ভূমিকা: হজ্জ ইসলামের অন্যতম রুকন ও ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ। এটি একটি ফরয ইবাদত। যা সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের উপর ফরয। এর গুরুত্ব যেমন অপরিসীম তেমনি ফযীলতও সীমাহীন। পৃথিবীতে যত নেক আমল রয়েছে তন্মধ্যে হজ্জ শ্রেষ্ঠতম। রাসূল (সাঃ) অন্য সকল আমলের উপর হজ্জের মর্যাদাকে পূর্ব ও পশ্চিম দিগন্তের দূরত্বের সাথে তুলনা করেছেন। আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হজ্জ পালনকারীকে গুনাহমুক্ত নবজাতকের ন্যায় বলা হয়েছে। কবুল হজ্জের পুরস্কার জান্নাত। হজ্জের প্রতিটি কর্ম সম্পাদনের জন্য রয়েছে পৃথক ফযীলত ও মর্যাদা। এই ইবাদতের মাধ্যমে বিশ্ব মুসলিম একত্রিত হওয়ার সুযোগ লাভ করে। হজ্জ মাত্র কয়েকদিনের কর্মকাণ্ড হলেও এর বিধি-বিধান অনেক এগুলো সঠিক ভাবে পালন করতে পারলেই বিনিময় জান্নাত এছাড়াও আরাফার ময়দান সহ দোয়া কবুলের স্থানগুলোতে দোয়া করে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ অর্জনের সুযোগ রয়েছে কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য অধিকাংশ মানুষ টাকার জোরে হজ্জ করতে যায় সমাজে নিজেকে মর্যাদাবান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য অথচ বিদায় হজ্জের ভাষণে প্রিয় নবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,হে আল্লাহ!এই হজ্জ নয় লোক দেখানোর জন্য এবং নয় জনশ্রুতির জন্যও[ইবনে মাজা, ২৮৯০ সিলসিলা সহীহা,২৬১৭]হজ্জ এত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত অথচ কিভাবে হজ্জ উমরাহ করতে হয় এটি একদিকে যেমন অনেকেরই অজানা অপরদিকে জানার আগ্রহ তেমন পরিলক্ষিত হয় না বরং চরম অবহেলা পরিলক্ষিত হয়। এজন্য বারবার হজ্জ করেও অনেক হাজ্জীদের জীবনেও তেমন কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যায় না হজ্জ করার পরেও সুদ, ঘুষ দুর্নীতি, যিনা-ব্যভিচার, বান্দার হক নষ্ট করাসহ বিভিন্ন কাজে জড়িত থাকতে দেখা যায়।এগুলো হজ্জ কবুল না হওয়ার লক্ষন এজন্য প্রিয় নবী রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, শীঘ্রই তোমরা তোমাদের রবের সাথে সাক্ষাত করবে। তখন তিনি তোমাদের আমল সম্পর্কে তোমাদের জিজ্ঞেস করবেন। সাবধান! আমার পরে তোমরা পথভ্রষ্ট হয়ে ফিরে যেয়ো না[সহীহ বুখারী, ৫৫৫০আধুনিক প্রকাশনী- ৫১৪৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫০৩৯] সুতরাং এই বিষয়গুলো মাথায় রেখে মাকবূল হজ্জের দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে যথাযথ পদ্ধতিতে হজ্জ উমরাহ সম্পাদন করার চেষ্টা করতে হবে।
◾নিম্নে কুরআন সুন্নার আলোকে হজ্জ-এর সংজ্ঞা, হুকুম, সময়, হজ্জের গুরুত্ব ও ফযীলত সংক্ষেপে আলোচনা করা হ’ল।
_____________________________
হজ্জ-এর সংজ্ঞা: ‘হজ্জ’-এর আভিধানিক অর্থ: সংকল্প করা (القصد)। পারিভাষিক অর্থ: মহান আল্লাহর নৈকট্য বা সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দেখানো পদ্ধতিতে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে মক্কায় গিয়ে শরী‘আতে নির্ধারিত নির্দিষ্ট কার্যাবলি সম্পাদন করাকে হজ্জ বলে।
