একজন মুমিন মুত্তাকী নারী-পুরুষের জন্য দৈনিক ১০ টি করনীয় ও বর্জনীয় কার্যাবলী

প্রশ্ন: একনজরে একজন মুমিন মুত্তাকী নারী-পুরুষের জন্য দৈনিক ১০ টি করনীয় কার্যাবলী এবং ১০ টি বর্জনীয় কার্যাবলীর বিস্তারিত বিবরণ।
▬▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা : ইমাম ইবনুল জাওযি (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেছেন, ‘বছরের বারোটি মাস যেন (নবি) ইয়াকুব (আ.)-এর বারো জন পুত্রের ন্যায়৷ তাদের মধ্যে ইউসুফ (আ.) যেমন তাঁর পিতার নিকট সর্বাধিক প্রিয় ছিলেন, তেমনি রামাদান মাসও আল্লাহর নিকট সবচেয়ে বেশি প্রিয়। আল্লাহ তা‘আলা যেভাবে এক ভাই (ইউসুফ আ.)-এর দু‘আয় এগারো জন (ভাই)-কে ক্ষমা করেছিলেন, সেভাবে রামাদান মাসে তোমার দু‘আর ফলে তোমার বাকি এগারো মাসের পাপগুলো তিনি ক্ষমা করে দিতে পারেন৷’প্রিয় পাঠক,প্রকৃতপক্ষে রামাযান মাস পাওয়া একজন মুমিনের জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে বিশেষ দয়া ও নেয়ামত। আলোচ্য প্রবন্ধে রামাযানে একজন মুমিনের কী কর্মসূচি হওয়া উচিত,সে বিষয়ে সংক্ষিপ্ত পরিসরে কিছু আলোকপাত করা হলো।

▪️একনজরে রামাদানে একজন মুমিনের দৈনিক ১০ টি মৌলিক কর্মসূচি
.
(১) দিনে সিয়াম পালন করা : রামাদানের প্রথম ও প্রধান কর্মসূচি হলো ছিয়াম পালন করা। প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ ও মুক্বীম মুসলিম নর-নারীকে ফরয সিয়াম রাখতেই হবে। মহান আল্লাহ বলেন,﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ﴾ ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যাতে তোমরা তাক্বওয়া অবলম্বন কর’ (সূরা আল-বাক্বারা, ২/১৮৩)। আবূ হুরায়রা রা: বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন,مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ ‘যে ব্যক্তি ঈমানসহ সওয়াবের আশায় রামাদানে সিয়াম পালন করবে, তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করা হবে’(সহীহ বুখারী, হা/৩৮, ১৮০২, ১৯১০, ২০১৪; সহীহ মুসলিম, হা/৭৬০; মিশকাত, হা/১৯৫৮)
.
(২) রাতে ক্বিয়াম করা তথা তারাবীহ পড়া : রামাদান মাসে রাতে তারাবীহ পড়ার মাধ্যমে আমরা বহু নেকীর অধিকারী হতে পারি। আবূ হুরায়রা (রা:) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, مَنْ قَامَهُ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ ‘যে ব্যক্তি ঈমানসহ সওয়াবের আশায় রামাদানে তারাবীহ বা কেয়ামুল লাইল পড়বে, তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করা হবে’। (সহীহ বুখারী, হা/২০০৮)
.
