রামাদানে গৃহিণী নারীদের দৈনন্দিন যাবতীয় করণীয়-বর্জনীয় কার্যাবলীর একটি রুটিন

রামাদানে গৃহিণী নারীদের দৈনন্দিন যাবতীয় করণীয়-বর্জনীয় কার্যাবলীর একটি রুটিন। এই রুটিন অনুসরণ করা নারী পুরুষ উভয়ের জন্য সহজ হবে ইনশাআল্লাহ।
▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬
(১). যারা বিকেলে বা আগ রাতেই ভাত রান্না করে রাখবেন আর ভোর রাতে শুধু গরম করবেন; তারা রামাদানে নারী-পুরুষ উভয়ে রাত ৩টা ১৫ মিনিটে ঘুম থেকে ওঠবো। ৩:১৫—৩:৩০ অযু-ইস্তিঞ্জা (ওয়াশরুমের কাজ) সম্পন্ন করে নামাজের প্রস্তুতি গ্রহণ করবেন। সাহরীর শেষ সময় এর প্রতি লক্ষ্য রেখে ভোর ৪টা পর্যন্ত তাহিয়্যাতুল অজু (দুই রাকাত) ও তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করবেন। সময় থাকলে কিছু সময় তিলাওয়াত করবেন। দরুদ, ইস্তিগফার ও দুআ-কান্নাকাটি করবেন। তবে যাদের সন্ধায় রান্না করা হয়নি অর্থাৎ যারা ভোর রাতে ভাত রান্না করবেন, তারা ২:৩০-এ ঘুম থেকে জেগে ওঠার চেষ্টা করবেন। ২:৩০—৩:৩০ কুকারে/পাতিলে ভাত বসিয়ে দিন, ফাঁকে ফাঁকে খাবার-টেবিল প্রস্তুত করুন এবং অজু-ইস্তিঞ্জা সম্পন্ন করে ফেলুন।
.
(২). আপনার দেশের নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী রাতের শেষ সময়ে সাহরী খাবেন। ধরুন ৪:৩৫ মিনিটে ফজরের আযান হবে তাহলে ৪:১০—৪:৩০ (২০ মিনিটে) সাহরী খাবেন। (সব খাবার আগেই সামনে এনে রাখবেন, যাতে আরামে সাহরী খেতে পারেন; খাবার পরিবেশন করার জন্য বারবার যাতে ওঠতে না হয়। পরিবারের সদস্যরা সবাই নিয়ে নিয়ে খাবে)। ৪:৩০—৬:০০ থালা-বাসন মাজা, দাঁত ব্রাশ করে নেওয়া, অজু-ইস্তিঞ্জা (যদি প্রয়োজন হয়) সম্পন্ন করা এবং ফজরের সালাত আদায় ও মাসনুন যিকিরগুলো সম্পন্ন করবেন। এরপর সম্ভব হলে সূর্যোদয় পর্যন্ত অপেক্ষা করে, চাশতের সালাত পড়ে ঘুমাতে যাবেন। ফজরের ওয়াক্ত শেষ হওয়ার পর সূর্যোদয় শুরু হওয়ার ১০/১৫ মিনিট পরই চাশতের সালাত পড়া যায়। সুতরাং ফজরের পর সালাতের স্থান থেকে না ওঠে সূর্যোদয় পর্যন্ত সেখানে বসে থেকে যিকির বা তিলাওয়াত করে, এরপর দুই রাকাত চাশতের নামাজ পড়লে (এটিকে ‘ইশরাকের সালাত’ও বলা হয়) একটি পূর্ণ কবুল হজ ও উমরার সওয়াব দেওয়া হয়। (ইমাম তিরমিযি, আস-সুনান: ৫৮৬; হাদিসটি হাসান)
.