ওমরাহ-এর সংজ্ঞা: ওমরাহ’-এর আভিধানিক অর্থ : আবাদ স্থানে যাওয়ার সংকল্প করা (الاعتمار) , যিয়ারত করা। পারিভাষিক অর্থ: বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করা সাফা মারওয়া সাঈ করা এবং মাথার চুল মন্ডল করাকে উমরাহ বলে।
▪️হজ্জ-এর সময়কাল :হজ্জের জন্য নির্দিষ্ট তিনটি মাস হ’ল শাওয়াল, যুলক্বা‘দাহ ও যুলহিজ্জাহ[সূরা বাকারা: ১৯৭]। এ মাসগুলির মধ্যেই যেকোন সময় হজ্জের ইহরাম বেঁধে বায়তুল্লাহর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে হয় এবং ৯ই যিলহাজ্জ তারিখে আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করতে হয়। ৯ তারিখে আরাফাতের ময়দানে অবস্থান না করলে হজ্জ হবে না। পক্ষান্তরে ‘ওমরাহ’ করা সুন্নাত এবং বছরের যেকোন সময় তা করা চলে।[সাইয়িদ সাবিক্ব, ফিক্বহুস সুন্নাহ (কায়রো: দারুল ফাৎহ ৫ম সংস্করণ ১৪১২/১৯৯২), পৃঃ ১/৪৬২, ৫৪০]
▪️হজ্জের হুকুম: নিরাপদ ও সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থা সহ দৈহিক ও আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান প্রত্যেক মুমিনের জন্য জীবনে একবার হজ্জ করা ফরয।মহান আল্লাহ বলেন, আর আল্লাহর উদ্দেশ্যে এ গৃহের হজ্জ করা ঐ ব্যক্তির উপর ফরয করা হ’ল, যার এখানে আসার সামর্থ্য রয়েছে। আর যে ব্যক্তি তা অস্বীকার করে (সে জেনে রাখুক যে,) আল্লাহ জগদ্বাসী থেকে মুখাপেক্ষীহীন’[আলে ইমরান ৩/৯৭]। এটিই হজ্জ ফরয হওয়ার মূল দলীল।[তাফসীরে ইবনু কাছীর ২/৮১, অত্র আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।]
তিনি আরো বলেন, আর তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্জ ও ওমরাহ পূর্ণ কর। কিন্তু যদি তোমরা বাধাপ্রাপ্ত হও, তাহ’লে যা সহজলভ্য হয়, তাই কুরবানী কর’[সূরা বাক্বারাহ ২/১৯৬]। এ আয়াতটি হজ্জ ফরয হওয়ার পাশাপাশি ওমরাহ ফরয হওয়ারও দাবী রাখে, যে ব্যাপারে অধিকাংশ সাহাবী ও ওলামায়ে কেরাম অভিমত ব্যক্ত করেছেন।[তাফসীরে ইবনু কাছীর ১/৫৩০-৫৩১, অত্র আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য]
ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা আকরা‘ বিন হাবেস নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! হজ্জ কি প্রতি বছর ফরয না জীবনে একবারই ফরয? তিনি বললেন, না বরং হজ্জ জীবনে একবার ফরয। যে অধিক করবে তা তার জন্য নফল হবে’।[আবুদাউদ হা/১৭২১; ইবনু মাজাহ হা/২৮৮৬;আহমাদ হা/২৬৪২; দারেমী হা/১৭৮৮]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, مَنْ أَرَادَ الْحَجَّ فَلْيَتَعَجَّلْ ‘যে ব্যক্তি হজ্জের সংকল্প করে, সে যেন দ্রুত সেটা সম্পাদন করে’।[আবুদাঊদ, দারেমী, মিশকাত হা/২৫২৩] যাদের উপরে হজ্জ ফরয হওয়া সত্ত্বেও দেরী করেন, তারা হাদীসটি লক্ষ্য করুন।
