আযানের বিশেষ নিয়মাবলী ও আযানের জওয়াব

প্রশ্ন: আযানের বিশেষ নিয়মাবলী কি?আযানের জওয়াব দেয়ার হুকুম কি? আযানের জওয়াব দেওয়ার সুন্নাহ সম্মত পদ্ধতি কি?
▬▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: মহান আল্লাহ তায়ালার বড়ত্বের এ ধ্বনি প্রতিধ্বনি আযান প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে উচ্চারণ করা হয়। যিনি আজান দেন তার মর্যাদাও আল্লাহ তায়ালার কাছে সবচেয়ে বেশি। কেয়ামতের ময়দানে মহা পুরস্কারে ভূষিত হবে মুয়াজ্জিন। তবে যারা আজানের জবাব দিবেন তাদের ফজিলতও কম নয়। জেনে নিন আজান ও আজানের জওয়াবের নিয়মাবলি:

▪️১। আযান যেন তার শব্দবিন্যাসের বিপরীত না হয়। যার পর যে বাক্য পরস্পর সজ্জিত আছে ঠিক সেই পর্যায়ক্রমে তাই বলা জরুরী।উদাহ্‌রণস্বরুপ: যদি কেউ حيَّ عَلَى الصَّلاَة বলার আগে حيَّ عَلَى الْفَلاَح বলে ফেলে, তাহলে পুনরায় حيَّ عَلَى الصَّلاَة বলে যথা অনুক্রমে আযান শেষ করবে। (ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/৩৪৮)।

▪️২। একটা বাক্য বলার পর অন্য বাক্য বলতে যেন বেশী দেরী না হয়। মাইক ইত্যাদি ঠিক করতে গিয়ে বা অন্য কোন কারণে বিরতি অধিক হলে পুনরায় শুরু থেকে আযান দিতে হবে।

▪️৩। আযান যেন নামাযের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার পূর্বে না হয়। যেহেতু ওয়াক্তের পূর্বে আযান যথেষ্ট নয়। (মুগনী ১/৪৪৫)। পূর্বে দিয়ে ফেললে ওয়াক্ত হলে পুনরায় আযান দেওয়া জরুরী। (আউনুল মা’বূদ ২/১৬৬) একদা বিলাল (রাঃ) (ফজরের) আযান ফজর উদয় হওয়ার আগেই দিয়ে ফেলেছিলেন। মহানবী (ﷺ) তাঁকে আদেশ করলেন যে, তিনি যেন ফিরে গিয়ে বলেন, ‘শোনো! বান্দা ঘুমিয়েছিল। শোনো! বান্দা ঘুমিয়েছিল।’অর্থাৎ ঘুমের ঘোরে সময় বুঝতে পারিনি। (আবূদাঊদ, সুনান ৫৩২নং)।

▪️৪। আযানের শব্দাবলী আরবী। ভিন্ন ভাষায় (অনুবাদ করে) আযান তো শুদ্ধ নয়ই; পরন্তু ঐ আরবী শব্দগুলোর উচ্চারণে ভুল করাও বৈধ নয়। সুতরাং যদি আযানের এমন উচ্চারণ করা হয়,যাতে তার অর্থ বদলে যায়,তাহলে আযান শুদ্ধ নয়। যেমন, آللهُ أَكْبَر ‘আ-ল্লা-হু আকবার’ (প্রথমকার আলিফে টান দিয়ে) বলা। এর অর্থ হবে, ‘আল্লাহ কি সবার চেয়ে মহান?’ আল্লাহর মহানতায় সন্দেহ্‌ পোষণ করে এ ধরনের প্রশ্ন বোধক বাক্য বললে মানুষ কাফের হয়ে যায়। না জেনে বললে কাফের না হলেও আযান শুদ্ধ নয়। তদনুরুপ الله أكبار ‘আল্লাহু আকবা-র’ (আকবারের শেষে টান দিয়ে) বললে এর অর্থ দাঁড়াবে, ‘আল্লাহ একমুখো তবলা!’ অথবা ‘আল্লাহ আকবা-র (এক শয়তানের নাম)! নাঊযু বিল্লাহি মিন যালিক। অনুরুপ যেখানে টান আছে সেখানে না টানা এবং যেখানে টান নেই সেখানে টান দেওয়া, ع (আইন) কে ا (আলিফ) এর মত অথবা তার বিপরীত, ح (বড় হে বা হা) কে هـ (ছোট হে বা হা)এর মত অথবা তার বিপরীত উচ্চারণ, ‘ফালাহ্‌’ ও ‘স্বালাহ্‌’ বলার সময় ‘হ্‌’এর উচ্চারণ বাদ দিয়ে ‘ফালা’ ও ‘সালা’ বলা,যের-যবর প্রভৃতি উল্টাপাল্টা করা ইত্যাদি আযানের অর্থ বদলে দেয়। এতে আযান শুদ্ধ হয় না।

