কত বছর বয়সে শিশুদের উপর সিয়াম ফরয হয় এবং ছোট শিশুদের সিয়াম পালনে অভস্থ করার পদ্বতি

ইবাদতসমূহের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ও ফযীলতপূর্ণ একটি ইবাদত হল রামাদানে সিয়াম পালন করা। ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে কত বছর বয়সে শিশুদের উপর সিয়াম পালন করা ফরয হয় এই মর্মে সুস্পষ্ট করে কোন দলীল পাওয়া যায় না। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে শরীয়তের হুকুম আহকাম তখনই ফরজ হয় যখন শিশু বালেগ হয়। অর্থাৎ শিশু বালেগ না হলে তার উপর সিয়াম ফরয হয় না। এ মর্মে দলিল হল: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; তিন ব্যক্তি কিয়ামত দিবসে দায়-দায়িত্বমুক্ত। ঘুমন্ত ব্যক্তি জেগে না ওঠা পর্যন্ত, অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালেগ না হওয়া পর্যন্ত এবং নির্বোধ ব্যক্তি (বুদ্ধি-বিবেচনার) জ্ঞান ফিরে না আসা পর্যন্ত। (আবু দাউদ হা/৪৪০১; মিশকাত হা/৩২৮৭; সহীহুল জামে হা/৩৫১২)। আর ইসলামে ছেলে এবং মেয়ে উভয়ের বালেগ হওয়ার বয়সসীমা ও আলামত শরীয়তের পক্ষ থেকে নির্ধারিত রয়েছে। কোনো ছেলে বা মেয়ের মধ্যে বালেগ হওয়ার নির্দিষ্ট আলামত পাওয়া গেলে বা নির্দিষ্ট বয়সসীমায় পৌঁছলেই তাকে বালেগ গণ্য করা হবে এবং তখন থেকেই শরীয়তের হুকুম-আহকাম তার উপর প্রযোজ্য হবে। ছেলেদের বালেগ হওয়ার আলামত হল: (ক). স্বপ্নদোষ হওয়া। (খ). বীর্যপাত হওয়া। (গ). দাঁড়ি বা গোঁফ উঠা। আর মেয়েদের বালেগ হওয়ার আলামত হলো: (ক). স্বপ্নদোষ হওয়া। (খ). হায়েয (ঋতুস্রাব) আসা। (গ). গর্ভধারণ করা। (ঘ). স্তন বড় হওয়া। বালেগ হওয়ার উপরোক্ত নির্দিষ্ট আলামত যদি কোন ছেলে বা মেয়ের মধ্যে পাওয়া না যায় সেক্ষেত্রে উভয়ের বয়স যখন হিজরী বর্ষ হিসাবে পনেরো বছর পূর্ণ হবে তখন প্রত্যেককে বালেগ গণ্য করা হবে এবং পনেরো বছর পূর্ণ হওয়ার পর কোন আলামত পাওয়া না গেলেও সে বালেগ বলেই বিবেচিত হবে। (আল ইনায়া শারহুল হেদায়া ৮/২০১, তাফসীরে কুরতুবী ১২/১৫১, সহীহ বুখারী হা/২৬৬৪, ৪০৯৭ মুসলিম হা/ ১৮৬৮ মিশকাত হা/৩৩৭৬, ৩৯৭৪; উসায়মীন, আশ-শারহুল মুমতে ৬/৩২৩)।
.
