রামাদান মাসে ২৫টি সুন্নাত বিরোধী বিদআতি কার্যক্রমের বর্ননা

ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান। ইসলামে নতুন করে কোন কিছু সংযোজন-বিয়োজনের সুযোগ নেই। এ ব্যবস্থা মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক জীবন থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক জীবন পর্যন্ত পরিব্যপ্ত। যা সর্বদিক থেকে পরিপূর্ণ ও সুস্পষ্ট। এতে কোন অস্পষ্টতার চিহ্ন নেই। এর প্রতিটি বিধান মানবতার জন্য অনুসরণীয় ও অনুশীলনযোগ্য। সর্বশেষ নবী ও রাসূল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা তাঁর জীবনে সম্পূর্ণটাই বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রদর্শিত এ জীবন বিধানের বাস্তব রূপ হচ্ছে তাঁর সুন্নাত। এজন্য পরবর্তীকালে এর বাইরে ইবাদতের নামে যা কিছু নতুন আবিষ্কৃত হয়েছে সেটাকেই বিদআত হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। শরীআতে নতুন কোন রীতি-নীতি সংযোজিত হলে সেটা বিদআত হয়; যা গর্হিত অপরাধ। মূলত বিদআত মুমিনের আমল বিনষ্টকারী এক ভয়ংকর মারণাস্ত্র। এটি জঘন্য অপরাধ ও ঈমান বিধ্বংসী এক মারাত্মক ব্যাধি। ঘুর্ণিঝড় যেমন সবকিছুকে মুহূর্তের মধ্যে লণ্ড-ভণ্ড ও বিনাশ করে দেয় অনুরূপ বিদআতও তার পুঞ্জীভূত আক্রমণে মুসলিম জীবনকে গ্রাস করে ফেলে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, مَا فَرَّطۡنَا فِی الۡکِتٰبِ مِنۡ شَیۡءٍ ‘আমরা এ কিতাবে কোন কিছুই বাদ দেইনি।’ (সূরা আল-আনআম: ৩৮)। উপরিউক্ত আয়াতদ্বয় থেকে স্পষ্ট হয় যে, ইসলাম পরিপূর্ণ একটি জীবন ব্যবস্থা। দ্বীন পরিপূর্ণ থাকার পরেও বর্তমানে ইসলামের চতুর্থ স্তম্ভের রামাদান মাসে সমাজে একাধিক বিদআত প্রচলিত রয়েছে। যেগুলো এক জায়গায় এক রকম, অন্য জায়গায় আরেক রকম। এক দেশের লোকাচার অন্য দেশ থেকে ভিন্ন। নিম্নে আমাদের দেশে প্রচলিত এ সংক্রান্ত কিছু বিদআতী কাজের চিত্র তুলে ধরবো ইন শা আল্লাহ্।

▪️একনজরে রামাদান মাসে প্রচলিত বিদআতসমূহ:
_______________________________________
.
(১). রামাদান আসার পূর্বে ফযীলতের আশায় রামাদানের প্রচার করা:
.
আমাদের সমাজে হাদীসের নামে প্রচার করা হয় যে, যে ব্যক্তি রামাদানের সংবাদ মানুষের মাঝে প্রচার করবে; তার উপর জাহান্নামের আগুন হারাম করে দেয়া হবে। এটা কোন হাদীস নয়। বরং বিদআতীদের অপপ্রচার। তাই এসব করা থেকে সাবধান থাকতে হবে। অন্যথায় রাসূল (ﷺ) এর নামে মিথ্যা প্রচারের পরিণতি হবে জাহান্নাম। (দেখুন সহীহ বুখারী হা/৩৪৬২)
.
(২). নতুন চাঁদ দেখে আঙ্গুল উঁচু করা:
.
চাঁদ দেখে সেদিকে আঙ্গুল ইশারা করা বিদআত। কেননা এ ব্যাপারে কোন সহীহ দলীল পাওয়া যায় না। শায়খ আলী ইবনু মাহফূয বলেন, ‘যে ব্যক্তি এমনভাবে নতুন চাঁদের দিকে হাত উঠিয়ে দু‘আ করবে এবং চুমু খাবে সে সুন্নাত বিরোধী কাজ করবে। কারণ এ বিষয়ে শারঈ কোন বিধান আছে এটা আমি জানি না।’
(আল-ইবদা‘ ফী রামাযানিল ইবতিদা‘, পৃ. ৩০৩)। শায়খ বকর বিন আব্দুল্লাহ আবু যায়েদ (১৩৬৫-১৪২৯ হি.) বলেন, ‘শুধু রামাযানের চাঁদ দেখে সেদিকে হাত উঠিয়ে দু‘আ করা একটি নোংরা বিদআত, বড় ধরনের অজ্ঞতা এবং আল্লাহর বিধানের সাথে বেআদবী।’ (তাছহীহুদ দু‘আ, পৃ. ৫০৯)। তবে চাঁদ দেখার সুন্নাতী পদ্ধতি হলো দুআ পাঠ করা। দুআটি হলো- اَللّهُمَّ أَهْلِلْهُ عَلَيْنَا بِالْيُمْنِ وَالْإِيْمَانِ وَالسَّلَامَةِ وَالْإِسْلَامِ رَبِّىْ وَرَبُّكَ اللهُ উচ্চারণ: আল্ল-হুম্মা আহলিলহু আলায়না বিল ইউম্নি ওয়াল ঈমানি ওয়াস্ সালা-মাতি ওয়াল ইসলাম। রব্বী ওয়া রব্বুকাল্লহ।’ অনুবাদ: ‘হে আল্লাহ! এ চাঁদকে আমাদের মাঝে বরকত, ঈমান, শান্তি, নিরাপত্তা ও ইসলামের সাথে উদিত করুন। আমার রব ও তোমার রব আল্লাহ।’ (তিরমিযী, হা/৩৪৫১; মিশকাত, হা/২৩২৮)
.
