🔰ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ:
__________________________________
হজ্জ ও উমরার কার্যক্রম শুরু করার নিয়্যতকেই ইহরাম বলা হয়। ‘ইহরাম’ অর্থ ‘হারাম করা’। ইহরাম বাঁধার কারণে কতগুলো কাজ হালাল হওয়া সত্ত্বেও হারাম হয়ে যায়। আর এজন্য একে ইহরাম বলা হয়। ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ মোট নয়টি। যথা-
⛔[১] পুরুষদের সেলাই করা কাপড় পরিধান করা: মুহরিম ব্যক্তি জামা, পাগড়ি, পায়জামা, টুপি, মোজা পরতে পারবে না। তবে কেউ যদি সেন্ডেল না পায়, তাহলে মোজাকে টাখনুর নিচ পর্যন্ত কেটে পরতে পারবে।আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে বর্ণিত যে, এক ব্যক্তি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! মুহরিম ব্যক্তি কোন ধরনের পোষাক পরবে? আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, সে জামা, পাগড়ি, পায়জামা, টুপি এবং জাফরান ও অরস (এক প্রকার ঘাসের সুগন্ধি) লাগানো কাপড় পরিধান করবে না। তবে কারো জুতা না থাকলে সে টাখনুর নিচ পর্যন্ত মোজা কেটে (জুতার ন্যায়) পরবে।[ছহীহ বুখারী, হা/১৫৪২]
⛔[২] মাথা ও মুখ ঢাকা: পুরুষদের কোন কিছু দিয়ে মাথা ও মুখ ঢাকা নিষেধ ইবনু উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, একদা এক ব্যক্তি রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! মুহরিম পুরুষ ব্যক্তি কোন ধরনের কাপড় পরতে পারবে বা কোন ধরনের কাপড় পরিধান করা থেকে বিরত থাকবে? রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, জামা, পায়জামা, পাগড়ি, ও মোজা পরিধান করবে না। তবে কারো যদি জুতা না থাকে অর্থাৎ জুতা না পায়, তাহলে চামড়ার মোজা গিরার নিচে কেটে জুতার মতো করে পরতে পারে। আর টুপিযুক্ত জামাও পরবে না। অনুরূপভাবে জাফরান ও অরস (এক প্রকার উদ্ভিদের সুগন্ধি) লাগানো কোনো কাপড় পরিধান করবেন।[ছহীহ বুখারী, হা/১৫৪২; ছহীহ মুসলিম, হা/১১৭৭; নাসাঈ, হা/২৬৬৭]
⛔[৩] চুল কাটা বা তুলে ফেলা: মাথার চুল, বগলের ও নাভির নিচের লোম এবং দাড়ি ও গোঁফ এমনকি শরীরের যে কোনো স্থান হতে কোন পশম উঠানো বা কাটা নারী-পুরুষ সকলের জন্য নিষিদ্ধ। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তোমরা তোমাদের মাথার চুল ন্যাড়া করো না, যে পর্যন্ত না কুরবানীর পশু তার স্থানে পোঁছে’ (আল-বাক্বারা, ২/১৯৬)। এ আয়াতটি প্রমাণ করে ইহরাম অবস্থায় মাথার চুল কাটা যাবে না।
⛔[৪] নখ কাটা: ইহরাম অবস্থায় হাত-পায়ের নখ কাটা বা তুলে ফেলা যাবে না। এটি নারী-পুরুষ সকলের জন্য একই হুকুম।
