হাদিস থেকে বাছাইকৃত উচ্চারণ ও অর্থসহ গুরুত্বপূর্ণ ৩০ টি দুআর মধ্যে ২৮তম দুআ

কবর যিয়ারত করতে গিয়ে দলিল বিহীন বিদআতি দু’আ না পড়ে বরং বিশুদ্ধ হাদীসের উপর আমল করে এই দু’আটি পড়ুন।
▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: সবকিছু অনিশ্চিত হলেও আপনার আমার মৃত্যু সুনিশ্চিত। প্রত্যেক জীবকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। জন্ম ও মৃত্যু একটি অন্যটির সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। দু’টির কোনটির ক্ষমতা মানুষের হাতে নেই। আল্লাহর হুকুমেই জন্ম হয়। আল্লাহর হুকুমেই মৃত্যু হয়। কখন হবে,কোথায় হবে, কিভাবে হবে, তা কারো জানা নেই। জীবনের সুইচ তাঁরই হাতে, যিনি জীবন দান করেছেন।সুতরাং জাগতিক জীবনের মূল্যহীনতা প্রসঙ্গে ধারণা ও উপদেশ গ্রহণ, মৃত্যু, আখিরাত বা পরকালকে স্মরণ এবং মৃতব্যক্তির জন্য দুআ করার উদ্দেশ্যে মহিলা ব্যতীত শুধু পুরুষের জন্য কবর যিয়ারত করা সুন্নাত বা মুস্তাহাব। উপদেশ গ্রহণ করা ও আখিরাতকে স্মরণ করার জন্য কবর যিয়ারত করা শরিয়তে অনুমোদিত। শর্ত হলো কবরস্থান যিয়ারতের সময় এমন কোন কথা বলা যাবে না যা রব্বকে রাগান্বিত করে। যেমন- আল্লাহ্‌কে বাদ দিয়ে কবরস্থ ব্যক্তির কাছে দোয়া করা, তার কাছে বিপদ দূর করার জন্য সাহায্য চাওয়া কিংবা কবরস্থ ব্যক্তিকে সত্যায়ন করা এবং তার জন্য জান্নাত অবধারিত মর্মে নিশ্চিত করা ইত্যাদি। কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্য দুইটি:
.
(ক). যিয়ারতকারী মৃত্যু ও মৃতদেরকে স্মরণ করে উপকৃত হওয়া এবং এটা জানা যে, সকলের চূড়ান্ত গন্তব্য জান্নাত কিংবা জাহান্নাম। এটাই যিয়ারতের প্রধান উদ্দেশ্য।
.
(খ). মৃতব্যক্তির উপকার করা। সালাম দিয়ে, দোয়া ও ইস্তিগফার করে তার প্রতি ইহসান করা। এটি মুসলমানদের জন্য খাস। কবর যিয়ারতের দু’আগুলোর মধ্যে অন্যতম সুন্দর অর্থবহ পরিপূর্ণ একটি দু’আ ইমাম মুসলিম বুরায়দাহ (রাঃ) থেকে এবং অপর বর্ননা আম্মাজান আয়শা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) বর্ননা করেছেন।প্রখ্যাত সাহাবী বুরায়দাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেন,রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে ক্ববরস্থানে গেলে এই দু’আ পড়তে শিখিয়েছেন। দু’আটির মূল আরবি হচ্ছে:
.
السَّلامُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الدِّيارِ من المؤمنينَ والمُسْلمينَ، إن شاءَ اللهُ بِكُمْ لَاحِقُوْنَ، وَيَرْحَمُ اللّٰهُ الْمُسْتَقْدِمِيْنَ مِنَّا وَالْمُسْتَأْخِرِيْنَ
أَسْأَلُ اللهَ لَنَا وَلَكُمُ الْعَافِيةَ
.
