال أهل العلم . فقيل له : وإن قنت فأجاب : ما دام أن العلماء قالوا : لا يقنت ، فعليه أن يترك .
فقيل له : وهل هو جائز ؟ فأجاب : لا بأس ؛ لأنه حتى لو قنت فإنه لا يعتبر عاصياً ؛ لكن الأحسن أن يدعو لمن أراد القنوت لهم في أثناء الخطبة” ا

“আহালুল আলেমদের মতে ইমাম সাহেব জুমআর সালাতে কুনূত পাঠ করবেন না। কেননা সেখানে সকল মুমিনদের জন্য দোয়া করাই বাঞ্ছনীয়। যেহেতু জুমার নামাজে সকল মুমিনদের জন্য দোয়া করা উচিত সেহেতু সেটাই করা আমাদের জন্য জরুরী। তাকে পুনরায় জিজ্ঞেস করা হলো কেউ যদি দোয়া কুনুত পড়ে তাহলে? উত্তরে তিনি বলেন, ওলামাগণ সব সময় একই কথা বলেছেন যে দোয়া কুনুত পড়তে হবে না তবে কেউ যদি পড়ে তাহলে তার জন্য দোয়া কুনুত পরিত্যাগ করা উচিত। পুনরায় প্রশ্ন করা হলো: এটা কি জায়েজ? উত্তরে তিনি বলেন, কোন সমস্যা নাই যদি কেউ দোয়া কুনুত পাঠ করে তাহলে সে গুনাগার হবে না। অতএব,ইমাম জুমআর দিন যার জন্য দুআ করার ইচ্ছা করবেন, তিনি খুতবার মধ্যেই তার জন্য দু’আ করবেন”। (উসাইমীন লিকাউল-বাবিল মাফতুহ: ১৫/২৪)
.
সৌদি ফতোয়া বোর্ড এবং সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের প্রবীণ সদস্য, যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫৪ হি./১৯৩৫ খ্রি.]-কে এই ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছেন, খুতবাতে দুআ করাই যথেষ্ট; জুমআর সালাতে কুনূত পড়া হবে না। একই প্রশ্ন সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) আলিমগণকে জিজ্ঞেস করা হলে জবাবে তারা বলেন: মুসলিমদের বিভিন্ন বিপদ-আপদে ফরজ সালাতে কুনুত পড়া জায়েজ, কিন্তু জুমআর নামাযে কুনুত পড়ার ব্যাপারে নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে কোন হাদীস বর্ণিত হয়নি….। (ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ ফাতওয়া নং-১৮৪৮৮)
.
পরিশেষে প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত আলোচনা থেকে যা বুঝা যায় তা হচ্ছে, কুনুতে নাযেলা একটি প্রমানিত আমল।মুসলিমদের বিপদ-আপদে ফরজ সালাতের শেষ রাকআতে কুনুতে নাযেলা পড়ে দু’আ করা মুস্তাহাব। কুনুতে নাযেলা পাঁচ ওয়াক্ত (ফজর-এশা) সালাতেই পড়া যায় তবে জুম’আর সালাতে পড়া নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে,দলিলের আলোকে বিশুদ্ধ কথা হচ্ছে,”জুম’আর সালাতে পড়া উচিত নয়”।কেননা রাসূল (ﷺ) জুম’আর সালাতে নিজে কখনো পড়েছেন কিংবা কাউকে পড়তে বলেছেন এই মর্মে বিশুদ্ধ কোন দলিল নেই।অতএব, উত্তম হচ্ছে জুমআর সালাতে কুনূত পড়া বর্জন করা। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_____________________
উপস্থাপনায়:
আপনাদের দ্বীনি ভাই
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।