(৩). রামাদান উপলক্ষে আলোকসজ্জা করা:
.
শুধু রামাদান মাস উপলক্ষে মোমবাতি, বিভিন্ন রং-বেরং প্রদীপ জ্বালিয়ে আলোকসজ্জা করা এবং এর মাধ্যমে সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ করা বিদআত।
.
(৪). মিছিল বের করা:
.
কিছু কিছু মুসলিম দেশে দেখা যায়, চাঁদ দেখার পর পরস্পরের মাঝে প্রচার করার জন্য মিছিল বের করা হয়। সাথে ঢাক-ঢোল পিটানো হয় বা সাইরেন বাজানো হয়, মসজিদের মাইকে কুরআন তেলাওয়াত, বক্তৃতা ও গযল ইত্যাদি বাজানো হয়। এগুলো বিদআতী কর্মের অন্তর্ভুক্ত।
.
(৫). সূরা আনআম পড়া:
.
রামাদানের প্রথম দিন প্রথম রাক‘আতে সূরা আন‘ষআম সম্পূর্ণ শেষ করা। অথচ আমলটি ভিত্তিহীন। মুহাদ্দিসগণ বলেন, এই বর্ণনার সনদের কোন ভিত্তি নেই (لا أصل له)। ধারণা করা হয় যে, এই সূরাটি একবারে এক সাথে অবতীর্ণ হয়েছিল। মুস্তাদরাকে হাকেমে (২/৩১৪), ইবনু আব্বাস, আলী ও জাবির (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) হতে বর্ণিত। হাদীসটি সম্পর্কে ইমাম যাহাবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আমি মনে করছি হাদীসটি মওযূ‘ বা জাল। যদিও ইমাম হাকেম বলেছেন, ইমাম মুসলিমের শর্তে হাদীসটি সহীহ। কিন্তু শৈথিল্যবাদী হিসাবে তার এই মন্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়।
.
(৬). সন্দেহের দিনে সিয়াম পালন করা:
.
অধিক সতর্কতা অবলম্বনের জন্য সন্দেহপূর্বক রামাদানের একদিন আগে সিয়াম রাখা বিদআত। এ ব্যাপারে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, مَنْ صَامَ الْيَوْمَ الَّذِى يَشُكُّ فِيهِ النَّاسُ فَقَدْ عَصَى أَبَا الْقَاسِمِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘যে ব্যক্তি সন্দেহের দিনে সিয়াম পালন করবে, সে আবুল ক্বাসেম মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -কে অস্বীকার করল।’ (তিরমিযী হা/৬৮৬, সনদ সহীহ)
.
(৭). ঋতুবতী মহিলাদের খানা-পিনা থেকে দূরে থাকা:
.
অনেক ঋতুবতী মহিলা মনে করেন, রামাদানে দিনের বেলা পানাহার করা থেকে দূরে থাকলে সওয়াব হয়। আবার কেউ কেউ নিয়ত না করেই পুরা দিন কিছুই পানাহার করেন না। অথচ এটা শরীআতের স্পষ্ট লংঘন।
.
(৮). সিয়াম অবস্থায় চুপ থাকা:
.
সিয়াম অবস্থায় সাধারণ কথা বলাকে অনেকেই গুণাহের কাজ মনে করেন, যা বিদআত। শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়া (মৃত ৭২৮ হি.) বলেন, ‘সিয়াম অবস্থায় চুপ থাকা বা সাধারণ কথা-বার্তা থেকে বিরত থাকা সকল আলেমদের ঐকমত্যে অপছন্দনীয় বিদআত।’ (মাজমু‘ঊল ফাতাওয়া, ২৫তম খণ্ড, পৃ. ২৯২)। ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘এক সময় নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কথা বলছিলেন। সেখানে এক লোককে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখে তার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। লোকেরা বলল; সে আবু ইসরাঈল, সে মানত করেছে যে, সে দাঁড়িয়ে থাকবে, বসবে না, ছায়া গ্রহণ করবে না, কারো সাথে কথা বলবে না এবং সিয়াম পালন করবে। অতঃপর নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন; তাকে নির্দেশ দাও যে, সে যেন কথা বলে, ছায়া গ্রহণ করে, বসে এবং তার সিয়াম পূর্ণ করে।’ (সহীহ বুখারী হা/৬৭০৪)
.