▪️বদলী হজ্জ:কেউ অন্যের পক্ষ হ’তে বদলী হজ্জ করতে চাইলে তাকে প্রথমে নিজের হজ্জ করতে হবে।[আবুদাঊদ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/২৫২৯] যার উপর হজ্জ ফরয হয়েছে, কিন্তু রোগ বা অতি বার্ধক্যের কারণে নিরাশ হয়ে গেছেন, তাঁর পক্ষে বা মৃতব্যক্তির পক্ষে বদলী হজ্জ করা যাবে। নারী পুরুষের পক্ষে অথবা পুরুষ নারীর পক্ষে বদলী হজ্জ করতে পারেন। বদলী ওমরাহর কোন দলীল পাওয়া যায় না। ওমরাহ ফরয নয়। তাই নফল হজ্জ বা নফল ওমরাহর কোন বদলী হয় না।
▪️শিশুর হজ্জ: শিশু হজ্জ করলে তার হজ্জ হবে ও তার পিতা নেকী পাবেন। জনৈক মহিলা স্বীয় শিশু সন্তানের হজ্জ কবুল হবে কি না জিজ্ঞেস করলে রাসূল (আল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘তার হজ্জ হয়ে যাবে এবং এজন্য তুমিও নেকী পাবে’[সহীহ মুসলিম হা/১৩৩৬; মিশকাত হা/২৫১০]
কিন্তু ঐ শিশুর উপর থেকে হজ্জের ফরযিয়াত বিলুপ্ত হবে না। বড় হয়ে সামর্থ্যবান হ’লে পুনরায় তাকে নিজের হজ্জ করতে হবে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘কোন শিশু বালেগ হওয়ার পূর্বে হজ্জ করলেও পরবর্তীতে (সামর্থবান হ’লে) তাকে পুনরায় হজ্জ করতে হবে’ [মুস্তাদরাকে হাকেম হা/১৭৬৯; ইবনু খুযায়মা হা/৩০৫০ সহীহুল জামে‘ হা/৪৮৫,২৭২৯; ইরওয়া হা/৬৮৬]
▪️অন্যের খরচে হজ্জ :অন্যের খরচে ও ব্যবস্থাপনায় হজ্জ করা যাবে এবং এর ফলে তার উপর হজ্জের ফরযিয়াত বিলুপ্ত হবে। যিনি হজ্জ করাবেন, তিনি এই বিরাট সৎকর্মের নেকী পাবেন এবং হজ্জকারী তার হজ্জের নেকী পাবেন।অধিকবার হজ্জ বা ওমরাহ করা নফল বা অতিরিক্ত বিষয়’।[আবুদাঊদ, নাসাঈ, আহমাদ, আলবানী মিশকাত হা/২৫২০] তাই বারবার নফল হজ্জ ও ওমরাহ করার চাইতে গরীব নিকটাত্মীয়দের মধ্যে উক্ত অর্থ বিতরণ করা এবং অন্যান্য দ্বীনী কাজে সাদাক্বা করা উত্তম।
৯ম অথবা ১০ম হিজরীতে হজ্জ ফরয হয়। হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) এ মতকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তবে জমহূর বিদ্বানগণের মতে ৬ষ্ঠ হিজরীতে হজ্জের হুকুম নাযিল হয় এবং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) ১০ম হিজরীতে জীবনে একবার ও শেষবার সপরিবারে হজ্জ করেন।[ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৪৪২, ৪৪৪]
তিনি জীবনে মোট ৪ বার ওমরাহ করেন ও একবার হজ্জ করেন।[মিশকাত হা/২৫১৮]
হজ্জ তিন প্রকার। তামাত্তু, ক্বিরান ও ইফরাদ। এর মধ্যে ‘তামাত্তু’ সর্বোত্তম[সহীহ বুখারী,৭২৩০ মিশকাত: ২৫৫৯] যদিও মুশরিকরা একে হজ্জের পবিত্রতা বিরোধী বলে মনে করত এবং হীন কাজ ভাবতো।
হজ্জ কত প্রকার:
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
হজ্জ তিন প্রকার। তামাত্তু, ক্বিরান ও ইফরাদ। এর মধ্যে ‘তামাত্তু’ সর্বোত্তম[সহীহ বুখারী,৭২৩০, মিশকাত: ২৫৫৯]