⛔[৫] সুগন্ধি ব্যবহার করা: শরীরে বা কাপড়ে সুগন্ধি ব্যবহার করা যাবে না। এমনকি ইহরাম অবস্থায় কেউ মারা গেলেও সুগন্ধি ব্যবহার করা যাবে না।ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা এক ব্যক্তি আরাফার ময়দানে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে অবস্থানরত ছিলেন। হঠাৎ তিনি বাহন থেকে নীচে পড়ে গেলে তার ঘাড় মটকে যায় এবং তিনি মারা যান। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বিষয়টি অবহিত করা হলে তিনি বললেন, তাকে কুলপাতা মিশ্রিত পানি দিয়ে গোসল দাও, দুই কাপড় দিয়েই তার কাফনের ব্যবস্থা কর, তাকে সুগন্ধি লাগিও না এবং তার মাথাও আবৃত কর না। (রাবী আইয়্যুব বলেন) কারণ আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তাকে তালবিয়াহ পাঠরত অবস্থায় উঠাবেন।[ছহীহ বুখারী, হা/১২৬৬; ছহীহ মুসলিম, হা/১২০৬] এ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ইহরাম অবস্থায় সুগন্ধি ব্যবহার করা যাবে না। তবে ইহরাম বাঁধার আগে শুধু শরীরে (কাপড়ে নয়) সুগন্ধি মেখে নেওয়া যাবে, যা ইহরাম অবস্থায় অব্যাহত থাকলেও কোনো সমস্যা নেই।
⛔[৬] হাতমোজা পরিধান করাঃ
ইহরাম অবস্থায় মহিলারা নেক্বাব ও হাতমোজা পরবে না। কারণ রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘মুহরিম মহিলাগণ নেক্বাব এবং হাতমোজা লাগাবে না’ (বুখারী হা/১৮৩৮; মিশকাত হা/২৬৭৮)।তবে ফেৎনার আশংকা থাকলে তারা ভিন্ন কাপড় দ্বারা মুখ ও হাত ঢাকতে পারবে (ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ১১/১৯২-১৯৩)।
শায়খ বিন বায বলেন, এজন্য আলাদা সেলাইযুক্ত স্কার্ফ বা মোজা পরবে না। বরং বড় কাপড় দিয়ে মুখমন্ডল ও হাত ঢেকে রাখবে (মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৫/২২৩; আশ-শারহুল মুমতে‘ ৭/১৬৫)।তবে কেউ ভুলক্রমে বা অজ্ঞতাবশে নেক্বাব বা হাতমোজা পরিধান করে থাকলে তাকে কোন কাফফারা দিতে হবে না (বাক্বারাহ ২/২৮৬; উছায়মীন, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২৪/৪৩৩-৪৩৪)।
⛔[৭] বিবাহ করা এবং বিবাহের প্রস্তাব দেওয়া: ইহরাম অবস্থায় বিবাহ করা, বিবাহের প্রস্তাব দেওয়া এবং কারো বিবাহে ঘটকালি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। উছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ইহরাম অবস্থায় বিবাহ করবে না। কারো বিবাহের ব্যবস্থা করবে না। এমনকি বিবাহের প্রস্তাবও দিবে না।[ইবনু মাজাহ, হা/১৯৬৬]
যদি কেউ বিবাহ করে ফেলে, তাহলে সেই বিবাহ সঠিক হবে না।
⛔[৮] স্থলপ্রাণী শিকার করা: আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿غَيْرَ مُحِلِّي الصَّيْدِ وَأَنْتُمْ حُرُمٌ﴾ ‘মুহরিম অবস্থায় তোমাদের জন্য স্থলপ্রাণী শিকার করা হারাম করা ষহয়েছে’ (আল-মায়েদা, ৫/১)। এই আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ইহরাম অবস্থায় স্থলপ্রাণী শিকার করা যাবে না এবং শিকারে সহযোগিতা করা যাবে না। যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে শিকার করে, তাহলে তার কাফফারা হলো- আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে প্রাণী হত্যা করবে, তার কাফফারা হলো অনুরূপ গৃহপালিত প্রাণী কা‘বাতে কুরবানীর জন্য পাঠাতে হবে, যে ব্যাপারে তোমাদের মধ্যে ন্যায়পরায়ণ দুইজন লোক ফয়সালা করে দিবে কিংবা তার কাফফারা হলো কয়েকজন মিসকীনকে খাদ্য প্রদান করতে হবে অথবা তিন দিন ছিয়াম পালন করতে হবে। এটা নিজ কর্মের পরিণাম হিসাবে’ (আল-মায়েদা, ৫/৯৫)। এই আয়াতে উল্লেখিত ‘ইচ্ছাকৃতভাবে’ শব্দ দ্বারা বুঝা যায়, ভুলবশত প্রাণী হত্যা করলে কাফফারা দিতে হবে না।
⛔[৯] স্বামী-স্ত্রী মিলন ও মিলন ছাড়া যৌনতৃপ্তি মিটানো: আল্লাহ তাআলা বলেন,হজ্জের জন্য রয়েছে নির্ধারিত কয়েকটি মাস। অতএব, যে ব্যক্তি ওই মাসসমূহে হজ্জ পালন করবে, সে যেন যৌনকর্ম, অশ্লীলতা, অবাধ্যতা ও ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত না হয় (আল-বাক্বারা, ২/১৯৭)। এই আয়াত প্রমাণ করে যে, স্বামী-স্ত্রীর মিলন ছাড়াও যৌনতৃপ্তি মিটানো নিষেধ। তবে এ অপরাধের কারণে হজ্জ-উমরার কিরূপ ক্ষতি হবে এবং কাফফারা কি অপরিহার্য হবে? এ সম্পর্কে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে সরাসরি কোনো ছহীহ হাদীছ পাওয়া যায় না।
🔰ওমরাহ্র কাজগুলি ধারাবাহিকভাবে নিম্নরূপ:
________________________________
✔️(১) ইহরামের পূর্বে ওযূ বা গোসলের মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করা উত্তম [তিরমিযী হা/৮৩০, মিশকাত হা/২৫৪৭]। তবে শর্ত নয়। মহিলাগণ নাপাক অবস্থাতেও ইহরাম বাঁধতে পারবে। [মুসলিম হা/১২১৮, মিশকাত হা/২৫৫৫]
✔️(২) পুরুষদের জন্য সাদা সেলাই বিহীন লুঙ্গী ও চাদর পরিধান করা।[আহমাদ হা/৪৮৯৯] মহিলাদের জন্য যেকোন ধরনের শালীন পোষাক পরিধান করা। তবে নেকাব ও হাতমোজা ব্যবহার থেকে বিরত থাকা [আবুদাঊদ হা/১৮২৭]
✔️(৩) মীক্বাত থেকে ইহ্রাম বাঁধাঃকারণ রাসূল (ছাঃ) সারা বিশ্ব থেকে হজ্জব্রত পালনকারীদের জন্য পৃথক পৃথক মীকাত নির্ধারণ করে দিয়েছেন। [সহীহ বুখারী, মুসলিম; মিশকাত হা/২৫১৬]। অতএব হজ্জ পালনকারীগণ ইহরামের কাপড় সাথে নিয়ে বিমানে আরোহন করবেন এবং বিমান কর্তৃক মীকাতের ঘোষণা আসার পর বিমানের মধ্যে ইহরামের কাপড় পরিধান করবেন। মনে রাখতে হবে ইহরাম পরিধান ও তালবিয়া পাঠ একত্রে হ’তে হবে। ৫ ঘণ্টা আগে ইহরামের কাপড় পরে বিমানের ঘোষণার পর তালবিয়া পাঠ সম্পূর্ণরূপে বিদ‘আতী রীতি,যা পরিত্যাজ্য।
✔️(৪) মীকাতে গিয়ে ইহরামের উদ্দেশ্যে প্রথমে গোসল করাঃ আর ইহরামের পূর্বে গোসল করা পুরুষ ও মহিলা উভয়ের জন্য সুন্নাত। এমনকি ঋতুবতি এবং নিফাস অবস্থায় থাকা মহিলাও গোসল করবে। কারণ (আবূ বাকর সিদ্দীক (রা.)-এর স্ত্রী) আসমা বিন্তে উমায়সকে বিদায় হাজ্জের বছর যুলহুলাইফা নামক স্থানে মুহাম্মাদ বিন আবু বাকর ভূমিষ্ট হলে নবী (সা.) নির্দেশ দিয়ে বলেন: তুমি গোসল করে (লজ্জাস্থানে) কাপড় ভালভাবে বেঁধে নিয়ে ইহরাম করে নাও।[সহীহ মুসলিম ১২০৯-১২১০]
