কাদের উপর রামাদানের সাওম পালন করা ওয়াজিব

ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে যে ব্যক্তির মধ্যে ৫টি শর্ত পাওয়া যায় তার উপর সাওম পালন করা ওয়াজিব। যেমন:

(১). যদি সে মুসলিম হয়।

(২). যদি সে মুকাল্লাফ (যার উপর শারী‘আতের বিধি-বিধান প্রযোজ্য) হয়।

(৩). যদি সে সাওম পালন করতে সক্ষম হয়। (৪). যদি সে অবস্থানকারী (মুকিম) হয়। এবং (৫). যদি সাওম পালনে বাধাদানকারী বিষয়সমূহ তার মধ্যে না পাওয়া যায়। এই পাঁচটি শর্ত যে ব্যক্তির মধ্যে পাওয়া যায় তার উপর সাওম পালন করা ওয়াজিব। (ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-২৬৮১৪) এবার আমরা পাঁচটি শর্ত সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
.
▪️প্রথম শর্ত: মুসলিম হওয়া।
.
প্রথম শর্ত অনুযায়ী সিয়াম পালনকারী ব্যক্তি মুসলিম হতে হবে। একজন কাফির ব্যক্তি এই বিধানের বহির্ভূত; কারন একজন অমুসলিম কাফিরের জন্য সাওম পালন করা বাধ্যতামূলক নয়, আর সে তা পালন করলেও তার সিয়াম শুদ্ধ হবে না। আর যদি সে ইসলাম কবুল করে, তাহলে তাকে সেই দিনগুলোর কাযা করতেও আদেশ করা হবে না। আর এর দলীল হলো আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “আর তাদের দানসমূহ কবুল হতে এটিই বাঁধা দিয়েছিল যে তারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (মুহাম্মাদ) এর সাথে কুফরী করেছিল এবং তারা শুধু অলসতা বশতই সালাতে উপস্থিত হত আর তারা শুধু বাধ্য হয়েই অনিচ্ছাকৃত ভাবে দান করত।” (আত-তাওবাহ; ৯/৫৪)। ঈমান থাকা আমল কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত। কাফের যত আমলই করুক না কেন ঈমান না থাকার কারণে সেটা আখিরাতে তার কোন কাজে আসবে না। কাফের যদি কোন ভাল কাজ করে; যেমন: আত্মীয়দের দান করে, অসহায়কে সহায়তা দেয়, কাউকে বিপদ থেকে উত্তরণে সহায়তা করে, সে এ সমস্ত ভাল কাজের দ্বারা আখিরাতে উপকৃত হতে পারবে না। তবে দুনিয়াতেই তাকে সেটার কারণে পর্যাপ্ত রিযক দেয়া হবে। তবে হ্যাঁ, রামাদানে দিনেরবেলা কোন কাফের ইসলাম গ্রহণ করলে ঐ দিনের বাকি অংশটা পানাহার থেকে বিরত থাকবে। (বিস্তারিত নিচে আলোচনা রয়েছে)
.
▪️দ্বিতীয় শর্ত: যদি সে মুকাল্লাফ (শারী‘আত সম্মত ভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়া)।
.
শিশু বালেগ না হলে তার উপর সিয়াম ফরয হয় না। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; তিন ব্যক্তি কিয়ামত দিবসে দায়-দায়িত্বমুক্ত। ঘুমন্ত ব্যক্তি জেগে না ওঠা পর্যন্ত, অপ্রাপ্তবয়স্ক বালেগ না হওয়া পর্যন্ত এবং নির্বোধ ব্যক্তি (বুদ্ধি-বিবেচনার) জ্ঞান ফিরে না আসা পর্যন্ত। (আবু দাউদ হা/৪৪০১; মিশকাত হা/৩২৮৭; সহীহুল জামে হা/৩৫১২)। আর ইসলামে ছেলে এবং মেয়ে উভয়ের বালেগ হওয়ার বয়সসীমা ও আলামত শরীয়তের পক্ষ থেকে নির্ধারিত রয়েছে। কোনো ছেলে বা মেয়ের মধ্যে বালেগ হওয়ার নির্দিষ্ট আলামত পাওয়া গেলে বা নির্দিষ্ট বয়সসীমায় পৌঁছলেই তাকে বালেগ গণ্য করা হবে এবং তখন থেকেই শরীয়তের হুকুম-আহকাম তার উপর প্রযোজ্য হবে। ছেলেদের বালেগ হওয়ার আলামত হলো: (ক). স্বপ্নদোষ হওয়া। (খ). বীর্যপাত হওয়া। (গ). দাঁড়ি বা গোঁফ উঠা। আর মেয়েদের বালেগ হওয়ার আলামত হল: (ক). স্বপ্নদোষ হওয়া। (খ). হায়েয (ঋতুস্রাব) আসা। (গ). গর্ভধারণ করা। (ঘ). স্তন বড় হওয়া। বালেগ হওয়ার উপরোক্ত নির্দিষ্ট আলামত যদি কোনো ছেলে বা মেয়ের মধ্যে পাওয়া না যায় সেক্ষেত্রে উভয়ের বয়স যখন হিজরী বর্ষ হিসাবে পনেরো বছর পূর্ণ হবে তখন প্রত্যেককে বালেগ গণ্য করা হবে এবং পনেরো বছর পূর্ণ হওয়ার পর কোনো আলামত পাওয়া না গেলেও সে বালেগ বলেই বিবেচিত হবে। (আল ইনায়া শারহুল হেদায়া ৮/২০১, তাফসীরে কুরতুবী ১২/১৫১, সহীহ বুখারী হা/২৬৬৪, ৪০৯৭ মুসলিম হা/ ১৮৬৮)
.