(৯). কুরআন খতমের দিন পানি ভর্তি পাত্র উপস্থিত করা:
.
তারাবীহর সালাতে যেদিন পবিত্র কুরআন খতম হবে সেদিন অর্থাৎ ২৭ রামাযানে একটি পানি ভর্তি বড় পাত্র ইমাম সাহেবের কাছাকাছি রাখা হয়। আর ইমাম সাহেব সেদিন কুরআন খতম করে সালাত শেষে ঐ পানিতে ফুঁক দেন। আর সেই পানি মুসল্লীরা বরকতের আশায় তা বাড়ীতে নিয়ে যান। এটি একটি নোংরা বিদআত। এ থেকে বিরত থাকতে হবে।
.
(১০). কুরআন বখশিয়ে দেয়া:
.
এটা এক আশ্চর্য ধরনের বিদআত। বর্তমানে বিশেষ করে মেয়েরা পুরো মাস ধরে অনেক কষ্ট করে কুরআন পড়েন ও খতমও করেন। অতঃপর রামাযানের শেষের দিকে মসজিদের হুজুর বা তারাবীহর ইমামদের ডেকে সেটা আবার বখশিয়ে নেন। হয়ত অনেকের কাছে শব্দটি নতুন। কিন্তু চরম বাস্তবতা এটাই। ইমাম বিশেষ মুনাজাতের মাধ্যমে যার নাম বলা হয়, সরাসরি তার নামেই বখশিয়ে দেন। অর্থাৎ এই কুরআন পড়ে পাঠক যত নেকী কামাই করেছিলেন, তার সবই বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজনের জীবিত বা মৃত যে কোন ব্যক্তির নামে দিয়ে দেয়া হয়। এটা হয় সাধারণত ২৭ রামাদানের রাত্রিতে। সেদিন হুজুর অনেক ব্যস্ত থাকেন। বলা যায়, প্রায় ফজর পর্যন্ত ইমাম সাহেবদের এই কষ্টটা করতে হয়। তবে কষ্টতেও মজা আছে। কারণ প্রত্যেক বাড়ী থেকেই বিশেষ মুনাজাতের জন্য লোকেরা বিশেষ ইনকাম হাদিয়া দিয়ে দেন। পুরা রামাদানে তারাবীহ পড়িয়ে যা হয়, এক রাতে তার চেয়ে অনেক বেশি হয়। এটা বিনা পূজির বিদআতী ব্যবসা।
.
(১১). কারো নামে কুরআন পড়া:
.
কুরআন পড়লে অসংখ্য নেকী হয়। (তিরমিযী হা/২৯১০; মিশকাত হা/২১৩৭; সিলসিলা সহীহাহ হা/৩৩২৭)। কিন্তু অন্য কারো জন্য কুরআন পড়ে দেয়া ঠিক নয়। এটি একটি আবিষ্কৃত নতুন বিদআত। সমাজে যারা কুরআন পড়তে পারেন না কিন্তু সালাত আদায় করেন, তারা কোন হাফেয বা ইমামদের ধরে কুরআন পড়ান, আর উনি বসে বসে শুনেন। এমতাবস্থায় যখন শ্রোতার কোন কাজের সময় হয়, তখন পাঠককে বলেন, ‘আচ্ছা হুজুর রাখেন, আবার অমুক সময় আসব।’ এভাবে শুনে শুনে কুরআন খতম করেন। আর শেষে হুজুরকে বিশেষ হাদিয়া দেয়া হয়। দুঃখের বিষয় হলো- ঐ এক মাস বড় সাহেব যদি কুরআন পড়তেন, তাহলে হয়তো অনেক এগিয়ে যেতে পারতেন। আর এর মর্যাদাও অনেক বেশি। হাদীসটি খেয়াল করুন- আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন; “কুরআনের হাফিয বা পাঠক লিপিকার সম্মানিত ফিরিশতাদের মত। (কুরআন শিখতে গিয়ে) খুব কষ্টদায়ক হওয়া সত্ত্বেও যে বারবার কুরআন পাঠ করার চেষ্টা করে, সে দ্বিগুণ নেকী পাবে।’’ (সহীহ বুখারী, হা/৪৯৩৭)
.
(১২). সালাতুত তাসবীহ পড়া:
.