✔️(৫) উমরা পালনে ইচ্ছুক ব্যক্তির জন্য সুন্নাত হলো, ফরয গোসল সম্পাদনের ন্যায় ভালভাবে গোসল করা, মাথায় ও দাড়িতে যথাসাধ্য যে কোন ভাল সুগন্ধি ব্যবহার করা। আর তার ঘ্রাণ ইহরাম করার পরে অবশিষ্ট থাকলে কোন ক্ষতি নেই। তবে ইহরাম বাধার পরে সুগন্ধি ব্যবহার করা যাবে না। [মুসলিম হা/১১৯০] তবে পোষাকে নয় [বুখারী হা/১৭৮৯)। যে কোন ফরয ছালাতের পরে কিংবা ‘তাহিইয়াতুল ওযূ’ দু’রাক‘আত নফল ছালাতের পরে ইহরাম বাঁধা চলে। তবে ইহরাম বাঁধার সাথে সালাতের কোন সম্পর্ক নেই (বিস্তারিত দ্রঃ ‘হজ্জ ও ওমরাহ’ বই)
✔️(৬) ওমরার উদ্দেশ্যে (অন্তরে) নিয়ত করে ইহ্রাম বাঁধা। (রুকন) অর্থাৎ ইহরাম (হাজ্জ বা উমারায় প্রবেশের অন্তরে নিয়্যাত) করবে এবং বলবে:لَبَّيْكَ عُمْرَة [লাব্বাইকা উমরাতা [অর্থঃ [হে আল্লাহ!]আমি হাজির হয়েছি উমরার উদ্দেশ্যে। অতঃপর অধিক পরিমানে তালবিয়া পাঠ করবে।
لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ لَبَّيْكَ لَا شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ لَا شَرِيكَ لَكَ
[লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারীকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হাম্দা ওয়ান্নি’মাতা লাকা ওয়াল্মুলক, লা শারীকা লাকা]
অর্থঃ তোমার নিকট আমি হাজির হয়েছি, হে আল্লাহ! আমি হাজির হয়েছি, আমি হাজির হয়েছি, তোমার কোন অংশীদার নেই। আমি হাজির হয়েছি, নিশ্চয়ই সমস্ত প্রশংসা, নিয়ামাত এবং রাজত্ব তোমারই। তোমার কোন অংশীদার নেই।[সহীহ বুখারী ১৫৪৯, মুসলিম ১১৮৪, ইবনে মাজাহ ২৯১৮] এর কারণ হল যে, তালবিয়া উচ্চস্বরে পাঠ করা আল্লাহর নিদর্শন প্রকাশ করা এবং তার তাওহীদের (একত্ব) ঘোষনা করা।তবে মহিলারা তালবিয়া এবং অন্যান্য যিকির ও দু‘আ উচ্চস্বরে পাঠ করবে না; কারণ, তাদের ক্ষেত্রে পর্দাই হচ্ছে শারঈ বিধান। মক্কা পর্যন্ত সারা রাস্তা এই তালবিয়া বেশী করে পাঠ করবে এবং অন্যান্য তাসবীহ তাহলীলেও লিপ্ত থাকবে।
✔️(৭) অতঃপর মক্কায় প্রবেশ করলে সম্ভব হলে গোসল করে নেয়া সুন্নাত। কারণ, নবী (সা.) মক্কায় প্রবেশকালে গোসল করতেন। আরো আব্দুল্লাহ বিন উমার (সা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (সা.) মক্কা প্রবেশের সময় বাতহা নামক উঁচু এলাকা হয়ে প্রবেশ করতেন এবং মক্কা প্রস্থানের সময় নীচু এলাকা হয়ে বের হতেন।[সহীহ বুখারী ১৫৭৬-১৫৭৭] অতএব নাবী (সা.) যে পথ হয়ে প্রবেশ করেছেন এবং যে পথ হয়ে বিদায় হতেন সে পথ দিয়ে কোন হাজী যদি প্রবেশ করতে পারে এবং বিদায় হতে পারে তাহলে তা মুস্তাহাব।
অতঃপর মাসজিদ হারামে পৌঁছে প্রবেশের সময় প্রথমে ডান পা রাখবে এবং এ দু‘আ পাঠ করবে:
بِسْمِ اللَّهِ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي ذُنُوبِي وَافْتَحْ لِي أَبْوَابَ رَحْمَتِكَ، أَعُوذُ بِاللَّهِ الْعَظِيمِ وَبِوَجْهِهِ الْكَرِيمِ وَسُلْطَانِهِ الْقَدِيمِ مِنْ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ
[বিসমিল্লাহি, ওয়াস্সালাতু ওয়াস্সালামু আলা রাসূলিল্লাহ, আল্লাহুম্মাগফিরলী যুনূবী ওয়াফ্তাহলী আবওয়াবা রাহমাতিকা। আউযু বিল্লাহিল আযীম, ওয়াবি ওয়াজ্হিহিল কারীম, ওয়া সুলতানিহিল ক্বাদীম মিনাশশাইত্ব-নির রাজীম]
আমি আল্লাহর নামে শুরু করছি, সালাত (দরূদ) ও সালাম বর্ষিত হোক আল্লাহর রাসূলের প্রতি। হে আল্লাহ! তুমি আমার গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দাও এবং তোমার রাহমাতের দরজাসমূহ আমার জন্য খুলে দাও। আমি মহান আল্লাহর নিকট তাঁর সম্মানিত চেহারার মাধ্যমে এবং তাঁর প্রাচীন (স্থায়ী) রাজত্বের মাধ্যমে আশ্রয় গ্রহণ করছি।[আবূ দাউদ ৪৬৬ ও ইবনু মাজাহ ৭৭১]
✔️(৮) অতঃপর সম্ভব হলে মহান আল্লাহর মহত্ব প্রকাশ এবং তাঁর রসূল (সা.)-এর অনুসরণের উদ্দেশ্যে ডান হাত দ্বারা হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করবে এবং বিসমিল্লাহি আল্লাহু আক্বার’ বলে হাজরে আসওয়াদে চুম্বন দিবে। কখনো এ ভ্রান্ত বিশ্বাস রাখবে না যে, পাথর কোন উপকার বা অপকার করতে পারে। ইহা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করবে।এ মর্মে আমীরুল মু’মিনীন উমার বিন খাত্তাব (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি হাজরে আসওয়াদে চুম্বন দেয়ার পর বলতেন:নিশ্চয়ই আমি জানি যে, তুমি একটি পাথর মাত্র, তুমি কোন ক্ষতিও করতে পার না এবং উপকারও করতে পার না। তাই আমি যদি নবী (সা.)-কে, তোমাকে চুমা দিতে না দেখতাম, তাহলে আমি তোমাকে কখনো চুমা দিতাম না।[সহীহ বুখারী ১৫৯৭, ১৬০৫]
তবে যদি সরাসরি চুম্বন দেয়া সম্ভব না হয় তাহলে নিজ হাতে স্পর্শ করে হাতে চুম্বন দিবে।আর যদি হাত দ্বারা স্পর্শ করা সম্ভব না হয় তাহলে ভিড় করবে না; কারণ, ভিড় করলে নিজেরও কষ্ট হবে এবং অপরকেও কষ্ট দেয়া হবে। বরং অনেক সময় তা ক্ষতির কারণ হয়, ইবাদাতের বিনয় ও আন্তরিকতা বিনষ্ট হয়। যার ফলে তাওয়াফের লক্ষ্য উদ্দেশ্য যে আল্লাহর ইবাদাত তা হারিয়ে যায়। আবার কখনো কখনো আপত্তিকর কথা, ঝগড়া ও বিবাদ পর্যন্ত হয়ে যায়। তাই ভিড় থাকলে দূর থেকে হলেও ইশারা করাই যথেষ্ট।আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, নবী (সা.) উটের পিঠে চেপে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করলেন এবং হাজরে আসওয়াদের সামনে আসলেই সে দিকে ইশারা করতেন।[সহীহ বুখারী ১৬১২।]
রুকনে ইয়ামানী ও হাজরে আসওয়াদের মাঝখানে এ দু‘আ পাঠ করবে:
رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
[রাব্বানা আ-তিনা ফিদ্দুনইয়া হাসানাহ্, ওয়াফিল আ-খিরাতি হাসানাহ্, ওয়া ক্বিনা আযাবান্নার]
হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে দুনিয়াতেও কল্যাণ দাও এবং আখেরাতেও কল্যাণ দাও এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব হতে রক্ষা কর [সূরাহ্ আল-বাক্বারা ২:২০১]।[হাসান: সুনানে আবূ দাউদ ১৮৯২]
✔️(১০) আর যখনই হাজরে আসওয়াদের সামনে হয়ে অতিক্রম করবে তখন উপরোক্ত কাজগুলি করবে এবং তাকবীর পাঠ করবে। আর বাকী তাওয়াফে নিজ পছন্দ মত যিকির, দু‘আ এবং কুরআন তিলাওয়াত করতে পারবে। কারণ, কা’বা ঘরের তাওয়াফ, সাফা ও মারওয়ার সাঈ এবং জামরাসমূহে কংকর নিক্ষেপ আল্লাহর যিকির প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেই বিধিবদ্ধ করা হয়েছে।
আর এই তাওয়াফে কুদূমের (মক্কায় প্রথম পদার্পণ করে) সাত চক্করেই ইযতিবা করা এবং প্রথম তিন চক্করে রামাল করা সুন্নাত। তবে বাকী চার চক্করে রামাল করা যাবে না। আর ইযতিবা হলো, ডান কাঁধ খোলা রাখা ও চাদরের মধ্যভাগকে ডান বগলের নীচে রাখা এবং চাদরের দু’দিক বাম কাঁধের উপর রাখা। আর রামাল হল, পায়ের ধাপ কাছাকাছি ফেলে দ্রুত চলা।আর তাওয়াফ হচ্ছে সাত চক্কর, যা হাজরে আসওয়াদ থেকে শুরু হয় এবং সেখানেই শেষ হয়। আর হিজরের (হাতীম) মধ্য দিয়ে তাওয়াফ করলে তা শুদ্ধ হবে না। সুতরাং সাত চক্কর সম্পূর্ণ হলে মাকামে ইবরাহীমের দিকে এগিয়ে যাবে, অতঃপর এই আয়াতটি পাঠ করবে:﴿وَاتَّخِذُواْ مِن مَّقَامِ إِبْرَاهِيمَ مُصَلًّى
[ওয়াত্তাখিযু মিম্ মাক্বামি ইবরাহীমা মুসাল্লা]
আর মাকামে ইবরাহীমকে সলাতের স্থান হিসেবে গ্রহণ কর।[সূরা আল-বাক্বারা ২ঃ১২৫]
✔️(১১) অতঃপর তার পেছনে সম্ভব হলে নিকটবর্তী হয়ে দু’রাক’আত সলাত আদায় করবে। তবে ইহা সম্ভব না হলে দূরে যে কোন জায়গায় তা আদায় করবে। প্রথম রাকা’তে সূরাহ্ আল-ফাতিহার পরে সূরাহ্ আল-কাফিরূন এবং দ্বিতীয় রাকা’তে সূরাহ আল-ফাতিহার পরে সূরাহ্ ইখলাস পাঠ করবে।[সহীহ: নাসাঈ ২৯৬৩] অতঃপর হাজরে আসওয়াদের নিকট ফিরে এসে সহজসাধ্য হলে ইসতিলাম করবে (চুম্বন দিবে) আর তা সম্ভব না হলে তার দিকে ইশারা করবে না। তারপর সাঈ করার উদ্দেশ্যে সাফা পাহাড়ের নিকটবর্তী হবে এবং এই আয়াতটি পাঠ করবে:(إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِن شَعَآئِرِ اللّهِ)[ইন্নাস্সাফা ওয়াল মারওয়াতা মিন শাআ’ইরিল্লাহ্]নিশ্চয়ই সাফা এবং মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনগুলোর অন্যতম।[সূরা আল-বাক্বারা ২:১৫৮] একমাত্র এ জায়গা ব্যতীত অন্য কোন জায়গায় এই আয়াতটি পাঠ করবে না। অতঃপর সাফা পাহাড়ের উপর এমনভাবে চড়বে, যাতে কা’বা ঘর দেখা যায়।
