রামাদান মাসে সাহরির সময় মাইকে উচ্চ আওয়াজে কুরআন তেলাওয়াত করা, গজল গাওয়া এবং ডাকাডাকি করার বিধান

প্রশ্ন: রামাদান মাসে সাহরির সময় মাইকে উচ্চ আওয়াজে কুরআন তেলাওয়াত করা, গজল গাওয়া এবং ডাকাডাকি করার বিধান কি? সাহরীর সময় সুন্নাহ সম্মত পদ্ধতি অনুযায়ী করণীয় কি?
▬▬▬▬▬▬▬▪️🌻▪️▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: দুঃখজনক হলেও সত্য রামাদান মাস আসলে অনেক এলাকায় দেখা যায় শেষ রাতে সাহরির সময় মুআযযিনগণ মাইকে উচ্চ আওয়াজে কুরআন তেলাওয়াত, গজল, ইসলামী সঙ্গীত ইত্যাদি গাওয়া শুরু করে। অথবা টেপ রেকর্ডার চালিয়ে বক্তাদের ওয়াজ, গজল বাজাতে থাকে। সেই সাথে চলতে থাকে- ভায়েরা আমার, বোনেরা আমার, উঠুন, সাহরীর সময় হয়েছে, রান্না-বান্না করুন, খাওয়া-দাওয়া করুন ইত্যাদি বলে অনবরত ডাকাডাকি। অথবা কোথাও বা কিছুক্ষণ পরপর উঁচু আওয়াজে হুইশেল বাজানো হয়। এর থেকে আরো আজব কিছু আচরণ দেখা যায়। যেমন: এলাকার কিছু যুবক রামাদানের শেষ রাতে মাইক নিয়ে এসে সম্মিলিত কণ্ঠে গজল বা কাওয়ালী গেয়ে মানুষের বাড়ির দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে চাঁদা আদায় করে। অথবা মাইক বাজিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে থাকে। এ ছাড়াও এলাকা ভেদে বিভিন্ন বিদআতী কার্যক্রম দেখা যায়। অথচ ইসলামি শরীয়তের দৃষ্টিতে রামাদান মাসে সাহারীর সময় মানুষকে জাগানোর জন্য আযান ব্যতীত মাইকে ইসলামী গজল, জাগরণী, কুরআন তেলাওয়াত, বক্তব্য, সাইরেন বাজানো কোনকিছুই জায়েয নয়। সবই শরীআতের নামে নতুন আবিষ্কার, যা স্পষ্ট বিদআত। (ইসলাম ওয়েব, ফৎওয়া নং-২৯৩৩৪৯)। কারণ, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন; ‘যে ব্যক্তি আমাদের এই দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছুর উদ্ভব ঘটাল, যা তার মধ্যে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত‌।’ (সহীহ বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১৪০)। সহীহ ভাষ্যকার হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, ‘বর্তমান কালে সাহরির সময় লোক জাগানোর নামে আযান ব্যতীত যা কিছু করা হয় সবই বিদআত।’ (ফাৎহুল বারী; ‘ফজরের পূর্বে আযান’ অনুচ্ছেদ; খণ্ড:২; পৃ. ৪৩৬; হা/৬২১-এর ব্যাখ্যা দ্র:)
.