(৩) কুরআন পড়া: রামাদান কুরআনের মাস। আল্লাহ বলেন,﴿شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ﴾ ‘রামাদান মাস, যে মাসে বিশ্বমানবের জন্য পথ-প্রদর্শন এবং সুপথের উজ্জ্বল নিদর্শন এবং হক্ব ও বাতিলের প্রভেদকারী কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে’ (আল-বাক্বারা, ২/১৮৪)। তাই আসুন! কুরআনের মাসে বেশি বেশি কুরআন পড়ি। ইবনু উমার (রা:) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন,الصِّيَامُ وَالْقُرْاٰنُ يَشْفَعَانِ لِلْعَبْدِ، يَقُوْلُ الصِّيَامُ : أَيْ رَبِّ! إِنِّىْ مَنَعْتُهُ الطَّعَامَ وَالشَّهَوَاتِ بِالنَّهَارِ، فَشَفِّعْنِىْ فِيهِ، وَيَقُولُ الْقُرْاٰنُ : مَنَعْتُهُ النُّوْمَ بِاللَّيْلِ فَشَفِّعْنِىْ فِيهِ، فَيُشَفَّعَانِ ‘সিয়াম এবং কুরআন বান্দার জন্য শাফাআত করবে। সিয়াম বলবে, হে রব! আমি তাকে দিনে খাবার গ্রহণ করতে ও প্রবৃত্তির তাড়না মিটাতে বাধা দিয়েছি। অতএব, তার ব্যাপারে এখন আমার শাফাআত কবুল করো। কুরআন বলবে, হে রব! আমি তাকে রাতে ঘুম থেকে বিরত রেখেছি। অতএব, তার ব্যাপারে এখন আমার সুপারিশ গ্রহণ করো। অতঃপর উভয়ের সুপারিশই কবুল করা হবে’(মুসতাদরাক হাকেম, হা/২০৩৬; শুআবুল ঈমান, হা/১৮৩৯; মিশকাত, হা/১৯৬)
.
(৪) দান-সাদাক্বা করা : রামাদান মাসে বেশি বেশি দান-ছাদাক্বা করা উচিত। রাসূলুল্লাহ (রা:) রামাযান মাসে বেশি বেশি দান করতেন। হাদীসে এসেছে, ইবনু আব্বাস (রা:) বলেন,أَجْوَدَ النَّاسِ بِالْخَيْرِ وَكَانَ أَجْوَدُ مَا يَكُونُ فِي رَمَضَانَ حِينَ يَلْقَاهُ جِبْرِيلُ ‘নবী করীম (ﷺ) ধনসম্পদ ব্যয় করার ব্যাপারে সকলের চেয়ে দানশীল ছিলেন। আর রামাযানে জিবরীল আ: যখন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন, তখন তিনি আরও অধিক দান করতেন’ (সহীহ বুখারী, হা/১৯০২; সহীহ মুসলিম, হা/২৩০৮; মিশকাত, হা/২০৯৮
.
(৫) আল্লাহর কাছে বেশি বেশি ক্ষমা প্রার্থনা করা : রামাদান ক্ষমার মাস। তাই রামাদান মাসে একজন মুমিনের অন্যতম কর্মসূচি হবে আল্লাহর কাছে বেশি বেশি ক্ষমা প্রার্থনা করার মাধ্যমে পাপমুক্ত হওয়া। আবূ হুরায়রা (রা:)বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,رَغِمَ أَنْفُ رَجُلٍ دَخَلَ عَلَيْهِ رَمَضَانُ ثُمَّ انْسَلَخَ قَبْلَ أَنْ يُغْفَرَ لَهُ ‘ভূলুষ্ঠিত হোক তার নাক, যার নিকট রামাযান মাস এলো অথচ তার গুনাহ মাফ হয়ে যাওয়ার পূর্বেই তা পার হয়ে গেল’(তিরমিযী, হা/৩৫৪৫, হদীস হাসান সহীহ; মিশকাত, হা/৯২৭)
.
(৬) বেশি বেশি নেক আমল করা: রামাদানে বেশি বেশি নেক আমল করা উচিত। কেননা রামাদানে আমলের ছওয়াব অগণিত। আমরা অনেকেই বলি, রামাদানে একটি সুন্নাত একটি ফরযের সমান আর একটি ফরয ৭০টি ফরযের সমান। আসলে এটি ভুল ধারণা। এই মর্মে হাদীছটি মুনকার/বাতিল। (যঈফ আত-তারগীব, হা/৫৮৯; ইবনু খুযায়মা, হা/১৮৮৭; শুআবুল ঈমান, হা/৩৩৩৬, আলবানী রহ: বলেন, হাদীসটি মুনকার বা বাতিল। কারণ এর সনদে আলী ইবনু যায়েদ ইবনু জাদআন একজন দুর্বল রাবী; মিশকাত, হা/১৯৬৫) প্রকৃতপক্ষে রামাযান মাসে আমলের সওয়াব এত বেশি যে, ফেরেশতারা নয়; বরং এর প্রতিদান আল্লাহ নিজেই দেন(সহীহ বুখারী, হা/১৯০৪;সহীহ মুসলিম, হা/১১৫১; নাসাঈ, হা/২২১৭; ইবনু মাজাহ, হা/১৬৩৮; মিশকাত, হা/১৯৫৯।)
.