যদিও শিশু-কিশোরদের সিয়াম পালনের ক্ষেত্রে সালাত বা অন্যান্য ইবাদতের মত সুনির্দিষ্ট কোন বয়স শর্ত না থাকলেও এর গুরুত্ব বিবেচনায় অভিভাবকদের উচিত তাদেরকে সিয়াম পালনে উদ্বুদ্ধ করা এবং এতদ্বিষয়ে বিভিন্ন বিধি-বিধান সম্পর্কে তাদেরকে অবহিত করা। কেননা যেকোন শিশু বা কিশোর সক্ষম হলেই সিয়াম রাখতে পারে। এক্ষেত্রে শারঈ কোন বাধা নেই। এক্ষেত্রে অভিভাবকের দায়িত্ব হলো- শিশুরা যাতে করে সিয়ামের ব্যাপারে যথেষ্ট ধারণা অর্জন করতে পারে সেজন্য এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় বিধি-বিধানগুলো তাদেরকে অবগত করানো উচিত। এর ফল হবে- শৈশবকাল থেকেই তারা সঠিক উপায়ে সিয়াম পালনে অভ্যস্ত হবে। যেমন: সাহরী খাওয়া, সকল ধরনের পানাহার থেকে বিরত থাকা। বন্ধু-বান্ধব ও অন্যান্যের সাথে মিথ্যা না বলা, দ্বন্দ্ব-ফাসাদে লিপ্ত না হওয়া ও যাবতীয় অন্যায়-অশ্লীল কাজ-কর্ম থেকে বিরত থাকা।কুরআন তেলাওয়াত করা ও দান-সাদাক্বাহ করা। ভুলবশতঃ কিছু খেয়ে ফেললে সিয়াম ছেড়ে না দিয়ে বরং তা পূর্ণ করা, সূর্যাস্তের সাথে সাথে ইফতার করা। এবং তারাবীহ কিংবা তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করা ইত্যাদি।
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন; যদিও অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালক-বালিকাদের ওপর সিয়াম পালন ফরজ নয়, তবে শিশুর বয়স ১০ বছর হলে বা তারও পূর্বে সিয়াম রাখার মত শারীরিক সক্ষমতা আসলে অভিভাবকরা অভ্যস্ত করার জন্য তাদের সিয়াম পালন করতে আদেশ করবেন এবং তাদেরকে প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসবেন। (ইবনু কুদামাহ, মুগনী ৩/১৬১; ইবনে উসাইমীন মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১৯/ ১৯-২০, ২৮-২৯, ৮৩)। সাহাবায়ে কেরাম বলেন, আমরা পরবর্তীতে আশূরার সিয়াম রাখতাম এবং আমাদের ছোট ছোট বাচ্চাদেরকেও রাখাতাম। তাদের জন্য তুলার খেলনা তৈরী করতাম এবং তাদেরকে মসজিদে নিয়ে যেতাম। রুবাই বিনতে মুআব্বিয (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, “আশূরার দিন সকালে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আনসাদের সকল পল্লীতে এ নির্দেশ দিলেন যে ব্যক্তি সিয়াম পালন করেনি সে যেন দিনের বাকি অংশ না খেয়ে থাকে, আর যার সিয়াম অবস্থায় সকাল হয়েছে, সে যেন সিয়াম পূর্ণ করে। তিনি (রুবাই বিনতে মুআব্বিয রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, পরবর্তীতে আমরা ঐ দিন (আশূরার) সিয়াম পালন করতাম এবং আমাদের শিশুদের সিয়াম পালন করাতাম। আমরা তাদের জন্য পশমের খেলনা তৈরি করে দিতাম। তাদের কেউ খাবারের জন্য কাঁদলে তাকে ঐ খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে রাখতাম। আর এভাবেই ইফতারের সময় হয়ে যেত।” (সহীহ বুখারী হা/১৯৬০; মুসলিম হা/১১৩৬)। উল্লেখ্য যে, বালেগ হওয়ার পূর্বে আদায়কৃত সিয়ামের সওয়াব অবশ্যই পাবে। সাথে সাথে অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুকে ইবাদতে সহায়তার জন্য তাদের পিতা-মাতাও সওয়াব পাবে। (ইবনু তায়মিয়াহ, আল ফাতাওয়াল কুবরা ৫/৩১৮; বিন বায, মাজমূ ফাতাওয়া ১৬/৩৭৭)। বিদ্বানগণ বলেন, অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের আমলের সওয়াব লিখা হয়; কিন্তু কোন গুনাহ লেখা হয় না। (মাওয়াহিবুল জলীল; ১/৪১৩)
.
▪️একনজরে শিশুদেরকে রোযা পালনে অভ্যস্ত করে তোলার বেশকিছু পন্থা যেমন:
___________________________
(১). শিশুদের নিকট সিয়ামের ফজিলত সম্পর্কিত হাদিসগুলো তুলে ধরতে হবে। তাদেরকে জানাতে হবে সিয়াম পালন জান্নাতে প্রবেশের মাধ্যম। জান্নাতের একটি দরজার নাম হচ্ছে ‘আর-রাইয়্যান’। এ দরজা দিয়ে শুধু রোযাদারগণ প্রবেশ করবে।

(২). রামাদান আসার পূর্বেই শিশুদের কিছু সিয়াম রাখানোর মাধ্যমে সিয়াম পালনে তাদেরকে অভ্যস্ত করে তোলার চেষ্টা করতে হবে। যেমন: শা’বান মাসে কয়েকটি রোযা রাখানো। যাতে তারা কিছুটা অভ্যস্ত হয় এবং আকস্মিক ভাবে রামাদানের রোযার সম্মুখীন না হয়।
.