রামাদানের ২৭ রাত্রিতে কিংবা শেষ দশকের কোন এক বিজোড় রাত্রে ইমাম সাহেব সবাইকে নিয়ে জামাআতের সাথে এ সালাত আদায় করে থাকেন। অথচ এটা বিদআত। পারলে দিনে একবার, নইলে সপ্তাহে, মাসে, বছরে কিংবা জীবনে একবার পড়বে। তাতে আগে-পিছের জানা-অজানা, ছোট-বড় সব গোনাহ মাফ হয়ে যাবে। (আবু দাঊদ, হা/১২৯৭-১২৯৯; ইবনু মাজাহ, হা/১৩৮৬-১৩৮৭; মিশকাত, হা/১৩২৮)। কিন্তু এই সালাতের সহীহ কোন দলীল নেই। সালাতুত তাসবীহ সম্পর্কে যে হাদীসগুলো বর্ণিত হয়েছে, সেগুলোর বিশুদ্ধতা নিয়ে মুহাদ্দিসগণের মাঝে অনেক মতানৈক্য রয়েছে। কেউ এ সম্পর্কিত হাদীসকে ‘মুরসাল’, কেউ ‘মওকূফ’, কেউ ‘যঈফ’, কেউ ‘মওযূ’ বা জাল বলেছেন। সঊদী আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদ মন্তব্য করেছেন, صَلَاةُ التَّسْبِيْحِ بِدْعَةٌ وَحَدِيْثُهَا لَيْسَ بِثَابِتٍ بَلْ هُوَ مُنْكَرٌ وَذَكَرَهُ بَعْضُ أَهْلِ الْعِلْمِ فِى الْمَوْضُوْعَاتِ ‘সালাতুত তাসবীহ’ বিদআত। এর হাদীস প্রমাণিত নয়; বরং মুনকার বা অস্বীকৃত। কোন কোন মুহাদ্দিস জাল হাদীসের মধ্যে একে উল্লেখ করেছেন।’ (ফাতাওয়া লাজনা আদ-দায়েমাহ, ৮ম খণ্ড, পৃ. ১৬৪)। যদিও আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) উক্ত হাদীসের যঈফ সূত্রসমূহ পরস্পরকে শক্তিশালী করে বলে তাকে স্বীয় সহীহ আবু দাঊদে উল্লেখ করেছেন। (হা/১১৫২)। তবুও এরূপ বিতর্কিত, সন্দেহযুক্ত ও দুর্বল ভিত্তির উপরে কোন ইবাদত বিশেষ করে সালাত প্রতিষ্ঠা করা যায় না। তাই এ থেকে বিরত থাকাই উত্তম। উল্লেখ্য, এই সালাতকে অনেকেই ‘লাইলাতুল ক্বদর’-এর সালাত বলে থাকে। এটাও বিদ‘আত।
.
(১৩). যে কোন আমলে ৭০ গুণ সওয়াব হওয়ার আশা করা:
.
একটি অস্বীকৃত হাদীসের উপর ভিত্তি করে সাধারণ মানুষ উক্ত ধারণা পোষণ করে থাকে। এমনকি কিছু আলেমও মনে করেন, অন্য মাসের চেয়ে রামাদানে কোন ফরয ইবাদত করলে তা ৭০ গুণ বৃদ্ধি করা হয়। অথচ মুহাদ্দিসগণের ঐকমত্যে হাদীছটি ‘মুনকার’। (ইবনু খুযায়মাহ, হা/১৮৮৭; মিশকাত, হা/১৯৬৫; সিলসিলা যঈফা হা/৮৭১)
.
(১৪). রামাদানকে তিন ভাগে ভাগ করা:
.
রামাদানকে তিনভাগে বিভক্ত করা সম্পর্কি বর্ণিত হাদীসটি যঈফ ও মুনকার। (ইবনু খুযায়মাহ, হা/১৮৮৭; মিশকাত, হা/১৯৬৫; সিলসিলা যঈফাহ, হা/১৫৬৯)‌।
যেখানে বলা হয়েছে যে, ‘এটি এমন একটি মাস, যার প্রথম ভাগ রহমত, মাঝভাগ মাগফিরাত এবং শেষভাগ জাহান্নাম থেকে মুক্তি।’ (বায়হাক্বী-শু‘আবুল ঈমান, হা/৩৩৩৬; মিশকাত, হা/১৯৬৫)। অথচ আল্লাহর রহমত, ক্ষমা ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে কোন সীমাবদ্ধ নয়। এছাড়া এটা একাধিক সহীহ হাদীসের বিরোধী। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যখন রামাযান মাস আগমন করে, তখন আসমানের দরজা সমূহ খুলে দেয়া হয়। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, জান্নাতের দরজা সমূহ খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজা সমূহ বন্ধ করা হয় ও শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়। অন্য বর্ণনায় এসেছে, রহমতের দরজা সমূহ খুলে দেয়া হয়।’ (সহীহ বুখারী, হা/১৮৯৯, হা/৩২৭৭;সহীহ মুসলিম, হা/১০৭৯; মিশকাত, হা/১৯৫৬)। তাই রামাযানকে রহমত, মাগফিরাত ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি এ তিন ভাগে ভাগ করা বিদ‘আত।
.
(১৫). নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই সাহরী সম্পন্ন করাকে জরূরী মনে করা:
.
