ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে একজন পুরুষের জন্য একাধিক বিবাহের হুকুম এবং শর্তাবলী

ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে একজন পুরুষের জন্য একাধিক বিবাহের হুকুম এবং শর্তাবলী। একজন স্ত্রী থাকা উত্তম নাকি একাধিক? একাধিক বিবাহের ক্ষেত্রে স্ত্রীদের অধিকার আদায়ে অবহেলার পরিণতি?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: মহান আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করার সাথে সাথে তার জীবনধারণের জন্য কিছু চাহিদা দিয়েছেন এবং সেই চাহিদা কিভাবে মেটাতে হবে সেই পদ্ধতিও বলে দিয়েছেন। মানবজীবনের জন্য যেমন, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার প্রয়োজন ঠিক তেমনই জৈবিক চাহিদাও গুরুত্বপূর্ণ। এই চাহিদা পূরণের জন্য ইসলাম বিবাহের বিধান দিয়েছে। ইসলামে বিবাহের ব্যাপারে মৌলিক বিধান হলো, সামর্থ্য থাকলে একজন পুরুষের জন্য একাধিক বিবাহ করা জায়েজ। অর্থাৎ একজন পুরুষের জন্য শর্তসাপেক্ষে একসাথে সর্বোচ্চ চারজন স্ত্রী রাখার অনুমতি রয়েছে এর বেশি নয়। কেউ যদি চারের অধিক অর্থাৎ পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম বিবাহ করতে চায় তার জন্য সেটাও জায়েজ। তবে শর্ত হলো একই সময়ে চারের অধিক রাখা স্ত্রী যাবেনা‌। অর্থাৎ কোনো স্ত্রী মারা গেলে বা তালাক দিয়ে দিলে নতুনভাবে আরেক জনকে বিবাহ করতে পারে। কিন্তু একই সময় চারজন স্ত্রী থাকা অবস্থায় পঞ্চম বিবাহ করা হারাম। এই মর্মে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যদি তোমরা আশঙ্কা কর যে, (নারী) ইয়াতীমদের প্রতি সুবিচার করতে পারবে না তবে নারীদের মধ্য হতে নিজেদের পছন্দমত দুই, তিন কিংবা চার জনকে বিবাহ করো, কিন্তু যদি তোমরা আশঙ্কা কর যে, তোমরা সুবিচার করতে পারবে না, তাহলে একজনকে কিংবা তোমাদের অধীনস্থ দাসীকে।’ (আন-নিসা-৪/৩)। উক্ত আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, একজন পুরুষ একই সঙ্গে সর্বাধিক চারজন মহিলাকে বিবাহ করতে পারবে। কেননা এখানে বিবাহের সর্বোচ্চ সংখ্যা বর্ণনা করা হয়েছে, আর তা হলো, ‘চার’। (ইসলাম সাওয়াল জাওয়াব, ফৎওয়া নং-২৩৪২৯৮)। আবু হাইয়ান আন্দালুসী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘(দুই, তিন বা চার) এখান থেকে প্রমাণিত হয় যে, আমাদের জন্য দু’টি, তিনটি অথবা চারটি পর্যন্ত বিবাহ করা বৈধ। আর আমাদের জন্য পাঁচটি বা এর বেশি বিবাহ করা জায়েয নয়।’ (আল-বাহরুল মুহীত্ব, ৩/১৭১ পৃ.)। ইমাম ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যদি এক সঙ্গে চারের অধিক স্ত্রী রাখা জায়েয হত, তাহলে অবশ্যই আল্লাহ তা‘আলা সেটা বর্ণনা করতেন।’ (তাফসীরে ইবনু কাছীর, ২/২০৯ পৃ.)।

▪️একজন পুরুষের জন্য একাধিক বিবাহের শর্তাবলী কি?
