ইকামত সম্পর্কে বিস্তারিত

প্রশ্ন: ইকামত শব্দের অর্থ কি? ইকামত কিভাবে দিতে হয়? ইকামাতের জওয়াব দেওয়ার বিধান কি? ইকামত ও নামায শুরু করার মাঝে ব্যবধান কেমন হবে?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: ইকামতের আভিধানিক অর্থ: الإقامة শব্দটি أقام ক্রিয়া এর মূল ধাতু বা মাসদার। আরবিতে إقامة الشيء তখনই বলা হয়,যখন কোনো কিছু স্থির ও সোজা করা হয়।

শরী‘আতের পরিভাষায় ইকামত: “নির্দিষ্ট যিকিরের মাধ্যমে সালাত আরম্ভ হওয়ার ঘোষণা দেওয়া”। (রওজুল মুরবি: (১/৪২৮)। অতএব, আযান হচ্ছে সময়ের ঘোষণা দেওয়া, আর ইকামত হচ্ছে সালাত আরম্ভের ঘোষণা দেওয়া।ইকামতকে দ্বিতীয় আযান বা দ্বিতীয় আহ্বানও বলা হয়। (শারহুল উমদাহ: (২/৯৫)।

পাঁচ ওয়াক্ত ও জুমু‘আর সালাত আদায়ের জন্য আযান ও ইকামত দেওয়া পুরুষদের ওপর ফরযে কিফায়া, নারীদের ওপর নয়। আযান ও ইকামত উভয় ইসলামী শরী‘আতের বিধান। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,“আর যখন তোমরা সালাতের দিকে ডাক, তখন ‎তারা একে উপহাস ও খেল-তামাশারূপে গ্রহণ ‎করে। তা এই কারণে যে, তারা এমন কওম,যারা ‎বুঝে না।” [সুরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ৫৮]। অন্যত্র তিনি বলেন,“হে মুমিনগণ, যখন জুমু‘আর দিনে সালাতের জন্য আহ্বান করা হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের দিকে ধাবিত হও।” [সূরা আল-জুমু‘আ: ৯]।
.
রাসূল (ﷺ)এর দুই মুআযযিনের আযান দুই রকম ছিল, তেমনি উভয়ের ইকামতও ছিল দুই রকম; জোড় এবং বিজোড়। বিলাল (রাঃ) কে আযান ডবল ডবল শব্দে এবং ইকামত ‘ক্বাদ ক্বা-মাতিস সলা-হ্‌’ ছাড়া (অন্যান্য) বাক্যাবলীকে একক একক শব্দে বলতে আদেশ করা হয়েছিল। (বুখারী, মুসলিম, সহীহ প্রমুখ, মিশকাত ৬৪১)। সুতরাং বিলালের উক্ত হাদীসের ভিত্তিতে ইকামত হবে ৯টি বাক্যে; ‘ক্বাদ ক্বামাতিস সালাহ্‌ ২বার এবং বাকী হবে ১ বার করে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ২/৫৯)
.
কিন্তু আব্দুল্লাহ বিন যায়দকে স্বপ্নে শিখানো হয়েছিল নিম্নরুপ ইকামত, আর এটাই প্রসিদ্ধ:-اَللهُ أَكْبَر اَللهُ أَكْبَر، أَشْهَدُ أَنْ لاَّ إِلهَ إِلاَّ الله، أَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّداً رَّسُوْلُ الله، حَيَّ عَلَى الصَّلاَة،حَيَّ عَلَى الْفَلاَح، قَدْ قَامَتِ الصَّلاَة، قَدْ قَامَتِ الصَّلاَة، اَللهُ أَكْبَر اَللهُ أَكْبَر، لاَ إِلهَ إِلاَّ الله،

আল্লাহু আকবার ২ বার। আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্‌ ১ বার। আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ্‌ ১ বার। হাইয়্যা আলাস স্বলাহ্‌ ১ বার। হাইয়্যা আলাল ফালাহ্‌ ১ বার। ক্বাদ ক্বামাতিস স্বলাহ্‌ (অর্থাৎ নামায প্রতিষ্ঠা বা শুরু হল) ২ বার। আল্লাহু আকবার ২বার এবং লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্‌ ১ বার। (আবূদাঊদ, সুনান ৪৯৯, দারেমী, সুনান ১১৭১, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ ৩৭০, ইবনে হিব্বান, সহীহ ১৬৭১নং, বায়হাকী ১/৩৯১)।
.