(৩). রামাদানের প্রথমদিকে দিনের কিছু অংশে রোযা পালন করানো। পরে ক্রমান্বয়ে সেই সময়কে বাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা।
.
(৪). একেবারে রাতের শেষ সময়ে সাহরী গ্রহণ করা। এতে করে তাদের জন্য দিনের বেলায় সিয়ান পালন সহজ হবে।
.
(৫). সিয়াম পালন করার জন্য প্রতিদিন বা প্রতি সপ্তাহে পুরস্কার দেওয়ার মাধ্যমে তাদেরকে সিয়াম পালনে উৎসাহিত করা।
.
(৬). ইফতার ও সাহরীর সময় পরিবারের সকল সদস্যের সামনে তাদের অর্থাৎ শিশুদের
প্রশংসা করা। যাতে তাদের মানসিক উন্নয়ন ঘটে এবং পরবর্তীতে সিয়াম পালনে উৎসাহিত হয়।
.
(৭). যার একাধিক শিশু রয়েছে তাদের মাঝে প্রতিযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি করা। তবে খুবই সতর্কতার সাথে খেয়াল রাখতে হবে যাতে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া শিশুটির প্রতি কঠোরতা প্রদর্শন করা না হয়।
.
(৮). তাদের মধ্যে যাদের ক্ষুধা লাগবে তাদেরকে ঘুম পাড়িয়ে অথবা বৈধ খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে রাখা। এমন খেলনা যাতে পরিশ্রম করতে হয় না। যেভাবে সম্মানিত সাহাবীগণ তাঁদের সন্তানদের ক্ষেত্রে করতেন। নির্ভরযোগ্য ইসলামী চ্যানেল গুলোতে শিশুদের উপযোগী কিছু অনুষ্ঠান রয়েছে এবং রক্ষণশীল কিছু কার্টুন সিরিজ রয়েছে। এগুলো দিয়ে তাদেরকে ব্যস্ত রাখা যেতে পারে।
.
(৯). ভাল হয় যদি বাবা তার ছেলেকে মসজিদে নিয়ে যান। বিশেষতঃ আসরের সময়। যাতে সে নামাযের জামাতে হাযির থাকতে পারে। বিভিন্ন দ্বীনি ক্লাসে অংশ নিতে পারে এবং মসজিদে অবস্থান করে কুরআন তিলাওয়াত ও আল্লাহ তা’আলার যিকিরে রত থাকতে পারে।
.
(১০). যেসব পরিবারের শিশুরা রোযা রাখে তাদের বাসায় বেড়াতে যাওয়ার জন্য দিনে বা রাতের কিছু সময় নির্দিষ্ট করে নেয়া। যাতে তারা সিয়াম পালন অব্যাহত রাখার প্রেরণা পায়।
.
(১১). ইফতারের পর শরীয়ত অনুমোদিত ঘুরাফিরার সুযোগ দেয়া। অথবা তারা পছন্দ করে এমন খাবার, চকলেট, মিষ্টি, ফল-ফলাদি ও শরবত প্রস্তুত করা।
.
আমরা এ ব্যাপারেও লক্ষ্য রাখতে বলছি যে, শিশুর যদি খুব বেশি কষ্ট হয় তবে রোযাটি পূর্ণ করতে তার ওপর অতিরিক্ত চাপ দেওয়া উচিত নয়। যাতে তার মাঝে ইবাদতের প্রতি অনীহা না আসে অথবা তার মাঝে মিথ্যা বলার প্রবণতা তৈরী না করে অথবা তার অসুস্থতা বৃদ্ধির কারণ না ঘটায়। কেননা ইসলামী শরিয়তে সে মুকাল্লাফ (ভারার্পিত) নয়। তাই এ ব্যাপারে খেয়াল রাখা উচিত এবং সিয়াম পালনে আদেশ করার ব্যাপারে কড়াকড়ি না করা উচিত। (ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৩৯২৫২) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
__________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।