_______________________________________
আমি পূর্বে উল্লেখ করেছি যে, শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে একজন পুরুষের জন্য বহু বিবাহ করা শর্তসাপেক্ষে সুন্নত ও আফযল। হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের ইমামদের ঐক্যমত্য অনুসারে যার সামর্থ্য আছে তার জন্য একাধিক বিবাহ করা সুন্নত। কিন্তু বাধ্যতামূলক বা অপরিহার্য নয় (আল-মুগনী,৯/৩৪০)। তবে যে পুরুষ একাধিক বিবাহ করতে চায় সেক্ষেত্রে তার জন্য কুরআন-সুন্নাহর আলোকে আহালুল আলেমগণ দুটি শর্ত দিয়েছেন। (১). ইনসাফ রক্ষা করা (২) স্ত্রীদের ভরণ-পোষণের ক্ষমতা থাকা।
.
▪️(১). ইনসাফ রক্ষা করা: আরবী আদল’ শব্দের সমার্থক শব্দ হচ্ছে ‘ইনছাফ’ ও ‘কিসত’।যা বাংলা প্রতিশব্দরূপে, সুবিচার, ন্যায়বিচার ইত্যাদি শব্দ ব্যবহৃত হয়। আভিধানিক অর্থ হ’ল সুবিচার করা, সমান করা, নিরপেক্ষতা, বিনিময় প্রভৃতি।এক বা একাধিক স্ত্রী থাকলে স্বামীর সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ও কর্তব্য হল স্ত্রীদের অধিকার যথাযথ সংরক্ষণ করা এবং তাদের প্রতি ন্যায়বিচার করা। মহান আল্লাহ বলেন, কিন্তু যদি তোমরা আশঙ্কা কর যে, তোমরা সুবিচার করতে পারবে না, তাহলে একজনকে কিংবা তোমাদের অধীনস্থ দাসীকে; এটাই হবে অবিচার না করার নিকটবর্তী। (সূরা নিসা; ৪/৩)। এই আয়াতটি ইঙ্গিত করে যে, বহু-বিবাহ অনুমোদিত হওয়ার জন্য ন্যায়সঙ্গত অধিকার রক্ষা করা একটি শর্ত। অর্থাৎ কুরআনে চারজন স্ত্রীর কথা বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং সাথে সাথে একথাও বলে দেয়া হয়েছে যে, যদি তোমরা তাদের মধ্যে সমতা বিধান তথা ন্যায় বিচার করতে না পার, তাহলে এক স্ত্রীর উপরই নির্ভর কর। এতে বোঝা যাচ্ছে যে, একাধিক বিয়ে ঠিক তখনই বৈধ হতে পারে, যখন শরীআত মোতাবেক সবার সাথে সমান আচরণ করা হবে; তাদের সবার অধিকার সমভাবে সংরক্ষণ করা হবে। এ ব্যাপারে অপারগ হলে এক স্ত্রীর উপরই নির্ভর করতে হবে এবং এটাই ইসলামের নির্দেশ। মোটকথা যদি কোনো পুরুষ ভয় পায় যে, একাধিক বিয়ে করলে সে তার স্ত্রীদের সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত আচরণ করতে পারবে না, তাহলে তার জন্য একাধিক বিয়ে করা হারাম। আর একজন পুরুষের একাধিক স্ত্রী রাখার অনুমতির জন্য যে ন্যায়বিচার প্রয়োজন তা হলো খরচ, পোশাক, তাদের সাথে রাত্রিযাপন এবং অধীনস্থ অন্যান্য বৈষয়িক জিনিসের ক্ষেত্রে সে তার স্ত্রীদের সাথে সমান আচরণ করবে। তবে সঙ্গম, আলিঙ্গন ইত্যাদিতে সমতা রক্ষা আবশ্যক নয়। কারণ এটা নির্ভর করে ব্যক্তির সুস্থতা, উদ্যম, প্রফুল্লতা, মানসিকতা, পরিবেশ ইত্যাদির উপর। এতদসত্ত্বেও কখনো কখনো তা ওয়াজিব হয়ে যায়। অর্থাৎ সঙ্গম না করলে কোনো একজন পাপে লিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা হয়ে পড়লে তখন সঙ্গম করা আবশ্যক হয়ে যায়। আর স্বাভাবিকভাবে আবশ্যক না হলেও একেবারে পরিহার করা বৈধ নয়। (‘আওনুল মা‘বূদ ৪র্থ খন্ড, হাঃ ২১৩৩; তুহ্ফাতুল আহওয়াযী ৩য় খন্ড, হাঃ ১১৪১; মিরকাতুল মাফাতীহ)
.
