শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে কুরবানির ইতিহাস ও গুরুত্ব এবং ফজিলত

কুরবানির পরিচয়: আভিধানিক অর্থে, যে পশুকে কুরবানি করা হয় তথা ইদুল আজহার দিনগুলোতে জবেহ করা হয়, তাকেই উদ্বহিয়্যাহ বা কুরবানি বলে। উদ্বহিয়্যাহ’র বহুবচন হলো আদ্বাহী। পারিভাষিক অর্থে, আল্লাহ’র নৈকট্য অর্জনের জন্য ইদুল আজহার দিন থেকে শুরু করে আইয়্যামে তাশরীক্বের (১১, ১২ ও ১৩ই যুলহাজ্ব) শেষদিন পর্যন্ত যে গৃহপালিত চতুষ্পদ পশুকে কুরবানি করা হয়, তাকে উদ্বহিয়্যাহ তথা কুরবানি বলা হয়।
·
▪️কুরবানীর ইতিহাস:
.
মহান আল্লাহ বলেন, প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমরা কুরবানীর বিধান রেখেছিলাম, যাতে তারা যবহ করার সময় আল্লাহর নাম স্মরণ করে এজন্য যে, তিনি চতুষ্পদ গবাদি পশু থেকে তাদের জন্য রিযিক নির্ধারণ করেছেন। অনন্তর তোমাদের উপাস্য মাত্র একজন। অতএব তাঁর নিকটে তোমরা আত্মসমর্পণ কর এবং আপনি বিনয়ীদের সুসংবাদ প্রদান করুন’ (সূরা হজ্জ ২২/৩৪) মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম কুরবানীর ঘটনা ঘটে আদম (আঃ)-এর দুই পুত্র হাবিল-কাবীলের মাধ্যমে। কুরআনুল কারীমে হাবিল-কাবীলের কুরবানীর ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে-হে রাসূল! আপনি তাদেরকে আদমের পুত্রদ্বয়ের বৃত্তান্ত যথাযথভাবে পাঠ করে শুনান। যখন তারা উভয়েই কুরবানী করেছিল, তখন একজনের কুরবানী কবুল হ’ল এবং অন্যজনের কুরবানী কবুল হ’ল না। সে (কাবীল) বলল, আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব। অপরজন (হাবিল) বলল, অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকীদের কুরবানী কবুল করেন। সে (হাবিল) বলল, যদি তুমি আমাকে হত্যা করতে আমার দিকে হস্ত প্রসারিত কর, তবুও আমি তোমাকে হত্যা করতে তোমার প্রতি হস্ত প্রসারিত করব না। কেননা আমি বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি’ (সূরা মায়েদা ২৭-২৮)।
.
▪️আমাদের জন্য প্রণীত কুরবানীর ইতিহাস:
.
কুরবানীর প্রচলন আদি পিতা আদম (আঃ)-এর সময় থেকে শুরু হ’লেও মুসলিম উম্মাহ প্রতি বছর ১০ যিলহজ্জ যে কুরবানী দিয়ে থাকেন, এর প্রচলন এসেছে নবী ইবরাহীম আলাইহিস সালাম থেকে। ইবরাহীমী কুরবানীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বর্ণনা করে আল্লাহ বলেন,যখন সে (ইসমাঈল) তার পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হ’ল, তখন তিনি (ইবরাহীম) তাকে বললেন, হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে যবহ করছি। অতএব বল, তোমার মতামত কি? ছেলে বলল, হে আববা! আপনাকে যা নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তা প্রতিপালন করুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন’ (সূরা সাফফাত ৩৭/১০২)। অতঃপর যখন পিতা ও পুত্র আত্মসমর্পণ করল এবং পিতা পুত্রকে উপুড় করে ফেলল’ (১০৩), ‘তখন আমরা তাকে ডাক দিলাম, হে ইবরাহীম (১০৪)! ‘নিশ্চয়ই তুমি তোমার স্বপ্ন সত্যে পরিণত করেছ। আমরা এমনিভাবে সৎকর্মশীল বান্দাদের পুরষ্কৃত করে থাকি’ (১০৫)। ‘নিশ্চয়ই এটি একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা’ (১০৬)। ‘আর আমরা তার (অর্থাৎ ইসমাঈলের) পরিবর্তে যবহ করার জন্য দিলাম একটি মহান কুরবানী’ (১০৭)। ‘এবং আমরা এটিকে (অর্থাৎ কুরবানীর এ প্রথাটিকে) পরবর্তীদেরকে মধ্যে রেখে দিলাম’ (১০৮)। ‘ইবরাহীমের উপরে শান্তি বর্ষিত হোক’ (১০৯)! হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর ৮৬ বৎসর বয়সে ইসমাঈল বিবি হাজেরার গর্ভে এবং ৯৯ বছর বয়সে ইসহাক্ব বিবি সারাহর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। ইবরাহীম (আঃ) সর্বমোট ২০০ বছর বেঁচে ছিলেন আল্লাহু আলাম।
.