(৭) পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা: রামাদান মাসে আমাদের সকল প্রকার পাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। হাদীছে এসেছে, আবূ হুরায়রা (রা:) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন,مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالْعَمَلَ بِهِ فَلَيْسَ للهِ حَاجَةٌ فِي أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকতে পারল না, তার খাদ্য ও পানীয় ত্যাগ করাতে আল্লাহর কিছু আসে যায় না’(সহীহ বুখারী, হা/১৯০৩; ইবনু মাজাহ, হা/১৬৮৯; আবূ দাঊদ, হা/২৩৬২)
.
(৮) বেশি বেশি দু‘আ করা : রামাদানে বেশি বেশি দু‘আ করা উচিত। আমাদের অনেকে শুধু ইফতারের পূর্ব মুহূর্তে দু‘আ করে, অন্য সময় দু‘আ করে না। আসলে ইফতারের পূর্ব মুহূর্তে দু‘আ কবুল করা হয় এই মর্মে হাদীসটি দুর্বল।(যঈফ ইবনু মাজাহ, হা/১৭৫৩) তাই শুধু ইফতারের পূর্ব মুহূর্তে নই, বরং ছিয়াম অবস্থায় সারা দিন দু‘আ কবুল করা হয়। আবূ হুরায়রা (রা:) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,ثَلَاثُ دَعَوَاتٍ مُسْتَجَابَات لَا شَكَّ فِيهِنَّ: دَعْوَةُ الْوَالِدِ، وَدَعْوَةُ الْمُسَافِرِ، وَدَعْوَةُ الْمَظْلُومِ ‘তিন ব্যক্তির দু‘আ কবুল করা হয়— ১.সওম পালনকারী ব্যক্তির, ২. মুসাফির ব্যক্তির এবং ৩. মাযলূম ব্যক্তির’।(আবূ দাঊদ, হা/১৫৩৬,সিলসিলা সহীহা,হা/৫৯৫; মিশকাতা, হা/২২৫০)
.
(৯) কাউকে ইফতার করানো: রামাদানের কর্মসূচির মধ্যে অন্যতম কর্মসূচি হল অন্যজনকে ইফতার করানো। হাদীসে এসেছে, যায়েদ ইবনু খালেদ আল-জুহানী রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,مَنْ فَطَّرَ صَائِمًا كَانَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِهِ غَيْرَ أَنَّهُ لاَ يَنْقُصُ مِنْ أَجْرِ الصَّائِمِ شَيْئًا ‘কোনো সিয়াম পালনকারীকে যে লোক ইফতার করায় সে লোকের জন্যও সিয়াম পালনকারীর সমপরিমাণ সওয়াব রয়েছে। কিন্তু এর ফলে ছিয়াম পালনকারীর সওয়াব থেকে বিন্দুমাত্র কমানো হবে না’ (ইবনু মাজাহ,হা/১৭৪৬; তিরমিযী, হা/৮০৭,সনদ সহীহ)
.