▪️(২). স্ত্রীদের ভরণ-পোষণের ক্ষমতা: ইসলামী শরীয়তে বিবাহের মাধ্যমে অজানা, অপরিচিত একটি ছেলে আর মেয়ের যে বন্ধন তৈরি হয়, তার মাধ্যমে স্ত্রীর ভরণপোষণের সকল দায়িত্ব স্বামীর উপর এসে পড়ে। স্ত্রীর শোভনীয় মান অনুপাতে ভরণপোষণ নিয়মিত সরবরাহ করা স্বামীর কর্তব্য, যেন স্ত্রী নির্লিপ্তভাবে স্বামীর ঘর-সংসার পরিচালন ও সংরক্ষণ এবং সন্তান প্রসব ও লালন-পালনের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারে। এটাই বিবাহের অর্থনৈতিক গুরুত্বের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। মহান আল্লাহ বলেন, ‘সামর্থ্যবান নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যয় করবে এবং যার জীবনোপকরণ সীমিত সে আল্লাহ যা দান করেছেন তা হতে ব্যয় করবে। আল্লাহ যাকে যে সামর্থ্য দিয়েছেন তদপেক্ষা অতিরিক্ত বোঝা তিনি তার উপর চাপান না।’ (সূরা আত-ত্বালাক; ৬৫/৭)। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম শাওকানী (১১৭৩-১২৫০ হি.) বলেন, ‘এ আয়াতে আদেশ করা হয়েছে সচ্ছল অবস্থার লোকদেরকে যে, তারা দুগ্ধদায়িনী স্ত্রীদের জন্য তাদের স্বাচ্ছন্দ্য অনুপাতে বহন করবে। আর যাদের রিযিক নিম্নতম প্রয়োজন মত কিংবা সংকীর্ণ, সচ্ছল নয়, তারা আল্লাহর দেয়া রিযিক অনুযায়ী খরচ করবে। তার বেশি করার কোন দায়িত্ব তাদের নেই। (যায়নুদ্দীন ইবন নাজীম আল-হানাফী, আল-বাহরুর রায়েক শারহু কানযিক দাকাইক, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ২২৪)
.
অপরদিকে স্ত্রীদের ভরণ-পোষণের ক্ষমতা যাদের নেই তাদের সম্পর্কে অপর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, আর যাদের বিবাহের সামর্থ্য নেই আল্লাহ তাদেরকে নিজ অনুগ্রহে অভাবমুক্ত না করা পর্যন্ত তারা যেন সংযম অবলম্বন করে। (সূরা নূর-২৪/৩৩)। এই আয়াতটি প্রমাণ করে যারা অর্থ-সম্পদের দিক দিয়ে বিয়ের সামর্থ্য রাখে না যেমন, স্ত্রীর মোহর প্রদানের পর্যাপ্ত অর্থ না থাকা, ও স্ত্রীর জন্য ব্যয় করার প্রয়োজনীয় অর্থ না থাকা এবং বিয়ে করলে আশঙ্কা আছে যে, স্ত্রীর অধিকার আদায় না করার কারণে গোনাহগার হয়ে যাবে, তারা যেন পবিত্রতা ও ধৈর্যসহকারে অপেক্ষা করে, যে পর্যন্ত না আল্লাহ তা’আলা স্বীয় অনুগ্রহে তাদেরকে সম্পদশালী বানিয়ে দেন। বিয়ে করার কারণে আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে ধনাঢ্যতা দান করার ওয়াদা তখন, যখন পবিত্ৰতা সংরক্ষণ ও সুন্নাত পালনের নিয়তে তা সম্পাদন করা হয়, অতঃপর আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল ও ভরসা করা হয়। (দেখুন: তাফসীরে কুরতুবী অত্র আয়াতের তাফসির, আল-মুফাস্সাল ফী আহকাম আল-মারাহ,খন্ড ৬, পৃ.