▪️৫। আযানের সমস্ত শব্দাবলী গোনা-গাঁথা। এর উপর কিছু অতিরিক্ত করা বিদআত। মহানবী (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি আমাদের এ (দ্বীনের) ব্যাপারে কোন নতুন কিছু উদ্ভাবন করবে, যা তার অন্তর্ভুক্ত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত।” (বুখারী, মুসলিম, সহীহ)। তাই ‘হাইয়্যা আলা খাইরিল আমাল,’ ‘আশহাদু আন্না সাইয়্যিদানা’ প্রভৃতি বাড়তি শব্দ ও বাক্য বিদআত। (ফাতাওয়া মুহিম্মাহ্‌ তাতাআল্লাকু বিসসলাহ্‌, ইবনে বায ৩৪পৃ:) তদনুরুপ ফজর ছাড়া অন্য ওয়াক্তের আযানে ‘আসস্বলাতু খাইরুম’ বলা বৈধ নয়। ইবনে উমার (রাঃ) এটিকে বিদআত বলেছেন এবং তা শুনে সে আযানের মসজিদ ত্যাগ করেছেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৫৩৮নং)। অনুরুপ আযানের পর আযানের মত চিল্লিয়ে ‘নামায পড়’ ইত্যাদি বলাও বিদআত। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৫২)।

প্রকাশ যে, ফজরের আযানে ‘আসস্বলাতু খাইরুম’ বলতে ভুলে গেলে আযানের কোন ক্ষতি হয় না। (ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/৩৪৯)। আযান দিতে দিতে অতি প্রয়োজনে কথা বলায় দোষ নেই। (বুখারী, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/১১৬)। কোন কারণে আযান দিতে দিতে মুআযযিন তা শেষ করতে না পারলে অন্য ব্যক্তি নতুন করে শুরু থেকে আযান দেবে।টেপ-রেকর্ডারের মাধমে আযান শুদ্ধ নয়। কারণ, আযান এক ইবাদত। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ২/৬১-৬২ সালাতে মুবাশ্বির)।

