কথা বলা কিংবা স্থান পরিবর্তন করার মাধ্যমে ফরজ সালাত থেকে নফল সালাতকে পৃথক করার বিধান

রাসূল (ﷺ)- এর বিশুদ্ধ হাদীসের আলোকে আহালুল আলেমগনের মতামত হচ্ছে, ফরজ ও নফল সালাতের মাঝে কোন কথা বলে কিংবা স্থান পরিবর্তন করে একটা পার্থক্য তৈরী করা মুস্তাহাব। অর্থাৎ যে স্থানে দাড়িয়ে ফরজ সালাত আদায় করা হয়েছে সেখান থেকে কিছুটা এদিক ওদিক সরে নফল সালাত আদায় করা মুস্তাহাব। এই মর্মে দলিল হচ্ছে, বিখ্যাত সাহাবী আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “তোমাদের কেউ যখন সালাত পড়ে তখন কি সে একটু সামনে কিংবা পেছনে, কিংবা ডানে কিংবা বামে সরে আসতে পারে না; মানে নফল সালাতে” অর্থাৎ কেউ যদি ফরজ সালাতের পর নফল সালাত পড়ে। (আবু দাউদ হা/৮৫৪ মিশকাত হা/ ৯৫৩) তাহক্বীক্ব ইমাম আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ): সুনানে ইবনে মাজাহ গ্রন্থে হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন ইবনে মাজাহ হা/১৪২৮) এই বিধান ইমাম, মুক্তাদী নারী-পুরুষ একাকী কিংবা জামাআতে সবার জন্যই প্রযোজ্য। দলিল আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে মারফূ সূত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘‘তোমাদেরকে কিসে অপারগ করেছে নফল সালাতে ডানে বা বামে অগ্রসর বা পিছনে সরে আসতে?’’ (আবূ দাঊদ হা/১০০৬, মুসনাদে আহমাদ হা/৯২১২) সুতরাং হাদীসটি উন্মুক্ত বা ‘আমভাবে প্রমাণ করছে এটি সবার জন্য প্রযোজ্য।
.
কথা বলে কিংবা স্থান পরিবর্তনের মাধ্যমে ফরজ সালাত থেকে নফল সালাতকে পৃথক করার সর্বোত্তম পদ্ধতি হচ্ছে পুরুষদের জন্য জামআতে ফরজ সালাত আদায় করে নিজ ঘরে গিয়ে নফল সালাত আদায় করা। কারণ ফরজ সালাত ছাড়া ব্যক্তির সর্বোত্তম সালাত হচ্ছে তার নিজ ঘরে আদায়কৃত সালাত। এ বিষয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সহীহ হাদিস সাব্যস্ত হয়েছে। ফরজ সালাত থেকে নফল সালাতকে পৃথক করার ব্যাপারে সহীহ মুসলিমে মুয়াবিয়া (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন: “যখন তুমি জুমার সালাত আদায় করবে তখন তুমি এর সাথে অন্য কোন সালাতকে মিলিয়ে ফেলবে না; কথা বলে কিংবা মসজিদ থেকে বেরিয়ে গিয়ে পৃথক করবে।” কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে সে নির্দেশ দিতেন- “এক সালাতের সাথে যেন অন্য সালাতকে মিলিয়ে ফেলা না হয়; আমরা যেন কথা বলি কিংবা মসজিদ থেকে বেরিয়ে যাই।”(সহীহ মুসলিম হা/১৪৬৩)
.
উক্ত হাদীসের আলোকে শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] সহিহ মুসলিমের ব্যাখ্যায় বলেন:” فيه دليل لما قاله أصحابنا – يعني فقهاء الشافعية – أن النافلة الراتبة وغيرها يستحب أن يتحول لها عن موضع الفريضة إلى موضع آخر، وأفضله التحول إلى البيت، وإلا فموضع آخر من المسجد أو غيره ليكثر مواضع سجوده، ولتنفصل صورة النافلة عن صورة الفريضة. وقوله ( حتى نتكلم ) دليل على أن الفصل بينهما يحصل بالكلام أيضا ، ولكن بالانتقال أفضل لما ذكرناه. والله أعلم” অর্থাৎ “এ হাদিসের মধ্যে আমাদের মাযহাবের আলেমগণ (তথা শাফেয়ি ফিকাহবিদগণ) যা বলেন এর সপক্ষে দলিল রয়েছে। অর্থাৎ যে কোন সুন্নত সালাত আদায় করার জন্য ফরজ সালাত যে স্থানে আদায় করা হয়েছে সে স্থান ছেড়ে অন্যস্থানে যাওয়া মুস্তাহাব। আর সবচেয়ে উত্তম হচ্ছে বাড়ীতে গিয়ে সুন্নত সালাত আদায় করা; কিংবা মসজিদের অন্য কোন জায়গায়, কিংবা মসজিদের বাইরে অন্য কোন স্থানে; যাতে করে ব্যক্তির সিজদার স্থান বৃদ্ধি পায় এবং যাতে করে দৃশ্যতঃ ফরয সালাত থেকে নফল সালাত পৃথক হয়ে যায়। তাঁর কথা: “কথা বলে” এর মধ্যে দলিল রয়েছে যে, এই দুই প্রকার সালাতের মাঝে কথা বলার মাধ্যমেও পৃথকীকরণ করা যায়। তবে স্থান পরিবর্তনের মাধ্যমে পৃথক করা উত্তম; ইতিপূর্বে যেসব দলিল উল্লেখ করেছি সেগুলোর ভিত্তিতে। আল্লাহই ভাল জানেন।(ইমাম নববী,শারহু সহীহ মুসলিম,খন্ড:২ পৃষ্ঠা:৪৭৭ এবং ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১১৬০৬৪)
.
শাইখুল ইসলাম ইমাম তাক্বিউদ্দীন আবুল ‘আব্বাস আহমাদ বিন ‘আব্দুল হালীম বিন তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেন: “” والسنة أن يفصل بين الفرض والنفل في الجمعة وغيرها، كما ثبت عنه في الصحيح أنه صلى الله عليه وسلم نهى أن توصل صلاة بصلاة حتى يفصل بينهما بقيام أو كلام، فلا يفعل ما يفعله كثير من الناس يصل السلام بركعتي السنة، فإن هذا ركوب لنهي النبي صلى الله عليه وسلم، وفي هذا من الحكمة التمييز بين الفرض وغير الفرض، كما يميز بين العبادة وغير العبادة ، ولهذا استحب تعجيل الفطور، وتأخير السحور، والأكل يوم الفطر قبل الصلاة، ونهي عن استقبال رمضان بيوم أو يومين، فهذا كله للفصل بين المأمور به من الصيام وغير المأمور به، والفصل بين العبادة وغيرها، وهكذا تتمييز الجمعة التي أوجبها الله من غيرها”

