ইচ্ছাপূর্বক মিথ্যা বলার নানাবিধ কারণ

ইচ্ছাপূর্বক মিথ্যা বলার নানাবিধ কারণ রয়েছে। তন্মধ্যে নেতৃত্বের লোভ একটি, বিস্তারিত জানতে পুড়ুন:
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ শাইখুল ইসলাম ইমাম তাক্বিউদ্দীন আবুল ‘আব্বাস আহমাদ বিন ‘আব্দুল হালীম বিন তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন, ইচ্ছাপূর্বক মিথ্যা বলার নানাবিধ কারণ রয়েছে। তন্মধ্যে নেতৃত্বের লোভ একটি(মাজমূউ ফাতাওয়া খন্ড: ১৮ পৃষ্ঠা: ৪৬)।
.
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া আরো বলেছেন, মানুষের মনে অনেক বাসনাই সুপ্ত থাকে, যা সে বুঝতে পারে না। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মোহ অনেক মানুষের মনের মাঝে লুক্কায়িত তেমনি একটি সুপ্তবাসনা। লোকটা হয়ত খাঁটি মনে আল্লাহর ইবাদত করে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সমস্যাবলীই বা কী, আর দোষ-ত্রুটিই বা কোথায় তাও সে হয়ত জানত না। কিন্তু যেকোনভাবে তার সামনে ক্ষমতা লাভের কোন একটি সুযোগ এসে গেল অমনিই সে তা লুফে নিতে তৎপর হয়ে উঠল। অথচ তার মাঝে যে ক্ষমতার বাসনা ছিল তা সে এর আগ মুহূর্তেও বুঝে উঠতে পারেনি। পরিবেশ অনুকূল হওয়ায় সেই সুপ্ত বাসনা এখন জেগে উঠেছে। ক্ষমতার সিঁড়িতে এভাবে বহু মানুষই পা রেখেছে। এজন্যই ক্ষমতার এই মোহকে ‘সুপ্তবাসনা’ বলা হয়।(মাজমূউ ফাতাওয়া খন্ড: ১৬ পৃষ্ঠা: ৩৪৬)।
.
ইমাম ইবনু রজব আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৯৫ হি.] বলেছেন, ক্ষমতাবান ও প্রতিপত্তিশালীরা মানুষের মুখ থেকে প্রশংসা ও সুখ্যাতি শুনতে ভালবাসে। তারা জনগণের কাছে তা দাবীও করে। যারা তাদের প্রশংসা করে না তাদেরকে তারা নানাভাবে কষ্ট দেয়। অনেক সময় তারা একাজে এতটাই বাড়াবাড়ি করে বসে যে প্রশংসা থেকে নিন্দাই তাদের বেশী পাওনা হয়ে দাঁড়ায়। আবার কোন কোন সময় তারা তাদের দৃষ্টিতে ভাল কাজ করছে বলে যাহির করে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে তাদের মন্দ অভিপ্রায় কাজ করে। এভাবে মিথ্যাকে সত্যের আবরণে আচ্ছাদিত করতে পেরে তারা উৎফুল্ল হয় এবং লোকদের থেকে প্রশংসা লাভ ও তাদের মাঝে তাদের নাম ছড়িয়ে পড়ার আকাঙ্খা পোষণ করে। এমন লোকদের প্রসঙ্গেই আল্লাহ বলেন, যেসব লোকেরা তাদের মিথ্যাচারে খুশী হয় এবং তারা যা করেনি, এমন কাজে প্রশংসা পেতে চায়, তুমি ভাব না যে তারা শাস্তি থেকে বেঁচে যাবে। বস্ত্ততঃ তাদের জন্য রয়েছে মর্মান্তিক আযাব’ (আলে ইমরান ৩/১৮৮)। এ আয়াত এরূপ বিনাকাজে প্রশংসার জন্য লালায়িতদের জন্য অবতীর্ণ হয়েছে। অথচ মানবকুল থেকে প্রশংসা তলব করা, প্রশংসা পেয়ে খুশি হওয়া এবং প্রশংসা না করার দরুন শাস্তি দেওয়া কেবলমাত্র লা শরীক আল্লাহর জন্যই মানায়। এজন্যই সৎপথপ্রাপ্ত ইমামগণ তাদের কাজ-কর্মের দরুন তাদের প্রশংসা করতে নিষেধ করতেন। মানুষের কোন কল্যাণ করার জন্য তাদের স্বত-স্ত্ততি করতে দিতেন না; বরং সেজন্য অংশীদার শূন্য এক আল্লাহর প্রশংসা করতে তারা বেশী বেশী উদ্বুদ্ধ করতেন। কেননা সকল প্রকার নে‘মত ও অনুগ্রহের মালিক তো তিনিই। খলীফা ওমর বিন আব্দুল আযীয এ ব্যাপারে খুবই সংযত ছিলেন। একবার তিনি হজ্জে আগত লোকদের পড়ে শোনানোর জন্য একটি পত্র প্রেরণ করেন। তাতে তিনি তাদের উপকার করতে আদেশ দেন এবং তাদের উপর যে যুলুম-নিপীড়ন জারী ছিল তা বন্ধ করতে বলেন। ঐ পত্রে এও ছিল যে, এসব কল্যাণ প্রাপ্তির দরুন তোমরা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারো প্রশংসা কর না। কেননা তিনি যদি আমাকে আমার নিজের হাতে সোপর্দ করতেন তাহ’লে আমি অন্যদের মতই হ’তাম। তাঁর সঙ্গে সেই মহিলার ঘটনা তো সুপ্রসিদ্ধ, যে তার ইয়াতীম মেয়েদের জন্য খলীফার নিকট ভাতা বরাদ্দের আবেদন জানিয়েছিল। মহিলাটির চারটি মেয়ে ছিল। খলীফা তাদের দু’জনের