অবুঝ শিশুকে খাওয়ানোর সময় বিসমিল্লাহ বলার বিধান

প্রশ্ন: অবুঝ শিশুকে খাওয়ানোর সময় বিসমিল্লাহ বলার বিধান কি? খাওয়ার শুরুতে শুধু বিসমিল্লাহ বলতে হবে নাকি বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম বলতে হবে?
▬▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: আলহামদুলিল্লাহ, যাবতীয় প্রশংসা একমাত্র মহান আল্লাহর জন্য। খাবার শুরু করার আগে ‘বিসমিল্লাহ’ বলা এবং শেষ করার পর আল্লাহর প্রশংসা করা মুস্তাহাব। খাবারের শুরুতে এই আদব পালন করলে খাবার ঠিকমত দেহে কাজ করা এবং তার অপকারিতা দূর করার ব্যাপারে বড় প্রভাব রয়েছে। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মহান ইমাম, শাইখুল ইসলাম আবু আব্দুল্লাহ আহমাদ বিন মুহাম্মাদ বিন হাম্বাল আশ-শাইবানী (রাহিমাহুল্লাহ) জন্ম ১৬৪ হি./৭৮০ খ্রি. এবং মৃত্যু ২৪১ হি./৮৫৫ খ্রি.] বলেন: খাবারে ৪টি জিনিস জমা হলে সে খাবার পরিপূর্ণ হয়; খাবার আগে ‘বিসমিল্লাহ’ বলা, শেষে আল্লাহর প্রশংসা করা, (একাধিক লোকের) অনেক হাত পড়া এবং তা হালাল হওয়া। (ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মা‘আদ,খন্ড:৪ পৃষ্ঠা:২৩২)। তাছাড়া আল্লাহর নাম নিয়ে খাওয়া শুরু করলে শয়তানের প্রভাব থেকে বাঁচা যায়। আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘‘অবশ্যই শয়তান (মুসলিমের) খাবার খেতে সক্ষম হয়; যদি খাওয়ার শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ না বলা হয়।” (সহীহ মুসলিম, আবু দাঊদ হা/৩৭৬৬)।
.
এখন প্রশ্ন হলো যে শিশু এখনো কথা বলতে পারে না সে যখন খাওয়া শুরু করে, তখন তার পক্ষ থেকে বিসমিল্লাহ বলার হুকুম কি?
.
এই প্রশ্নটি বর্তমান সৌদি আরবের যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম আবদুল-রহমান বিন নাসির আল-বারাক (জন্ম: ১৯৩৩ বা ১৯৩৪ খি:) (হাফিযাহুল্লাহ) এর কাছে জিজ্ঞেস করা হলে উত্তরে শাইখ বলেন; আপনার কাজের জন্য বিসমিল্লাহ বলুন, সন্তানের পক্ষে নয়। অন্য কথায়, আপনি তাকে খাওয়ানোর জন্য বিসমিল্লাহ বলুন, তার পক্ষ থেকে নয়। কাজ শুরু করার সময় এটি করা উচিত। কিন্তু আপনি তাকে খাওয়ানো প্রতিটি টুকরার সঙ্গে না। (ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-২৬৪২০০)।
.
দ্বিতীয়ত: খাওয়ার শুরুতে শুধু বিসমিল্লাহ বলতে হবে নাকি বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম বলতে হবে?
.
খাওয়ার সময় মহান আল্লাহকে স্মরণ করার জন্য ইসলামী শরীয়ত কর্তৃক যে বাক্যাংশটি নির্ধারিত হয়েছে তা হলো শুধুমাত্র “বিসমিল্লাহ” (আল্লাহর নামে) বলা। কারণ, আম্মিজান আইশাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) [মৃত: ৫৭/৫৮ হি.] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; যখন তোমাদের কোন ব্যক্তি খাওয়া শুরু করে তখন যেন সে বিসমিল্লাহ বলে। সে খাওয়ার শুরুতে বিসমিল্লাহ বলতে ভুলে গেলে তবে যেন বলে, “বিসমিল্লাহি ফি আওয়ালিহি ওয়া আখিরিহি” (এর শুরু ও শেষ আল্লাহ তা’আলার নামে)। (আবু দাঊদ ৩৭৬৭, তিরমিযী ১৮৫৮, সহীহ ইবনু মাজাহ ৩২৬৪, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব ২১০৭, সহীহ ইবনু হিব্বান ৫২১৪, সনদ সহীহ)। এ হাদীস থেকে বুঝা যায়, খাওয়ার শুরুতে শুধু ‘বিসমিল্লাহ’ বলাই যথেষ্ট। কেননা হাদীসে শুধুমাত্র বিসমিল্লাহ বলার কথা এসেছে এবং পুরো ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ বলার কথা আসেনি।
.