জুমার ফরজ সালাত ও অন্য ফরজ সালাত থেকে নফল সালাতকে পৃথক করা সুন্নত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সহিহ হাদিসে সাব্যস্ত হয়েছে যে, তিনি এক সালাতের সাথে অন্য সালাতকে মিলিয়ে ফেলতে নিষেধ করেছেন। দাঁড়ানোর মাধ্যমে কিংবা কথা বলার মাধ্যমে দুই সালাত মধ্যে পার্থক্য করা যায়। তাই অনেক মানুষ যা করে থাকেন ‘(ফরজ) সালাতের সালাম ও দুই রাকাত সুন্নত সালাতের মাঝখানে কোন বিচ্ছিন্নতা তৈরী না করা। নিশ্চয় এটি করা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিষেধাজ্ঞাতে লিপ্ত হওয়ার নামান্তর। এ নিষেধাজ্ঞার রহস্য হল যেন ফরজ সালাত ও নফল সালাতের মধ্যে পার্থক্য তৈরী করা যায়। যেমনিভাবে ইবাদত ও ইবাদত নয় এমন কর্মের মধ্যে পার্থক্য করা হয়। এ কারণে অনতিবিলম্বে ইফতার করা, বিলম্বে সেহেরী খাওয়া ও ঈদের দিন সালাতের আগে খাবার গ্রহণ করা মুস্তাহাব করা হয়েছে এবং রমজান শুরু হওয়ার একদিন কিংবা দুইদিন আগে থেকেই রোজা রাখা নিষেধ করা হয়েছে। এ সবকিছুই করা হয়েছে যাতে করে রোজার মধ্যে আদিষ্ট ও অনাদিষ্ট বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য করা জন্য এবং ইবাদত ও গর-ইবাদতের মধ্যে পার্থক্য করার জন্য। এবং একইভাবে জুমার সাথে অন্য কিছুর পার্থক্য তৈরী করা যায় যা পালন করা আল্লাহ তাআলা ফরজ করেছেন।(আল-ফাতাওয়া আল-কুবরা খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ৩৫৯)
.
ফরজ সালাত ও নফল সালাতের মাঝে কোন কথা বলে কিংবা স্থান পরিবর্তন করে একটা ভেদ তৈরী করা মুস্তাহাব। এই বিধানের হেকমত উল্লেখ করতে গিয়ে আহালুল আলেমগন বলেন: যাতে করে মুসলমান তার সেজদার স্থানের সংখ্যা বাড়াতে পারে; যেন হাশরের দিন এ স্থানগুলো তার পক্ষে আল্লাহর কাছে সাক্ষ্য দিতে পারে ইতিপূর্বে ইমাম নববীর বক্তব্যে যা উল্লেখ করেছি।