উল্লেখ্য যে, যারা মুআযযিন আবু মাহ্‌যূরার মত তারজী’ আযান দেয়,তাদের উচিৎ তাঁর মতই ইকামত দেওয়া। তিনি বলেন, ‘মহানবী (ﷺ) তাঁকে আযানের ১৯টি এবং ইকামতের ১৭টি বাক্য শিখিয়েছেন।’ (মুসনাদে আহমাদ, আবুদাঊদ হা/৫০১ ও ৫০২, ১/৭২ পৃঃ; নাসাঈ হা/৬৩৩, মিশকাত ৬৪৪)। সুতরাং তাঁর ইকামত ছিল বিলাল (রাঃ) এর আযানের মতই। তবে তাতে ‘হাইয়্যা আলাল ফালাহ্‌’ এর পর অতিরিক্ত ছিল ‘ক্বাদ ক্বামাতিস স্বলাহ্‌’ ২ বার।(আবূদাঊদ, সুনান ৫০২)।
.
ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ্‌ (রহঃ) বলেন, আহলে হাদীস ও তাঁদের সমর্থকদের নিকট সঠিক সিদ্ধান্ত এই যে, মহানবী (ﷺ) হতে যা কিছু শুদ্ধভাবে প্রমাণিত আছে তার প্রত্যেকটার উপর আমল করতে হবে। আর তাঁরা ঐ আমলের কোনটিকেও অপছন্দ করেন না। কেননা, আযান ও ইকামতের পদ্ধতি একাধিক হওয়ার ব্যাপারটা ক্বিরাআত, তাশাহহুদ প্রভৃতির পদ্ধতি একাধিক হওয়ার মতই।’ (মাজমূউ ফাতাওয়া ২২/৩৩৫, ২২/৬৬) সুতরাং উভয় প্রকারই আযান ও ইকামত আমলযোগ্য। আর বৈধ নয় এ নিয়ে কাদা ছুঁড়াছুঁড়ি। প্রকাশ থাকে যে,ভুলে ইকামত না দিয়ে (একাকী অথবা জামাআতী) নামায পড়ে ফেললে নামাযের কোন ক্ষতি হয় না। ইকামত নামায হতে পৃথক জিনিস। অতএব ঐ ভুলের জন্য সহু সিজদা বিধেয় নয়। (তুহ্‌ফাতুল ইখওয়ান, ইবনে বায ৭৮পৃ:)।
.
◾জামাতে সালাত আদায়ের সময় ইকামত কে দেবে?
_______________________________________
ইমাম ও মুক্তাদীগণের মধ্যে যে কেউ ইকামত দিতে পারে। যে আযান দিয়েছে তারই ইকামত দেওয়া জরুরী নয়। আর এ ব্যাপারে যে হাদীস এসেছে তা সহীহ নয়। (সিলসিলাহ যায়ীফাহ,আলবানী-৩৫)। যয়ীফ হাদীসকে ভিত্তি করেই বহু স্থানে মুআযযিন ছাড়া অন্য কেউ ইকামত দিলে তার প্রতি চোখ তোলা হয়! আবার এর চেয়ে আরো বিস্ময়ের কথা এই যে, খালি মাথায় ইকামত দিলে অনেক জায়গায় ইকামত পুনরায় ফিরিয়ে বলা হয়! কারণ, তাদের নিকট আযান, ইকামত, নামায, যবাই প্রভৃতির সময় টুপী না হলেও তালপাতা বা প্লাস্টিকের ডালি, নচেৎ গা-মোছা গামছা, নতুবা নাক-মোছা রুমাল অথবা অন্য কিছু দিয়ে মাথা ঢাকা জরুরী! প্রকাশ যে, ইমামকে উপস্থিত না দেখা পর্যন্ত ইকামত দেওয়া বিধেয় নয়। (সহীহ মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান ৫৩৭)।
.