২৮৬)। আর এই ধৈর্যের জন্য হাদীসে রাসূল (ﷺ) একটি কৌশলও বলে দিয়েছেন যে, তারা বেশী পরিমানে সিয়াম পালন করবে। তারা এরূপ করলে আল্লাহ্ তা’আলা স্বীয় অনুগ্রহে তাদেরকে বিয়ের সামর্থ্য পরিমানে অর্থ-সম্পদ দান করবেন। এ প্রসঙ্গে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে যে হাদীসগুলো বর্ণিত হয়েছে সেগুলোই এ আয়াতগুলোর সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা করতে পারে। যেমন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “হে যুবকগণ! তোমাদের মধ্য থেকে যে বিয়ে করতে পারে তার বিয়ে করে নেয়া উচিত। কারণ এটি হচ্ছে চোখকে কুদৃষ্টি থেকে বাঁচাবার এবং মানুষের সততা ও চারিত্রিক পবিত্ৰতা রক্ষার উৎকৃষ্ট উপায়। আর যার বিয়ে করার ক্ষমতা নেই তার সাওম পালন করা উচিত। কারণ সাওম মানুষের দেহের উত্তাপ ঠাণ্ডা করে দেয়।”(সহীহ বুখারী হা/ ১৯০৫, সহীহ মুসলিম হা/১০১৮)
.
◾একজন স্ত্রী থাকা উত্তম নাকি একাধিক?
_______________________________________
একজন ব্যক্তির একটি বিবাহ করা উত্তম নাকি একাধিক বিবাহ করা উত্তম এই প্রশ্নের সহজ উত্তর হলো, শারীরিক, অর্থনৈতিক এবং স্ত্রীদের মাঝে ইনসাফ রক্ষার সক্ষমতা থাকলে একজন ব্যক্তির জন্য একাধিক বিবাহ করা উত্তম। কেননা এতে একদিকে যেমন জন্মহার বৃদ্ধির মাধ্যমে একটি জাতি বৃহৎ জাতিকে পরিণত হয়ে উম্মতে মুহাম্মদীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে অপরদিকে একজন স্ত্রীর প্রতি ইহসান, শিক্ষাদান ও ভরণ-পোষণের ফলে যে নেকী অর্জিত হয়, একাধিক স্ত্রীর ক্ষেত্রে শরীয়তের বিধান অনুযায়ী ইনসাফ বজায় রাখলে সেই একই অনুপাতে নেকী বেশী হয়। রাসূলুল্লাহ রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘তোমরা অধিক সোহাগিনী ও অধিক সন্তানদায়িনী মহিলাকে বিবাহ কর। কারণ আমি ক্বিয়ামতের দিন তোমাদের সংখ্যাধিক্য নিয়ে গর্ব করব।’ (আবু দাঊদ হা/২০৫০; মিশকাত হা/৩০৯১ সনদ সহীহ)। আর পরিবারের জন্য খরচকৃত অর্থের ফযীলত অনেক বেশী। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, أَفْضَل دِيْنَارٍ يُنْفِقُهُ الرَّجُلُ دِيْنَارٌ يُنْفِقُهُ عَلَى عِيَالِهِ، ‘উত্তম হলো ঐ দীনার যা কোন ব্যক্তি তার পরিবার-পরিজনের জন্য খরচ করে।’ (সহীহ মুসলিম হা/৯৯৪; মিশকাত হা/১৯৩২)। রাসূল (ﷺ) আরো বলেছেন, إِذَا أَنْفَقَ الرَّجُلُ عَلَى أَهْلِهِ يَحْتَسِبُهَا فَهُوَ لَهُ صَدَقَةٌ. ‘কোন ব্যক্তি স্বীয় পরিবার-পরিজনের জন্য পূণ্যের আশায় যখন ব্যয় করে তখন সেটা তার জন্য সাদাক্বা হয়ে যায়।’(সহীহ বুখারী হা/৫৫)। এমনকি কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীকে যে পানি পান করায় তার জন্যও তার নেকী রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, إِنَّ الرَّجُلَ إِذَا سَقَى امْرَأَتَهُ مِنَ الْمَاءِ أُجِرَ. ‘নিশ্চয়ই কোন ব্যক্তি যখন তার স্ত্রীকে পানি পান করায় তখন সে তার বিনিময়ে সওয়াব পায়।’