শরীয়তের আলোকে কবর যিয়ারত

শরীয়তের আলোকে কবর যিয়ারতের সুন্নাতী পদ্ধতি কি? কবর যিয়ারতের সময় কোন দু’আ পড়তে হয়? কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে কোথাও যাওয়া যাবে কি? কবর যিয়ারত করলে মৃত ব্যক্তির কোন উপকার হয় কি?
▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: সবকিছু অনিশ্চিত হলেও আপনার আমার মৃত্যু সুনিশ্চিত। প্রত্যেক জীবকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। জন্ম ও মৃত্যু একটি অন্যটির সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। দু’টির কোনটির ক্ষমতা মানুষের হাতে নেই। আল্লাহর হুকুমেই জন্ম হয়। আল্লাহর হুকুমেই মৃত্যু হয়। কখন হবে,কোথায় হবে, কিভাবে হবে, তা কারো জানা নেই। জীবনের সুইচ তাঁরই হাতে, যিনি জীবন দান করেছেন।সুতরাং জাগতিক জীবনের মূল্যহীনতা প্রসঙ্গে ধারণা ও উপদেশ গ্রহণ, মৃত্যু, আখিরাত বা পরকালকে স্মরণ এবং মৃতব্যক্তির জন্য দুআ করার উদ্দেশ্যে মহিলা ব্যতীত শুধু পুরুষের জন্য কবর যিয়ারত করা সুন্নাত বা মুস্তাহাব। এর দ্বারা মৃত্যু ও আখেরাতের কথা স্মরণ হয়। কবর আযাবের ভীতি সঞ্চারিত হয়, হৃদয় বিগলিত হয়, চক্ষু অশ্রুসিক্ত হয়, অন্যায় থেকে তওবা এবং নেকীর প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়, পরকালীন মুক্তির প্রেরণা সৃষ্টি হয়।উপরোক্ত উদ্দেশ্যেই কেবল কবর যিয়ারতের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কবর যিয়ারত করতে গিয়ে সেখানে এমন কথা বলা হবে না যাতে আল্লাহ তা’আলা অসন্তুষ্ট হন। যেমন, মৃতব্যক্তির নিকট কিছু প্রার্থনা করা, তার কাছে কিছু চাওয়া, তার মিথ্যা প্রশংসা করা, সে জান্নাতী বলে পাক্কা ধারণা করা ইত্যাদি। প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন, (কবরের ধারে-পাশে এবং মৃতদেরকে নিয়েই শির্ক ও মূর্তিপূজা শুরু হয়েছে বলে) আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। সুতরাং এখন তোমরা কবর যিয়ারত করতে পার। কারণ, তা তোমাদেরকে আখেরাত স্মরণ করিয়ে দেয়।”(সহীহ মুসলিম ৯৭৭, আবু দাউদ ৩২৩৫, মুসনাদে আহমাদ ৫/৩৫০-৩৫৫)। রাসূল (ﷺ) আরো বলেন,“আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। শোনো! এখন তোমরা যিয়ারত করতে পার। কারণ, কবর। যিয়ারত হৃদয় নম্র করে, চক্ষু অশ্রুসিক্ত করে এবং পরকাল স্মরণ করিয়ে দেয়। তবে (যিয়ারতে গিয়ে) বাজে কথা বলো না।”(মুস্তাদরাকে হাকেম ১/৩৭৬ মুসনাদে আহমাদ ৩/২৩৭-২৫০)।এক বর্ণনায় আছে, “তোমাদের কবর যিয়ারত যেন তোমাদের কল্যাণ বৃদ্ধি করে। (মুসনাদে আহমাদ,৫/৩৫০-৩৫৫ প্রমুখ) অন্য এক বর্ণনায় তিনি বলেন, “সুতরাং যে ব্যক্তি যিয়ারত করার ইচ্ছা করে সে করতে পারে; তবে যেন (সেখানে) তোমরা অশ্লীল ও বাজে কথা বলো না।” (সুনানে নাসাঈ ২০৩২, হাদীস সম্ভার ১৩৯৫)