সাহরী সময়ের পূর্বে করতে হবে এটাই ঠিক। কিন্তু অতিরিক্ত সতর্কতার কারণে যদি দশ মিনিট বা পনের মিনিট পূর্বে হয়, তাহলে সেটা বিদআত হবে। শায়খ সালেহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, বর্তমানে কিছু সময়সূচী দেখা যায়, যেখানে ‘সেহরী থেকে বিরত থাকার সময়’ উল্লেখ করা থাকে। যা হয় মূল ফজরের (আযান) দশ বা পনের মিনিট পূর্বে। এটা কি সুন্নাত না-কি বিদ‘আত? উত্তরে শায়খ বলেন, এটা একটি স্পষ্ট বিদ‘আত। সুন্নাত হিসাবে এর কোন ভিত্তি নেই। বরং সুন্নাত হলো সম্পূর্ণ এর বিপরীত। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তোমরা পানাহার কর যতক্ষণ না কাল রেখা থেকে ভোরের শুভ্র রেখা পরিষ্কার দেখা যায়। অতঃপর সিয়াম পূর্ণ কর রাত (সূর্যাস্ত) পর্যন্ত। আর যতক্ষণ তোমরা ই‘তিকাফ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান কর, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রীদের সাথে মিলামেশা কর না। এই হলো আল্লাহ কর্তৃক বেঁধে দেয়া সীমা। অতএব এর কাছেও যেও না। এভাবেই আল্লাহ নিজের আয়াত সমূহ মানুষের জন্য বর্ণনা করেন, যাতে তারা বাঁচতে পারে। (সূরা আল-বাক্বারাহ: ১৮৭)। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন; বিলাল আযান দিবে রাতে। তখন তোমরা পানাহার কর, যতক্ষণ তোমরা আব্দুল্লাহ ইবনু উম্মে মাকতূমের আযান না শোন। আর ইবনু উম্মে মাকতূম ফযর হলেই আযান দেয়। (সহীহ মুসলিম, হা/১০৯২; মিশকাত, হা/৬৮০)। সুতরাং যারা এভাবে সাহরীর পূর্বেই সাহরী গ্রহণের সময় নির্ধারণ করেছে, তারা আল্লাহর দেওয়া ফরযের উপর বাড়াবাড়ি করেছে, যা বাতিল ও প্রত্যাখ্যাত।
.
(১৬). মসজিদের মাইকে ডাকাডাকি করা:
.
রামাদান মাসে শেষ রাতে মুআযযিন কর্তৃক মাইকে উচ্চ আওয়াযে কুরআন তেলাওয়াত, গযল, ইসলামী সঙ্গীত বলা অথবা টেপ রেকর্ডার চালিয়ে বক্তাদের ওয়ায, গযল বাজানো কিংবা ‘ভায়েরা আমার, বোনেরা আমার! উঠুন, সাহারীর সময় হয়েছে, রান্না-বান্না করুন, খাওয়া-দাওয়া করুন’ ইত্যাদি বলে অনবরত ডাকাডাকি অথবা উঁচু আওয়াযে হুইসল বাজানো সবই শরীআতের নামে নতুন আবিষ্কার, যা স্পষ্ট বিদআত।(ইবনু হাজার, ফাৎহুল বারী, হা/৬২১-এর ব্যাখ্যা, ২/৪৩৬ পৃঃ, ‘আযান’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১৩)। এছাড়া এলাকার কিছু যুবক রামাদানের প্রতি রাতের শেষে মাইক নিয়ে সম্মিলিত কণ্ঠে গযল বা কাওয়ালী গেয়ে মানুষের বাড়ীর দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে চাঁদা আদায় করে অথবা মাইক বাজিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে থাকে। এ ছাড়াও এলাকা ভেদে ভিন্ন ভিন্ন বিদআতী কার্যক্রম দেখা যায়। বরং এ সময় সেহরীর আযান দেয়া সুন্নাত।(সহীহ বুখারী, হা/১৯১৮; নাসাঈ, হা/ ৬৪১, সনদ সহীহ) অতএব মনগড়া পদ্ধতি পরিত্যাগ করে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর শিখানো পদ্ধতিকে গ্রহণ করা জরূরী।
.
(১৭). সাহরীর সময় মুখে নিয়ত করা:
.
নিয়ত অর্থ, মনন করা বা সংকল্প করা। তাই মনে মনে সিয়ামের নিয়ত করতে হবে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ফজরের পূর্বে সিয়ামের নিয়ত করেনি, তার সিয়াম হয়নি।’ (আবু দাঊদ, হা/২৪৫৪, সনদ সহীহ; মিশকাত, হা/১৯৮৭)। মুখে আরবীতে নিয়ত পড়ার শারঈ কোন ভিত্তি নেই। মুখে উচ্চারণ করে নিয়ত বলা বিদআত। শাইখ ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন; ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, النية وهى القصد و محلها القلب و تلفظ بها بدعة ‘নিয়ত অর্থ পরিকল্পনা করা। তার স্থান হলো অন্তর। আর মুখে উচ্চারণ করা বিদআত।’ (বিন বায অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ফাতওয়া নং-১২০১)
.