তাছাড়া আমাদের জানা উচিত, শেষ রাতে মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা নিচের আসমানে নেমে আসেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন; প্রতি রাত্রে শেষ তৃতীয়াংশে আমাদের মর্যাদাবান বারাকাতপূর্ণ রব দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন এবং বলেন, ‘যে আমাকে ডাকবে আমি তার ডাকে সাড়া দেব। যে আমার নিকট কিছু প্রার্থনা করবে আমি তাকে তা দান করব। যে আমার নিকট মাফ চাইবে আমি তাকে মাফ করে দেব। (সহীহ বুখারী হা/ ১১৪৫; সহীহ মুসলিম হা/ ৭৫৮)। এটা দু‘আ কবুলের সময়। আল্লাহ তাআলার নিকট এ সময় কেউ দু‘আ করলে তিনি তা কবুল করেন। মুমিন বান্দাগণ এ সময় তাহাজ্জুদের সালাত পড়েন, কুরআন তেলাওয়াত করেন, মহান আল্লাহর দরবারে রোনাযারী করে থাকেন। সুতরাং এ সময় মাইক বাজিয়ে, গজল গেয়ে বা চাঁদা তুলে এ মূল্যবান সময়ে ইবাদতে বিঘ্নিত করা নিঃসন্দেহে গুণাহের কাজ। এতে মানুষের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটানো হয়। যার ফলে অনেকের সাহরি এমনকি ফজরের সালাত পর্যন্ত ছুটে যায়। এই কারণে অনেক সিয়াম পালনকারী সাহরির শেষ সময় পর্যন্ত বিলম্ব না করে আগে ভাগে সাহরি শেষ করে দেয়। এসব গুলোই গুনাহের কাজ। তাহলে আমাদেরকে জানতে হবে এ ক্ষেত্রে সুন্নাহ কী?
.
▪️সাহরির সময় সুন্নাহ সম্মত পদ্ধতি অনুযায়ী করণীয় কি?
______________________________________
প্রকৃতপক্ষে এই সময় পালনীয় সুন্নাহ হচ্ছে, সাহরির জন্য দুটি আযান দেওয়া। শরীয়তের দৃষ্টিতে এটি মুস্তাহাব। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যামানায় বেলাল (রাঃ) সাহরির আযান দিতেন এবং আব্দুল্লাহ ইবনু উম্মে মাকতূম (রাঃ) ফজরের আযান দিতেন। তবে বর্তমানে চাইলে দুজন মুওয়াযযিন দুটি আযান দিতে পারেন; আবার একই ব্যক্তির জন্য সাহরি ও ফজরের আযান দিতে পারবেন। এতে কোন সমস্যা নেই। আবার একই মসজিদে একাধিক মুওয়াযযিন থাকাতে কোন দোষ নেই। উসমান (রাঃ)-এর আমলে মসজিদে নববীতে চারজন মুওয়াযযিন ছিলেন। অতএব পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের জন্য পাঁচজন মুওয়াযযিন নিয়োগ দিলেও কোন আপত্তি নেই। (শাওকানী, নায়লুল আওত্বার ২/৬০-৬১)। তবে একই ব্যক্তি দুটি আযান দেওয়ার সময় সাহরির আযানের সময় ‘আস-সালাতু খায়রুম মিনান নাওম’ বলতে হবেনা। কারণ সাহরি গ্রহণকারী ও তাহাজ্জুদ আদায়কারীগণ যাতে উভয় আযানের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারেন। পাশাপাশি উভয় সময়ের মধ্যে এমন পার্থক্য থাকবে, যাতে একজন ব্যক্তি সহজে ফজরের আযানের পূর্বে প্রয়োজনে রান্না ও খাদ্য গ্রহণ সম্পন্ন করতে পারে। তা একঘণ্টা বা তার কিছু কমবেশী হতে পারে। যাতে মানুষ বুঝতে পারে যে ফজরের সময় ঘনিয়ে এসেছে।
.