▪️ঘটনার বর্ননা:
.
ফার্রা বলেন, যবহের সময় ইসমাঈলের বয়স ছিল ১৩ বছর। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ঐ সময় তিনি কেবল সাবালকত্বে উপনীত হয়েছিলেন।এমন সময় পিতা ইবরাহীম স্বপ্নে দেখলেন যে, তিনি বৃদ্ধ বয়সের একমাত্র সন্তান নয়নের পুত্তলি ইসমাঈলকে কুরবানী করছেন। নবীদের স্বপ্ন ‘অহি’ হয়ে থাকে। তাদের চক্ষু মুদিত থাকলেও অন্তরচক্ষু খোলা থাকে। ইবরাহীম (আঃ) একই স্বপ্ন পরপর তিনরাত্রি দেখেন। প্রথম রাতে তিনি স্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে উঠে ভাবতে থাকেন, কি করবেন। এজন্য প্রথম রাতকে (৮ই যিলহাজ্জ) ‘ইয়াউমুত তারবিয়াহ’ (يوم الةروية) বা ‘স্বপ্ন দেখানোর দিন’ বলা হয়। দ্বিতীয় রাতে পুনরায় একই স্বপ্ন দেখার পর তিনি নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারেন যে, এটা আল্লাহর পক্ষ হ’তে নির্দেশ হয়েছে। এজন্য এ দিনটি (৯ই যিলহাজ্জ) ‘ইয়াউমু আরাফা’ (يوم عرفة) বা ‘নিশ্চিত হওয়ার দিন’ বলা হয়। তৃতীয় দিনে পুনরায় একই স্বপ্ন দেখায় তিনি ছেলেকে কুরবানী করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন। এজন্য এ দিনটিকে (১০ই যিলহাজ্জ) ‘ইয়াউমুন নাহর’ (يوم النحر) বা ‘কুরবানীর দিন’ বলা হয় ।এই সময় ইবরাহীম (আঃ) শয়তানকে তিন স্থানে তিনবার সাতটি করে পাথরের কংকর ছুঁড়ে মারেন।উক্ত সুন্নাত অনুসরণে উম্মতে মুহাম্মাদীও হজ্জের সময় তিন জামরায় তিনবার শয়তানের বিরুদ্ধে কংকর নিক্ষেপ করে থাকে এবং প্রতিবারে আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা করে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে থাকে।আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে ছহীহ সনদে মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে যে, ইবরাহীম (আঃ) ছেলেকে কুরবানীর প্রস্ত্ততি নিলেন এবং তাকে মাটিতে উপুড় করে ফেললেন। এমন সময় পিছন থেকে আওয়ায এলো (يَا اِبْرَاهِيْمُ قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا) ‘হে ইবরাহীম! তুমি স্বপ্ন সার্থক করেছ’ (সূরা সাফফাত ১০৫)। ইবরাহীম পিছন ফিরে দেখেন যে, একটি সুন্দর শিংওয়ালা ও চোখওয়ালা সাদা দুম্বা (كَبْشٌ أَبْيَضُ أَقْرَنُ أَعْيَنُ) দাঁড়িয়ে আছে। অতঃপর তিনি সেটি মিনা প্রান্তরে (‘ছাবীর’ টীলার পাদদেশে) কুরবানী করেন। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এজন্য আমরা কুরবানীর সময় অনুরূপ ছাগল-দুম্বা খুঁজে থাকি।তিনি বলেন, ঐ দুম্বাটি ছিল হাবীলের কুরবানী, যা জান্নাতে ছিল, যাকে আল্লাহ ইসমাঈলের ফিদ্ইয়া হিসাবে পাঠিয়েছিলেন। ইবরাহীম উক্ত দুম্বাটি ছেলের ফিদ্ইয়া হিসাবে কুরবানী করলেন ও ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন (يَا بُنَىَّ اَلْيَوْمَ وُهِبْتَ لِىْ) ‘হে পুত্র! আজই তোমাকে আমার জন্য দান করা হ’ল।নিঃসন্দেহে এখানে মূল উদ্দেশ্য যবহ ছিলনা, বরং উদ্দেশ্য ছিল পিতা-পুত্রের আনুগত্য ও তাক্বওয়ার পরীক্ষা নেওয়া। সে পরীক্ষায় উভয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন পিতার পূর্ণ প্রস্ত্ততি এবং পুত্রের স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি ও আনুগত্যের মাধ্যমে। ইমাম কুরতুবী উপরোক্ত ১০৭ নং আয়াত وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيْمٍ উল্লেখ করে বলেন, এ আয়াতটি দলীল হ’ল এ বিষয়ে যে, উট ও গরুর চেয়ে ছাগল কুরবানী করা উত্তম’। রাসূল (ﷺ) নিজেও শিংওয়ালা দু’টো করে ‘খাসি’ কুরবানী দিতেন। অনেক বিদ্বান বলেছেন, যদি এর চাইতে উত্তম কিছু থাকত, তবে আল্লাহ তাই দিয়ে ইসমাঈলের ফিদ্ইয়া দিতেন’(বিস্তারিত জানতে দেখুন মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মুওয়াত্ত্বা মালেক, মিশকাত হা/২৬২১, ২৬২৬ ‘হজ্জ’ অধ্যায়, ‘কংকর নিক্ষেপ’ অনুচ্ছেদ। মুসনাদে আহমাদ হা/২৭০৭, তাহক্বীক্ব: আহমাদ শাকির ১/২৯৭পৃঃ; সনদ সহীহ, তাফসীরে কুরতুবী ১৫/৯৯-১০৭ পৃষ্ঠা তাফসীরে ইবনে কাছীর ৪/১৭ পৃষ্ঠা:)
.