(১৮). দেরিতে ইফতার করা:
.
অধিক পরহেযগারিতা ও তাক্বওয়ার প্রদর্শন করতে গিয়ে সতর্কতা স্বরূপ নির্ধারিত সময়ের সাথে আরো কয়েক মিনিট সময় যোগ করে ইফতরা করা হয়। যা প্রকাশ্য বিদআত ও সূক্ষ্ম জালিয়াতি ছাড়া কিছুই নয়। কেননা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, لَا يَزَالُ النَّاسُ بِخَيْرٍ مَا عَجَّلُوا الفِطْرَ ‘মানুষ ততদিন কল্যাণের উপর থাকবে, যতদিন তাড়াতাড়ি ইফতার করবে।’ (সহীহ বুখারী, হা/১৯৫৭; তিরমিযী, হা/৬৯৯; ইবনু মাজাহ, হা/১৬৯৮; মিশকাত, হা/১৯৮৪)। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন, وَغَرَبَتِ الشَّمْسُ فَقَدْ أَفْطَرَ الصَّائِمُ ‘সূর্যাস্তের সাথে সাথেই সায়েম ইফতার করবে।’ (সহীহ বুখারী, হা/১৯৫৪; মিশকাত, হা/১৯৮৫)। সহীহ বুখারীতে বর্ণিত পূর্বের হাদীসে ‘তাড়াতাড়ি ইফতার করা’-কে কল্যাণের উপর থাকার কথা বলা হয়েছে। এখানে ‘তাড়াতাড়ি ইফতার করা’ বলতে যথাসময় ইফতার করাকে বুঝানো হয়েছে। সময়ের আগে নয়। অর্থাৎ সূর্যাস্তের সাথে সাথে সায়েম ইফতার করবে। নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, لَا يَزَالُ الدِّيْنُ ظَاهِرًا مَا عَجَّلَ النَّاسُ الْفِطْرَ لأَنَّ الْيَهُوْدَ وَالنَّصَارَى يُؤَخِّرُوْنَ ‘দ্বীন ততদিন বিজয়ী থাকবে, যতদিন লোকেরা জলদি ইফতার করবে। কেননা ইহূদী ও খ্রীষ্টানরা ইফতার বিলম্বে করে।’ (আবু দাঊদ, হা/২৩৫৩; মিশকাত, হা/১৯৯৫, সনদ সহীহ)। ইবনু হাজার আসক্বালানী (৭৭৩-৮৫২ হিঃ) বলেন, ইফতারের সময় অযথা বিলম্ব করা একটি জঘন্য বিদআতের অন্তর্ভুক্ত। মনে হচ্ছে সে ইবাদতের মধ্যে ‘ইহত্বিয়াত’ তথা অধিক সর্তকতা অবলম্বন করবে। আর বিষয়টি অল্প মানুষই জানে। এর মাধ্যমে আযানকে সূর্যাস্তেরও কিছু পর পর্যন্ত বিলম্ব করে সাধারণ মানুষের উপর যুলুম করা হয়। ধারণার উপর ইবাদত করতে গিয়ে তারা ইফতারকে বিলম্ব করছে, অনুরূপভাবে সেহরীও আগে আগে সম্পন্ন করছে, যা স্পষ্ট সুন্নাত বিরোধী আমল। ফলে তাদের কল্যাণ কমে যাচ্ছে এবং খারাবী বৃদ্ধি পাচ্ছে। আল্লাহ আমাদের সাহায্য করুন-আমীন!! (ইবনু হাজার,ফাৎহুল বারী, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৯৯)
.
(১৯). তারাবীহর সালাতের জন্য মানুষকে ডাকাডাকি করা:
.
তারাবীহর সালাত সুন্নাত। এটা ওয়াজিব বা ফরয কিংবা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহও নয়, বরং এটি সুন্নাত। যদি কেউ পড়ে, তাহলে তার জন্য নিঃসন্দেহে অফুরন্ত নেকী ও মর্যাদা রয়েছে। পূর্বের (সগীরা) গোনাহ মাফের গ্যারান্টি রয়েছে। কিন্তু সিয়ামের জন্য তারাবীহর সালাতকে আবশ্যিক করে নেয়া কিংবা অন্যকে এ ভাবে বলা যে, তারাবীহর সালাত আবশ্যক, পড়তেই হবে। তুমি সিয়াম রাখবে, অথচ তারাবীহ পড়বে না? এ সকল কথার শারঈ কোন ভিত্তি নেই। উল্লেখ্য, তারাবীহ সালাতের কোন ক্বাযাও নেই এবং ছেড়ে দিলে কোন গুনাহও হবে না। তবে অফুরন্ত নেকী থেকে বঞ্চিত হবে।
.
(২০). তেলাওয়াত সকল মসিজদে একই সাথে শুরু করা:
.