(১০) শেষ দশ রাতে বেশি বেশি ইবাদত করা: রামাদানের সর্বশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি হলো শেষ দশ রাতে বেশি বেশি ইবাদত করা। আয়েশা রা: বলেন,كَانَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ يَجْتَهِدُ فِي الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مَا لاَ يَجْتَهِدُ فِي غَيْرِهَا ‘রামাযানের শেষ দশ দিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) (ইবাদতে) এত বেশি সাধনা করতেন (সহীহ মুসলিম, হা/১১৭৫; তিরমিযী, হা/৭৯৬; ইবনু মাজাহ, হা/১৭৬৭; মিশকাত, হা/২০৮৯)এর উদ্দেশ্য হলো যাতে করে ক্বদরের রাত্রিটি ছুটে না যায়। কেননা রাসূল (ﷺ) বলেছেন,إِنَّ هَذَا الشَّهْرَ قَدْ حَضَرَكُمْ وَفِيهِ لَيْلَةٌ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ مَنْ حُرِمَهَا فَقَدْ حُرِمَ الْخَيْرَ كُلَّهُ وَلَا يُحْرَمُ خَيْرَهَا إِلَّا مَحْرُومٌ ‘তোমাদের নিকট এ মাস সমুপস্থিত। এতে রয়েছে এমন এক রাত, যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এ থেকে যে ব্যক্তি বঞ্চিত হলো, সে সমস্ত কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হলো। কেবল বঞ্চিত ব্যক্তিরাই তা থেকে বঞ্চিত হয়’। (ইবনু মাজাহ, হা/১৬৪৪,মিশকাত, হা/১৯৬৪) তাই আমাদের প্রত্যেককে শেষ দশ রাতে বেশি বেশি ইবাদতে জোর দিতে হবে, যাতে করে কোনোভাবেই ক্বদরের রাতটি ছুটে না যায়। আবূ হুরায়রা রা: বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, مَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ ‘যে ব্যক্তি লায়লাতুল ক্বদরে ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রাত জেগে ইবাদত করে, তার পিছনের সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করা হবে’। (সহীহ বুখারী, হা/৩৮, ১৮০২, ১৯১০, ২০১৪;সহীহ মুসলিম, হা/৭৬০; মিশকাত,হা/১৯৫৮)
.
▪️একজন মুমিন মুত্তাকী নারী পুরুষের জন্য দৈনিক ১০ টি বর্জনীয় কার্যাবলী অর্থাৎ রামাদানে যে ১০ টি ভুল করা যাবে না
__________________________________
.
(১). সাহরি খাওয়ার পর ফজরের নামাজ আদায় না করে বিছানায় যাওয়া ঠিক নয়। শরীর তখন ক্লান্ত ও অলস থাকে, ফলে কাত হলেই চোখ বুজে আসে; ফজর মিস হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বরং এ সময়টা সামান্য হাঁটাচলা করে, ইস্তিগফার ও দরুদ পড়ে কাটানো যেতে পারে।আল্লাহ সৌভাগ্যবান ব্যক্তিদের প্রশংসায় বলেন, ‘‘তারা রাতে সামান্য সময়ের জন্যই নিদ্রায় যেতো এবং রাতের শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা প্রার্থনা (ইস্তিগফার) করতো।’’ (সুরা যারিয়াত,৫১/১৭-১৮)
.
(২). স্বাভাবিক ভাবে সিয়াম অবস্থায় মাথায় পানি দিতে এবং গোসল করতে সমস্যা নেই। তবে রামাদানে পুকুরে বা নদীতে সাঁতার কাটা থেকে বিরত থাকা উচিত। কারণ পানি গলা দিয়ে ভেতরে চলে যেতে পারে। অতএব, সতর্ক থাকা দরকার। তাছাড়া, ফরজ গোসল বা সাধারণ অজুতে গড়গড় করে কুলি করা যাবে না এবং নাকের ভেতর পানি দেওয়ার সময়ও যথাযথ সতর্ক থাকতে হবে, যাতে পানি ভেতরে চলে না যায়। লাকীত ইবনু সাবিরা (রাহঃ) হতে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! ওযু প্রসঙ্গে আমাকে জানিয়ে দিন। তিনি বললেনঃ ভালোভাবে ওযু কর, আঙ্গুলগুলোর মাঝে খিলাল কর এবং রোযা পালনকারী না হলে নাকের গভীরে পানি পৌছাও। — (তিরমিজি হা/৭৮৮ ইবনু মাজাহ হা/৪০৭)
.