▪️কুরবানীর গুরুত্ব:
.
কুরবানী মুসলিম উম্মার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত।আল্লাহ বলেন,আর কুরবানীর পশু সমূহকে আমরা তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শন সমূহের অন্তর্ভুক্ত করেছি।এর মধ্যে তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে।(সূরা হজ্জ ২২/৩৬)। আল্লাহ আরও বলেন,আর আমরা তার (অর্থাৎ ইসমাঈলের) পরিবর্তে যবহ করার জন্য দিলাম একটি মহান কুরবানী’। ‘এবং আমরা এটিকে (অর্থাৎ কুরবানীর এ প্রথাটিকে) পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিলাম’ (সূরা সাফফাত ৩৭/১০৭-১০৮)।আল্লাহ বলেন, তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে ছালাত আদায় কর এবং কুরবানী কর’ (সূরা কাওসার ১০৮/২)। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল ﷺ বলেছেন, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানী করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়।(ইবনু মাজাহ হা/২৫৩২; আহমাদ, বায়হাক্বী, হাকেম, দারাকুৎনী, মির‘আত (বেনারস) ৫/৭২; নায়লুল আওত্বার ৬/২২৭ পৃ.) কুরবানী ইসলামের একটি ‘মহান নিদর্শন’ (شعار عظيم), যা ‘সুন্নাতে ইবরাহীমী’ হিসাবে রাসূল (ﷺ) নিজে মদীনায় প্রতি বছর আদায় করেছেন এবং ছাহাবীগণও নিয়মিতভাবে কুরবানী করেছেন। অতঃপর অবিরত ধারায় মুসলিম উম্মাহ্র সামর্থ্যবানদের মধ্যে এটি চালু আছে। এটি কিতাব ও সুন্নাহ এবং ইজমায়ে উম্মত দ্বারা সুপ্রমাণিত।(মির‘আত খন্ড: ৫ পৃষ্ঠা: ৭১, ৭৩)
.
▪️কুরবানির ফজিলত:
.
(১). কুরআন থেকে: মহান আল্লাহ বলেছেন,“এটাই হলো আল্লাহ’র বিধান; যে আল্লাহ’র নিদর্শনসমূহকে সম্মান করে, নিঃসন্দেহে তা অন্তরস্থ তাকওয়ার অন্তর্ভুক্ত।” [সূরাহ হাজ্ব: ৩২] আর কুরবানির পশু মহান আল্লাহ’র নিদর্শনাবলির অন্তর্ভুক্ত।

(২). সুন্নাহ থেকে: বারা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে বর্ণিত, নাবী ﷺ বলেছেন,যে ব্যক্তি (ইদের) নামাজের আগে জবেহ করেছে, সে কেবল নিজের জন্যই জবেহ করেছে। আর যে ব্যক্তি নামাজের পরে জবেহ করেছে, সে তার কুরবানি পূর্ণ করেছে। আর সে মুসলিমদের রীতি অনুসারেই করেছে।”(সাহীহ বুখারী, হা/৫৫৫৬)

(৩). আল্লাহ’র উদ্দেশ্যে জবেহ করা এবং কুরবানি করার মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য কামনা করা সবচেয়ে মহান ও মর্যাদাপূর্ণ ইবাদতসমূহের অন্তর্ভুক্ত। মহান আল্লাহ তাঁর মহান কিতাবের একাধিক জায়গায় নামাজের সাথে জবেহ করার বিষয়টি মিলিয়ে উল্লেখ করেছেন, জবেহের উচ্চ মর্যাদা ও বড়ো অবস্থানের কারণে। মহান আল্লাহ আমাদেরকে যিলহজ্জের প্রথম ১০ দিনের আমলগুলো এবং রবের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কুরবানীর বিধান পালন করার তৌফিক দান করুক। (মহান আল্লাহই অধিক জ্ঞানী)।
_____________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।