বিষয়টি নতুন হলেও আমাদের দেশে তারাবীহর মুসল্লীদের মধ্যে একটি অলিখিত নিয়ম করা আছে যে, প্রত্যেক মসজিদে একই সমান ক্বিরাআত পড়তে হবে। যেমন; সিলেটে প্রথম দেড় পারা পড়বে, অনুরূপ ঢাকা, চিটাগাং, রাজশাহী, ফরিদপুর সব জায়গাই একই ক্বিরাআত হবে, কম-বেশি হবে না। যাতে করে একজন মুসল্লী দেশের যেখানেই থাকুন না কেন, তিনি সেখানে গিয়েই তারাবীহতে অংশগ্রহণ করলে কুরআন খতমের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারলেন। অথচ আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের যতটুকু তেলাওয়াত করা সহজ ততটুকু তেলাওয়াত করার কথা বলেছেন। (সূরা আল-মুয্যাম্মিল: ২০)। এর পাশাপাশি সময়ের বিষয়টিকেও বিশেষভাবে নির্দিষ্ট করা হয়ে থাকে।অর্থাৎ পুরা ঢাকা শহরে একই সাথে সালাত শুরু হবে। অথচ এটা সালাতের সাথে যেমন বেআদবী; তেমনি পবিত্র কুরআনের সাথেও কিছু সীমাবদ্ধতা বেঁধে দেয়া, যা অন্যায় এবং সুন্নাতের স্পষ্ট লংঘন।
.
(২১). তারাবীহর সময় বিশেষ দুআ পাঠ:
.
তারাবীহর সালাতের জন্য নির্দিষ্ট কোন দুআ নেই। অথচ প্রতি চার রাকআত পর পর ‘সুবহানা যিল মুলকি ওয়াল মালাকূতি….ইয়া মুজীরু, ইয়া মুজীরু’ মর্মে যে দু‘আ আবিষ্কার করেছে, নিঃসন্দেহে তা স্পষ্ট বিদ‘আত। সুতরাং এই দুআ পড়া যাবে না। বরং অন্যান্য সালাতের পর যে পাঠ করা হয় সেগুলোই পড়বে। (হিলইয়াতুল আওলিয়া, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২২১; সনদ সহীহ,সিলসিলা সহীহাহ, হা/৯৭২-এর আলোচনা দ্র.)। আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ ইবনুল হাজ্জ আল-মালেকী (মৃত ৭৩৭ হি.) বলেন, ‘তারাবীহতে ইমাম ও মুক্তাদি মিলে তৈরিকৃত যে পন্থা রয়েছে, তা ত্যাগ করা আবশ্যক। আর তা হলো- প্রত্যেক ২ সালামের পর অর্থাৎ ৪ রাকআত পর পর সবাই এক সাথে উঁচু আওয়াযে যে বিশেষ দু‘আ পাঠ করা হয়, তা স্পষ্ট বিদ‘আত‌।’ (আল-মাদখাল, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৯৩-২৯৪)
.
(২২). ইতিকাফ সংক্রান্ত ভুল ধারণা:
.
ই‘তিকাফ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আল্লাহর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি রামাদানের শেষ ১০ দিন ই‘তিকাফ করতেন। কিন্তু এ সম্পর্কে আমাদের দেশে মনে করা হয় যে, সমাজের পক্ষ থেকে এক ব্যক্তিকে অবশ্যই ইতিকাফে বসতে হবে, তা না হলে সবাই গুণাহগার হবে। কিন্তু এ ধারণা মোটেই ঠিক নয়। বরং এটি ব্যক্তিগত ইবাদত।
.
(২৩). ২৭ রামাদানে কুরআন খতম ও বিশেষ দু‘আ বা মুনাজাত করা:
.
নির্দিষ্ট দিন ঠিক করে দ্বীনী কাজ করা ইসলাম সমর্থিত নয়। শুধু দুই ঈদ ব্যতীত। তাছাড়া তারাবীহর সালাতে কুরআন খতম করার পক্ষে কোন দলীল পাওয়া যায় না। তবে তারাবীহ বা তাহাজ্জুদ সালাতে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সাহাবায়ে কেরাম অনেক বেশী তেলাওয়াত করতেন মর্মে অনেক দলীল রয়েছে। (মুওয়াত্ত্বা মালিক, ১ম খণ্ড, পৃ. ১১৫; মিশকাত,হা/১৩০২; সহীহ ইবনু খুযায়মাহ, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৮৬)। সমাজে ‘খতম তারাবীহ’ নামে নতুন প্রথা সৃষ্টি হয়েছে। এতে ইমাম যেমন তারতীলসহ তেলাওয়াত করতে পারেন না, তেমনি মুক্তাদীরা কিছু বুঝতে পারেন না। তাই সালাতে খতম করার বিষয়টি কেউ যদি শরীআত মনে করে পালন করে, তাহলে অবশ্যই বিদআত হবে। এছাড়া এইদিন তারাবীহর সালাত শেষে বিশেষ মুনাজাত ধরা হয়। এ ব্যাপারে শায়খ উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ)-কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘তারাবীহর সালাতে কুরআন খতমের ব্যাপারে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অথবা সাহাবীগণের পক্ষ থেকে কোন সুন্নাতের বিষয়ে আমার জানা নেই।’ (উসাইমীন, মাজমূ‘ঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, ১৪তম খণ্ড, পৃ. ২১২)। শায়খ বকর বিন আব্দুল্লাহ আবু যায়েদ বলেন, ‘তারাবীহর সালাতের শেষে ‘কুরআন খতমের দু‘আ’ নামে যে দু‘আ করা হয়, তা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বা সাহাবীগণ (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)-এর শরী‘আতে কোন ভিত্তি নেই। বস্তুত এর কোন বর্ণনাও আসেনি। যদি কেউ দাবী করে যে, দলীল আছে, তাহলে সে যেন তা দেখায়।’ (তাছহীহুদ দু‘আ, পৃ. ৪২৩-৪২৪)
.
