রামাদানের সিয়ামের জন্য নিয়ত

প্রশ্ন: নিয়ত শব্দের অর্থ কি? রমাদানের সিয়ামের জন্য নিয়ত করা কি অপরিহার্য? রামাযানের শুরুতে পূর্ণ মাসের জন্য একবার নিয়ত করলে যথেষ্ট হবে নাকি প্রতিটি সিয়ামের জন্য আলেদা আলেদা নিয়ত করতে হবে?
▬▬▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: নিয়ত’ অর্থ সংকল্প বা ইচ্ছা করা। আর শরী‘আতের পরিভাষায় নিয়ত বলতে দু’টি জিনিস বুঝায়। (১). অভ্যাস থেকে ইবাদতকে আলাদা করা এবং (২) এক ইবাদত থেকে অন্য ইবাদতকে আলাদা করা। হাদীছে উল্লিখিত নিয়তের উপর নির্ভরশীলের অর্থ হচ্ছে কর্মের সাওয়াব বা শাস্তি নিয়ত অনুসারেই আল্লাহ নির্ধারণ করবেন। রোজা ও অন্যান্য ইবাদত বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য যেসব শর্ত রয়েছে, তার মধ্যে নিয়ত একটি অন্যতম শর্ত। নিয়ত করতে হয় পড়তে হয় না মুখে উচ্চারণ করে নাওয়াইতু আন…’’জাতীয় কিছু বলে যে নিয়ত পড়া সর্বসম্মতিক্রমে বিদআত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “নিশ্চয়ই সকল কাজের প্রাপ্য নিয়াতের ওপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যেক মানুষ তার নিয়াত অনুযায়ী প্রতিফল পাবে।”(সহীহ বুখারী, হা/১; সহীহ মুসলিম,হা/১৯০৭) সুতরাং কোনো ইবাদতই নিয়ত ছাড়া বিশুদ্ধ হবে না। রোজাও ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। তাই তা নিয়ত ছাড়া বিশুদ্ধ হবে না কিন্তু সেই নিয়ত মুখে উচ্চারণ করে পড়তে হবেনা।
.
নিয়তের ক্ষেত্রে শর্ত হল: নফল সিয়ামের ক্ষেত্রে দিনে নিয়ত করা যায়।কিন্তু ফরজ সিয়ামের জন্য অবশ্যই রাত থাকতে ও ফজরের আগেই নিয়ত করতে হবে। কারন রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,“যে ব্যক্তি রাত থাকতে রোজার নিয়ত করে না, তার রোজা হয় না। (তিরমিযী, হা/৭৩০; আবূ দাঊদ, হা/২৪৫৪; ইবনু মাজাহ, হা/১৭০০; সনদ: সহীহ) আর সুনানে নাসাঈ -এর ভাষ্য হচ্ছে- “যে ব্যক্তি রাতের বেলায় রোযার নিয়ত করেনি তার রোযা নেই। (নাসাঈ হা/২৩৩৪ তিরমিযি হা/৫৮৩) এ হাদীস থেকে জানা যায় যে, সিয়াম বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য ফজরের পূর্বে অর্থাৎ- রাত থাকতেই সিয়াম পালনের উদ্দেশে নিয়্যাত করা, অর্থাৎ- রাত থাকতেই সিয়াম পালনের উদ্দেশে দৃঢ় প্রত্যয় করা আবশ্যক। তা না হলে তার সিয়াম বিশুদ্ধ হবে না।আমীর ইয়ামানী বলেনঃ অত্র হাদীস প্রমাণ করে যে, রাতের কোন অংশে সিয়াম পালনের ইচ্ছা ব্যক্ত না করলে তার সিয়াম হবে না। আর এ ইচ্ছা ব্যক্ত করা তথা নিয়্যাত করার প্রথম ওয়াক্ত সূর্যাস্তের পর থেকেই শুরু হয়। কেননা সিয়াম একটি ‘আমল বা কাজ। আর যে কোন কাজ তথা ‘ইবাদাত নিয়্যাতের উপর নির্ভরশীল। অতএব এ ‘ইবাদাত বাস্তবে রূপলাভ করবে না যদি না রাত থাকতেই তার জন্য নিয়্যাত করা হয়। (মিশকাতুল মাসাবিহ হা ১৯৮৭ ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)
.
সিয়ামের নিয়ত করার সঠিক পদ্ধতি হচ্ছে ব্যক্তি অন্তরে আগামীকাল রোযা রাখার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেয়া। হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ শাইখুল ইসলাম ইমাম তাক্বিউদ্দীন আবুল ‘আব্বাস আহমাদ বিন ‘আব্দুল হালীম বিন তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন,”যে ব্যক্তির অন্তরে উদিত হয়েছে যে, সে আগামীকাল রোযাদার সেই নিয়ত করেছে।(ইখতিয়ারাত’ পৃষ্ঠা-১৯১) সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণকে রমযানের রোযা রাখার নিয়ত করার পদ্ধতি কি জানতে চাইলে জবাবে তারা বলেন: রোযা রাখার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেয়ার মাধ্যমে নিয়ত হয়ে যাবে। প্রতি রাতে রাত থাকতেই রোযার নিয়ত করতে হবে। (ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; গ্রুপ: ২; খণ্ড: ১০; পৃষ্ঠা: ২৪৬)
.
▌রামাযানের শুরুতে পূর্ণ মাসের জন্য একবার নিয়ত করলে যথেষ্ট হবে নাকি প্রতিটি সিয়ামের জন্য আলেদা আলেদা নিয়ত করতে হবে?
_______________________________________
প্রত্যেক রোজার জন্য আলাদা আলাদা নিয়াত করতে হবে নাকি পুরা মাসের জন্য একবার নিয়ত করলেই যথেষ্ট হবে এই মাসালায় আহালুল ইমামগনের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে আলেমগনের একটি অংশ বলেছেন প্রতিটি সিয়ামের জন্য আলেদা আলেদা নিয়ত করা হবে। অর্থাৎ ফরজ রোজার জন্য অবশ্যই ফজর হওয়ার আগে রাতের বেলায় প্রতিদিনের (রোজার) জন্য নতুন করে নিয়ত করা রোজাদারের জন্য ওয়াজিব। কারণ প্রত্যেক দিন একেকটি স্বতন্ত্র ইবাদত। তাই দিন নবায়িত হওয়ার সাথে সাথে নিয়তকে নবায়ন করাও জরুরি। যেহেতু রাসূলুল্লাহ ﷺ এর ব্যাপক কথা হলো—“নিশ্চয়ই সকল কাজের প্রাপ্য নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যেক মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী প্রতিফল পাবে।” কেউ যদি ঘুম থেকে ওঠে এবং সেহেরি খায়, তাহলে এটাই নিয়াত। সে যদি ফজর হওয়ার আগে না ওঠে এবং ঘুমের আগে রোজা রাখার জন্য নিয়ত করে থাকে, তাহলে সে ঘুম থেকে উঠে (সেহেরি করা হতে) বিরত থাকবে। আর রাতে নিয়ত করার কারণে তার এই রোজা হয়ে যাবে।অপরদিকে জমহুর ওলামাদের মতে পুরা মাসের জন্য একবার নিয়ত করলেই যথেষ্ট হবে যাইহোক এই মাসালায় দুটি মতই সঠিক।
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন, প্রশ্ন করা হয় “কোনো ব্যক্তি যদি রমজানের রোজা করার নিয়াত করে, তাহলে কি সেই নিয়াত সকল দিনের জন্য যথেষ্ট হবে? উত্তরে শাইখ বলেছেন “প্রত্যেক দিনের জন্য (স্বতন্ত্র) নিয়াত করতে হবে। কেননা প্রতিটি দিন একেকটি ইবাদত। প্রতিটি দিন স্বতন্ত্র একেকটি ইবাদত। সুতরাং রমজানের প্রত্যেক দিনের জন্য (স্বতন্ত্র) নিয়াত করা আবশ্যক। অনুরূপভাবে কাজা ও মানতের রোজার দিনগুলোর ক্ষেত্রেও প্রত্যেক দিনের জন্য (আলাদা) নিয়াত করতে হবে। কেননা প্রত্যেক দিন একেকটি স্বতন্ত্র ইবাদত। হ্যাঁ,এটাই সঠিক কথা।”(শাইখের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের আর্টিকেলে ফাতওয়া নং ১০৪১৪)
.
সৌদি ফতোয়া বোর্ড এবং সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের প্রবীণ সদস্য, যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫৪ হি./১৯৩৫ খ্রি.]কে প্রশ্ন:করা হয় রমজানে মাসে ফজরের আগে প্রত্যেক রাতে কি আলাদা নিয়াত করতে হবে, নাকি পুরো (রমজান) মাসে একবার নিয়াত করাই যথেষ্ট হবে?”উত্তরে তিনি বলেন “রোজা ও অন্যান্য ইবাদত বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য যেসব শর্ত রয়েছে, তার মধ্যে নিয়াত একটি অন্যতম শর্ত। যেহেতু রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “নিশ্চয়ই সকল কাজের প্রাপ্য নিয়াতের ওপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যেক মানুষ তার নিয়াত অনুযায়ী প্রতিফল পাবে।”(সহীহ বুখারী, হা/১; সাহীহ মুসলিম, হা/১৯০৭)সুতরাং কোনো ইবাদতই নিয়াত ছাড়া বিশুদ্ধ হবে না। রোজাও ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। তাই তা নিয়াত ছাড়া বিশুদ্ধ হবে না। যেহেতু রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “যে ব্যক্তি রাত থাকতে রোজার নিয়ত করে না, তার রোজা হয় না।” (তিরমিযী, হা/৭৩০; আবূ দাঊদ, হা/২৪৫৪; ইবনু মাজাহ, হা/১৭০০; সনদ: সাহীহ) তাই রোজা বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য নিয়াত শর্ত। আর ফরজ রোজার জন্য অবশ্যই ফজর হওয়ার আগে রাতের বেলায় নিয়াত করে ফেলতে হবে। প্রতিদিনের (রোজার) জন্য নতুন করে নিয়াত করা রোজাদারের জন্য ওয়াজিব। কারণ প্রত্যেক দিন একেকটি স্বতন্ত্র ইবাদত। তাই দিন নবায়িত হওয়ার সাথে সাথে নিয়াতকে নবায়ন করাও জরুরি। যেহেতু রাসূলুল্লাহ ﷺ এর ব্যাপক কথা হলো—“নিশ্চয়ই সকল কাজের প্রাপ্য নিয়াতের ওপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যেক মানুষ তার নিয়াত অনুযায়ী প্রতিফল পাবে।”সে যদি ঘুম থেকে ওঠে এবং সেহেরি খায়, তাহলে এটাই নিয়াত। সে যদি ফজর হওয়ার আগে না ওঠে এবং ঘুমের আগে রোজা রাখার জন্য নিয়ত করে থাকে, তাহলে সে ঘুম থেকে উঠে (সেহেরি করা হতে) বিরত থাকবে। আর রাতে নিয়াত করার কারণে তার এই রোজা হয়ে যাবে।”(শায়খের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ফাতওয়া নং ৭৬৮৯)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] কে রমজানে মাসে ফজরের আগে প্রত্যেক রাতে কি আলাদা নিয়াত করতে হবে, নাকি পুরো (রমজান) মাসে একবার নিয়াত করাই যথেষ্ট হবে? মর্মে প্রশ্ন করা হলে জবাবে তিনি বলেন, রামাযানের শুরুতে পূর্ণ মাসের জন্য একবার নিয়ত করলেই যথেষ্ট হবে। কারণ সিয়াম পালনকারী প্রতিদিন সাহারী খায় সিয়াম রাখার জন্যই। তবে সফর, অসুস্থতা কিংবা শারঈ কারণে সিয়ামে বিচ্ছিন্নতা আসলে পুনরায় নতুন করে নিয়ত করতে হবে (মাজমু ফাতাওয়া উসাইমীন,১৯/১৩৩ পৃ.আল-শারহুল মুমতি’ খন্ড: ৬ পৃষ্ঠা: ৩৬৯-৩৭০)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] কে এই প্রশ্ন ফরজ রোজা বা নফল নামাজের নিয়াত উচ্চারণ করা প্রসঙ্গে। এটি কি জায়েজ?”

জবাবে শাইখ বলেন: “সকল ইবাদতের ক্ষেত্রে নিয়াত মুখে উচ্চারণ করা বিদ‘আত। সুতরাং ওজু করার সময় কেউ এ কথা বলবে না যে, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নী নাওয়াইতু আন আতাওয়াদ্বদ্বাআ’ তথা ‘হে আল্লাহ, আমি ওজু করার নিয়াত করলাম’। নামাজ পড়ার সময় কেউ বলবে না যে, ‘নাওয়াইতু আন উসাল্লিয়া’ তথা ‘আমি নামাজ পড়ার নিয়াত করলাম’। দান করার সময় কেউ বলবে না যে, ‘নাওয়াইতু আন আতাসাদ্দাক্বা’ তথা ‘আমি দান করার নিয়াত করলাম’। রোজা করার সময় কেউ বলবে না যে, ‘নাওয়াইতু আন আসূমা’ তথা ‘আমি রোজা করার নিয়াত করলাম’। হজ করার সময় কেউ বলবে না যে, ‘নাওয়াইতু আন আহুজ্জা’ তথা ‘আমি হজ করার নিয়াত করলাম’।কোনো ইবাদতের ক্ষেত্রেই মুখে নিয়াত উচ্চারণ করার বিষয়টি নাবী ﷺ থেকে বর্ণিত হয়নি। তাহলে কেন তুমি মুখে নিয়াত উচ্চারণ করবে? নিয়াত করার জায়গা কি অন্তর নয়? মহান আল্লাহ কি বলেননি যে, ‘আর অবশ্যই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি এবং তার প্রবৃত্তি তাকে যে কুমন্ত্রণা দেয় তাও আমি জানি’ (সূরাহ ক্বাফ: ১৬)? হ্যাঁ, অবশ্যই আমরা এ কথা বলি যে, আল্লাহ নিয়াত (অন্তরের সংকল্প) সম্পর্কে অবগত। তাহলে কীভাবে তুমি তোমার প্রতিপালক জানাবে যে, তুমি নিয়াত করেছ? হয়ত সে (উত্তরদাতা) বলবে যে, আমি বলছি, আল্লাহ’র প্রতি ইখলাস তথা একনিষ্ঠতা জাহির করার মাধ্যমে (তা জানাব)। আমরা বলব, ইখলাসের জায়গাও অন্তর। আর যার জায়গা অন্তর, তার জন্য অন্তরে নিয়াত করাই যথেষ্ট।” ইমাম উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ)ফাতাওয়া নূরুন আলাদ দারাব,অডিও ক্লিপ নং,-৩৪৯ ফাতওয়ার অনুবাদক: মুহাম্মাদ ‘আব্দুল্লাহ মৃধা) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
__________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।