▪️তৃতীয় শর্ত: সক্ষম অর্থাৎ যে সিয়াম পালনে সক্ষম।
.
যে ব্যক্তি সিয়াম পালন করতে অক্ষম তার উপর সিয়াম পালন ওয়াজিব নয়। আর এর দলীল আল্লাহ তা‘আলার বাণী; “আর যে অসুস্থ অথবা ভ্রমণে আছে সে সেই সংখ্যায় অন্য দিনগুলোতে এর ক্বাদ্বা (কাযা) করবে।” (আল-বাকারাহ, ২/১৮৫)। আর শরীয়তের দৃষ্টিতে অক্ষমতা দুই শ্রেণীতে বিভক্ত। যেমন; অস্থায়ী অক্ষমতা ও স্থায়ী অক্ষমতা। (১). আর অস্থায়ী অক্ষমতা উল্লেখিত হয়েছে পূর্বের আয়াতটিতে যেমন-এমন রোগী যার সুস্থতার আশা করা যায় এবং মুসাফির; এ সমস্ত ব্যক্তিদের জন্য সাওম পালন না করা জায়েয। এরপর তাদের ছুটে যাওয়া সাওম কাযা করা ওয়াজিব। (২). আর স্থায়ী অক্ষমতা যেমন-এমন রোগী যার সুস্থতা আশা করা যায় না এবং এমন বৃদ্ধ লোক যিনি সিয়াম পালনে অক্ষম, আর তা উল্লেখিত হয়েছে তাঁর-আল্লাহ তা‘আলার বাণীতে “আর যারা সাওম পালনে অক্ষম তারা ফিদয়াহ দিবে (অর্থাৎ মিসকীন খাওয়াবে)। (আল-বাকারাহ, ২/১৮৪)। এই আয়াতটিকে যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুফাসসিরকুল শিরোমণি, উম্মাহ’র শ্রেষ্ঠ ইলমী ব্যক্তিত্ব, সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) [মৃত: ৬৮ হি.] তাফসীর করে বলেছেন-“বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা যাদের অনেক বয়স হয়েছে তারা যদি সাওম পালনে সক্ষম না হয়, তবে তারা প্রতিদিনের বদলে একজন মিসকীনকে খাওয়াবে।” অর্থাৎ, যে ব্যক্তি বেশী বার্ধক্যে পৌঁছে যাওয়ার কারণে অথবা আরোগ্য লাভের আশা নেই, এমন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ার কারণে রোযা রাখতে অত্যন্ত কষ্ট বোধ করে, সে এর পরিবর্তে একজন মিসকীনকে খাদ্য দান করবে। তবে অধিকাংশ মুফাসসিরগণ এর অর্থ ‘রোযা রাখার সামর্থ্য রাখে’ করেছেন। আর এ অর্থে এর ব্যাখ্যা হলো, ইসলামের প্রথম পর্যায়ে রোযা রাখার অভ্যাস না থাকার ফলে সামর্থ্যবানদেরকেও অনুমতি দেওয়া হয়েছিল যে, তারা রোযা রাখতে না পারলে এর পরিবর্তে একজন মিসকীনকে খাদ্য দান করবে। পরে {فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ} আয়াত অবতীর্ণ হলে আগের বিধান রহিত করে প্রত্যেক সামর্থ্যবানের উপর রোযা ফরয করা হয়। কেবল বৃদ্ধ ও চিররোগা ব্যক্তির জন্য এই বিধান অবশিষ্ট রাখা হয়েছে। তারা রোযার পরিবর্তে খাদ্য দান করবে। গর্ভিণী এবং দুগ্ধদাত্রী মহিলাদের রোযা রাখা কষ্টকর হলে, তারাও রোগীর বিধানের আওতায় পড়বে। অর্থাৎ, তারা রোযা না রেখে পরে তার কাযা করবে। (তুহফাতুল আহওয়াযী সহীহ বুখারী ৪৫০৭, মুসলিম: ১১৪৫, আবু দাউদ: ২৩১৫, ২৩১৬ ও তিরমিযী হা/ ৭৯৮)
.
