সাহরী

প্রশ্ন: সাহরী শব্দের অর্থ কি? রামাদানে সেহরীর সময় কখন শুরু হয় এবং ফজরের আযানের কতক্ষণ পূর্বে সাহরী খাওয়া শেষ করতে হবে? সাহরীতে সুন্নাহ সম্মত খাবার কি? সাহরী সংক্রান্ত যে মাসআলাগুলো জেনে রাখা ভালো।
▬▬▬▬▬▬▬▪️🌻▪️▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: ‘সাহরী’ আরবি শব্দ। আরবি ভাষায় সাহরীর অর্থ হলো শেষ রাত বা ঊষা ইত্যাদি। শরীয়তের পরিভাষায় মাহে রমাদানের সিয়াম রাখার নিয়তে শেষ রাতের পূর্ব মুহূর্তের খাবারকেই সাহরী বলে। আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, تَسَحَّرُوا فَإِنَّ فِي السَّحُورِ بَرَكَةً তোমরা সাহুর (সাহরি) করো, কারণ সাহুরে (সাহরিতে) বরকত রয়েছে। (সহীহ বুখারী, হা/১৯২৩, সহীহ মুসলিম, হা/১০৯৫)। উক্ত হাদীসে ভোর রাতের খাবার বুঝাতে ‘সাহুর’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু বাংলা ভাষায় তা সেহেরি/সাহরি/সেহরি ব্যবহৃত হয়। হাদীসের ব্যাখ্যায় সিন্দী বলেন; সাহরি খাওয়ার মধ্যে বারাকাত আছে। অর্থাৎ- এতে সাওয়াব আছে এজন্য যে, এ সময় দু‘আ ও জিকির করা হয়। আর সেহরী খাওয়ার মধ্যে সিয়াম পালনের শক্তি অর্জিত হয়।
.
▪️সাহরি খাওয়ার হুকুম এবং সঠিক সময়:
_______________________________________
মুসলিম উম্মাহর আহালুল আলেমগণের সর্বসম্মতিক্রমে সিয়াম পালনের জন্য সাহরি খাওয়া মুস্তাহাব এবং যে ব্যক্তি তা ইচ্ছাকৃত তা ত্যাগ করে সে গোনাহগার নয়। এমনকি সিয়াম শুদ্ধ হওয়ার জন্য সাহরি খাওয়া শর্ত নয়। তবে অবশ্যই সাহরি খাওয়া উত্তম। অনেকে সাহরি না খেয়ে রোজা রাখাটা অভ্যাসে পরিণত করেছেন। এটা করা উচিত নয়। ইচ্ছা করে সাহরি না খেয়ে রোজা রাখা মাকরুহ (অপছন্দনীয়), যদিও রোজা আদায় হয়ে যাবে। তাছাড়া, বিশেষ কোনো কারণে ভোর রাতে সাহরি খেতে উঠতে না পারলেও নিয়ত ঠিক থাকলে রোজার কোনো ক্ষতি হবে না। সাহরি খাওয়া যে উত্তম তা প্রকাশ করার জন্য মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) উম্মতকে বিভিন্ন কথার মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি সাহরিকে বরকতময় খাদ্য বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘তোমরা সাহরি খাও। কারণ, সাহরিতে বরকত আছে।” (সহীহ বুখারী হা/১৮২৩, সহীহ মুসলিম হা/১০৯৫)। রাসূল (ﷺ) আরো বলেছেন; ‘‘আমাদের রোযা ও আহলে কিতাবের রোযার মাঝে পার্থক্য হলো সাহরি খাওয়া।” (সহীহ মুসলিম হা/১০৯৬, আবু দাঊদ হা/২৩৪৩, তিরমিযী হা/৭০৯, মিশকাত হা/১৯৮৩)
.
সাহরি না খেয়ে রোযা রাখা কি জায়েয হবে কিনা এমন প্রশ্ন বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.]-কে জিজ্ঞেস করা হলে জবাবে শাইখ বলেছেন, সিয়াম শুদ্ধ হওয়ার জন্য সাহরি খাওয়া শর্ত নয়। বরং সাহরি খাওয়া মুস্তাহাব। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “তোমরা সাহরি খাও; কারণ সাহরিতে বরকত রয়েছে।” (সহীহ বুখারী হা/১৮২৩, ইমাম বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড/৪; পৃষ্ঠা:২৫৯)
.