◾ইকামতের জওয়াব দেওয়ার বিধান:
_______________________________
ইক্বামতের জবাব দিতে হবে। অধিকাংশ বিদ্বানের মতে ইক্বামতের জওয়াব দেওয়া মুস্তাহাব। (ইবনু কুদামাহ,
মুগনী ১/৩১০)। নবী করীম (ﷺ) সাধারণভাবে বলেন, মুয়াযযিন যা বলেন তোমরাও তাই বল।(বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৬৫৭)। উক্ত হাদীস থেকে ইক্বামতের উত্তর দেওয়ার কথা প্রমাণিত হয়‌। (আলবানী, মিশকাত হা/৬৭০-এর টীকা দ্রঃ)। তাছাড়া হাদীসে ইকামতকে দ্বিতীয় আযান বলা হয়, তাই ইকামতও এক প্রকার আযান। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৪৯)। সুতরাং এর জওয়াবও আযানের মতই। অবশ্য ‘হাইয়্যা আলাস সলা-হ্‌’ ও ‘ফালাহ্‌’ এর জওয়াবে ‘লাহাউলা অলা ক্বুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ্‌’ এবং শেষে (সময় পেলে) দরুদ ও অসীলার দুআ পাঠ করা বিধেয়।যেহেতু হাদীসে মুআযযিনের জওয়াব (তার মতই) বলতে এবং তার শেষে দরুদ ও অসীলার দুআ পড়তে আমাদেরকে আদেশ করা হয়েছে। (সহীহ মুসলিম, মিশকাত ৬৫৭)। উক্ত হাদীসের ভিত্তিতেই ‘ক্বাদ ক্বামাতিস স্বলাহ্‌’ এর জওয়াবে ‘ক্বাদ ক্বামাতিস স্বলাহ্‌’ই বলতে হবে। কিন্তু এর জওয়াবে ‘আক্বামাহুল্লাহু অআদামাহা’ বলার হাদীস সহীহ নয়। (আবুদাঊদ,মিশকাত হা/৬৭০)। আর যয়ীফ হাদীসকে ভিত্তি করে শরীয়তের কোন আমল ও ইবাদত বৈধ নয়। (দেখুন, মিশকাত, আলবানীর টীকা ১/১২১)।মতান্তরে কেউ কেউ বলেছেন, যেহেতু ইকামতের জবাবে কোন স্পষ্ট সহীহ হাদীস নেই, তাই ইকামতের জবাব দেওয়া সুন্নত নয়। অল্লাহু আ’লাম।
.
◾ইকামত ও নামায শুরু করার মাঝে ব্যবধান:
_____________________________________
আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেন, “নামাযের ইকামত হয়ে গেলে তোমরা আমাকে না দেখা পর্যন্ত (নামাযের জন্য) দাঁড়াও না।” (সহীহ বুখারী ৬৩৭)। যেমন: ইকামত হয়ে গেলে তাড়াহুড়ো করে দাঁড়ানোও উচিৎ নয়। কারণ উক্ত হাদীসের এক বর্ণনায় তিনি বলেন, “তোমাদের মাঝে যেন ধীরতা ও শান্তভাব থাকে।” (সহীহ বুখারী: ৬৩৮) যেহেতু রাজাধিরাজের দরবারে কোন প্রকারের হৈ-হুল্লোড় ও তাড়াহুড়ো চলে না। বলা বাহুল্য এই দরবারে থাকবে শত আদব, শত বিনয়, ধীরতা ও স্থিরতা। হুমাইদ বলেন, আমি সাবেত আল-বুনানীকে ইকামতের পর কথাবার্তা বলার বৈধতার ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তিনি আনাস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীস শুনালেন; ‘একদা নামাযের ইকামত হয়ে গেলে এক ব্যক্তি নবী (ﷺ) কে নামাযে প্রবেশ করতে আটকে রেখেছিল।’ (বুখারী ৬৪৩)। ‘মসজিদের এক প্রান্তে গোপনে কথা বলতে লাগলে উপস্থিত মুসল্লীগণ ঘুমে ঢলে পড়েছিল।’ (সহীহ বুখারী ৬৪২)।
.