মোটামুটি উচ্চারণ:আসসালা-মু আলাইকুম আহলাদ্দিয়া-রি মিনাল মু’মিনীনা অলমুসলিমীন, অইন্না ইনশা-আল্লা-হু বিকুম লালা-হিক্বূন,ওয়া ইয়ারহামুল্লাহুল মুসতাক্বদিমীনা মিন্না ওয়াল মুসতা’খিরীনা, আসআলুল্লা-হা লানা অলাকুমুল আ-ফিয়াহ।(আরবির সঠিক উচ্চারণ বাংলায় লেখা কোনোভাবেই শতভাগ সম্ভব নয়; তাই আরবি টেক্সট মিলিয়ে পড়ার চেষ্টা করুন,পাশাপাশি আরবির সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে পড়ুন, না হয় ভুল শিখতে হবে) কমেন্ট থেকে ভিডিও দেখে শিখতে পারেন ইনশাআল্লাহ।
.
অর্থ: “কবরবাসী মুমিন ও মুসলিমগণ! আপনাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। ইনশাআল্লাহ্‌, আপনাদের সাথে মিলিত হব।আল্লাহ আমাদের পুর্ববর্তীদের এবং পরবর্তীদের প্রতি দয়া করুন।আমি আমাদের জন্য এবং আপনাদের জন্য নিরাপত্তার দোয়া করছি”।(সহীহ মুসলিম হা/ ৯৭৫,নাসায়ী হা/ ২০৪০, ইবনু মাজাহ্ হা/১৫৪৭, মুসনাদে আহমাদ হা/ ২২৯৮৫, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী হা; ৭২১২, মিশকাতুল মাসাবিহ, হা/১৭৬৪)
.
এবার এভাবে আরবী এবং বাংলা উচ্চারণসহ সহজে মুখস্থ করুন:
.
السَّلامُ عَلَيْكُمْ
(আসসালা-মু আলাইকুম) অর্থ: আপনাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক।
.
أَهْلَ الدِّيارِ
(আহলাদ্দিয়া-রি) অর্থ: (হে) কবরবাসীগন
.
من المؤمنينَ والمُسْلمينَ،
(মিনাল মু’মিনীনা অলমুসলিমীন) অর্থ: মুমিন ও মুসলিমগণ!
.
إن شاءَ اللهُ
(ইনশাআল্লাহ্) অর্থ: আল্লাহ চাহে তো,
.
بِكُمْ لَاحِقُوْنَ،
(বিকুম লালা-হিক্বূন) অর্থ: আপনাদের সাথে মিলিত হব,
.
وَيَرْحَمُ اللّٰهُ
(ওয়া ইয়ারহামুল্লাহু-) অর্থ: এবং আল্লাহ রহম করুন।
.
الْمُسْتَقْدِمِيْنَ مِنَّا وَالْمُسْتَأْخِرِيْنَ
(মুসতাক্বদিমীনা মিন্না ওয়াল মুসতা’খিরীনা) অর্থ: আল্লাহ আমাদের পুর্ববর্তীদের এবং পরবর্তীদের প্রতি,
.
أَسْأَلُ اللهَ لَنَا
(আসআলুল্লা-হা লানা) অর্থ: আমি আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য প্রার্থনা করছি।
.
وَلَكُمُ الْعَافِيةَ
(অলাকুমুল আ-ফিয়াহ) অর্থ: এবং আপনাদের জন্য নিরাপত্তার (দু’আ করছি)।
.
প্রিয় পাঠক! কবর যিয়ারতের উপরোক্ত দু’আটি অতি ছোট্ট এবং খুবই সুন্দর। তাই কবর যিয়ারতের সময় বিদআতী কিংবা দলিল বিহীন দু’আ পাঠ না করে এই দু’আটি মুখস্থ করে নিন।পাশাপাশি আরো কয়েকটি বিষয় জেনে নিন আর তা হচ্ছে,
.