সাহরি খাওয়ার স্বাভাবিক সময় হল অর্ধরাত্রির পর থেকে ফজরের আগে পর্যন্ত। আর মুস্তাহাব বা সঠিক সময় হল, ফজর হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা না হলে শেষ সময়ে সেহরী খাওয়া। আনাস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, যায়দ বিন সাবেত রাঃ তাঁকে জানিয়েছেন যে, তাঁরা নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সাথে সাহরি খেয়ে (ফজরের) নামায পড়তে উঠে গেছেন। আনাস বলেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম- ‘সাহরি খাওয়া ও আযান হওয়ার মধ্যে কতটুকু সময় ছিল?’ উত্তরে যায়দ বললেন, “পঞ্চাশ অথবা ষাটটি আয়াত পড়তে যতটুকু লাগে।” (সহীহ বুখারী হা/৫৭৫, ১৯২১, মুসলিম হা/১০৯৭, তিরমিযী হা/৭০৩)। উক্ত হাদীসে আয়াত বলতে মধ্যম ধরনের আয়াত গণ্য হবে। আর এই শ্রেণীর ৫০/৬০টি আয়াত পড়তে মোটামুটি ১৫/২০ মিনিট সময় লাগে। অতএব সুন্নত হলো, আযানের ১৫/২০ মিনিট আগে সাহরি খাওয়া। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর সাহাবাগণ খুব তাড়াতাড়ি (সময় হওয়া মাত্র) ইফতার করতেন এবং খুব দেরী করে সাহরি খেতেন। (বাইহাকী ৪/২৩৮, মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবাহ হা/৮৯৩২, সহীহুল জামে হা/৩৯৮৯)। সুতরাং সাহরি আগে আগে খেয়ে ফেলা উচিৎ নয়। মধ্য রাতে সাহরি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়া তো মোটেই উচিৎ নয়। কারণ, তাতে ফজরের নামায ছুটে যায়। ঘুমিয়ে থেকে হয় তার জামাআত ছুটে যায়। নচেৎ, নামাযের সময় চলে গিয়ে সূর্য উঠার পর চেতন হলে নামাযটাই কাযা হয়ে যায়। নাঊযু বিল্লাহি মিন যালিক। আর নিঃসন্দেহে এটি একটি বড় মসীবত; যাতে বহু রোযাদার ফেঁসে থাকে। আল্লাহ তাদেরকে হেদায়াত করুন।
.
▪️কোন ধরনের খাবার দিয়ে সাহরি খাওয়া উত্তম:
_______________________________________
শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে অল্প-বিস্তর যে কোন খাবার খেলেই সাহরি খাওয়ার বিধি পালিত হয়ে যাবে। এমনকি কেউ যদি এক ঢোক দুধ, চা অথবা পানিও পান করে অথবা ২/১টি বিস্কুট বা খেজুরও খায়, তাহলে তারও সাহরি খাওয়ার সুন্নত পালন হয়ে যাবে। আর এই সামান্য পরিমাণ খাবারেই রোযাদার এই বিরাট ফরজ সিয়াম পালনের মাধ্যমে মহান আল্লাহর আনুগত্য করতে শক্তি পাবে এবং ফিরিশ্তাবর্গ তার জন্য দুআ করবে। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন; ‘‘সাহরি খাওয়াতে বরকত আসে। সুতরাং তোমরা তা খেতে ছেড়ো না; যদিও তাতে তোমরা এক ঢোক পানিও খাও। কেননা, যারা সাহরি খায় তাদের জন্য আল্লাহ রহমত বর্ষণ করেন এবং ফিরিশ্তা দুআ করতে থাকেন।’’ (ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ: ১১০৮৬; সহীহুল জামেইস সাগীর হা/৩৬৮৩)। রাসূল (ﷺ) আরো বলেন, ‘‘তোমরা সাহরি খাও; যদিও এক ঢোক পানি হয়।” (সহীহুল জামেই সাগীর হা/২৯৪৫)। আবু হুরাইরা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন; ‘‘মুমিনের শ্রেষ্ঠ সাহরি হল খেজুর।’’ (আবু দাঊদ হা/২৩৪৫, সিলসিলাহ সহীহাহ হা/৫৬২)। অবশ্য সাহরি খাওয়াতে বাড়াবাড়ি করা উচিৎ নয়। কারণ, বেশী পানাহার করার ফলে ইবাদত ও আনুগত্যে আলস্য সৃষ্টি হয়। কিছু লোক আছে, যারা গলায় গলায় ভ্যারাইটিজ পানাহার করে এমনভাবে পেট পূর্ণ করে নেয় যে, মনে হয় তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। যার ফলে ফজরের নামাযে বড় আলস্য ও শৈথিল্যের সাথে উপস্থিত হয় এবং মসজিদে আল্লাহর যিকরের জন্যও সামান্য ক্ষণ বসতে সক্ষম হয় না। আর দিনের বেলায় পেটের বিভিন্ন প্রকার সমস্যার শিকার হয়। অথচ মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন! ‘‘উদর অপেক্ষা নিকৃষ্টতর কোন পাত্র মানুষ পূর্ণ করে না। আদম সন্তানের জন্য ততটুকুই খাদ্য যথেষ্ট, যতটুকুতে তার পিঠ সোজা করে রাখে। আর যদি এর চেয়ে বেশী খেতেই হয় তাহলে যেন সে তার পেটের এক তৃতীয়াংশ আহারের জন্য, এক তৃতীয়াংশ পানের জন্য এবং অন্য আর এক তৃতীয়াংশ শবাস-প্রশবাসের জন্য ব্যবহার করে।’’ (তিরমিযী হা/২৩৮০, ইবনে মাজাহ হা/ ৩৩৪৯, সিলসিলাহ সহীহাহ হা/২২৬৫)
.
▪️সাহরি খাওয়ার সময় ফজর উদয় হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ হলে করণীয় কি?