✔️(১২) তারপর কিবলামুখী হয়ে দুই হাত উত্তোলন করে মহান আল্লাহর প্রশংসা করবে এবং নিজ ইচ্ছা মত দু‘আ করবে। এস্থানে নবী (সা.) থেকে প্রমাণিত দু‘আ হচ্ছে:لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ أَنْجَزَ وَعْدَهُ وَنَصَرَ عَبْدَهُ وَهَزَمَ الْأَحْزَابَ وَحْدَهُ
[লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্দাহু লা শারীকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু, ওয়াহু ওয়া আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্দাহু, আনজাযা ওয়া’দাহু, ওয়া নাসারা আব্দাহু, ওয়া হাযামাল আহযাবা ওয়াহ্দাহু]
আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য মা’বূদ নেই, যিনি এক ও একক, যাঁর কোন শরীক নেই, রাজত্ব তাঁরই, তাঁরই সমস্ত প্রশংসা, তিনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান। আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য মা’বূদ নেই, তিনি নিজ প্রতিশ্রুতি সম্পূর্ণ করেছেন, নিজ বান্দাকে সাহায্য করেছেন এবং তিনি একাই সমস্ত ভ্রান্ত দলসমূহকে পরাজিত করেছেন।[সহীহ মুসলিম ১২১৮]
এ যিকিরটি তিনবার করে করবে এবং তার মাঝে-মাঝে দু‘আ করবে। অতঃপর ‘সাফা’ পর্বত হতে নেমে মারওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হবে। তারপর সবুজ বাতী পর্যন্ত পৌঁছিলে কোন মানুষকে কষ্ট না দিয়ে যথাসাধ্য জোরে দৌঁড় দিবে। অতঃপর আগের সবুজ বাতী পর্যন্ত পৌঁছে ‘মারওয়া’ পর্বত পর্যন্ত সাধারণ গতিতে চলতে থাকবে।
✔️(১৩) অতঃপর ‘মারওয়া’ পর্বতের উপর চেপে কিবলামুখী হয়ে দু’হাত উত্তোলন করে সে সব যিকির ও দু‘আ পাঠ করবে যা ‘সাফা’ পর্বতের উপর করা সুন্নাত। তারপর ‘মারওয়া’ পর্বত হতে নেমে ‘সাফা’ পর্বতের উদ্দেশ্যে চলার স্থানে চলবে এবং দৌঁড়ের স্থানে দৌঁড় দিবে।তারপর ‘সাফা’ পর্বেতের উপর চেপে কিবলামুখী হয়ে দুই হাত উত্তোলন করে সে সব যিকির ও দুআ পাঠ করবে যা প্রথমবার সাফার পর্বতের উপর করা হয়েছে।
আর অবশিষ্ট সাঈতে নিজ পছন্দ মত যে কোন যিকির, কুরআনের তিলাওয়াত এবং দুআ পাঠ করতে থাকবে। আর ‘সাফা’ ও মারওয়া পর্বতের উপর আরোহণ করা এবং দুই সবুজ বাতীর মাঝখানে দৌড় দেয়া সুন্নাত, ইহা ওয়াজিব নয়।
‘সাফা’ পর্বত হতে ‘মারওয়া’ পর্বত পর্যন্ত আসলে এক চক্কর এবং ‘মারওয়া’ পর্বত হতে ‘সাফা’ পর্বত পর্যন্ত আসলে আর এক চক্কর। এভাবে সাঈ সাফা থেকে শুরু হবে এবং মারওয়াতে সাত চক্কর শেষে হবে।এটা রুকন।