একদা নামাযের ইকামত হয়ে গেলে মুসল্লীগণ কাতার সোজা করে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। আল্লাহর রাসূল (ﷺ) হুজরা হতে বের হয়ে যখন ইমামতির জায়গায় এলেন, তখন তাঁর মনে পড়ল যে, তিনি নাপাকীর গোসল করেননি। তিনি সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, “তোমরা স্বস্থানে দন্ডায়মান থাক।” অতঃপর তিনি হুজরায় ফিরে গিয়ে গোসল করলেন। তিনি যখন বের হয়ে এলেন, তখন তাঁর মাথা হতে পানি টপকাচ্ছিল। এরপর তিনি ইমামতি করে নামায পড়লেন। (সহীহ বুখারী: ৬৪০)। উক্ত হাদীস থেকে এ কথা বুঝা যায় যে, প্রয়োজনে ইকামত ও নামাযের মাঝে বেশ কিছু সময় বিরতি হলে কোন ক্ষতি হয় না। পরন্তু ইকামত ফিরিয়ে বলতে হয় না।
.
ইকামত হওয়ার পর কোন জরুরী কথা, নামায ও কাতার বিষয়ক কথা বলা বৈধ। তবে নামাযের প্রস্তুতি নেওয়ার পর কোন পার্থিব কথা বলা উচিৎ নয়। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৫১)। ইকামত শুরু হলে এবং ইমাম উপস্থিত থাকলে প্রত্যেকে নিজের সুবিধামত উঠে নামাযের জন্য দন্ডায়মান হবে। ইকামতের শুরুতে, মাঝে বা শেষে, যে কোন সময়ে দাঁড়ালেই চলবে। তবে এ কথার খেয়াল অবশ্যই রাখা উচিৎ, যাতে ইমামের সাথে তকবীরে তাহ্‌রীমা ছুটে না যায়। (আলমুমতে শারহে ফিক্‌হ,ইবনে উসাইমীন ৩/১০)।

◾উল্লেখ যে, আযান ও ইকামতের মাঝে দুআ কবুল হয়:
_______________________________________
আযান হওয়ার পর এবং ইকামত হওয়ার পূর্বের সময়ে দুআ কবুল হয়ে থাকে। তাই এই সময় দুনিয়া ও আখেরাতের মঙ্গল আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা উচিৎ। মহানবী (ﷺ) বলেন, “আযান ও ইকামতের মাঝে দুআ রদ্দ্‌ করা হয় না।” (অর্থাৎ মঞ্জুর করা হয়।) (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ৫২১নং, তিরমিযী, সুনান)। এক বর্ণনায় আছে, “সুতরাং তোমরা এ সময়ে দুআ কর।” (সহীহুল জামে ৩৪০৫) তিনি আরো বলেন, “দু’টি সময়ে দুআ (প্রার্থনা) কারীর দুআ রদ্দ্‌ হয় না; যখন নামাযের ইকামত হয় এবং জিহাদের কাতারে।” (হাকেম, মুস্তাদরাক, মালেক, মুঅত্তা, সহিহ তারগিব ২৬০)।
_______________________
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।