(৩). একেবারে বিশেষ প্রয়োজন ব্যতীত ইউটিউব, ফেইসবুক এবং অন্যান্য সোশাল মিডিয়া ব্যবহার করা থেকে যথাসাধ্য বিরত থাকতে হবে। কারন বর্তমান ইউটিউবার গুলো টাকা ইনকামের জন্য মনিটাইজেশন on করে রাখে ফলে ভাল কিছু দেখতে গেলেও অনেক আজে-বাজে ভিডিওর সাজেশন আসবে। ইচ্ছা না থাকলেও কৌতূহল মেটাতে গিয়ে হয়তো অনেক কিছু দেখা হয়ে যাবে। রোজার মর্যাদা কমবে, অন্তর শক্ত হতে থাকবে এবং মানসিক প্রশান্তি নষ্ট হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না—গান শুনা, মুভি/নাটক দেখা থেকেও বিরত থাকতে হবে। ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃরাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা মদ, জুয়া ও সব ধরনের বাদ্যযন্ত্র হারাম করেছেন’ (বায়হাক্বী,মিশকাত হা/৪৫০৩; বাংলা মিশকাত ৮ম খণ্ড হা/৪৩০৪)।
.
(৪). ফেইসবুক অ্যাপের Watch videos আইকনটি হাইড করে দেওয়া দরকার। কারণ, এটি ফিতনার দরজা খুলে দেয়। শুরুটা হয় সাধারণ কোনো ভিডিওতে ক্লিক করে, এরপর মহাসমুদ্রে গিয়ে খাবি খেতে হয়। হরেক রকমের ভিডিও দেখতে দেখতে রুহানিয়াত (আধ্যাত্মিকতা) হ্রাস পায়; ফলে রোজার মর্যাদা ও মাহাত্ম্য নষ্ট হয়। একই সাথে ইউটিউবের শর্টস, ফেইসবুকের রিল আর টিকটকের ছোট ছোট ভিডিও থেকে সাবধান থাকা জরুরি।
.
(৫). অনেকেই রোজার দিনগুলো বেশি বেশি ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেন। এটি একদমই উচিত নয়। রোজার প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইমাম ইবনুল জাওযি (রাহ.) বলেন, যদি কবরবাসীরা একটি দিনের জন্য দুনিয়াতে ফিরতে পারতো, তবে তারা রামাদানের কোনো একটি দিন চাইতো। তাই, যথাসম্ভব নেক আমলে সময়গুলো কাজে লাগানো উচিত।
.
(৬). ইফতারকে সুস্বাদু ও জাঁকজমকপূর্ণ করতে গিয়ে অনেকেই ইফতারের পূর্বের মূল্যবান সময়টা নষ্ট করে ফেলেন। অথচ রমাদানে সারাক্ষণই সিয়াম পালনকারীর দু’আ কবুল হয় এমনকি ইফতারের পূর্বমুহূর্তে দু‘আ কবুল হয়। যদিও এই মর্মে বর্নিত হাদীসটি জয়ীফ মুসনাদে আহমাদ হা/৮০৪৩) তবুও এ সময়ে বেশি করে ইস্তিগফার ও দু‘আ করা উচিত। ইমাম নববী (রহঃ) বলেছেন: রোজাদারের জন্য রোজাপালনকালে নিজের জন্য, প্রিয় মানুষের জন্য এবং সকল মুসলমানের দুনিয়া ও আখেরাতের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দু’আ করা মুস্তাহাব। (আল-মাজমু খন্ড:৬ পৃষ্ঠা:৩৭৫)
.
(৭). অনেকেই রামাদানে দ্রুত কুরআন খতম করতে গিয়ে তিলাওয়াতের হক আদায় করেন না। বেশি খতমের আকাঙ্ক্ষায় এমনভাবে তিলাওয়াত করেন যে, তিলাওয়াতই সহিহ হয় না। এমন তিলাওয়াতে তেমন ফায়দা হবে না। ধীরে-সুস্থে, আগ্রহ সহকারে, ভালোবাসা নিয়ে পড়তে হবে। পরিমাণ কম হলেও আল্লাহ এতে বেশি খুশি হবেন। কোয়ান্টিটির চেয়ে কোয়ালিটিকে প্রধান্য দিতে হবে। যদি তিলাওয়াত সহিহ হয়, তবে পুরো রামাদানে অন্তত একবার কুরআন খতম দেওয়ার চেষ্টা করবো। এটা কুরআনের হক। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রা.)-কে বলেছিলেন, ‘‘তুমি (অন্তত) ৪০ দিনে কুরআন পাঠ (শেষ) করবে।’’(ইমাম তিরমিযি, আস-সুনান: ২৯৪৭; হাদিসটি সহিহ)
.