ভাতা বরাদ্দ করেছিলেন। ঐ মহিলা আল্লাহর প্রশংসা করে। কিছুকাল পর তিনি তৃতীয়জনের জন্য ভাতা নির্ধারণ করেন। এবারও মহিলা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে। তার শুকরিয়া প্রকাশের কথা জেনে খলীফা তাকে বলেন, আমরা তাদের জন্য ভাতা বরাদ্দ করতে পেরেছি। আপনার এভাবে প্রশংসার প্রকৃত হকদারের প্রশংসা করার জন্যেই। এখন আপনি ঐ তিনজনকে বলবেন, তারা যেন চতুর্থজনের প্রতি সহমর্মিতা দেখায়। তিনি এর দ্বারা বুঝাতে চেয়েছেন যে, রাষ্ট্রের নির্বাহী পদাধিকারী কেবলই আল্লাহর আদেশ বাস্তবায়নে নিযুক্ত। তিনি আল্লাহর বান্দাদেরকে তাঁর আনুগত্যের হুকুমদাতা এবং তাঁর নিষিদ্ধ জিনিসগুলো থেকে নিষেধকারী মাত্র। আল্লাহর বান্দাদেরকে আল্লাহর দিকে আহবান জানানোর মাধ্যমে তিনি তাদের কল্যাণকামী। তার বিশেষ চাওয়া-পাওয়া যে, দ্বীন সর্বতোভাবে আল্লাহর জন্য হয়ে থাক এবং ইয্যত-সম্মান সব আল্লাহর হোক। তারপরও তার সদাই ভয় হ’ত যে, তিনি আল্লাহর হক আদায়ে কতইনা ত্রুটি করে ফেলছেন। (শারহু হাদীস মাযেবানে জায়ে‘আনে, পৃষ্ঠা: ৪১-৪৩)।
.
আল্লামা ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৫১ হি.] বলেছেন, কোন লোক ক্ষমতা লাভ করলে তার অনেক সঙ্গী-সাথী ক্ষমতা লাভের আগে সে তাদের সাথে যেমন আচরণ করত, ক্ষমতা লাভের পরেও তার থেকে তেমন আচরণ প্রত্যাশা করে। কিন্তু তা না পাওয়ার দরুন তাদের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক টুটে যায়। এটা ঐ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রত্যাশী সঙ্গীর অজ্ঞতা। সে যেন একজন মাতাল সঙ্গী থেকে তার স্বাভাবিক সুস্থ অবস্থার সময়কালীন আচরণ কামনা করছে। এটা তো কখনো হবার নয়। কেননা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা মাদকের মতই এক প্রকার নেশা, এমনকি তার থেকেও মারাত্মক। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যদি নেশাকর না হ’ত তবে এই ক্ষমতার পূজারীরা কখনই চিরস্থায়ী পরকালের বদলে তা গ্রহণ করত না। সুতরাং তার নেশা চা-কফির নেশা থেকেও অনেক অনেক বেশী। আর চরম নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি থেকে সুস্থ-সবল মানুষের আচরণ লাভ অসম্ভব। তাই আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সৃষ্টির মহান ব্যক্তিত্ব মূসা (আঃ)-কে মিশরের কিবতী (কপটিক) সম্প্রদায়ের প্রধান নেতা ফেরা‘ঊনের সাথে বিনয়-নম্র ভাষায় সম্ভাষণ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন,فَقُوْلاَ لَهُ قَوْلاً لَيِّنًا لَعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ أَوْ يَخْشَى ‘তোমরা দু’জন তাকে নরম ভাষায় বুঝাও। হ’তে পারে সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভীত হবে’ (সূরা ত্বা-হা ২০/৪৪)। সুতরাং রাষ্ট্রনায়ক বা ক্ষমতাসীনদের সাথে বিনম্র বচনে কথা বলা শরী‘আত, বিবেক, প্রথা ইত্যাদি সবকিছুরই দাবী। কিন্তু অনেক সময় লোকে তা করে উঠতে পারে না বলে সমস্যা সৃষ্টি হয়।(বাদায়েউল ফাওয়ায়েদ খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ৬৫২)।
.
ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) আরো বলেছেন,‘রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতি লালসার ন্যূনতম ক্ষতি এই যে, তা আল্লাহর ভালবাসা ও যিকির থেকে মনকে অন্য দিকে সরিয়ে দেয়। আর যার ধন-সম্পদ, ক্ষমতালিপ্সা তাকে আল্লাহর যিকির থেকে বিমুখ করে দেয়, সে ক্ষতিগ্রস্তদের শ্রেণীভুক্ত। আর মন যখন আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফিল হয়ে পড়ে, তখন শয়তান সেখানে বাসা বাঁধে এবং যেদিকে খুশি তাকে পরিচালিত করে’।(উদ্দাতুছ ছাবিরীন, পৃষ্ঠা: ১৮৬) সংকলিত (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।

▬▬▬✿◈✿▬▬▬

উপস্থাপনায়:

জুয়েল মাহমুদ সালাফি।