(২৪). জুম‘আতুল বিদা পালন:
.
‘জুম‘আতুল বিদা’ নামে শরী‘আতে কোন জুম‘আর ভিত্তি নেই। একটি জাল হাদীসের মিথ্যা ফযীলতের কারণে এই নামটি প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। (আব্দুল হাই লাক্ষে্নৗবী হানাফী, আল-আছারুল মারফূ‘আহ ফিল আখবারিল মাওযূ‘আহ, পৃ. ৮৫)। বিদ‘আতপন্থীরা রামাযানের শেষ বা বিদায়ী জুম‘আকে ‘জুম‘আতুল বিদা’ বলে থাকে। সঊদী আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া বোর্ড ‘লাজনাহ দায়েমাহ’-কে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তারা বলেন, সালাত একটি ইবাদত। আর এর ভিত্তিও আছে- সেটা তাওক্বীফী… কিন্তু ‘জুম‘আতুল বিদা’ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে তো নয়ই; বরং সাহাবী, তাবেঈ, ইমাম-মুজতাহিদগণ এর পক্ষ থেকেও এমন কোন কথা বা আমল বর্ণিত হয়নি। যদি তাদের মাঝে আমল থাকতই, তাহলে কেউ না কেউ আমাদের পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিতেন। কিন্তু না, কথা ও কর্মে কেউই কোন হাদীসের মাধ্যমে বর্ণনা করেননি। আর এটা একটি স্পষ্ট বিদ‘আত। (ফাতাওয়া লাজনাহ আদয়-দায়েমাহ, ৮ম খণ্ড, পৃ. ১৬৭-১৬৮)। শায়খ সালেহ আল-উসাইমীন (রহঃ)ও অনুরূপ জবাব দিয়েছেন। (শায়খ উসাইমীন, মাজমূ‘ঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, ১৪তম খণ্ড, পৃ. ৩৩১)
.
(২৫). দলবদ্ধভাবে কবর যিয়ারত করতে যাওয়া:
.
রামাদান মাস আসলে কবর যিয়ারতের হিড়িক পড়ে যায়। পুরা বছর বাপ-মা, আত্মীয়-স্বজনের জন্য ১ মিনিট দুআও হয়ত করে না। কিন্তু রামাযান মাস আসলে হুজুরকে সাথে নিয়ে কবর পাড়ে গিয়ে দলবদ্ধ মুনাজাতের জন্য খুব এগিয়ে থাকেন। এ বিষয়ে সহীহ কোন দলীল পাওয়া যায় না। বিধায় তা স্পষ্ট বিদ‘আত। বরং যেকোন সময়, যেকোন দিনে কবর যিয়ারত করবে। (সহীহ মুসলিম, হা/৯৭৪-৯৭৫; মিশকাত, হা/১৭৬৭)
.
(২৬). মৃত ব্যক্তির নামে ইফতার করানো:
.
মৃত ব্যক্তির নামে ধনী গরীব সবাইকে দাওয়াত দিয়ে ইফতার মাহফিল ও সম্মিলিত মুনাজাত করা বিদআত। তাছাড়া মৃত ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে যা খাওয়ানো হয় তা সদাকা যা সবাই খেতে পারে না। বরং এটি জীবিত ব্যক্তি তার নিজের জন্য করবে। (ইবনু মাজাহ, হা/১৭৪৬,সনদ সহীহ)।

পরিশেষে,কষ্টার্জিত ইবাদত আল্লাহর নিকট কবুলযোগ্য করার জন্য বিদআতমুক্ত ইবাদত করা জরূরী। অন্যথায় শুধু পরিশ্রম অন্তঃসারশূন্য হবে।রামাযান হলো খালেছ ইবাদতের মৌসুম। তাই এ মাসের সময়গুলো যতটা শুধু আল্লাহর সাথে কাটানো যায় ততটাই কল্যাণ। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে রামাদান ও সিয়ামের ফযীলত লাভ করার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন। (আল ইখলাস থেকে সংকলিত) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।