▪️চতুর্থ শর্ত: সে যেন মুকীম বা অবস্থানকারী হয়।
.
একজন ব্যক্তি যদি মুসাফির হয় তবে তার উপর সাওম পালন করা ওয়াজিব নয়। এর দলীল হল তাঁর-আল্লাহ তা‘আলা-বলেন, আর যে অসুস্থ অথবা ভ্রমণে আছে সে সেই সংখ্যায় অন্য দিনগুলোতে এর কাযা করবে।”(আল-বাকারাহ, ২/ ১৮৫)। আর আলিমগণ এ ব্যাপারে ইজমা (ঐকমত্য) প্রকাশ করেছেন যে, একজন মুসাফিরের জন্য সাওম ভঙ্গ করা জায়েয (বৈধ)। আর একজন মুসাফিরের জন্য উত্তম হলো তার জন্য যেটা বেশি সহজ তা করা। যদি সাওম পালন করায় তার ক্ষতি হয় তবে তার (মুসাফিরের) জন্য সাওম পালন করা হারাম। এর দলীল হল তাঁর-তা‘আলা বলেন, “তোমরা নিজেরা নিজেদেরকে হত্যা করো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি অতি দয়াময়।(আন-নিসা, ৪/২৯)। এই আয়াতটি থেকে এই নির্দেশনা পাওয়া যায় যে, যা মানুষের জন্য ক্ষতিকর তা তার জন্য নিষিদ্ধ। এখন যদি আপনি বলেন সেই ক্ষতির পরিমাণ কতটুকু যা সিয়াম পালনকে হারাম করে? তবে তার উত্তর হল: এমন ক্ষতি যা ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করা সম্ভব অথবা কারো দেয়া তথ্যের মাধ্যমে জানা সম্ভব। (১). আর ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করা একজন রোগী নিজেই অনুভব করবে যে সাওম পালন করার কারণে তার ক্ষতি হচ্ছে ও তা তার পীড়ার কারণ হচ্ছে যার কারণে সুস্থতা দেরীতে হয় এ ধরণের কিছু। (২). আর তথ্যের মাধ্যমে এই ক্ষতি সম্পর্কে জানার অর্থ হল, একজন বিজ্ঞ ও বিশ্বস্ত ডাক্তার তাকে (রোগীকে) এ তথ্য দিবে যে সাওম পালন করা তার জন্য ক্ষতিকর।(ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-২০১৬৫)
.
▪️পঞ্চম শর্ত: যদি কোন ব্যক্তি থেকে সাওম পালনে বাধাদানকারী বিষয়সমূহ না পাওয়া যায়।
.
এটি বিশেষভাবে নারীদের জন্য প্রযোজ্য। সুতরাং হায়েয হয়েছে ও নিফাস হয়েছে এতদুভয়ের উপর সাওম পালন বাধ্যতামূলক নয়। এর দলীল হলো নবীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্বীকৃতিমূলক হাদীস “একজন নারীর মাসিক ঋতুস্রাব হলে সে কি সালাত ও সাওম ত্যাগ করে না?”(আল- বুখারী হা/২৯৮)।সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন, আলিমগণের ইজমা তথা সর্বসম্মত মত অনুসারে তার উপর সাওম পালন ওয়াজিব হয় না আর তা পালন করলে শুদ্ধও হয় না। তবে তার উপর এই দিনগুলো কাযা করা ইজমা সর্বসম্মতিক্রমে বাধ্যতামূলক। (ইমাম উসাইমীন আশ-শারহুল-মুমতি, ৬/৩৩০) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
__________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।