(৮). রামাদান মাসে অনেকের খরচ বেড়ে যায়। সাহরি ও ইফতারে থাকে বাহারি আইটেম। এছাড়া রামাদানের শেষ দিকে ইবাদতে উদাসীন হয়ে ঈদের শপিংয়ের জন্য তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। এগুলো একদম অনুচিত। রামাদানের মূল কনসার্ন হওয়া উচিত অধিক নেক আমল করা, কৃত গুনাহ মাফ করানো এবং তাকওয়া অর্জন করা। রাসূল ﷺ বলেছেন,যে ব্যক্তি রামাদান মাস পেলো, অথচ তার গুনাহ মাফ হলো না সে ধংস হোক। (আদাবুল মুফরাদ,হা/৬৫০)
.
(৯). রোজায় সময় কাটানোর জন্য অনেকে বিভিন্ন অলস খেলাধুলায় (লুডু, দাবা, কেরাম) লিপ্ত হন, যেগুলোতে ন্যূনতম শরীরচর্চাও হয় না। এই খেলাগুলো এমনিতেই শরিয়ত সমর্থন করে না। আবার কারো দিন কাটে সোশাল মিডিয়াতে ফান-ট্রল করে, গান শুনে, মুভি দেখে। এগুলো সবই রোজার শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক; এগুলো আত্মাকে কলুষিত করে।আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘قَدْ أَفْلَحَ مَنْ تَزَكَّى’ ‘অবশ্যই সফলতা অর্জন করবে যে আত্মশুদ্ধি করবে’ (সূরা আ‘লা ৮৭/১৪)। আয়াতের তাফসিরে আল্লামা ক্বাতাদাহ (রহঃ) বলেন, ‘عَمِلَ وَرِعًا’ ‘মুত্তাক্বী হিসাবে আমল করবে’। (তাফসীরে ত্বাবারী ১২/৫৪৬)
.
(১০). অনেকে রামাদানের অর্জনকে ঈদের দিনেই শেষ করে দেন। আড্ডা, গান, নেশা, নাটক-মুভি, গিবত, কুদৃষ্টি—সবকিছু যেন আগের রূপে ফিরে আসে। তারা ভুলে যান—দীর্ঘ এক মাসের কষ্টকর রোজা,
তাহাজ্জুদের নামাজ, আন্তরিক দু’আ পবিত্র কুরআনের মধুর তিলাওয়াত, স্পিরিচুয়ালিটি আর ইফতারের আনন্দের কথা। এটি নিজের নফসের প্রতি অবিচার।মহান আল্লাহ বলেন, প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ মানুষের প্রতি বিন্দুমাত্র জুলুম করেন না। কিন্তু মানুষ নিজেই নিজের প্রতি জুলুম করে। (সূরা ইউনুস হা/৪৪) সাহল ইবনু আব্দুল্লাহ (রহঃ) বলেন,‘যে ব্যক্তি অনর্থক কাজে লিপ্ত হয়, সে পরহেযগারিতা অর্জন থেকে বঞ্চিত হয়’(শু‘আবুল ঈমান হা/৫০৫৬) তিনি আরো বলেন,যে ব্যক্তি অনর্থক কাজে লিপ্ত হয়, সে তাক্বওয়া বা পরহেযগারিতা হতে বঞ্চিত হয়’। (হিলয়াতুল আউলিয়া ১০/১৯৬ পৃঃ কিছু বিষয় সংকলিত)
.
পরিশেষে আল্লাহ রব্বুল আলামীন আমাদেরকে রামাযান মাসের মর্যাদা রক্ষা করে তার যথাযথ হক্ব আদায় করার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন! (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।