ইয়াহুদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত না হওয়া পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না

প্রশ্ন: রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ই-য়া-হু-দীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত না হওয়া পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না। প্রশ্ন হল এই যুদ্ধটি কখন সংগঠিত হবে? ▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: পথভ্রষ্ট ই-য়া-হু-দীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া ক্বিয়ামতের দশটি বড় আলামতের একটি অন্যতম বড় আলামত। এই যুদ্ধটি তখনই শুরু হবে যখন নবী ঈসা বিন মরিয়ম (আলাইহিস সালাম) পুনরায় অবতরণ করবেন। কেয়ামতের বড় আলামত হচ্ছে সেগুলো যা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হুযাইফা বিন আসিদ (রাঃ)-এর হাদিসে উল্লেখ করেছেন। সে হাদিসে সব মিলিয়ে ১০টি আলামত উল্লেখ করা হয়েছে, এই আলামতগুলো একটার পর একটা প্রকাশ হতে থাকবে। প্রথমটি প্রকাশিত হওয়ার অব্যবহিত পরেই পরেরটি প্রকাশ পাবে। ইমাম মুসলিম হুযাইফাহ ইবনু আসীদ আল-গিফারী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণনা করেন যে, একদিন আমরা (বিবিধ বিষয়ে) আলোচনা করছিলাম। এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের নিকট আবির্ভূত হলেন এবং প্রশ্ন করলেন, তোমরা কী বিষয়ে আলোচনা করছ? উত্তরে তাঁরা বললেন, আমরা ক্বিয়ামত সম্পর্কে আলোচনা করছি। এ কথা শুনে তিনি বললেন, ততক্ষণ পর্যন্ত ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে না যতক্ষণ না তোমরা দশটি বিশেষ আলামত দেখবে। অতঃপর তিনি বর্ণনা করলেন:

(১). ধোঁয়া

(২). দাজ্জাল

(৩). দাব্বাতুল আরয বা ভূমির প্রাণী

(৪). পশ্চিমাকাশ হতে সূর্যোদয় হওয়া

(৫). মারইয়াম পুত্র ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর অবতরণ

(৬). ইয়া’জূজ- মা’জূজ এবং তিনবার ভূখণ্ড ধ্বসে যাওয়া তথা

(৭). পূর্ব দিকে ভূখণ্ড ধ্বস

(৮). পশ্চিম দিকে ভূখণ্ড ধ্বস

(৯). আরব উপদ্বীপে ভূখণ্ড ধ্বস

(১০). এ আলামতসমূহ প্রকাশিত হওয়ার পর এডেনের ভূগর্ভ থেকে এক অগ্ন্যুৎপাতের প্রকাশ ঘটবে, যা তাদেরকে ইয়ামান থেকে হাশরের মাঠ পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে যাবে। (সহীহ মুসলিম হা/২৯০১, ‘কিতাবুল ফিতান’; আবু দাঊদ হা/৪৩১১; তিরমিযী হা/২১৮৩; মুসনাদে আহমাদ হা/২৩৮৭৮)।
.
উপরোক্ত হাদীসের এই আলামতগুলোর ধারাবাহিকতা কী হবে? সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট সহীহ কোন দলীল পাওয়া যায় না। তবে বিভিন্ন দলিলকে একত্রে মিলিয়ে এগুলোর ধারাবাহিকতা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল কেয়ামতের বড় বড় আলামতগুলো কি ধারাবাহিক ভাবে আসবে?
.
জবাব দিতে গিয়ে শাইখ বলেছেন:

“أشراط الساعة الكبرى بعضها مرتب ومعلوم، وبعضها غير مرتب ولا يعلم ترتيبه، فمما جاء مرتباً نزول عيسى بن مريم وخروج يأجوج ومأجوج، والدجال فإن الدجال يبعث ثم ينزل عيسى بن مريم فيقتله ثم يخرج يأجوج ومأجوج.
وقد رتب السفاريني رحمه الله في عقيدته هذه الأشراط، لكن بعض هذا الترتيب تطمئن إليه النفس، وبعضها ليس كذلك، والترتيب لا يهمنا، وإنما يهمنا أن للساعة علامات عظيمة إذا وقعت فإن الساعة تكون قد قربت، وقد جعل الله للساعة أشراطاً؛ لأنها حدث هام يحتاج الناس إلى تنبيههم لقرب حدوثه
কিয়ামতের আলামত গুলোর মধ্যে কোনো কোনোটির ধারাবাহিকতা জানা গেছে; আর কোনো কোনোটির ধারাবাহিকতা জানা যায়নি। ধারাবাহিক আলামতগুলো হচ্ছে- ঈসা বিন মরিয়মের অবতরণ, ইয়াজুজ-মাজুজের বহিঃপ্রকাশ, দাজ্জালের আত্মপ্রকাশ। প্রথমে দাজ্জালকে পাঠানো হবে। তারপর ঈসা বিন মরিয়ম এসে দাজ্জালকে হত্যা করবেন। তারপর ইয়াজুজ-মাজুজ বের হবে। সাফফারিনী (রহঃ) তাঁর রচিত আকিদার গ্রন্থে এই আলামতগুলোর ধারাবাহিকতা নির্ধারণ করেছেন। কিন্তু তাঁর নির্ণয়কৃত এ ধারাবাহিকতার কোন কোন অংশের প্রতি মন সায় দিলেও সবটুকু অংশের প্রতি মন সায় দেয় না। তাই এই আলামতগুলোর ধারাবাহিকতা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে- কেয়ামতের বড় বড় কিছু আলামত আছে। এগুলোর কোন একটি প্রকাশ পেলে জানা যাবে, কেয়ামত অতি সন্নিকটে। কেয়ামত হচ্ছে- অনেক বড় একটা ঘটনা। এই মহা ঘটনার নিকটবর্তিতা সম্পর্কে মানুষকে আগেভাগে সতর্ক করা প্রয়োজন বিধায় আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের জন্য বেশ কিছু আলামত সৃষ্টি করেছেন।‌ (উসাইমীন মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড-২, ফতোয়া নং- ১৩৭)
.
দ্বিতীয়ত: ইহু-দীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সম্পর্কে প্রখ্যাত সাহাবী আবু হুরাইরা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) [মৃত: ৫৯ হি.] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন: মুসলিমগণ ইয়া-হু-দীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত না হওয়া পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না। তখন মুসলিমগণ তাদেরকে হত্যা করবে। এমনকি ই-য়া-হূদী পাথর এবং গাছের আড়ালে লুকিয়ে আত্মগোপন করবে, তখন সেই পাথর ও বৃক্ষ বলবে, হে মুসলিম! ওহে আল্লাহর বান্দা! এই যে ই-য়া-হু-দী আমার পিছনে রয়েছে। অতএব এদিকে আসো এবং তাকে হত্যা কর। তবে শুধু ‘গারকদ’ নামক বৃক্ষ ডেকে বলবে না, কেননা তা ইয়া-হু-দীদের গাছ। (সহীহ মুসলিম হা/২৯২২, মুসনাদে আহমাদ ৯৩৮৭, সহীহুল জামি ৭৪২৭, মিশকাত হা/৫৪১৪)
.
উক্ত হাদীসের আলোকে ইবনুল মুলকিন (রাহিমাহুল্লাহ)
বলেছেন;
المراد بقوله (تقاتلون اليهود) إذا نزل عيسى ،
فإن المسلمين معه ، واليهود مع الدجال

তোমরা ইহু-দী-দের সাথে যুদ্ধ করবে” কথাটির অর্থ হলো- যে এটি ঘটবে যখন ঈসা (আ:) অবতরণ করবেন; মুসলিমরা তার সাথে থাকবে এবং ইহু-দী-রা দাজ্জালের সাথে থাকবে।(আত-তাওদীহ লি শারহুল জামি আস-সহীহ ১৭/৬৬৩)
.
শাফিঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন; উক্ত হাদীসের শব্দ الْغَرْقَدَ (গারকদ) হলো এক ধরনের সুপরিচিত কাঁটাদার বৃক্ষ এটি ফি-লি-স্তিনের বায়তুল মাকদিস অঞ্চলে উৎপাদন হয়ে থাকে। আর এখানেই দা-জ্জাল ও ই-য়াহূদীরা নিহত হবে। (শারূহুন নাবাবী খন্ড: ১৮ পৃষ্ঠা: ৩৬)
.
শাইখুল ইসলাম ইমাম তাক্বিউদ্দীন আবুল আব্বাস আহমাদ বিন আব্দুল হালীম বিন তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেন:

اليهود إنما ينتظرون المسيح الدجال ، فإنه الذي يتبعه اليهود ، ويخرج معه سبعون ألف مطيلس من يهود أصبهان ، ويقتلهم المسلمون معه ، حتى يقول الشجر والحجر : يا مسلم ! هذا يهودي ورائي تعال فاقتله

ই-হু-দীরা প্রকৃতপক্ষে মিথ্যা মসীহ (আল-মাসিহ আদ- দাজ্জালের) জন্য অপেক্ষা করছে, কারণ ই-হু-দীরা তাকে অনুসরণ করবে। তার সাথে ইসফাহানের সত্তর হাজার ই-হু-দী তাদের মাথায় তায়ালিসাহ (এক প্রকারের মাথার আবরণ) পরিহিত অবস্থায় আবির্ভূত হবে। মুসলমানরা তাদের (ই-হু-দীদের) সাথে এবং তার (দাজ্জাল) সাথে যুদ্ধ করবে, এমন পরিমাণে যে গাছ এবং পাথর বলবে: “হে মুসলিম, এখানে আমার পিছনে একজন ই-হু-দী আছে; এসে তাকে হত্যা করো।” (ইবন তাইমিয়্যাহ, আল-জাওয়াবুস সহীহ লিমান বাদ্দালা দীনাল মাসীহ: খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ৩০)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন,