আল-রমলি (রাহিমাহুল্লাহ) তার ‘নিহায়াতুল মুহতাজ’ গ্রন্থে বলেন: : ” ويسن أن ينتقل للنفل أو الفرض من موضع فرضه أو نفله إلى غيره تكثيراً لمواضع السجود ، فإنها تشهد له، ولما فيه من إحياء البقاع بالعبادة ، فإن لم ينتقل إلى موضع آخر فصل بكلام إنسان ” ফরজ সালাত কিংবা নফল সালাতের জন্য পূর্বের ফরজ সালাত কিংবা নফল সালাত থেকে অন্যত্র স্থানান্তরিত হওয়া সুন্নত। যাতে করে ব্যক্তির সেজদার স্থান বাড়বে। যেহেতু সেজদার স্থানগুলো কেয়ামতের দিন তার পক্ষে সাক্ষী দিবে এবং এভাবে ভূখণ্ডকে ইবাদতের মাধ্যমে জীবন্ত করা হয়। যদি অন্য স্থানে স্থানান্তরিত না হয় তাহলে কোন মানুষের সাথে কথা বলে ছেদ তৈরী করবে। (নিহায়াতুল মুহতাজ’ খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ৫৫২ ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১১৬০৬৪)
.
তবে জেনে রাখা ভাল যে, উপরোক্ত হাদীসের অর্থ হচ্ছে, ফরজ সালাতের পর যে ব্যক্তি নফল সালাত পড়তে চায় সে যেন স্থান পরিবর্তন করে নেয়। এটি এক নফল সালাত থেকে অন্য নফল ক্ষেত্রে নয় কেননা আমাদের জানা মতে দুই নফল সালাতের ব্যাপারে রাসূল ﷺ থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে এমন কিছু বর্ণিত হয়নি। তবে কেউ যদি দুই নফল সালাতের মাঝেও সেটা করতে চায় যেমন যে ব্যক্তি চার রাকাত নফল সালাত পড়তে চায় সে যদি প্রথম দুই রাকাত আদায় করার পর স্থান পরিবর্তন করে যাতে করে তার সেজদার স্থান বৃদ্ধি পায় তাতে কোন সমস্যা নেই।

বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন:” والأفضل أن تكون ركعتين ركعتين ؛ للحديث الصحيح: (صلاة الليل والنهار مثنى مثنى) أما التقدم والتأخر والأخذ عن اليمين والشمال ، فهذا جاء في بعض الأحاديث الضعيفة ، ولا أعلم في الباب ما يدل على السنية ، وإنما جاء في بعض الأحاديث الضعيفة يتقدم أو يتأخر ، أو يأخذ يمينه أو شماله ، قال بعض أهل العلم : لأجل شهادة البقاع بهذه العبادة ، ولكن لا أعلم أنه ثبت في هذا شيء عن النبي صلى الله عليه وسلم ، إذا صلى الراتبة في محل واحد فلا بأس في هذا، ولا أعلم دليلا على استحباب التحول من مكانه إلى الركعتين الأخيرتين ، لا عن يمين ولا عن شمال ولا عن خلف ، فإن فعل فلا حرج ”

যোহরের ফরজ সালাতের পূর্বে চার রাকাত সুন্নত সালাত আদায় করা প্রসঙ্গে বলেন: উত্তম হচ্ছে- দুই রাকাত দুই রাকাত করে আদায় করা। যেহেতু সহিহ হাদিসে এসেছে- “রাত্রির সালাত হচ্ছে দুই রাকাত দুই রাকাত”। পক্ষান্তরে সামনে পিছে, ডানে বা বায়ে যাওয়া প্রসঙ্গে কিছু কিছু দুর্বল হাদিস এসেছে। এটি সুন্নত হওয়া প্রসঙ্গে আমি কোন দলিল জানি না। কিছু দুর্বল হাদিসে সামনে এগিয়ে যাওয়া বা পিছনে যাওয়া, ডানে যাওয়া ও বামে যাওয়ার প্রসঙ্গ এসেছে। কোন কোন আলেম বলেন: এটি করার কথা এসেছে যাতে করে স্থানগুলো এ ইবাদতের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু এ ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে কোন হাদিস সাব্যস্ত হয়েছে মর্মে আমার জানা নেই। যদি সুন্নত নামায একই স্থানে আদায় করে এতে কোন অসুবিধা নেই। প্রথম দুই রাকাত আদায় করার পর পরের দুই রাকাত আদায় করার জন্য স্থান পরিবর্তন করা মুস্তাহাব হওয়ার পক্ষে কোন দলিল আমার জানা নেই; ডানে বায়ে পিছনে কোন ক্ষেত্রেই নয়। তবে যদি এটা করে তাতেও কোন অসুবিধা নেই।(বিন বায ফাতাওয়া নূরুন ‘আলাদ দারব:১০/২৯৬ এবং ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-২২৫৮৯৩) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।