▪(১) হজ্জে তামাত্তু: হজ্জের মাসে ওমরাহর ইহরাম বেঁধে বায়তুল্লাহর ত্বাওয়াফ ও ছাফা-মারওয়ার সাঈ শেষে মাথা মুন্ডন করে বা চুল ছেঁটে হালাল হওয়ার মাধ্যমে প্রথমে ওমরাহর কাজ সম্পন্ন করা।[তিরমিজি, ৭৩০ মিশকাত,২৫২৮] অতঃপর ৮ই যিলহজ্জ তারিখে স্বীয় অবস্থানস্থল হ’তে হজ্জের ইহরাম বেঁধে পূর্বাহ্নে মিনায় গমন করা। অতঃপর ৯ই যিলহাজ্জ আরাফার ময়দানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান ও মুযদালিফায় রাত্রি যাপন শেষে ১০ই যিলহাজ্জ সকালে মিনায় প্রত্যাবর্তন করে বড় জামরায় ৭টি কংকর মেরে কুরবানী ও মাথা মুন্ডন শেষে প্রাথমিক হালাল হওয়া। অতঃপর মক্কায় গিয়ে ‘ত্বাওয়াফে ইফাযাহ’ ও সাঈ শেষে পূর্ণ হালাল হওয়া। অতঃপর মিনায় ফিরে সেখানে অবস্থান করে ১১, ১২, ১৩ তিনদিন তিন জামরায় প্রতিদিন ৩´৭=২১টি করে কংকর নিক্ষেপ শেষে মক্কায় ফিরে বিদায়ী ত্বাওয়াফ সেরে দেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়া।যেহেতু সমাপ্ত হওয়ার সর্বোত্তম তাই আমরা এই বইয়ে তামাত্তু হজ্জ সম্পর্কে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
▪️(২) হজ্জে ক্বিরান: এটি দু’ভাবে হ’তে পারে- (ক) একই সাথে ওমরাহ ও হজ্জের ইহরাম বাঁধা (খ) প্রথমে ওমরাহর ইহরাম বেঁধে অতঃপর ওমরাহর ত্বাওয়াফ শুরুর পূর্বে হজ্জের নিয়ত ওমরাহর সঙ্গে শামিল করা।এই হজ্জের নিয়তকারীগণ যথারীতি ত্বাওয়াফ ও সাঈ শেষে আরাফা-মুযদালিফায় হজ্জের মূল আনুষ্ঠানিকতা সমূহ সেরে মিনায় এসে বড় জামরায় ৭টি কংকর নিক্ষেপ করে কুরবানী ও মাথা মুন্ডন শেষে প্রাথমিক হালাল হবেন। অতঃপর মক্কায় গিয়ে ‘ত্বাওয়াফে ইফাযাহ’ শেষে পূর্ণ হালাল হবেন। অতঃপর মিনায় ফিরে গিয়ে তিনদিন সেখানে অবস্থান করে কংকর মেরে মক্কায় এসে বিদায়ী ত্বাওয়াফ শেষে বাড়ী ফিরবেন।[বিস্তারিত সহীহ বুখারী, ১৫৫৬ নাসাঈ,২৭৬৪]
বিদায় হজ্জে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজে ক্বিরান হজ্জ করেছিলেন। কিন্তু যাদের সঙ্গে কুরবানী ছিল না, তাদেরকে তিনি তামাত্তু হজ্জ করার আদেশ দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, এখন যেটা বুঝছি সেটা আগে বুঝতে পারলে আমি কুরবানী সাথে আনতাম না। বরং তোমাদের সাথে ওমরাহ করে হালাল হয়ে যেতাম (অর্থাৎ তামাত্তু হজ্জ করতাম)।[মুসলিম, মিশকাত হা/২৫৫৫ ‘বিদায় হজ্জ’ অনুচ্ছেদ]
যদি ক্বিরান হজ্জকারীগণ ত্বাওয়াফ ও সাঈ শেষে মাথার চুল ছেঁটে হালাল হয়ে যান, তবে সেটা ‘ওমরাহ’ হবে এবং তিনি তখন ‘তামাত্তু’ হজ্জ করবেন।
▪️(৩) হজ্জে ইফরাদ: শুধু হজ্জের নিয়তে ইহরাম বাঁধা এবং যথারীতি ত্বাওয়াফ, সাঈ ও হজ্জের আনুষ্ঠানিকতা সমূহ শেষ করে হালাল হওয়া। হজ্জে ক্বিরান ও ইফরাদের একই নিয়ম।পার্থক্য শুধু এই যে, হজ্জে ক্বিরানে ‘হাদ্ই’ বা পশু কুরবানী প্রয়োজন হবে। কিন্তু হজ্জে ইফরাদে কুরবানীর প্রয়োজন নেই।[বিস্তারিত সহীহ বুখারী: ১৫৬৮]
🔰এই শিরোনামে আমরা হজ্জে তামাত্তু সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ননা করব ইনশাআল্লাহ।