(৩). এরপর ৬:২০—৯:০০ পর্যন্ত ঘুমাবো। অপরদিকে আর যারা ফজরের পরই ঘুমিয়ে যেতে চাই, তারা সকালের মাসনুন যিকিরগুলো করে সোয়া ৫টার মধ্যে ঘুমিয়ে যেতে পারি এবং ৮:০০/৮:৩০-এ জাগতে পারি। এরপর অন্তত ৪ রাকাত চাশতের সালাত পড়বো। সর্বনিম্ন ২ রাকাত পড়ারও বৈধতা আছে। এরপর আমাদের যাদের অফিস থাকবে, তারা কাজে চলে যাবো। কাজের ফাঁকে ফাঁকে দরুদ, যিকির ও ইস্তিগফার পড়তে থাকবো। দাঁড়িয়ে, হেঁটে বা বসে, যেভাবেই হোক। যাদের অফিস নেই, অন্য কোনো ব্যস্ততাও নেই, তাদের জন্য নিচের সময়বণ্টন— সকাল ৯:০০—১২:৩০ কুরআন তিলাওয়াত (ইস্তিঞ্জা-ওয়াশরুমের কাজ) সেরে অজু করে প্রস্তুতি নিতে নিতেই চলে যাবে ২০/৩০ মিনিট। বাকি সময়টুকু তিলাওয়াত। যারা একটানা তিলাওয়াত করতে ক্লান্তিবোধ করবো, তারা কোনো দ্বীনি বইও পড়তে পারি। এছাড়া নফল সালাত কিংবা যিকিরও করতে পারি। নারীদের জন্য রান্নাবান্না ও অন্যান্য কাজ সম্পন্ন করা, বাসায় অ-রোজাদার (শিশু বা রোজায় অক্ষম মুরুব্বি) কেউ থাকলে তার খাবার প্রস্তুত করা। বাচ্চাকে সময় দেওয়া (পড়ালেখা বা অন্য কিছুতে) অথবা কোনো প্রোডাক্টিভ কাজ করা। (৯:০০—১২:৩০ এর সময়ের কাজগুলো অদল-বদল হতে পারে। যার যেভাবে সুবিধা হয়)
.
(৪). ১২:৩০-২:০০ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বাসার টুকিটাকি কাজ শেরে নেওয়া, গোসল করবো। (আমরা যারা ৯-টায় ঘুম থেকে জেগেই গোসল করতে চাই, তারা সেভাবেই সময় সেট করে নেবো)। ১২:৫০—২:০০ জোহরের সালাত আদায় করবো এবং মাসনুন দু‘আ ও যিকিরগুলো পড়বো। বাকি সময় নফল সালাত আদায় করবো। তারপর প্রয়োজন হলে বাজারে যাওয়া, বাচ্চাকে সময় দেওয়া, নিজের কোনো অ্যাকাডেমিক কাজ থাকলে এই সময়ে সম্পন্ন করে ফেলা। অর্থাৎ যার যা প্রয়োজন সেটা শেরে ফেলবেন।
.
(৫). ২:০০—৩:৩০ অর্থসহ কুরআন পড়বো, তাফসির, হাদিস অথবা দ্বীনি কোনো কিতাবাদি অধ্যয়ন করবো। যারা এখনো সহীহভাবে কুরআন পড়তে পারি না, তারা শিখে ফেলবো। ছোট কয়েকটি সূরা এবং গুরুত্বপূর্ণ কিছু দু‘আ-যিকর মুখস্থ করে নেবো। ক্লান্তি আসলে, মোবাইলে তিলাওয়াত অথবা দ্বীনি কোনো লেকচার বা আলোচনা শুনা যেতে পারে। (কর্মজীবী ব্যক্তিগণ আশা করি সাড়ে ৩টার মধ্যে বাসায় এসে ফ্রি হয়ে যেতে পারবেন)। নারীরা বিকাল রাতের খাবার প্রস্তুত করতে মাছ, মাংস, তরকারি কাটা বা এ জাতীয় কাজগুলো সম্পন্ন করে ফেলা।
.
(৬). ৩:৩০—৫:৩০ এই সময়ে একটু ক্লান্তি আসে। তাই, ঘুম বা একটু বিশ্রাম নেওয়া যেতে পারে। তবে যারা ঘুমাতে চাই না, তারা এ সময়ে অন্য কোনো প্রোডাক্টিভ কাজ করতে পারি অথবা যেকোনো নেক আমল করতে পারি। এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অজু-ইস্তিঞ্জা সম্পন্ন করবো, আসরের সালাত আদায় করবো এবং মাসনুন দু‘আ ও যিকরগুলো পড়বো। তারপর ইফতার তৈরি করবো অথবা ইফতার তৈরিতে সাহায্য করবো এবং পাকে পাকে ইফতারের আগ মুহূর্তে দু‘আ করবো। ইফতারের আয়োজন সহজ হলে, আসরের পর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ৩০ মিনিট কুরআন-হাদিসের তালিম হতে পারে। সম্মিলিত কোনো দ্বীনি আলোচনা কিংবা কুরআন তিলাওয়াতও করা যেতে পারে। এরপর ইফতারের প্রস্তুতি।
.