___________________________________
এটি একটি মতানৈক্য পণ্য মাসালা তবে বিশুদ্ধ কথা হল, ফজর উদয় হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ হলে রোযাদার ততক্ষণ পর্যন্ত পানাহার করতে পারে, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে ফজর উদয় হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে। আর সন্দেহের উপর পানাহার বন্ধ করবে না। যেহেতু মহান আল্লাহ পানাহার বন্ধ করার শেষ সময় নির্ধারিত করেছেন নিশ্চিত ও স্পষ্ট ফজরকে; সন্দিগ্ধ ও অস্পষ্ট ফজরকে নয়। আল্লাহ বলেছেন; “অর্থাৎ, আর তোমরা পানাহার কর, যতক্ষণ পর্যন্ত না (রাতের) কালো অন্ধকার থেকে ফজরের সাদা রেখা তোমাদের নিকট স্পষ্ট হয়েছে।” (সূরা বাকারাহ ২/১৮৭)। এক ব্যক্তি যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুফাসসিরকুল শিরোমণি, উম্মাহ’র শ্রেষ্ঠ ইলমী ব্যক্তিত্ব, সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা) [মৃত: ৬৮ হি.] -কে বলল, ‘আমি সাহরি খেতে থাকি। অতঃপর যখন (ফজর হওয়ার) সন্দেহ হয়, তখন (পানাহার) বন্ধ করি।’ ইবনু আব্বাস বললেন; ‘যতক্ষণ সন্দেহ থাকে ততক্ষণ খেতে থাক, সন্দেহ দূর হয়ে গেলে খাওয়া বন্ধ কর।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাহ, হা/ ৯০৫৭, ৯০৬৭)। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মহান ইমাম, শাইখুল ইসলাম আবু আব্দুল্লাহ আহমাদ বিন মুহাম্মাদ বিন হাম্বাল আশ-শাইবানী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ২৪১ হি.] বলেছেন; ‘ফজর উদয় হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ হলেও যতক্ষণ পর্যন্ত না নিশ্চিত হওয়া গেছে ততক্ষণ রোযাদার পানাহার করতে পারবে।’ (ফিকহুস সুন্নাহ খন্ড:১ পৃষ্ঠা:৪০৪)
.
সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন, যদি কোন ব্যক্তি অজ্ঞতাবশতঃ ফজর উদয় হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ রেখে খায়, অথবা ফজর উদয় হয়নি মনে করে খায়, অতঃপর জানতে পারে যে, খাওয়ার আগেই ফজর উদয় হয়ে গেছে, অথবা ফজরের আযান হয়ে গেছে, তাহলে তার রোযা শুদ্ধ এবং তাকে ঐ রোযা কাযা করতে হবে না। যদিও সে আসলে ফজরের পর খেয়েছে। কারণ, যেহেতু তিনি সময় সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন ফলে তিনি না জেনে খেয়েছেন। আর না জেনে খাওয়া ক্ষমার্হ। অর্থাৎ তা ধর্তব্য নয়। কারণ মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “যে রোযাদার ভুলে গিয়ে পানাহার করে ফেলে, সে যেন তাঁর রোযা পূর্ণ করে নেয়। এ পানাহার তাকে আল্লাহ্‌ই করিয়েছেন।” (বুখারী ১৯৩৩, মুসলিম ১১৫৫, আবু দাঊদ ২৩৯৮, তিরমিযী, দারেমী, ইবনে মাজাহ ১৬৭৩, দারাকুত্বনী, বাইহাক্বী ৪/২২৯, আহমাদ ২/৩৯৫, ৪২৫, ৪৯১, ৫১৩)। অপর বর্ণনায় আসমা বিন্তে আবী বাকর (রাযি.) বলেন, “রাসূল (ﷺ) এর যুগে একদা আমরা মেঘলা দিনে ইফতার করলাম। তারপর সূর্য দেখা গেল।” (সহীহ বুখারী হা/১৯৫৯, আবচ দাঊদ ২৩৫৯, ইমাম উসাইমিন আশ শারহুল মুমতে, খন্ড:৬, পৃষ্ঠা:৪০৯-৪১১)। পক্ষান্তরে যদি কেউ ঘুম থেকে জেগে উঠে জানতে পারে যে, ফজর বা ফজরের আযান হয়ে গেছে এবং তা সত্ত্বেও পানি বা অন্য কিছু খায়, তাহলে তার রোযা হবে না। তাকে ঐ দিন পানাহার ইত্যাদি রোযার মতই বন্ধ রেখে রমাযানের পর উক্ত সিয়ামের কাযা রাখতে হবে। জেনে রাখা ভালো যে, সাহরির শেষ সময় হল পূর্ব আকাশে ছড়িয়ে পড়া সাদা আলোক রেখার উদ্ভব কাল। সামুরাহ বিন জুনদুব (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন; ‘‘বিলালের আযান এবং (পূর্বাকাশে) আলম্বিত শুভ্র জ্যোতি যেন তোমাদেরকে সাহরি খাওয়াতে বাধা না দেয়। অবশ্য পূর্বাকাশে ছড়িয়ে পড়া জ্যোতি দেখে খাওয়া বন্ধ করো।’’ (সহীহ মুসলিম, আবু দাঊদ হা/২৩৪৬)। বলা বাহুল্য, ছড়িয়ে পড়া উক্ত সাদা রেখা পরিদৃষ্ট হলে সাথে সাথে রোযাদারের জন্য পানাহার ইত্যাদি থেকে বিরত হওয়া ওয়াজিব। তাতে সে ফজরের আযান শুনুক, অথবা না শুনুক। কারণ, মহান আল্লাহ বলেন; ‘‘তোমরা পানাহার কর, যতক্ষণ পর্যন্ত না (রাতের) কালো অন্ধকার থেকে ফজরের সাদা রেখা তোমাদের নিকট স্পষ্ট হয়েছে।’’ (সূরা বাকারাহ ২/১৮৭)। আর মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘ইবনে উম্মে মাকতূমের আযান না দেওয়া পর্যন্ত তোমরা পানাহার কর। কারণ, সে ফজর উদয় না হলে আযান দেয় না।’’ (সহীহ বুখারী হা/১৯১৮, সহীহ মুসলিম হা/১০৯২)। এখানে লক্ষণীয় যে, ফজর উদয় হয়েছে কি না, তা-ই দেখার বিষয়; আযান হয়েছে কি না, তা নয়। কেননা মোয়াজ্জিন নির্দিষ্ট সময়ের পরেও আযান দিতে পারেন অথবা না-ও দিতে পারেন।
.