_______________________________________
▪️প্রথমে হজ্জের ফযীলত: আল্লাহ তা‘আলা মুসলিম মিল্লাতের উপর হজ্জ ফরয করেছেন। উদ্দেশ্য স্বীয় বান্দাদের ক্ষমা করে তাদেরকে জান্নাতের সুখময় স্থান দান করা। আর তিনি হজ্জের প্রতিটি কর্ম সম্পাদনের জন্য পৃথক পৃথক ফযীলতের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।যেমন: আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সালালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্জ করেছে। যার মধ্যে সে অশ্লীল কথা বলেনি বা অশ্লীল কার্য করেনি, সে হজ্জ হ’তে ফিরবে সেদিনের ন্যায় (নিষ্পাপ অবস্থায়) যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিলেন’।[বুখারী হা/১৫২১; মুসলিম হা/১৩৫০; মিশকাত হা/২৫০৭] অর্থাৎ সে কাবীরা-ছাগীরা, প্রকাশ্য-গোপনীয় সকল গুনাহ থেকে ঐরূপ মুক্ত হয়ে ফিরে আসে। যেরূপ একজন শিশু গুনাহ মুক্ত হয়ে জন্মগ্রহণ করে।[ইবনু হাজার, ফাতহুলবারী ৩/৩৮২]
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘এক ওমরাহ অপর ওমরাহ পর্যন্ত সময়ের (ছগীরা গুনাহের) কাফফারা স্বরূপ। আর জান্নাতই হ’ল কবুল হজ্জের একমাত্র প্রতিদান’।[বুখারী হা/১৭৭৩; মুসলিম হা/১৩৪৯; মিশকাত হা/২৫০৮]
হজ্জে মাবরূর’ বা কবুল হজ্জ বলতে ঐ হজ্জকে বুঝায়, যে হজ্জে কোন গোনাহ করা হয়নি এবং যে হজ্জের আরকান-আহকাম সবকিছু (ছহীহ সুন্নাহ মোতাবেক) পরিপূর্ণভাবে আদায় করা হয়েছে। এতদ্ব্যতীত হজ্জ থেকে ফিরে আসার পরে পূর্বের চেয়ে উত্তম হওয়া এবং পূর্বের গোনাহে পুনরায় লিপ্ত না হওয়া কবুল হজ্জের বাহ্যিক নিদর্শন হিসাবে গণ্য হয়’।[ফৎহুল বারী ৩/৪৪৬; হা/১৫১৯-এর ব্যাখ্যা]
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি হজ্জ, ওমরাহ কিংবা জিহাদের উদ্দেশ্যে বের হ’ল এবং রাস্তায় মৃত্যুবরণ করল, আল্লাহ তার জন্য পূর্ণ নেকী লিখে দিবেন’।[বায়হাক্বী, মিশকাত হা/২৫৩৯; ছহীহাহ হা/২৫৫৩]
রাসূল (ছাঃ) বলেন,হজ্জ ও ওমরাহ পালনকারীগণ আল্লাহর মেহমান। তারা দো‘আ করলে তিনি কবুল করেন। তারা ক্ষমা প্রার্থনা করলে তিনি তাদের ক্ষমা করে দেন’।[ইবনু মাজাহ হা/২৮৯২; ছহীহ আত-তারগীব হা/১১০৯; মিশকাত হা/২৫৩৬]
অপর বর্ণনায় রয়েছে, ‘তারা কোন কিছু চাইলে তিনি তা দেন’।[ইবনু মাজাহ হা/২৮৯৩; ছহীহাহ হা/১৮২০; ছহীহুল জামে‘ হা/৪১৭১; ছহীহ আত-তারগীব হা/১১০৭]
▪️মসজিদে হারাম এর ফজিলতঃ জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “আমার মসজিদে একটি নামায মসজিদে হারাম ছাড়া অন্যান্য মসজিদে এক হাজার নামায অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। আর মসজিদে হারামে (কাবার মসজিদে) একটি নামায অন্যান্য মসজিদে এক লক্ষ নামায অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।” (আহমাদ ১৪৬৯৪, ১৫২৭১, ইবনে মাজাহ ১৪০৬, সহীহুল জামে’ ৩৮৩৮ হাদিস সম্ভার, হাদিস নং ১১৯৫]
আবূ সাঈদ ও আবদুল্লাহ বিন আম্র ইবনুল আস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃরসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, তিনটি মাসজিদ ব্যতীত আর কোথাও (আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায়) সফর করা যাবে না। মাসজিদুল হারাম, মাসজিদুল আক্সা এবং আমার এই মাসজিদের দিকে। [সহীহ বুখারী ১১৯৭, তিরমিযী ৩২৬, আহমাদ ১১০১৭, ১১০৯১, ১১২১৫, ১১৩২৯, ১১৪৭৩, ২৭৯২২, ২৭৯২৫, ২৭৯৪৭, ২৭৯৪৯। তাহক্বীক্ব আলবানী: সহীহ। তাখরীজ আলবানী: ইরওয়াহ ২৩১-২৩৫, ১৪৩। সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ১৪১০]