◾শরীয়তের আলোকে কবর যিয়ারতের আদব সমূহ:
_______________________________________
কবর যিয়ারতের নিদিষ্ট কোন দিন তারিখ নেই। বরং যেকোন দিন কবর যিয়ারত করা যায়। (সহীহ মুসলিম, মিশকাত হা/১৭৬৩)। জুম‘আর দিন কবর যিয়ারতের ফযীলত সম্পর্কে যে হাদীস বর্ণিত হয়েছে তা সহীহ নয়। (সিলসিলা যঈফাহ হা/৪৯-৫০; বায়হাক্বী, শো‘আবুল ঈমান মিশকাত হা/১৭৬৮ ‘কবর যিয়ারত’ অনুচ্ছেদ)। কবর যিয়ারতের সময় নিজের মৃত্যু ও আখেরাতকে স্মরণ করবে এবং কবরবাসীদের মাগফিরাতের উদ্দেশ্যে খালেছ মনে দোআ সমূহ পাঠ করবে। দোআর সময় একাকী দু’হাত উঠানো যাবে। যেমন: বাক্বী গারক্বাদ গোরস্থানে রাসূল (ﷺ) দীর্ঘক্ষণ ধরে দু’আ করার সময় একাকী তিন বার হাত উঠিয়েছিলেন। (সহীহ মুসলিম হা/২৩০১, জানায়েয’ অধ্যায়-৫, অনুচ্ছেদ-৩৫; ঐ, মিশকাত হা/১৭৬৬; তালখীছ পৃঃ ৮৩)। কিন্তু সম্মিলিতভাবে হাত উঠানো যাবেনা কেননা এই মর্মে বিশুদ্ধ কোন দলিল নেই। কবর যিয়ারতের সময় স্রেফ দু’আ ব্যতীত সালাত, তেলাওয়াত, যিকর-আযকার, দান-সাদাক্বা কিছুই করা জায়েয নয়। মোটকথা কবরস্থানে গিয়ে প্রথমে দোআ পাঠ করবে। আম্মাজান আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! কবর যিয়ারতের সময় আমি কী বলব? তখন রাসূল (ﷺ) বললেন, তুমি বল, اَلسَّلاَمُ عَلَى أَهْلِ الدِّيَارِ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُسْلِمِيْنَ، وَيَرْحَمُ اللهُ الْمُسْتَقْدِمِيْنَ مِنَّا وَالْمُسْتَأْخِرِيْنَ، وَإِنَّا إِنْ شَآءَ اللهُ بِكُمْ لَلاَحِقُوْنَ অনুবাদ: আস্সালা-মু আলা আহলিদ দিয়া-রি মিনাল মু’মিনীনা ওয়াল মুসলিমীনা; ওয়া ইয়ারহামুল্লা-হুল মুস্তাক্বদিমীনা মিন্না ওয়াল মুস্তা’খিরীনা; ওয়া ইন্না ইনশা-আল্লা-হু বিকুম লা লা-হেকূনা’। অর্থ: মুমিন ও মুসলিম কবরবাসীদের উপরে শান্তি বর্ষিত হৌক। আমাদের অগ্রবর্তী ও পরবর্তীদের উপরে আল্লাহ রহম করুন! আল্লাহ চাহে তো আমরা অবশ্যই আপনাদের সাথে মিলিত হতে যাচ্ছি।’ (সহীহ মুসলিম হা/২২৫৬;মিশকাত হা/১৭৬৭ ‘কবর যিয়ারত’ অনুচ্ছেদ)। এছাড়াও বিভিন্ন শব্দের আরো দুআ রয়েছে দেখুন। (সহীহ মুসলিম হা/২২৫৭; মিশকাত হা/ হা/২৯৮, ও ১৭৬৪।/২৯৮ ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়-৩; হা/১৭৬৬ জানায়েয’ অধ্যায়-৫, অনুচ্ছেদ-৮)
.