অতএব, মসজিদের মুআযযিন যদি নির্ভরযোগ্য হয় এবং জানা যায় যে, সে ফজর উদয় না হলে আযান দেয় না অথবা ফজর উদয় হওয়ার পরে দেরী করে আযান দেয় না, তাহলে তার আযান শোনামাত্র পানাহার থেকে বিরত হওয়া ওয়াজিব। পক্ষান্তরে মুআযযিন যদি (ফজর উদয়ের) সময় হওয়ার পূর্বেই আযান দেয়, তাহলে তার আযান শুনে পানাহার বন্ধ করা ওয়াজিব নয়। আবার মুআযযিন যদি ঢিলে হয় এবং যথাসময় থেকে দেরী করে আযান দেয়, তাহলে সময় শেষ জানা সত্ত্বেও আযান হয়নি বলে খেয়ে যাওয়া বৈধ নয়। কারণ, এতে রোযা হবে না। কিন্তু মুআযযিনের অবস্থা না জানা গেলে, অথবা একই শহরে একাধিক মসজিদের একাধিক মুআযযিনের বিভিন্ন সময়ে আযান হলে এবং শহরের ভিতরে ঘর-বাড়ি তথা লাইটের ফলে ফজর উদয় হওয়ার সময় নিজে নির্ধারণ না করতে পারলে নির্ভরযোগ্য সেই সহীহ আক্বীদার আলেমদের ইসলামী ক্যালেন্ডার অনুযায়ী আমল করা জরুরী, যাতে নিখুঁতভাবে ফজর উদয়ের স্থানীয় সময় ঘণ্টা-মিনিট সহ স্পষ্ট লিখা থাকে। অতঃপর নিজের ঘড়ি ঠিক রেখে সেই সময় অনুযায়ী সেহরী-ইফতার করলে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর সেই হাদীসের উপর আমল হবে, যাতে তিনি বলেন; ‘‘যে বিষয়ে সন্দেহ আছে সে বিষয় বর্জন করে তাই কর যাতে সন্দেহ নেই।’’ (সুনানে তিরমিযী হা/ ২৫১৮)। সুতরাং যে সন্দিহান বিষয়াবলী থেকে দূরে থাকবে, সে তার দ্বীন ও ইজ্জতকে বাঁচিয়ে নেবে। (সহীহ বুখারী হা/৫২, সহীহ মুসলিম হা/১৫৯৯)
.
একটি বিষয় খেয়াল রাখবেন যে, ফজর উদয় হওয়ার ৫/১০ মিনিট আগে সতর্কতামূলক ভাবে পানাহার থেকে বিরত হওয়া একটি বিদআত। যদিও কোন কোন ক্যালেন্ডারে একটি ঘর সেহরীর শেষ সময়ের এবং পৃথক আর একটি ঘর ফজরের আযানের লক্ষ্য করা যায়, তা আসলে শরীয়ত-বিরোধী কাজ। (তামামুল মিন্নাহ, আল্লামা আলবানী পৃষ্ঠা: ৪১৮,সামানিয়া ওয়া আরবাঊন সুআলান ফিস্-সিয়াম পৃষ্ঠা: ৪৮)। কারণ, শরীয়তের দৃষ্টিতে সেহরীর শেষ সময় যেটাই, সেটাই ফজরের আযানের সময়। আর ফজরের আযানের সময়ের আগে লোকেদের পানাহার বন্ধ করা অবশ্যই শরীয়ত-বিরোধী কাজ। বলা বাহুল্য, (বিশেষ করে) রমাযান মাসে মুআযযিন-ইমামদের উচিৎ, যথাসময়ে আযান দেওয়ার ব্যাপারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা রাখা। রাইট-টাইমের ঘড়ি দ্বারা ফজর উদয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আযান দেওয়া মোটেই উচিৎ নয়। যাতে তাঁরা লোকেদেরকে ধোকা দিয়ে এমন সময় আযান না দিয়ে বসেন, যে সময়ে তাদের জন্য আল্লাহর হালালকৃত খাদ্য তাদের জন্য হারাম করে দেন এবং সময় হওয়ার পূর্বেই ফজরের নামায হালাল করে বসেন। আর এ যে কত বড় বিপজ্জনক, সহজে অনুমান করা যায়। (ইমাম ইবনে উষাইমীন ফাসিঃ মুসনিদ পৃষ্ঠা: ৩৬)
.