◾তাওয়াফের ফজিলতঃ পৃথিবীর সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ঘর কাবাকে প্রদক্ষিণ করাকে তাওয়াফ বলে। মহান আল্লাহ বলেন, তোমরা প্রচীনগৃহ (কাবাকে) তাওয়াফ কর সূরা হজ্জ,২৯] তাওয়াফ এর ফজিলত সম্পর্কে হাদীসে এসেছে আবদুল্লাহ বিন উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃআমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে বলতে শুনেছিঃ যে ব্যক্তি বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করলো এবং দু’ রাকাআত নামায পড়লো, তা একটি ক্রীতদাসকে দাসত্বমুক্ত করার সমতুল্য। [তিরমিযী ৯৫৯, সহীহাহ ২৭৫২সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ২৯৫৬ ] অপর হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম বলেন,যে ব্যাক্তি একজন মুসলিম গোলাম আজাদ করল সে যেন তার প্রত্যেকটি অঙ্গকে জাহান্নাম থেকে হেফাজত করল[সহীহ বুখারী,৬৭১৫ মিশকাত,৩৩৮২]
◾রুকনে ইয়ামানী ও হাজরে আসওয়াদের ফজিলতঃ তাওয়াফকারী তাওয়াফের সময় হাজরে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামানী স্পর্শ করবে।রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন এই কোণদ্বয় স্পর্শ করলে পাপ জড়ে যায়[নাসাঈ,২৯১৯]অপর বর্ণনায় বলেন এই কোণদ্বয় স্পর্শ করলে যাবতীয় পাপের কাফফারা হয়ে যায় [তিরমিজি,৯৫৯
◾যমযমের ফজিলতঃ যমযমের ফজিলত সম্পর্কে সহিহ মুসলিমে দীর্ঘ হাদিসে এসেছে, এটি বরকতময় এটি খাদ্যগুণ সমৃদ্ধ [সহী মুসলিম,২৪৩] আবু দাউদে তুয়ালসী রহঃ উক্ত হাদিসের সাথে নিম্নোক্ত অংশটি যোগ করেন আরেকটি রোগব্যাধি নিরাময়কারী[আবু দাউদ তুয়ালসী,৪৫৯] ইবনে আব্বাস বলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন ভূপৃষ্ঠের সর্বশ্রেষ্ঠ পানি হল যমযমের পানি এর মধ্যে রয়েছে পুষ্টিকর খাদ্য রোগ-হতে আরোগ্য [ত্বাবরানী কাবীর, ১১১৬৭ সিলসিলা সহীহা,১০৫৬ ও ৩৫৮৫
◾আরাফার গুরুত্ব ও ফজিলতঃ প্রিয় নবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরাফার অত্যাধিক গুরুত্ব ও ফজিলত বর্ণনা করেছেন,আয়িশাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃতিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ এমন কোন দিন নেই, যেদিন আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদেরকে ‘আরাফার দিনের চেয়ে জাহান্নাম থেকে বেশি মুক্তি দিয়ে থাকেন। তিনি সেদিন বান্দাদের খুব নিকটবর্তী হন, তাদেরকে নিয়ে মালায়িকার (ফেরেশতাগণের) কাছে গর্ববোধ করে বলেন, এরা কি চায়? (অর্থাৎ- যা চায় আমি তাদেরকে তাই দেবো)।[সহীহ মুসলিম ১৩৪৮, মুসতাদ্রাক লিল হাকিম ১৭০৫, ইবনু মাজাহ ৩০১৪, সহীহাহ্ ২৫৫১, সহীহ আল জামি‘ ৫৭৯৬।মিশকাতুল মাসাবিহ,২৫৯৪]