অপরদিকে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম(পরম করুণাময় এবং দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি) বলার ব্যাপারে আহালুল আলেমগণ মতভেদ করেছেন। তবে অধিকাংশ আলেমগণ এই সংযোজনে অর্থাৎ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম বলাতে কোন ভুল নেই বলে অভিমত দিয়েছেন। যেমন:
.
শাইখুল ইসলাম ইমাম তাক্বিউদ্দীন আবুল আব্বাস আহমাদ বিন আব্দুল হালীম বিন তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেন; কেউ যদি খাওয়ার সময় বলে, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম তাহলে সেটা উত্তম এবং অধিকতর বিশুদ্ধ। (ফাতাওয়া আল-কুবরা খন্ড: ৫ পৃষ্ঠা:৪৮০)।
.
আল মাওসুআতু ফিকহিয়্যাহ কুয়েতী ফিকহের কিতাবে বলা হয়েছে, আহালুল ইমামগনের মতে খাওয়া শুরু করার সময় মহান আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা একটি সুন্নাত এবং যে শব্দগুচ্ছটি ব্যবহার করতে হবে তা হলো বিসমিল্লাহ বা বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। (আল মাওসুআতু ফিকহিয়্যাহ খন্ড: ৮ পৃষ্ঠা: ৯২)
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন, আল্লাহর নাম উল্লেখ করার সময় যে শব্দগুচ্ছটি ব্যবহার করতে হবে তা লক্ষ্য করা আরও গুরুত্বপূর্ণ। সর্বোত্তম হলো বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। (নববী আল আযকার খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ২৩১)।
.
অপরদিকে ইবনে হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর মন্তব্য বলতে গিয়ে বলেন; আমি এটিকে অর্থাৎ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম পড়া আরো উত্তম বলে দাবি করার পক্ষে কোন বিশেষ প্রমাণ দেখিনি। (ফাৎহুল বারী ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৬৩৫৭৩)।
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন, এবং আমি বলি; রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাহ অপেক্ষা উত্তম কিছু নেই। কেননা সর্বোত্তম দিক-নির্দেশনা হলো মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পথনির্দেশ এবং যদি খাওয়ার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ অর্থাৎ “বিসমিল্লাহ” বলা ছাড়া কিছুই প্রমাণিত না হয়, তাহলে এতে কিছু যোগ করা বৈধ নয়। একাই কথা বলা যাক যে, দীর্ঘ বাক্যাংশটি অর্থাৎ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম, বিসমিল্লাহ বলার চেয়ে উত্তম, এই ধরনের কথা বলা হাদিসে উল্লেখিত বিষয়ের বিপরীত। অথচ “সর্বোত্তম দিকনির্দেশনা হল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নির্দেশনা। (আলবানী সিলসিলা সহীহা খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ৩৪৩, ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৬৩৫৭৩)।
.
পরিশেষে, প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে, খাবারের শুরুতে মহান আল্লাহর নাম নিয়ে শুরু করা মুস্তাহাব। এটি নিয়ে ইমামগনের মধ্যে কোন মতানৈক্য নেই। কিন্তু বাক্যটি পড়ার সময় শুধু বিসমিল্লাহ বলতে হবে নাকি বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম বলতে হবে, এটি নিয়েই মূলত মতানৈক্য। তবে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব রাসূল (ﷺ)-এর হাদীসের আলোকে সর্বোত্তম হচ্ছে শুধুমাত্র বিসমিল্লাহ পড়া, অতিরিক্ত বাক্যাংশটি নয়। তবে কেউ যদি মাঝে মধ্যে পরিপূর্ণ বাক্যটি অর্থাৎ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম পড়ে তাতেও কোন সমস্যা নেই ইনশাআল্লাহ,যেমনটি অধিকাংশ আলেমগন বলেছেন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।