উল্লেখ্য যে সমাজে একটি হাদীসের ব্যাপক অপব্যাখ্যা হয়। তাই সে হাদীস সম্পর্কে সবার জানা উচিত, আবু হুরাইরা কর্তৃক বর্ণিত। আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন; ‘‘যখন তোমাদের কেউ আযান শোনে এবং সেই সময় তার হাতে (পানির) পাত্র থাকে, তখন সে যেন তা থেকে নিজের প্রয়োজন পূর্ণ না করা পর্যন্ত রেখে না দেয়।’’ (মুসনাদে আহমাদ, ২/৪৩২, ৫১০, আবু দাঊদ হা/২৩৫০)। উক্ত হাদীসটির বিধান সম্পর্কে আহলুল আলেমগণ থেকে কয়েকটি মতামত পাওয়া যায়। সকল মতামতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুটির মত হল:

(১).অনেক আলেম উক্ত হাদীসটিকে এ কথার দলীল মনে করেন যে, যে ব্যক্তির হাতে খাবারের পাত্র (নিয়ে খেতে) থাকা অবস্থায় ফজর (বা তার আযান) হয়ে যায়, তার জন্য তা থেকে নিজের প্রয়োজন পূর্ণ না করা পর্যন্ত রেখে দেওয়া (খাওয়া বন্ধ করা) বৈধ নয়। সুতরাং এ ব্যাপারটি আয়াতের সাধারণ নির্দেশ থেকে স্বতন্ত্র। মহান আল্লাহ বলেন; ‘‘আর তোমরা পানাহার কর, যতক্ষণ পর্যন্ত না (রাতের) কালো অন্ধকার থেকে ফজরের সাদা রেখা তোমাদের নিকট স্পষ্ট হয়েছে।’’ (কুরআনুল কারীম ২/১৮৭)। অতএব উক্ত আয়াত তথা অনুরূপ অর্থের সকল হাদীস উপর্যুক্ত হাদীসের বিরোধী নয়। তাছাড়া ইজমার প্রতিকূলও নয়। বরং সাহাবাদের একটি জামাআত এবং আরো অন্যান্যগণ উক্ত হাদীস অপেক্ষা আরো প্রশস্ততা রেখে মনে করেন যে, ফজর উজ্জ্বল হয়ে গেলে এবং ভোরের শুভ্র আলো রাস্তায় ছড়িয়ে পড়লেও সে পর্যন্ত পানাহার করা বৈধ। (ফাতহুল বারী ৪/১৬২-১৬৩, সিলসিলাহ সহীহাহ, ৩/৩৮২-৩৮৪)।

(২).তবে জমহুর আলেমগণের বিশুদ্ধ মতে এই হাদীসের সঠিক মর্ম হল, হাদীসে আযান দ্বারা ফজরের পূর্বে বিলাল (রাঃ) এর আযান উদ্দেশ্য। কেননা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ বিলাল রাত থাকতেই আযান দেয়, তাই তোমরা খেতে থাক ও পান করতে থাক যতক্ষণ না ইবনে উম্মে মাকতূম (রাদিয়াল্লাহু আনহু) আযান দেন। (সহীহ মুসলিম হা/১০৯৪) অথবা উক্ত হাদীসের অর্থ এই যে, আযান শুনেও যদি ফজর উদয়ে সন্দেহ হয়, যেমন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকার ফলে অন্ধকার থাকে, তাহলে সে সময় কেবল আযানে ফজর হওয়ার কথা নিশ্চিতরূপে জানা যায় না। কারণ, ফজর জানার যে মাধ্যম তা (ফজরের জ্যোতি) নেই। আর মুআযযিন তা দেখে ফজর উদয়ের কথা জানতে পারলে সেও জানতে পারত। পক্ষান্তরে ফজর উদয় হওয়ার কথা এমনিই বুঝতে পারা গেলে মুআযযিনের আযান শোনার প্রয়োজন নেই। কারণ, সে তো (রাতের) কালো অন্ধকার থেকে ফজরের সাদা রেখা স্পষ্ট হলেই পানাহার থেকে বিরত থাকতে আদিষ্ট। এ কথা বলেছেন খাত্ত্বাবী। বাইহাক্বী বলেন, ‘উক্ত হাদীস সহীহ হলে অধিকাংশ উলামার নিকট তার ব্যাখ্যা এই যে, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) জেনেছিলেন, মুআযযিন ফজর হওয়ার আগে আযান দেয়। সুতরাং তখন সে পান করলে ফজর উদয়ের আগেই পান করা হবে। (ইমাম বাইহাকী ৪/২১৮)
.
উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন: “যদি ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার সময় কারও মুখে খাবার থাকে, তবে সে যেন তা ফেলে দেয়। (খাবার) ফেলে দিলে – তার রোযা শুদ্ধ হবে, আর গিলে ফেললে – তার রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে। আর যদি ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার সময় সে সহবাসরত অবস্থায় থাকে, তবে সে অবস্থা থেকে তাৎক্ষণিক সরে গেলে – তার রোযা শুদ্ধ হবে। আর যদি ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার সময় সে সহবাসরত অবস্থায় থাকে এবং ফজরের ওয়াক্ত হয়েছে জেনেও সহবাসে লিপ্ত থাকে, তবে তার রোযা ভঙ্গ হবে- এ ব্যাপারে আলেমগণের মাঝে কোন দ্বিমত নেই। আর সে অনুসারে তার উপর কাফ্‌ফারা আবশ্যক হবে। তিনি আরও বলেন: “আমরা উল্লেখ করেছি যে, ফজর উদিত হওয়ার সময় যদি কারো মুখে খাবার থাকে, তবে সে তা ফেলে দিবে ও তার রোযা সম্পন্ন করবে। আর যদি ফজর হয়েছে জেনেও সে তা গিলে ফেলে, তবে তার রোযা বাতিল হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে কোন মতভেদ নেই। এর দলীল হচ্ছে ইবনে উমর ও আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহুম এর হাদীস। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ ‘ষআলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন; “বিলাল (রাদিয়াল্লাহু আনহু) রাত থাকতে আযান দেন। তাই তোমরা খেতে থাক ও পান করতে থাক যতক্ষণ না ইবনে উম্মে মাকতূম (রাদিয়াল্লাহু আনহু) আযান দেন। (সহীহ মুসলিম হা/১০৯৪; মিশকাত হা/৬৮১, ইমাম নববী আল মাজমু খন্ড: ৬ পৃষ্ঠা:৩২৯ ও ৩৩৩ ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং -১২৪২৯০)
.
অতএব, সিয়াম পালনকারীর মুখে কোন খাদ্য বা পানীয় থাকা অবস্থায় ফজরের আযান শুনবে, তখনই সে তা মুখ থেকে উগলে বা বের করে ফেলে দেবে। আর এতে তার রোযা শুদ্ধ হয়ে যাবে। (বাকিটা আল্লাহই ভালো জানেন)

▪️পরিশেষে একনজরে সাহরি খাওয়া সংক্রান্ত যে বিষয়গুলো জেনে রাখা ভাল;
______________________________________
(১).সাহরি দেরিতে অর্থাৎ শেষ সময়ে খাওয়া মুস্তাহাব। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর সাহাবাগণ খুব তাড়াতাড়ি (সময় হওয়া মাত্র) ইফতার করতেন এবং খুব দেরী করে সাহরি খেতেন। (বাইহাকী ৪/২৩৮, মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবাহ হা/৮৯৩২, সহীহুল জামে হা/৩৯৮৯)। সুতরাং সাহরি আগে আগে খেয়ে ফেলা উচিৎ নয়।
.
(২).অল্প কিছু হলেও সাহরি খেয়ে রোজা রাখা উচিত। অনেকে সাহরি না খেয়ে রোজা রাখাটা অভ্যাসে পরিণত করেছেন। এটা করা যাবে না। ইচ্ছা করে সাহরি না খেয়ে রোজা রাখা মাকরুহ (অপছন্দনীয়), যদিও রোজা আদায় হবে। তাছাড়া, বিশেষ কোনো কারণে সাহরি খেতে উঠতে না পারলেও রোজার কোনো ক্ষতি হবে না। সাহরি যথাসম্ভব শেষ সময়ে খাওয়া উত্তম। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ইহুদী-খ্রিষ্টান ও মুসলিমদের সিয়ামের মধ্য পার্থক্য হলো সেহরী গ্রহণ করা। (সহীহ মুসলিম, হা/১০৯৫; আবু দাঊদ, হা/২৩৪৩; মিশকাত, হা/১৯৮৩)
.
(৩).সাহরির সময় পড়তে হয় এমন কোন বিশেষ দুআ নেই। শরীয়তসম্মত হলো,খাওয়ার শুরুতে সায়েম بِسْمِ اللَّهِ ‘বিসমিল্লাহ’ (আল্লাহর নামে শুরু করছি) বলে খাওয়া শুরু করবে। (সহীহ বুখারী, হা/৫৩৭৬; সহীহ মুসলিম, হা/২০২২; মিশকাত হা/৪১৫৯)। এবং খাওয়া শেষে আলহামদুলিল্লাহ পড়ে তাঁর প্রশংসা করা, যেমনটি সব খাওয়ার বেলায় করা হয়। তবে যে ব্যক্তি রাতের এক তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হওয়ার পর সাহরি খায়; তিনি এমন একটি সময় পান যে সময়ে আল্লাহ তাআলা প্রথম আসমানে অবতরণ করেন এবং যে সময়ে দোয়া কবুল হয়। (ইমাম বুখারী হা/১০৯৪ ও মুসলিম হা/৭৫৮)। সুতরাং এ সময়ে যেকোন দুআ করা যেতে পারে। যেহেতু এটি দুআ কবুলের সময়; সাহরির সময় হিসেবে নয়।
.
(৪). অজ্ঞতাবশত সাহরি খাওয়ার পর যদি কেউ বুঝতে পারে যে, সাহরির সময় ১০/১৫ মিনিট আগেই শেষ হয়েছে; সেক্ষেত্রে সে সিয়াম পূর্ণ করবে। কারণ, অজ্ঞতার কারণে কেউ কোন ভুল করলে তার জন্য আল্লাহ পাকড়াও করেন না। (সূরা বাক্বারাহ ২/২৮৬)। কতিপয় সাহাবী সাদা রেখা ও কালো রেখার ব্যাখ্যা বুঝতে না পারায় নির্দিষ্ট সময়ের পরে সাহরি গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু রাসূল (ﷺ) তাদেরকে সিয়ামের ক্বাযা আদায় করতে বলেননি। যা প্রমাণ করে যে, কেউ ভুল করে কয়েক মিনিট পরে সাহারী খেলে তার উক্ত ছিয়ামই যথেষ্ট হবে। ক্বাযা আদায় করতে হবে না। (ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘উল ফাতাওয়া ২০/৫৭২-৭৩; মুগনী ৩/১৪৭)।
.