(১) শুধুমাত্র কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে কোথাও সফর করা যাবে না।এমনকি রাসূল (ﷺ)-এর কবর যিয়ারতের জন্যও নয়।কারন রাসূল (ﷺ) বলেন, সফরের জন্য বের হবে না তিনটি মসজিদের উদ্দেশ্যে ব্যতীত। মাসজিদুল হারাম, মাসজিদুল আক্বসা এবং আমার এই মসজিদ অর্থাৎ মসজিদে নববী। (সহীহ বুখারী হা/১১৮৯; মুসলিম হা/১৩৯৭) তবে অন্য উদ্দেশ্যে কোথাও সফর করলে এবং সেখানে কবর থাকলে উক্ত কবর যিয়ারত করাতে কোন বাধা নেই।
.
(২) মহিলারা কবর যিয়ারত করতে পারবে কিনা এই ব্যপারে ওলামাদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। কারন এই মর্মে দুই রকম বর্ননা পাওয়া যায়।তবে বর্ননা গুলো সমন্বয় করে জমহুর ওলামাদের বিশুদ্ধ মত হল মহিলাদের জন্য কবর যিয়ারত করা এবং যিয়ারতের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হওয়া হারাম এবং কবীরা গোনাহ। কারণ,নারীদের এমনিতেই ধৈর্য ও সহ্য শক্তি কম। তাছাড়া তারা যিয়ারতে গিয়ে শরীয়ত-বিরোধী কাজ অধিক করতে পারে। যেমন; চেঁচামেচি ও উচ্চস্বরে কান্নাকাটি পর্দাহীনতার সাথে যিয়ারতে যাওয়া,অভ্যাসগত ভাবে কবরস্থান বেড়াতে যাওয়া। (পার্ক মনে করে নেবে।) সেখানে বসে ফালতু আড্ডা দিয়ে বাজে কথাবার্তা ইত্যাদি বলা।যা কিছু মুসলিম দেশে এর বাস্তব উদাহরণ বর্তমান। তাই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মহিলাদের কবর যিয়ারাত অপছন্দ করেছেন।আবু হুরাইরা (রাঃ)থেকে বর্নিত তিনি বলেন,কবর যিয়ারাতকারী মহিলাদের রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অভিসম্পাত করেছেন।(তিরমিজি, ১০৫৬ ইবনে মাজা১৫৭৬)। তবে নারীদের জন্য কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হওয়া নিষিদ্ধ হলেও কবর যিয়ারতের নিয়্যত ছাড়া জরুরি প্রয়োজনে কোথাও যাওয়ার পথে কোনো মহিলা যদি কবরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে,তাহলে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কবরবাসীদের জন্য দো‘আ করলে কোন সমস্যা নেই। সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা)–এর হাদীসে এমনই ইঙ্গিত পাওয়া যায়।আয়েশা (রাঃ) তার ভাই আব্দুর রহমান বিন আবুবকর (রাঃ)-এর কবর যিয়ারত করার সময় তাকে বলা হ’ল রাসূল (ﷺ) কি কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেননি? তিনি বললেন,হ্যাঁ নিষেধ করেছিলেন। তবে পরে তিনি কবর যিয়ারত করার অনুমতি দিয়েছেন।(মুস্তাদরাক হাকেম হা/১৩৯২; আবু ইয়া‘লা হা/৪৮৭১ ইরওয়া হা/৭৭৫; ইবনু মাজাহ হা/১৫৭০, সনদ সহীহ)
.