فإن عيسى عليه الصلاة والسلام يغزوه ، ومعه المسلمون ، فيقتله بباب اللد ، باب هناك في فلسطين ، قرب القدس ، يقتله بحربته كما جاء في الحديث الصحيح ، والمسلمون معه يقتلون اليهود قتلة عظيمة ، جاء في الحديث عن النبي صلى الله عليه وسلم أن المسلمين يقاتلون اليهود ، فيقتلونهم ، ويسلطون عليهم ، ينادي الشجر والحجر : يا مسلم ، يا عبد الله ، هذا يهودي تعال فاقتله ، فيقتل عيسى الدجال وينتهي أمره

ঈসা (আ:) মুসলমানদের সমর্থনে তার (দাজ্জাল) সাথে যুদ্ধ করবেন এবং তিনি (ঈসা) তাকে আল-কুদস (জেরুজালেমের) কাছে ফিলিস্তিনে অবস্থিত, বাবে ‘লুদ্দ’ (ফিলিস্তীনের বায়তুল মুক্বাদ্দাসের পাশের একটি স্থান)-এর নগরদ্বারপ্রান্তে পেয়ে হত্যা করবেন। তিনি তাকে তার বর্শা দিয়ে হত্যা করবেন। যেমনটি সহীহ হাদীসে বলা হয়েছে যে, মুসলমানরা ইহু-দী-দের সাথে যু-দ্ধ করবে এবং তাদের হত্যা করবে এবং তাদের উপর বিজয় লাভ করবে, তারা (ই-য়া-হু-দীরা) পাথর বা বৃক্ষের আড়ালে আত্মগোপন করবে। তখন পাথর বা গাছ বলবে, হে মুসলিম, হে আল্লাহর বান্দা! এই তো ইহুা-দী আমার পিছনে। এসো, তাকে হত্যা কর। এবং ঈসা দা-জ্জা-লকে হত্যা করে তাকে শেষ করে দিবেন। (সহীহ মুসলিম হা/২৯২২, বিন বায ফাতাওয়া নূরুন আলাদ দারব: ৪/২৯০)
.
পরিশেষে, উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে- মুসলিমদের সাথে ইয়া-হু-দীদের উক্ত যু-দ্ধ কিয়ামতের বড় নিদর্শনগুলোর একটি।সেই যু*দ্ধে দা-জ্জা-ল এবং তার অনুসারী ই-য়া-হু-দীরা নবী ঈসা (আলাইহিস সালাম) এবং মুসলিমদের হাতে ধংস হবে।
কুরআনুল কারীমের সূরা নিসায় ১৫৯ নং আয়াতে ভবিষ্যদ্বানী করা হয়েছে যে, ই-য়া-হুদী ও না-সা-রারা বর্তমানে যদিও ঈসা আলাইহিস সালাম-এর প্রতি যথাযথ ঈমান রাখে না, বরং শৈথিল্য বা বাড়াবাড়ি করে, কিন্তু কিয়ামতের নিকটবর্তী যুগে তিনি যখন পুনরায় পৃথিবীতে অবতরণ করবেন, তখন এরাও তার প্রতি পুরোপুরি ঈমান আনয়ন করবে। না-সা-রারা তখন মুসলিমদের মত সহীহ আক্বীদা ও বিশ্বাসের সাথে ঈমানদার হবে। ই-য়া-হু-দীদের মধ্যে যারা তার বিরুদ্ধাচরণ করবে, তাদেরকে নিধন ও নিশ্চিহ্ন করা হবে, অবশিষ্টরা ইসলাম গ্রহণ করবে। তখন সমগ্র দুনিয়া থেকে সর্বপ্রকার কুফরী ধ্যান-ধারণা, আচার-অনুষ্ঠান উৎক্ষিপ্ত হয়ে যাবে; সর্বত্র ইসলামের একচ্ছত্র প্রাধান্য কায়েম হবে। মহান আল্লাহ বলেন; বরং আল্লাহ তাকে (ঈসা) তার (আল্লাহর) নিকট তুলে নিয়েছেন এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।কিতাবীদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যে তার মৃত্যুর পূর্বে তার প্রতি ঈমান আনবে না এবং কিয়ামতের দিনে সে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী হবে। (সূরা নিসা৪/১৫৮-১৫৯)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
____________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।