(৫).কেউ রামাদান মাসে রাতে স্ত্রী মিলন করে সময় স্বল্পতার কারণে গোসল না করে নাপাক অবস্থায় সাহরি খেলে সিয়ামের কোন ক্ষতি হবে না। আয়েশা (রাঃ) বলেন,রাসূল (ﷺ) অপবিত্র অবস্থায় গোসল না করেই ঘুমিয়ে যেতেন, অতঃপর উঠে গোসল করতেন।’ (ইবনু মাজাহ হা/৫৮১; তিরমিযী হা/১১৮, সনদ সহীহ)। এছাড়া কখনও জুনুবী অবস্থায় রাসূল (ﷺ)-এর ফজরের সময় হয়ে যেত। তখন তিনি গোসল করতেন এবং সিয়াম পালন করতেন। (বুখারী হা/১৯২৬)। তবে এক্ষেত্রে ওযু করে নেওয়া ভালো। (ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ১০/৩০৭)। তবে অবশ্যই ফজরের সালাত আদায়ের সময় পবিত্রতা অর্জন করে সালাত আদায় করতে হবে।
.
(৬).রামাদান মাসে কোন ব্যক্তি যদি স্ত্রী মিলনরত অবস্থায় ফজরের আযান শুনতে পায় এমতাবস্থায় যদি সে সঙ্গে সঙ্গে এথেকে বিরত হয়, তাহলে তার সাওম অক্ষুণ্ণ থাকবে। কিন্তু যদি সে ঐ অবস্থাতেই থাকে, তাহলে তার সাওম বাতিল হবে এবং তার উপর ক্বাযা ও কাফফারা ওয়াজিব হবে। (নববী, আল-মাজমূ‘ ৬/৩০৯; ইবনু কুদামা, মুগনী ৩/১৩৯)। তা হলো- (১). একজন দাস মুক্ত করবে অথবা (২). দু’মাস একটানা ছিয়াম পালন করবে অথবা (৩). ষাটজন মিসকীনকে মধ্যম মানের খাদ্য প্রদান করবে। (বুখারী হা/১৯৩৬; মুসলিম হা/১১১১; মিশকাত হা/২০০৪; ‘সাওম’ অধ্যায়)। নববী বলেন, ৬০ জন মিসকীনকে ৬০ মুদ খাদ্যশস্য প্রদান করবে। যার পরিমাণ ১৫ সা‘। (নববী, শরহ মুসলিম হা/১১১২)। অর্থাৎ মাদানী সা‘ অনুযায়ী সাড়ে ৩৭ কেজি চাউল
.
(৭).অনেকে আগে ভাগে সাহরি খেয়ে ঘুমিয়ে যায় এটি উচিত নয় আবার কেউ সাহরি খাওয়ার পরই ফজরের সালাত না পড়ে ঘুমিয়ে যায়। অথচ ফজরের সময় হওয়ার পূর্বে সালাত পড়া যাবে না। সাহরির সময় শেষ হওয়ার পর সালাত আদায় করতে হবে। (সূরা আন-নিসা: ১০৩; আবু দাঊদ, হা/৫৩২, সনদ সহীহ)
.
(৮). রাতে ঘুম ভাঙেনি এবং সিয়াম পালনেরও নিয়্যত করতে পারেনি এ অবস্থায় সূর্য উঠে গেছে। এমতাবস্থায় করণীয় হল সারাদিন না খেয়ে থাকা; অতঃপর রমাযানের পরেই সিয়ামটির কাজ আদায় করা। কারণ, ফরজ সিয়ামের নিয়ত সূর্যাস্তের পর থেকে ফজরের আযানের পূর্বে করতে হয় অপরদিকে নফল সিয়ামের নিয়ত দিনেও করা যায়। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন, একদিন নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার কাছে এসে বললেন, তোমার নিকট (খাবার) কিছু আছে কি? আমি বললাম না, কিছুই নেই। তিনি বললেন, তাহলে আমি (আজ) সিয়াম রাখলাম। (সহীহ মুসলিম, হা/১১৫৪; তিরমিযী, হা/৭৩৩; নাসাঈ, হা/২৩২৭; আবু দাঊদ, হা/২৪৫৫; মিশকাত, হা/২০৭৬)। এই হাদীস প্রমাণ করে যে, না খেয়েও সিয়াম রাখা যায়।
.
(৯).সাহরির সময়টুকু অত্যন্ত মূল্যবান। ফজরের আগের সময়টিতে কারও সাথে কথা না বলে দু‘আ ও ইস্তিগফার লেগে থাকা উচিত। ফজরের পূর্বের ইস্তিগফারের মর্যাদা অপরিসীম। আল্লাহ্ তা‘আলা কুরআনুল কারিমে বলেন, ‘‘আর আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের প্রতি (সু)দৃষ্টি রাখেন, যারা বলে, ‘হে আমাদের রব! আমরা ঈমান এনেছি, কাজেই আমাদের মাফ করে দাও এবং জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করো।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫-১৬)। এই লোকদের প্রশংসায় আল্লাহ্ বলেন, ‘‘তারা ধৈর্যশীল, সত্যবাদী, অনুগত, (সৎপথে) ব্যয়কারী এবং শেষ রাতে ক্ষমা প্রার্থনাকারী।’’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৭)।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন—‘‘সাহরির সময়ের ইবাদতকারীদের প্রতি আল্লাহ রহমত বর্ষণ করেন এবং ফেরেশতারা তাদের জন্য দু‘আ করেন।’’ (ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ: ১১০৮৬; শায়খ আলবানি, সিলসিলা সহিহাহ: ১৬৫৪; হাদিসটি সহিহ) রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘আল্লাহ্ তাঁর বান্দার অধিক নিকটবর্তী হন শেষ রাতে। ওই সময় যারা আল্লাহ্ তা‘আলার যিকর করে, সম্ভব হলে তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো।’’ (আবু দাউদ, আস-সুনান: ১২৭৭; হাদিসটি সহিহ)

(১০).হায়েয ওয়ালী (ঋতুবতী নারী) যদি ফাজরের আগে পবিত্র হয় ও পরে গোসল করে সিয়াম পালন করে তাহলে তার সাওম সঠিক হবে যদি সে ফজর উদিত হওয়ার (অর্থাৎ ফাজরের সময় শুরু হওয়ার) আগে পবিত্রতার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়। মূলনীতিটি হল, একজন নারী সে যে পবিত্র হয়েছে এ ব্যাপারে তাকে নিশ্চিত হতে হবে। কারণ, কখনো কখনো নারীদের কেউ কেউ মনে করে যে সে পবিত্র হয়েছে, কিন্তু আসলে সে পবিত্র হয় নি। এ কারণে মহিলা সাহাবীগণ আয়েশাহ্‌ -রাদিয়াল্লাহু আনহা-এর কাছে তুলো নিয়ে আসতেন এবং পবিত্রতার চিহ্ন এসেছে কিনা তা জানতে তাঁকে তা দেখাতেন, তিনি (আয়েশাহ্‌) তাঁদেরকে বলতেন, “আপনারা শ্বেতস্রাব না দেখা পর্যন্ত তাড়াহুড়ো করবেন না। তাই একজন নারীর উচিৎ ধীরস্থির ভাবে নিশ্চিত হওয়া যে সে পবিত্র হয়েছে কি না। সে পবিত্র হলে সাওম পালনের নিয়্যাত করবে যদিও বা সে ফাজর উদিত হওয়ার (অর্থাৎ ফাজরের সময় শুরু হওয়া) পরে গোসল করে, তবে তার উচিৎ সালাতের ব্যাপারে সতর্ক হওয়া এবং সময় মত ফাজরের সালাত পড়ার জন্য তাড়াতাড়ি গোসল করে নেওয়া।” (মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ইমাম উসাইমীন, ১৭/প্রশ্ন নং-৫৩)
.
(১১).রামাদানের দিন কোনো শিশু যদি বালিগ হয়, কোনো কাফির যদি ইসলাম গ্রহণ করে, কোন পাগল যদি জ্ঞান ফিরে পায়- তবে তাঁদের সবার হুকুম এক, আর তা হলো উযর (অজুহাত) চলে যাওয়ার সাথে সাথে দিনের বাকি অংশে সাওম ভঙ্গকারী সমস্ত কিছু হতে বিরত থাকা ওয়াজিব এবং এক্ষেত্রে তাদের সেই দিনের কাযা আদায় করা ওয়াজিব নয়। (ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং ৬৫৬৩৫)
.
(১২).রামাদানের দিন কোন হায়েযপ্রাপ্ত নারী যদি পবিত্র হয়, কোন মুসাফির ব্যক্তি স্বদেশে ফিরে আসে, কোন অসুস্থ ব্যক্তি যদি আরোগ্য লাভ করে, এদের সবার হুকুম এক। এদের সাওম ভঙ্গকারী যাবতীয় বস্তু থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব নয়, কারণ তারা বিরত থাকলেও কোনো উপকার পাবে না এবং তাদের উপর সেই দিনের কাযা আদায় করা ওয়াজিব। (মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ইমাম উসাইমীন, খন্ড: ১৯; প্রশ্ন নং-৫৮, ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৬৫৬৩৫)
.
(১৩).সাহরি খাওয়ার পর মুআযযিনের আযানের অপেক্ষা করে তার ‘আল্লা–’ বলার সাথে সাথে তৈরী রাখা পানি শেষ বারের মত পান করা বৈধ নয়। কারণ, আযান হয় ফজর উদয় হওয়ার সাথে সাথে এবং এ কথা জানাবার উদ্দেশ্যে যে সাহরির সময় শেষ। অতএব, খাবার সময় নেই জানার পরেও খাওয়া শরীয়তের বিরোধিতা তথা রোযা নষ্ট করার কাজ। (তাওজীহাতুন অফাওয়াএদ লিসসা-য়েমীনা অসসায়েমাত ৪০পৃঃ দ্রঃ) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
__________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।