(৩) কবর যিয়ারাতের দুআ পাঠ করার সময় একাকী দুই হাত উত্তোলন করা জায়েয। কেননা আম্মাজান আয়শা থেকে এই মর্মে বিশুদ্ধ হাদীস রয়েছে যে রাসূল (ﷺ) বাক্বী আল-গারক্বাদ গিয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে দু’আ করার সময় একাকী তিন বার হাত উঠিয়েছিলেন।(দেখুন সহীহ মুসলিম হা/২৩০১,জানায়েয’ অধ্যায়-৫, অনুচ্ছেদ-৩৫; ঐ, মিশকাত হা/১৭৬৬) তবে দু’আ করার সময় কবরগুলোকে সামনে রাখবেন না। বরং কা’বাকে সামনে রাখবেন। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবরের দিকে ফিরে নামায পড়তে নিষেধ করেছেন। আর দোয়া হচ্ছে- নামাযের মগজ; যা সুপরিজ্ঞাত। সুতরাং নামাযের যা হুকুম দু’আরও তা হুকুম। এছাড়া মুসলমানদের কবরগুলোর মাঝে জুতা নিয়ে হাঁটবেন না। তবে প্রয়োজন দেখা দিলে ভিন্ন কথা।(দেখুন সুনানে ইবনে মাজাহ হা/১৫৬৭)
.
(৪) কবর যিয়ারতের জন্য নির্দিষ্ট কোন দিন তারিখ খাস করা যাবে না। বরং যেকোন দিন কবর যিয়ারত করা যায়। জুম‘আর দিন কবর যিয়ারতের ফযীলত সম্পর্কে যে হাদীস বর্ণিত হয়েছে তা জাল। (সিলসিলা যঈফাহ হা/৪৯-৫০; বায়হাক্বী, শো‘আবুল ঈমান মিশকাত হা/১৭৬৮ ‘কবর যিয়ারত’ অনুচ্ছেদ)।
.
(৫) অমুসলিম কাফির-মুশরিক পিতা-মাতার কবর যিয়ারত করা যাবে। তাদের জন্য ক্রন্দন করাও যাবে। কেননা এর মাধ্যমে মৃত্যুকে স্মরণ করা হয়। কিন্তু সেখানে গিয়ে তাদের উদেশ্যে সালাম করা যাবে না। তাদের জন্য আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করা যাবে না। রাসূল (ﷺ)-কে তাঁর মায়ের কবর যিয়ারতের জন্য অতটুকুই মাত্র অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। দু’আ করার অনুমতি দেওয়া হয়নি যেমন,আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃতিনি বলেন, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একবার নিজের মায়ের ক্ববরে গেলেন। সেখানে তিনি নিজেও কাঁদলেন এবং তাঁর আশপাশের লোকদেরকেও কাঁদালেন। তারপর বললেন, আমি আমার মায়ের জন্য মাগফিরাত কামনা করতে আল্লাহর কাছে অনুমতি চাইলাম। কিন্তু আমাকে অনুমতি দেওয়া হলো না। তারপর আমি আমার মায়ের ক্ববরের কাছে যাওয়ার অনুমতি চাইলাম। আমাকে অনুমতি দেয়া হলো। তাই তোমরা ক্ববরের কাছে যাবে। কারণ ক্ববর মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দেয়। (সহীহ মুসলিম হা/ ৯৭৬, আবূ দাঊদ হা/ ৩২৩৪, ইবনু মাজাহ হা/১৫৭২,মিশকাত হা/১৭৬৩)
.
বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, সৌদি ফাতাওয়া বোর্ডের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতী, শাইখুল ইসলাম,ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] কে প্রশ্ন করা হয় কাফেরদের কবর যিয়ারত করা কি জায়েজ?
.
উত্তরে তিনি বলেন, শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্য হলে এতে কোন সমস্যা নেই। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মায়ের কবর যিয়ারত করেছেন। তিনি তাঁর রবের কাছে তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার অনুমতি চাইলে অনুমতি দেন নি। তবে কেবল কবর যিয়ারত করার অনুমতি দেয়া হয়েছে।”(মাজমু ফাতাওয়া ওয়া মাকালাত, ১৩/৩৩৭) আমরা আল্লাহর কাছে দু’আ করছি, তিনি যেন আমাদের মৃত ব্যক্তিদেরকে এবং মুসলমানদের মৃতব্যক্তিদেরকে ক্ষমা করে দেন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
________________________
আপনাদের দ্বীনি ভাই:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।