✔️(১৪) সবশেষে এভাবে সাত চক্কর শেষে হলে পুরুষ ব্যক্তি মাথার চুল মুণ্ডন করবে কিংবা পুরো মাথা থেকে চুল ছোট করবে, তবে মাথা মুণ্ডন-নেড়া করাই উত্তম। কিন্তু যদি কোন ব্যক্তি হাজ্জে তামাত্তুর নিয়্যাতে এসে থাকে এবং হাজ্জের সময় (৮ই যিলহাজ্জ) নিকটবর্তী হয় যার মধ্যে চুল গজবে না, তাহলে এমন ব্যক্তির জন্য মাথার চুল ছোট করাই উত্তম। যাতে করে হাজ্জের পর চুল মুণ্ডনের জন্য বড় থাকে।কারণ নবী (সা.) তাঁর সাহাবীগণ যখন চার যিলহজ্জে হাজ্জে তামাত্তুর উদ্দেশ্যে আসেন তখন তিনি তাঁদেরকে উমরা করে চুল ছোট করার মাধ্যমে হালাল হতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।পক্ষান্তরে মহিলারা সর্বাবস্থায় মাথার চুল ছোট করবে; তাদের মাথা মুণ্ডন করা নিষেধ। নারীরা তাদের প্রত্যেক বেণী হতে আঙ্গুলের এক পোর পরিমাণ ছোট করবে। মাথা মুণ্ডন বা চুল খাটো করা পুরো মাথার হবে। কারণ, আল্লাহ তা’আলা বলেছেন:(مُحَلِّقِينَ رُؤُوسَكُمْ وَمُقَصِّرِينَ)
তোমাদের মস্তক মুণ্ডিত অবস্থায় ও চুল কেটে।[সূরা আল-ফাত্হঃ ২৭] আর নবী (সা.) পুরো মাথার চুল মুণ্ডন করেছেন তাই চুল মুড়িয়ে বা খাটো করে হালাল হয়ে যাওয়া। এটা ওয়াজিব এবং তিনি মুসলিমদের সম্বোধন করে বলেছেন: তোমরা আমার নিকট হতে তোমাদের হাজ্জ ও উমরার বিধি-বিধান নিয়ে নাও।[সহীহ মুসলিম,৩০২৮]
অনুরূপ মাথার চুল মাথার চতুর্দিক থেকে ছোট করতে হবে। উপরোক্ত কাজগুলির মাধ্যমে উমরাহ্ সম্পূর্ণ হয়ে যাবে এবং পূর্ণাঙ্গরূপে হালাল হয়ে যাবে। তারপরে ইহরামের অবস্থার সমস্ত নিষিদ্ধ কাজ বৈধ হয়ে যাবে।
🔰ওমরায় গিয়ে মসজিদে নববীর যিয়ারতঃ
_________________________________
ওমরায় গিয়ে মসজিদে নববীর যিয়ারত করার আবশ্যকতা নেই। কেননা রাসূল (ছাঃ)-এর কবর যিয়ারত হজ্জ বা ওমরার কোন অংশ নয়। শায়খ বিন বায বলেন, রাসূল (ছাঃ)-এর কবর যিয়ারত করা ওয়াজিব নয় বা হজ্জের কোন শর্তও নয়, যেমনটি সাধারণ মানুষ ধারণা করে থাকে। [মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১৬/১১১] সুতরাং শুধুমাত্র মদীনার মসজিদে ইবাদতের উদ্দেশ্যে সফর জায়েয (বৈধ)। অন্য কোন উদ্দেশ্যে (যেমন- নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের এর মাজার যিয়ারত বা সাহাবার (রাঃ) কবর যিয়ারত ইত্যাদি) সফর করা জায়েয নয়। তবে মসজিদে নববী পৌঁছার পর উক্ত স্থান সমূহ যিয়ারত করতে কোন বাঁধা নেই।
উল্লেখ্য যে, হজ্জের সময় রাসূল (ছাঃ)-এর কবর যিয়ারতের ব্যাপারে যতগুলি বর্ণনা এসেছে, তার সবগুলি যঈফ অথবা জাল।[আলবানী, সিলসিলা যঈফাহ হা/৪৫-৪৭; দ্রঃ ‘হজ্জ ও ওমরাহ’ বই ১৩৯-৪০ পৃ.]
বিশেষ দ্রষ্টব্য:
◾(ক) ওমরার কোন একটি রুকন ছুটে গেলে ওমরা বাতিল হয়ে যাবে।
◾(খ) আর কোন একটি ওয়াজিব ছুটে গেলে কাফ্ফারা দিতে হবে।
উপসংহার: পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ হজ্জ সহীহ হাদীস মোতাবেক হওয়া অতীব জরুরী। কেননা বিদ‘আত মিশ্রিত কোন আমল আল্লাহর নিকটে কবুল হয় না। অতএব হজ্জ সহ যাবতীয় ইবাদত বিদ‘আত মুক্তভাবে আদায় করা একান্ত কর্তব্য। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। আমীন! আল্লাহু আলাম।
______________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।