জেনে রাখা ভাল যে, শুধুমাত্র কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে কোথাও সফর করা যাবে না। এমনকি রাসূল (ﷺ)-এর কবর যিয়ারতের জন্যও নয়। কারন রাসূল (ﷺ) বলেন, সফরের জন্য বের হবে না তিনটি মসজিদের উদ্দেশ্যে ব্যতীত। মাসজিদুল হারাম, মাসজিদুল আক্বসা এবং আমার এই মসজিদ অর্থাৎ মসজিদে নববী (সহীহ বুখারী হা/১১৮৯; মুসলিম হা/১৩৯৭; মিশকাত হা/৬৯৩)। তবে অন্য উদ্দেশ্যে কোথাও সফর করলে এবং সেখানে কবর থাকলে উক্ত কবর যিয়ারত করাতে কোন বাধা নেই। (ইবনে উসায়মীন, ফাতাওয়া নূরুন আলাদ-দারব ১৯৬/৭; ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ১/৪৩৪) যেমন: কেউ মসজিদে নববীতে সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে গিয়ে রাসূল (ﷺ) ও তাঁর সাথীদ্বয়ের কবর যিয়ারত করা যাবে। আর যেকোন স্থান থেকে যে কেউ মৃত মুমিন ব্যক্তির জন্য দু’আ করলে তার উপকার হবে। (সূরা হাশর১০; সহীহ মুসলিম হা/৯৬৩; আবুদাউদ হা/৩১৯৯; মিশকাত হা/১৬৫৫, ১৬৭৪)। কবর যিয়ারত করাতে যিয়ারতকারীর পরকালের কথা স্মরণ হয় বলে সে ব্যক্তি উপকৃত হয়। (সহীহ মুসলিম হা/৯৭৬; মিশকাত হা/১৭৬৩)।

উল্লেখ্য যে, অমুসলিম কাফির-মুশরিক পিতা-মাতার কবর যিয়ারত করা যাবে। তাদের জন্য ক্রন্দন করাও যাবে। কেননা এর মাধ্যমে মৃত্যুকে স্মরণ করা হয়। কিন্তু সেখানে গিয়ে তাদের উদেশ্যে সালাম করা যাবে না। তাদের জন্য আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করা যাবে না। রাসূল (ﷺ)-কে তাঁর মায়ের কবর যিয়ারতের জন্য অতটুকুই মাত্র অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। দু’আ করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। যেমন: আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একবার নিজের মায়ের ক্ববরে গেলেন। সেখানে তিনি নিজেও কাঁদলেন এবং তাঁর আশপাশের লোকদেরকেও কাঁদালেন। তারপর বললেন, আমি আমার মায়ের জন্য মাগফিরাত কামনা করতে আল্লাহর কাছে অনুমতি চাইলাম। কিন্তু আমাকে অনুমতি দেওয়া হল না। তারপর আমি আমার মায়ের ক্ববরের কাছে যাওয়ার অনুমতি চাইলাম। আমাকে অনুমতি দেয়া হলো। তাই তোমরা ক্ববরের কাছে যাবে। কারণ ক্ববর মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দেয়। (সহীহ মুসলিম ৯৭৬, আবূ দাঊদ ৩২৩৪, নাসায়ী ২০৩৪, ইবনু মাজাহ্ ১৫৭২, মুসতাদরাক লিল হাকিম ১৩৯০, সহীহ আত্ তারগীব ৩৫৪২,মিশকাত হা/১৭৬৩)
.
এই মর্মে বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, সৌদি ফাতাওয়া বোর্ডের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতী, শাইখুল ইসলাম,ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] কে প্রশ্ন করা হয় কাফেরদের কবর যিয়ারত করা কি জায়েজ? উত্তরে তিনি বলেন শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্য হলে এতে কোন সমস্যা নেই। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মায়ের কবর যিয়ারত করেছেন। তিনি তাঁর রবের কাছে তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার অনুমতি চাইলে অনুমতি দেন নি। তবে কেবল কবর যিয়ারত করার অনুমতি দেয়া হয়েছে।”(মাজমু ফাতাওয়া ওয়া মাকালাত, ১৩/৩৩৭)।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
____________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।