◾আযানের জবাব কিভাবে দিতে হয়? ________________________________
আযান শুরু হলে চুপ থেকে শুনে তার জওয়াব দেওয়া মুস্তাহাব। [ইবনু কুদামাহ, মুগনী ১/৩০৯; উসাইমীন, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১২/১৯৬; আলবানী, তামামুল মিন্নাহ ৩৪০ পৃ]। রাসূল (ﷺ) আযান ও ইক্বামতের জবাব এবং আযান পরবর্তী দো‘আ পাঠের অনেক ফযীলত বর্ণনা করেছেন। যেমন, রাসূল (ﷺ) বলেন, যে ব্যক্তি অন্তরের দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে আযানের জওয়াব দিবে,সে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে। [নাসাঈ হা/৬৭৪; মিশকাত হা/৬৭৬; ছহীহুত তারগীব হা/২৪৬]। মুআযযিন ‘হাইয়্যা আলাস স্বালাহ্‌’ ও ‘ফালাহ্‌’ বললে জওয়াবে শ্রোতা বলবে, لاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِالله উচ্চারণ:- লা হাউলা ওয়ালা ক্বুওঅতা ইল্লা বিল্লাহ্‌।অর্থাৎ, আল্লাহর তওফীক ছাড়া পাপকর্ম ত্যাগ করা এবং সৎকর্ম করার সাধ্য কারো নেই। (মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান ৫২৭)। মুআযযিন ‘আসস্বলাতু খাইরুম মিনান নাউম’ বললে অনুরুপ বলে জওয়াব দিতে হবে। এর জওয়াবে অন্য কোন দুআ (যেমন ‘স্বাদাকতা অবারিরতা বা বারারতা’ বলার হাদীস নেই। (সুবুলুস সালাম ৮৭পৃ:, তুহ্‌ফাতুল আহওয়াযী ১/৫২৫)।
.
রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘যখন তোমরা আযান শুনবে, তখন মুওয়ায্যিন যা বলে তদ্রূপ বল।’ [সহীহ মুসলিম, মিশকাত হা/৬৫৭]। আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “মুআযযিনকে আযান দিতে শুনলে তোমরাও ওর মতই বল।অতঃপর আমার উপর দরুদ পাঠ কর।কেননা, যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরুদ পাঠ করে, আল্লাহ এর বিনিময়ে তার উপর দশবার রহ্‌মত বর্ষণ করেন। অতঃপর তোমরা আমার জন্য আল্লাহর নিকট অসীলা প্রার্থনা কর। কারণ, অসীলা হল জান্নাতের এমন এক সুউচ্চ স্থান, যা আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে একটি বান্দার জন্য উপযুক্ত। আর আমি আশা রাখি যে, সেই বান্দা আমিই। সুতরাং যে ব্যক্তি আমার জন্য ঐ অসীলা প্রার্থনা করবে, তার জন্য আমার শাফাআত (সুপারিশ) অবধার্য হয়ে যাবে।” (সহীহ মুসলিম হা/৩৮৪, মিশকাত হা/৬৫৭)। ইবনে ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি রাসূল (ﷺ)-কে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! মুওয়াযযিনরা তো আমাদের উপর ফযীলত প্রাপ্ত হচ্ছে। আমরা কিভাবে তাদের সমান সওয়াব পাব? তিনি বলেন, মুওয়াযযিনরা যেরূপ বলে তুমিও তদ্রূপ বলবে। অতঃপর যখন আযান শেষ করবে! তখন আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করলে তুমিও তদ্রূপ সওয়াব প্রাপ্ত হবে।’ (আবুদাউদ হা/৫২৪; সহীহ আত-তারগীব হা/২৫৬)। সুতরাং যখন মুয়াজ্জিন আযান দিবে তখন প্রথমে আযানের জবাব দিবেন অর্থাৎ মোয়াজ্জিন যা বলে আপনিও তাই বলবেন আযানের জবাব দেয়া শেষ হলে প্রথমে রাসূল (ﷺ) এর উপর দুরুদ পড়বেন তারপর আযানের নিন্মলিখিত দোয়া পড়বেন।
اَللَّهُمَّ رَبَّ هٰذِهِ الدَّعْوَةِ التَّامَّةِ، وَالصَّلاَةِ الْقَائِمَةِ، آتِ مُحَمَّدًانِ الْوَسِيْلَةَ وَالْفَضِيْلَةَ، وَابْعَثْهُ مَقَامًا مَّحْمُوْدًا الَّذِىْ وَعَدْتَهُ –

উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা রববা হা-যিহিদ দা‘ওয়াতিত তা-ম্মাহ, ওয়াছ ছলা-তিল ক্বা-য়েমাহ, আ-তে মুহাম্মাদানিল ওয়াসীলাতা ওয়াল ফাযীলাহ, ওয়াব‘আছ্হু মাক্বা-মাম মাহমূদানিল্লাযী ওয়া‘আদ্তাহ’অনুবাদ: হে আল্লাহ! (তাওহীদের) এই পরিপূর্ণ আহবান ও প্রতিষ্ঠিত ছালাতের তুমি প্রভু। মুহাম্মাদ (ছাঃ) কে তুমি দান কর ‘অসীলা’ (নামক জান্নাতের সর্বোচ্চ সম্মানিত স্থান) ও মর্যাদা এবং পৌঁছে দাও তাঁকে (শাফা‘আতের) প্রশংসিত স্থান ‘মাক্বামে মাহমূদে’ যার ওয়াদা তুমি তাঁকে করেছ’। (মিশকাত হা/৫৫৭২, ‘ক্বিয়ামতের অবস্থা’ অধ্যায়-২৮, ‘হাউয ও শাফা‘আত’ অনুচ্ছেদ-৪)। মনে রাখা আবশ্যক যে, আযান উচ্চৈঃস্বরে দেওয়া সুন্নাত। কিন্তু উচ্চৈঃস্বরে আযানের দো‘আ পাঠ করা বিদ‘আত। অতএব মাইকে আযানের দো‘আ পাঠের রীতি অবশ্যই বর্জনীয়। আযানের অন্য দো‘আও রয়েছে।(মুসলিম, মিশকাত হা/৬৬১) প্রকাশ থাকে যে, আযান একটি ইবাদত। এতে কোনরূপ কমবেশী করা জায়েয নয়। তবুও আযানের দো‘আয় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শব্দ ও বাক্য যোগ হয়েছে,তা পরিত্যাগ করা আবশ্যক।
.
কিছু বিষয় জেনে রাখা ভাল যে, একই ওয়াক্তে একাধিকবার আযান হ’লে একটি আযানের জওয়াব দিলেই ফযীলত অর্জিত হবে ইনশাআল্লাহ। আযানের জওয়াব দেবে প্রত্যেক সেই ব্যক্তি যার জন্য আল্লাহর যিক্‌র করা বৈধ। অতএব পবিত্র অবস্থায়, অপবিত্র বা মাসিক অবস্থায় নারী-পুরুষ সকলের জন্যই আযানের জওয়াব দেওয়া মুস্তাহাব। অবশ্য নামায পড়া অবস্থায়, প্রস্রাব-পায়খানা করা অথবা বাথরুমে থাকা অবস্থায় এবং স্ত্রী-মিলন রত অবস্থায় আযানের উত্তর দেওয়া বৈধ নয়। এসব কাজ থেকে ফারেগ হওয়ার পর বাকী আযানের উত্তর দেওয়া বিধেয়।যে ব্যক্তি কুরআন তেলাওয়াত বা যিক্‌র করে অথবা দারস দেয় সে ব্যক্তি তা বন্ধ রেখে আযানের জওয়াব দিয়ে পুনরায় তা ছেড়ে রাখা জায়গা থেকে শুরু করবে (ফিকহুস সুন্নাহ্‌ ১/৮৭)। খাওয়ার সময় আযান হলে খেতে খেতেও আযানের জওয়াব দিতে এবং তারপর দুআ পড়তে কোন বাধা নেই। (ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/৫৩২)। আযানের সময় দুআ কবুল হয়ে থাকে তাই দোয়া করতে পারেন (আবূদাঊদ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, সহীহুল জামে ৩০৭৯)।

⛔উল্লেখ্য যে, আযানের পূর্বে/শুরুতে (উচ্চস্বরে বা মাইক্রোফোনে) দরুদ বা তাসবীহ পাঠ এবং অনুরুপ শেষেও দরুদ বা উক্ত দুআ (জোরে-শোরে) পাঠ বিদআত। শিখাবার উদ্দেশ্যেও আল্লাহর নবী (ﷺ) বা সালাফদের কেউই এরুপ করে যান নি। (ইবনে বায, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/৯২, টীকা)। যেমন: আযান ও ইকামতের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ্‌’ পড়া বিদআত। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ১/১৩২)। তদ্রুপ উপরোক্ত ঐ দুআ পড়ার সময় হাত তোলাও বিধেয় নয়। আযান শুরু হলে মহিলাদের মাথায় কাপড় নেওয়া, আযানে মহানবী (ﷺ) এর নাম শুনে চোখে আঙ্গুল বুলানো বিদআত। এ ব্যাপারে বর্ণিত হাদীসটি জাল। (তাযকিরাহ্‌, ইবনে তাহের, রিসালাতুন ইলা মুআযযিন ৫৬পৃ:)। অনুরুপ সেই সময় আঙ্গুলে চুমু খাওয়াও বিদআত। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_______________________
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।