(মুসনাদ হা/১০১৩২; সহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/১৯৬৩)। কিন্তু যদি শারীরিক, অর্থনৈতিক এবং স্ত্রীদের মাঝে ইনসাফ রক্ষা করার সক্ষমতা না থাকে অর্থাৎ উপরোক্ত শর্তাবলী পূরণে অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য একজন স্ত্রীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকাই উত্তম। কারণ দায়িত্ব অনেক কঠিন জিনিস। যা অবহেলা করলে কেয়ামতে মহান আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘…তাহলে অন্য মেয়েদের মধ্য থেকে যাদের তোমরা ভাল মনে কর দুই, তিন বা চারটি পর্যন্ত বিবাহ করতে পার। কিন্তু যদি তোমরা তাদের মধ্যে ন্যায়বিচার করতে পারবে না বলে ভয় কর, তাহলে মাত্র একটি বিবাহ কর…।’(সূরা নিসা; ৪/০৩)। হাদীসে রাসূল (ﷺ) বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রত্যেক দায়িত্বশীলকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। সে তা সংরক্ষণ করেছে, না তাতে অবহেলা করেছে? এমনকি পুরুষকে তার স্ত্রী (পরিবার-পরিজন) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।’(নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা হা/৯১৭৪; সিলসিলা সহীহাহ হা/১৬৩৬; সহীহুল জামে‘ হা/১৭৭৪)

◾একাধিক বিবাহের ক্ষেত্রে স্ত্রীদের অধিকার আদায়ে অবহেলার পরিণতি কি?
_____________________________________
ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে যদিও পুরুষগণ নারীদের উপর কর্তৃত্বশীল (সূরা আন-নিসা; ৩৪), তবুও মানুষ হিসাবে সমান অধিকার সকলের। একাধিক বিবাহের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ সকল পুরুষকে সতর্ক করে বলেন,“আর তোমরা যতই কামনা কর না কেন তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে সমান আচরণ করতে কখনো পারবে না। সুতরাং তোমরা (একজনের প্রতি) সম্পূর্ণরূপে ঝুঁকে পড়ো না, যার ফলে তোমরা (অপরকে) ঝুলন্তের মত করে রাখবে। আর যদি তোমরা মীমাংসা করে নাও এবং তাকওয়া অবলম্বন কর তবে নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”(সূরা নিসা; ৪/১২৯)। এই আয়াতে যে আদল বা ইনসাফের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে,“আর তোমরা যতই ইচ্ছে কর না কেন তোমাদের স্ত্রীদের প্রতি ইনসাফ বা সার্বিক সমান ব্যবহার করতে কখনই পারবে না” সেটা হচ্ছে, ভালবাসা ও স্বাভাবিক মনের টান। কেননা, কোন মানুষই দু’জনকে সবদিক থেকে সমান ভালবাসতে পারে না। কারণ ভালোবাসা হলো অন্তরের কাজ যা কোন মানুষের এখতিয়ারাধীন নয়। কোনো ব্যক্তির একাধিক স্ত্রী থাকলে তাদের কারো বিশেষ কিছু গুণাবলীর কারণে তার প্রতি স্বামীর অধিক ভালোবাসা থাকা স্বাভাবিক। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। আমরা জানি রাসূল (ﷺ)-এর স্ত্রীদের মধ্যে আম্মাজান আয়েশা (রাযীআল্লাহু আনহা)র প্রতি সব চেয়ে বেশী ভালোবাসা ছিল। যেমন: একদা হাদিয়া সংক্রান্ত বিষয়ে রাসূল (ﷺ) আম্মাজান উম্মু সালামাহ্ (রা:) কে উদ্দেশ্য করে বলেন, উম্মু সালামাহ্! আয়িশাহ’র সম্পর্কে তুমি আমাকে কষ্ট দিয়ো না। কেননা একমাত্র ‘আয়িশাহ্ ছাড়া আর কোন স্ত্রীর সাথে এক কাপড়ে থাকা কালে আমার কাছে ওয়াহী আসেনি। (সহীহ বুখারী হা/২৫৮১, মিশকাত হা/৬১৮৯) সুতরাং, ভালবাসা এটা মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আর এটা ইনসাফের পরিপন্থীও নয়। তবুও রাসূল (ﷺ) এ বিষয়ে আল্লাহকে ভয় করতেন এবং নিজের অপারগতা প্রকাশ করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর কাছে এই বলে প্রার্থনা করতেন, ‘‘হে আল্লাহ! স্ত্রীদের মাঝে ইনসাফ করা বা বাহ্যিক সমতা রক্ষা করা যেহেতু আমার আয়ত্তাধীন, আমি তা করছি, কিন্তু কোনো স্ত্রীর প্রতি হৃদয়ের টান বা অধিক ভালোবাসা এটা আমার আয়ত্তের বাহিরে। হে আল্লাহ! তুমিই তো মানুষের কলব বা হৃদয় পরিবর্তনের মালিক, সুতরাং তুমি যে বিষয়ের মালিক সে বিষয় তুমি আমার অপরাধ ধরো না এবং আমাকে তিরস্কার ও ভৎর্সনা করো না।’’(তুহফাতুল আহওয়াযী ৩য় খন্ড, হাঃ ১১৪০; ফাতহুল কাদীর ৩য় খন্ড, ৩০০পৃঃ)।
.
অতএব, আয়াতে চাওয়া সত্ত্বেও সুবিচার না করতে পারার অর্থই হলো, আন্তরিক টান এবং ভালোবাসায় অসমতা। আন্তরিক এই ভালোবাসা যদি বাহ্যিক অধিকারসমূহে সমতা বজায় রাখার পথে বাধা না হয়, তাহলে তা আল্লাহর নিকট পাকড়াও যোগ্য হবে না।
কিন্তু শরীআত নির্ধারিত অধিকার যেমন, রাত্রী যাপন, সহবাস, ভরণপোষণ ইত্যাদির ব্যাপারে ‘আদল’ অবশ্যই করা যায় এবং করতেই হবে। সেটা না করতে পারলে তাকে একটি বিয়েই করতে হবে অন্যথায় গুণাহগার হবে। যার কথা এ সূরারই অন্য আয়াতে বলা হয়েছে যে, ‘আর যদি তোমরা আদল বা সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে না পার, তবে একটি স্ত্রীতেই সীমাবদ্ধ থাক।’(তাফসীরে আদওয়াউল বায়ান)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর প্রত্যেক স্ত্রীর জন্য একটি দিন ও রাত নির্ধারিত করতেন। অবশ্য সাওদা বিনতু যাম‘আ (রাঃ) ব্যতীত। কেননা তিনি (বার্ধক্যের কারণে) তাঁর পালার দিনটি আয়েশা (রাঃ)-এর জন্য দান করেছিলেন।(আবুদাঊদ হা/২১৩৮) সুতরাং, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাধিক স্ত্রীর বেলায় সবার সাথে পরিপূর্ণ সমতার ব্যবহার করার ব্যাপারে বিশেষ তাকিদ দিয়েছেন এবং যারা এর খেলাফ করবে, তাদের জন্য কঠিন শাস্তির খবর দিয়েছেন।