হাদীসে এসেছে ইবনু উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, বিলাল (রাঃ) রাত থাকতে আযান দেয়। তাই তোমরা ইবনু উম্মু মাকতূম (রাঃ)-এর আযান না দেয়া পর্যন্ত খাওয়া-দাওয়া করতে থাকবে। ইবনু উমার (রাঃ) বলেন, ইবনু উম্মু মাকতূম (রাঃ) অন্ধ ছিলেন। ‘ভোর হয়ে গেছে, ভোর হয়ে গেছে’ তাকে না বলা পর্যন্ত তিনি আযান দিতেন না। (সহীহ বুখারী হা/১৯১৯; সহীহ মুসলিম হা/১০৯২; মিশকাত হা/৬৮০; সহীহ ইবনু হিব্বান ৩৪৭০)। তবে কারো হাতে খাবার থাকা অবস্থায় আযান হয়ে গেলে সাহরি খাওয়া সম্পন্ন করবে। নবী করীম রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘যখন তোমাদের কেউ খাবার পাত্র অথবা পানির পাত্র হাতে নেয়, আর এ সময় আযান শুনে, তখন সে যেন তা রেখে না দেয়; বরং খাওয়া শেষ করে।’ (আবু দাঊদ, মিশকাত হা/১৯৮৮; ‘সওম’ অধ্যায়)। অপর বর্ণনায় আরো স্পষ্ট করে এসেছে; সামুরা বিন জুনদুব (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘বেলালের আযান যেন তোমাদেরকে সাহরি খাওয়া থেকে বিরত না করে। কেননা সে রাত্রি থাকতে আযান দেয় এজন্য যে, যেন তোমাদের তাহাজ্জুদ গোযার মুসল্লীগণ (সাহারীর জন্য) ফিরে আসে ও তোমাদের ঘুমন্ত ব্যক্তিগণ (তাহাজ্জুদ বা সাহরির জন্য) জেগে ওঠে।’ (সহীহ মুসলিম হা/১০৯৪; মিশকাত হা/৬৮১; কুতুবে সিত্তাহর সকল গ্রন্থ তিরমিযী ব্যতীত, নায়ল ২/১১৭-১)। ইবনু ওমর (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে যে, উভয় আযানের মধ্যে সময়ের ব্যবধান খুবই কম ছিল। একজন নামতেন, অন্যজন উঠতেন। (মুসলিম হা/১০৯২)। শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন, ‘বিদ্বানগণ এর অর্থ করেছেন এই মর্মে যে, বেলাল সুবহে সাদিক-এর পূর্বেই আযান দিতেন। অতঃপর ফজর উদিত হওয়ার পর মিনার থেকে অবতরণ করে আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূমকে জাগাতেন। অতঃপর ইবনে উম্মে মাকতূম পেশাব-পায়খানা, ওযু-গোসল সেরে এসে ফজরের ওয়াক্তের শুরুতেই আযান দিতেন।’ (তানক্বীহ শরহ মিশকাত ১/১৩০ পৃঃ, ‘সালাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৬;
হা/৬৮০-এর ব্যাখ্যা)।
.
উপরোক্ত হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে রমাযান মাসে যখন সাহরির সময় হতো তখন লোকজনকে জাগানোর জন্য বিলাল (রাঃ) আযান দিতেন। এ আযান ফজরের আযান ছিল না। এজন্য নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; বিলাল (রাঃ) রাতে আযান দেয়, তাই তোমরা ইবনু উম্মু মাকতূম (রাঃ)-এর আযান না শোনা পর্যন্ত খাওয়া এবং পান করা চালিয়ে যেতে পারো। আবদুল্লাহ ইবনু উম্মু মাকতূম (রাঃ) অন্ধ হওয়ার করণে ফাজরের (ফজরের) সময় কখন হয়েছে তা তিনি বুঝতে পারতেন না। লোকজন যখন তাকে সালাতের সময় হওয়ার কথা বলতো তখনই তিনি আযান দিতেন। এ হাদীস দ্বারা এ বিষয়টিই প্রমাণ পাওয়া যায় যে, সাহরীর সময় মানুষকে জাগানোর জন্য আযান দেয়া যাবে। আবার মুসনাদে আহমাদ-এর বর্ণনায় রয়েছে যে, যখন ইবনু উম্মু মাকতূম (রাঃ) আযান দেয় তখন তোমরা খাও এবং পান কর। কিন্তু বিলাল (রাঃ) যখন আযান দেয় তখন তোমরা খাওয়া ও পান করা বন্ধ কর। এ হাদীস দ্বারা যে বিষয়টি জানা যায় তা হল সাহরির আযান কোন কোন দিন বিলাল (রাঃ) দিতেন। আবার কোন কোন সময় আবদুল্লাহ ইবনু মাকতূম (রাঃ) দিতেন। (মিসকাতুল মাসাবিহ ১/১৩০, হা/৬৮০ ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)। অতএব, মনগড়া পদ্ধতি পরিত্যাগ করে রাসূল (ﷺ)-এর শিখানো পদ্ধতিকে গ্রহণ করা জরূরী। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
_____________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।