(৭). নির্দিষ্ট সময়ে ইফতার করে সালাত আদায় করা, প্লেট-বাসন ধোয়ামোছা করা, মাগরিবের পর থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বিশ্রাম নিতে পারি। এসময় আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধবের খোঁজ নেওয়া যেতে পারে বা অনলাইনে কিছু সময় কাটানো যেতে পারে। এরপর ইস্তিঞ্জা ও অজু সেরে সালাতের জন্য প্রস্তুত হবো। (কর্মজীবী ব্যক্তিদের বিকাল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সময়টুকুর মাঝে কুরআন শেখা, তিলাওয়াত করা ও কুরআন অধ্যয়নের জন্য সময় বের করে নিতে হবে।)
.
(৮). রাত ৮:০০—১০:০০ ইশা ও তারাবীহর সালাত আদায় করবো। (সালাতে যত বেশি সময় দেওয়া যায়, তত ভালো। আমরা অ্যাভারেজ একটি হিসাব ধরেছি, যা খুব বেশি নয় আবার খুব কমও নয়। এখানে কম-বেশি হতে পারে)। ১০:০০—১১:০০ এই সময়ের মধ্যে তিন ধরনের কাজ করা যেতে পারে। সেগুলো হলো: (১). প্রয়োজনবোধ করলে হালকা খাবার খাওয়া; (২). মেন্টাল রিফ্রেশমেন্টের জন্য পরিচিতজনদের সাথে আলাপ-আলোচনা করা অথবা অনলাইনে একটু উঁকি দেওয়া; (৩). ঘুমানোর পূর্বের যিকির, দু‘আ ও সুরাগুলো পাঠ করা। অতঃপর রাত ১১:০০—৩:০০ বা ৩:১৫ পর্যন্ত ঘুম। (রাতে সোয়া ৪ ঘণ্টা এবং দিনে আরো ৩/৪ ঘণ্টা ঘুম। ইনশাআল্লাহ, এই সময় যথেষ্ট হবে।)
.
পরিশেষে, কিছু কথা না বললেই নয়, আসলে রামাদানে গৃহিণী নারীদের এত ব্যস্ততা থাকে যে, এসব রুটিন অনুসরণ করা অনেকাংশেই কঠিন হয়ে যায়। ঘড়ি ধরে রুটিন অনুসরণ করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। তবুও একটি নমুনা উপস্থাপনের চেষ্টা করেছি। বাকি, নিজেরাই নিজেদের মত করে এদিক-সেদিক করে নেবেন। পরিবারের কর্তাদের উচিত প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীদের কে সাহায্য করা। পাশাপাশি এটি মাথায় রাখবো যে, সাহরীর শেষ সময় প্রতিদিন ১মিনিট করে কমে আসবে বা এগিয়ে আসবে আবার ইফতারের সময় বাড়তে থাকবে। তাই, রুটিনের কাজগুলো পরিবর্তিত সময়ের সাথে সমন্বয় করে নিতে হবে। রামাদানে ইবাদত করবো স্বাচ্ছন্দ্যে, আগ্রহ ও ভালোবাসার সাথে। নিজের উপর প্রেশার নিয়ে ইবাদত-বন্দেগীকে বিরক্তির পর্যায়ে নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তাহলে শেষমেষ কিছুই হবে না। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন। সাহায্যকারী ও তাওফিকদাতা একমাত্র তিনিই। আল্লাহ তা‘আলা তাঁদের উপর সন্তুষ্ট হোন, সময়ের স্বল্পতায় তাঁদের আমলের ঘাটতিকে উপযুক্ত প্রতিদান দিয়ে পূর্ণ করুন। আমিন। রোজাদারদের খাবার প্রস্তুত করাও নিঃসন্দেহে ইবাদাতের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং, সময়স্বল্পতার জন্য আফসোস না করে প্রতিদান পাওয়ার আশায় সবর করা উচিত। (কিছু সংকলিত।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।