আর যে ব্যক্তি একাধিক স্ত্রীর অধিকারের ব্যাপারে উপরিউক্ত নীতি অবলম্বন করবে না এবং তাদের মধ্যে ন্যায়বিচার করবে না, ক্বিয়ামতের দিন তাদের পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। হাদীসে এসেছে, আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যে ব্যক্তির দুই স্ত্রী রয়েছে, সে যদি এদের মধ্যে ব্যবহারের ক্ষেত্রে পূর্ণ সমতা ও ইনসাফ করতে না পারে, তবে কিয়ামতের ময়দানে সে এমনভাবে উঠবে যে, তার শরীরের এক পার্শ্ব অবশ হয়ে থাকবে। (আবু দাউদ; ২১৩৩, তিরমিযী হা/১১৪১, ইবন মাজাহ হা/১৯৬৯, মিশকাতুল মাসাবিহ হা/৩২৩৬)। অপর বর্ণনায় রাসূল (ﷺ) আরো বলেছেন, যার দু’জন স্ত্রী আছে, আর সে তাদের একজনের চেয়ে অপরজনের প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়ে, সে ক্বিয়ামতের দিন তার (দেহের) এক পার্শ্ব পতিত অবস্থায় উপস্থিত হবে।’(নাসাঈ হা/৩৯৪২; ইরওয়া হা/২০১৭, সনদ সহীহ)। দুটি হাদীসের মর্ম হলো, যার দুই বা ততোধিক স্ত্রী থাকবে তার জন্য ওয়াজিব স্ত্রীদের খাদ্য বস্ত্র এবং তাদের কাছে রাত্রিযাপনে ন্যায়বিচার বা সমতা রক্ষা করা। যে এটা করবে না, সে গুনাহগার হবে। হাদীসে বলা হয়েছে, সে কিয়ামতের দিন একদিকে অবশ তথা প্যারালাইসিসগ্রস্ত হয়ে উঠবে। কেউ কেউ বলেছেন, হাশরের ময়দানের লোকেরা তাকে এ অবস্থায় দেখতে থাকবে, ফলে এটা হবে তার জন্য লজ্জাকর ব্যাপার এবং বেশী শাস্তি। হাদীসে দু’জন স্ত্রীর কথা বলা হয়েছে, কিন্তু দু’জন এখানে সীমাবদ্ধ নয়, তিন বা চারজন স্ত্রীর বেলায়ও সমতা রক্ষা আবশ্যক, অন্যথায় তার বেলায়ও একই শাস্তি প্রযোজ্য হবে। (আওনুল মা‘বূদ ৪র্থ খন্ড, হাঃ ২১৩৩; তুহ্ফাতুল আহওয়াযী ৩য় খন্ড, হাঃ ১১৪১)
.
পরিশেষে উপরোক্ত আলোচনার সারমর্ম হিসেবে পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, একজন আদর্শ স্বামী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে পারিবারিক জীবনে রাসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আদর্শই আপনার আদর্শ হতে হবে। একাধিক বিবাহের ক্ষেত্রে অবশ্যই স্ত্রীদের প্রতি ইনসাফপূর্ণ আচরণ এবং ভরণপোষণের বিষয় দায়িত্বশীল হতে হবে। দায়িত্বশীল না হয়ে একাধিক বিবাহ করার পরিণতি কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুস্পষ্টভাবে আমাদেরকে জানিয়ে গিয়েছেন। সুতরাং ‘সাবধান।’ রাসূল (ﷺ) বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রত্যেক দায়িত্বশীলকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। সে তা সংরক্ষণ করেছে, না তাতে অবহেলা করেছে? এমনকি পুরুষকে তার স্ত্রী (পরিবার-পরিজন) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।’(নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা হা/৯১৭৪; সিলসিলা সহীহাহ হা/১৬৩৬;সহীহুল জামে‘ হা/১৭৭৪)। আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক মুমিনা নারীদের স্বামীকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মত একজন আদর্শ স্বামী হিসাবে কবুল করুন। আমীন!! (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
____________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি