যে সকল আমল সম্পাদানের মাধ্যমে বান্দার পাপ ক্ষমা হয়

ভূমিকা: প্রথমেই একটি প্রশ্ন পরিস্কার করা দরকার অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে, কবীরা ও সগীরা সকল গুনাহ-ই কি মাফ হয়? এই প্রশ্নের উত্তরে বলবো, হ্যাঁ, আল্লাহ চাইলে সকল গুনাহ-ই মাফ করতে পারেন। তবে তিনি কুরআনে বলে দিয়েছেন যে, তিনি শির্কের গুনাহ মাফ করবেন না। এছাড়া অন্যান্য গুনাহ মাফ করবেন। যেমন: আল্লাহ তা‘আলা বলেন,নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে অংশী (শির্ক) করার অপরাধ ক্ষমা করেন না। এ ছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দেন। (সূরা নিসা,৪/৪৮)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট খালেছ অন্তরে তওবা কর। অবশ্যই তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের গোনাহসমূহ মার্জনা করে দিবেন এবং তোমাদেরকে এমন জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার তলদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত। (সূরা তাহরীম: ৬৬/৮)। শির্ক ছাড়া অন্যান্য কাবীরা গুনাহগুলো মাফ পেতে সাধারণত তাওবাহ্ করার দরকার হয়। কিন্তু সগীরা গুনাহ মাফের জন্য সবসময় তাওবার প্রয়োজন হয় না। দৈনন্দিন কিছু ‘আমলের মাধ্যমে এসব ছোট-খাট গুনাহগুলো মাফ হয়ে যায়। তাই কাবীরা গুনাহগুলো থেকে বেঁচে থাকলে সগীরা গুনাহগুলো আল্লাহ মাফ করে দেবেন বলে ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন। তিনি বলেন, তোমরা যদি নিষেধকৃত কাবীরা গুনাহগুলো বা গুরুতর/বড় পাপসমূহ পরিহার করো তাহলে আমরা তোমাদের (ছোট) লঘুতর পাপগুলোকে মোচন করে দেব এবং তোমাদেরকে সম্মানজনক স্থানে (জান্নাতে) প্রবেশ করাবো। (সূরা আন নিসা: ৪/৩১)। মহান আল্লাহ তা‘আলা শরীআতে এমন কতিপয় আমল বাতলে দিয়েছেন যা সম্পাদন করলে গোনাহ সমূহ মাফ হয়। গোনাহ এমন একটি বিষয়, যা একের পর এক করতে থাকলে মুমিন নারী-পুরুষের ঈমানী নূর নিভে যেতে থাকে। যা এক সময় তাকে জাহান্নামের পথে পরিচালিত করে। আর শয়তান সেটাই চায়। সে চায় আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দাকে দ্বীনের সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করে তার পথে পরিচালিত করতে। এজন্য সে সদা একাজে নিয়োজিত থাকে। এর সঙ্গে আছে তার দোসর ও অসংখ্য মানবরূপী শয়তান, যারা আল্লাহর দেয়া শরীআত ও তাঁর আদেশ-নিষেধকে সর্বাবস্থায় অমান্য করতে থাকে।
.
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তারা কি আল্লাহর পাকড়াও থেকে নিরাপদ হয়ে গেছে? ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায় ছাড়া আল্লাহর পাকড়াও থেকে কেউই নিরাপদ হতে পারে না।’ (সূরা আ‘রাফ: ৭/৯৯)। রাসূল (ﷺ) পাপের ভয়াবহতা সম্পর্কে বলেন, তোমরা তুচ্ছ-নগণ্য পাপ থেকেও বেঁচে থাক। কেননা তা যার মধ্যে একত্রিত হতে থাকবে তা তাকে ধ্বংস করে ছাড়বে।’ (মুসনাদে আহমাদ; সহীহুল জামে‘ হা/২৬৮৭)
.
একনজরে গোনাহ মোচনকারী আমল সমূহ: মানব জীবনে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ঈমান আনয়ন করা। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর আনুগত্য করা। অর্থাৎ আমলে ছালেহ সম্পাদন করা। ইসলামী শরী‘আতে এমন অনেক আমল রয়েছে, যার মাধ্যমে বান্দার গোনাহ মাফ হয়ে যায়। আলোচ্য নিবন্ধে পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে এরকম কিছু আমল তুলে ধরা হল:

(১). পরিপূর্ণভাবে ওযু করা ও মসজিদে গমন করা: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, আমি কি তোমাদেরকে এমন কাজের কথা জানাব না, যা করলে আল্লাহ বান্দার গোনাহ ক্ষমা করেন এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আপনি বলুন। তিনি বললেন, কষ্টকর অবস্থায়ও পূর্ণাঙ্গরূপে ওযু করা, সালাতের জন্য অধিক পদক্ষেপে মসজিদে যাওয়া এবং এক সালাতের পর আরেক সালাতের জন্য অপেক্ষায় থাকা। আর এ কাজগুলোই হল প্রস্তুতি (রিবাত)। (মুসলিম হা/৬০১; আহমাদ হা/৪৭৬; তিরমিযী হা/৫১; ইবনু মাজাহ হা/৪২৮)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আরো বলেন, مَنْ تَوَضَّأَ هَكَذَا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ وَكَانَتْ صَلاَتُهُ وَمَشْيُهُ إِلَى الْمَسْجِدِ نَافِلَةً ‘যে ব্যক্তি এভাবে (উত্তমরূপে) ওযু করে, তার পূর্বেকার সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়। ফলে তার সালাত ও মসজিদে যাওয়া অতিরিক্ত আমল বলে গণ্য হয়।’ (সহীহ মুসলিম হা/৫৬৬; ইবনু মাজাহ হা/২৮২)

(২). ওযুর পর সালাত আদায় করা: উসমান বিন আফফান (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পূর্ণাঙ্গরূপে ওযু করার পর বলেন, যে ব্যক্তি আমার এ ওযুর ন্যায় ওযু করার পর একাগ্রচিত্তে দু’রাকা‘আত সালাত আদায় করবে এবং এ সময় অন্য কোন ধারণা তার অন্তরে উদয় হবে না। তাহলে তার পূর্বেকার সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।’ (সহীহ বুখারী হা/১৫৯, ১৬৪; মুসলিম হা/২২৬; আহমাদ হা/৪১৮)। উসমান (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ আমি আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট শুনেছি, তিনি বলেছেন “যে কোন ব্যক্তি যখনই সুন্দরভাবে ওযু করে নামায পড়ে, তখনই তার ঐ ওযুর সময় থেকে দ্বিতীয় নামায পড়া পর্যন্ত মধ্যবর্তীকালীন সময়ের সমস্ত গোনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।” (নাসাঈ ১৪৬, ১৭৪; সহীহ তারগীব ১৮২; হাদিস সম্ভার, হাদিস নং ৫৫৭)

(৩). আরাফার দিন ও আশূরার সিয়াম পালন করা: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেন, আমি আল্লাহ তা‘আলার নিকট আরাফার দিনের সিয়াম সম্পর্কে আশা করি যে, তিনি এর মাধ্যমে পূর্ববর্তী এক বছর এবং পরবর্তী এক বছরের গোনাহ সমূহ ক্ষমা করে দিবেন।’ (তিরমিযী, হা/৭৪৯; সহীহ ইবনু মাজাহ হা/১৭৩০; মিশকাত হা/২০৪৪)। আশূরার সিয়াম সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, আশূরা বা ১০ই মুহাররমের সিয়াম আমি আশা করি আল্লাহর নিকটে বান্দার বিগত এক বছরের (সগীরা) গোনাহের কাফফারা হিসাবে গন্য হবে।’ (সহীহ মুসলিম ১১৬২; মিশকাত হা/২০৪৪)

(৪). খুশূ-খুযূ বা বিনয় ও একাগ্রতার সাথে সালাত আদায় করা: রাসূল (ﷺ) বলেন, আল্লাহ্ তা‘আলা পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন। যে ব্যক্তি উত্তম রূপে ওযু করবে, সঠিক সময়ে সালাত আদায় করবে এবং সালাতের রুকূ-সিজদাহ ও খুশূ-খুযূকে পরিপূর্ণ করবে, তার জন্য আল্লাহর উপর প্রতিশ্রুতি রয়েছে যে, তিনি তাকে ক্ষমা করবেন। আর যে এরূপ করবে না, তার জন্য কোন প্রতিশ্রুতি নেই। তিনি ইচ্ছে করলে ক্ষমা করবেন অথবা শাস্তি দিবেন।’ (আবু দাউদ হা/৪২৫; সহীহ আত-তারগীব হা/৫৭২; মিশকাত হা/৫৭০, সনদ সহীহ)

(৫). জামাআতের সাথে সালাত আদায় করা: উসমান ইবনু আফফান (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি উত্তম রূপে ওযু করে ফরয সালাতের জন্য পায়ে হেঁটে মসজিদে এসে ইমামের সাথে সালাত আদায় করে তার গোনাহ সমূহ ক্ষমা করা হয়।’ (ইবনু খুযায়মাহ হা/১৪৮৯; সহীহ আত-তারগীব হা/৩০০, ৪০৭, হাদীস সহীহ)

(৬). সালাতে সশব্দে আমীন বলা: আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, ইমাম যখন আমীন বলে, তোমরাও তখন আমীন বলবে। কেননা যার আমীন বলা ফেরেশতাগণের আমীন বলার সাথে মিলে যাবে তার পূর্বেকার গুনাহ সমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’ (বুখারী হা/৭৮০; মুসলিম হা/৪১০; মিশকাত হা/৮২৫)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আরো বলেন, إِذَا قَالَ أَحَدُكُمْ آمِيْنَ وَقَالَتِ الْمَلاَئِكَةُ فِى السَّمَاءِ آمِيْنَ فَوَافَقَتْ إِحْدَاهُمَا الأُخْرَى، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ ‘যখন তোমাদের কেউ (সালাতে) আমীন বলে এবং আকাশের ফেরেশতারাও আমীন বলেন। অতঃপর উভয়ের আমীন একই সাথে হলে তার পূর্ববর্তী সমস্ত পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।’ (সহীহ বুখারী হা/৭৮১; মুসলিম হা/৪১০)

(৭). ‘আল্লাহুম্মা রাব্বানা ওয়া লাকাল হামদ বলা : আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ইমাম যখন সামিয়াল্লাহু লিমান হামিদাহ বলেন, তখন তোমরা আল্লাহুম্মা রাব্বানা লাকাল হামদ বলবে। কেননা যার এ উক্তি ফেরেশতার উক্তির সঙ্গে মিলে যাবে, তার পূর্বেকার সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়।’ (সহীহ বুখারী হা/৭৯৬; আহমাদ হা/৯৯৩০)

(৮). বেশী বেশী সিজদা করা: মাদান ইবনু আবু ত্বালহা আল-ইয়ামাবী হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আযাদকৃত গোলাম ছাওবানের সাথে সাক্ষাৎ করলাম। আমি বললাম, আমাকে এমন একটি কাজের কথা বলে দিন যা করলে আল্লাহ আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। অথবা আমি তাকে প্রিয় ও পছন্দনীয় কাজের কথা জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু তিনি চুপ থাকলেন। আমি পুনরায় তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি তখনও চুপ থাকলেন। তৃতীয়বার জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আমি এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বলেছেন, ‘তুমি আল্লাহর জন্য অবশ্যই বেশী বেশী সিজদা করবে। কেননা তুমি যখনই আল্লাহর জন্য একটি সিজদা করবে, মহান আল্লাহ এর বিনিময়ে তোমার মর্যাদা এক ধাপ বৃদ্ধি করবেন এবং তোমার একটি গোনাহ ক্ষমা করে দিবেন।’ (মুসলিম হা/১১২১; তিরমিযী হা/৩৮৮; ইবনু মাজাহ হা/১৪২৩)

(৯). জুমআর দিন মনোযোগ সহকারে খুৎবা শ্রবণ করা ও সালাত আদায় করা: সালমান ফারিসী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, যে ব্যক্তি জুমআর দিন গোসল করে এবং যথাসাধ্য ভালরূপে পবিত্রতা অর্জন করে ও নিজের তেল হতে ব্যবহার করে বা নিজ ঘরের সুগন্ধি ব্যবহার করে। অতঃপর বের হয় এবং দু’জন লোকের মাঝে ফাঁকা করে না। অতঃপর তার নির্ধারিত সালাত (ইমাম খুৎবায় দাঁড়ানোর আগ পর্যন্ত যথাসাধ্য) আদায় করে এবং ইমামের খুৎবা দেয়ার সময় চুপ থাকে, তাহলে তার সে জুমআহ হতে অপর জুমআর মধ্যবর্তী সময়ের যাবতীয় গোনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।’ (বুখারী হা/৮৮৩; মিশকাত হা/১৩৮১)

(১০). ক্বিয়ামে রামাযান তথা তারাবীহ বা তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করা: আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-কে রামাযান সম্পর্কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি রামাযানে ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় ক্বিয়ামে রামাযান অর্থাৎ তারাবীহ বা তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করে তার পূর্ববর্তী গোনাহ সমূহ মাফ করে দেয়া হয়।’ (সহীহ বুখারী হা/২০০৮; মিশকাত ১৯১৮)

১১. কদরের রাত্রিতে ইবাদত করা: আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী করীম (ﷺ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি রামাযানে ঈমানের সাথে ও সওয়াব লাভের আশায় সিয়াম পালন করে, তার পূর্ববর্তী গোনাহ সমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াব লাভের আশায় লায়লাতুল ক্বদর (ক্বদরের রাত) জেগে সালাত আদায় করে তার পূর্ববর্তী গোনাহ সমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।’ (সহীহ বুখারী হা/২০১৪; নাসাঈ ৫০১৭)

(১২). হজ্জ ও ওমরা একত্রে আদায় করা: আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, তোমরা হজ্জ ও ওমরা পরপর একত্রে আদায় কর। কেননা এ হজ্জ ও ওমরা দারিদ্র্য ও গোনাহ দূর করে দেয়, লোহা ও সোনা-রূপার ময়লা যেমনভাবে হাপরের আগুনে দূর হয়। একটি কবুল হজ্জের প্রতিদান জান্নাত ব্যতীত আর কিছুই নয়।’ (ইবনু মাজাহ হা/২৮৮৭; তিরমিযী হা/৮১০; মিশকাত হা/২৫২৪-২৫; হাসান সহীহ)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আরো বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্জ করল, যার মধ্যে সে অশ্লীল কথা বলেনি এবং অশ্লীল কার্য করেনি, সে হজ্জ হতে ফিরে আসবে সেদিনের ন্যায় (নিষ্পাপ অবস্থায়), যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিল।’ (সহীহ বুখারী হা/১৫২১; মিশকাত ২৫০৭)

(১৩). অসচ্ছল ও অভাবীকে অবকাশ দেয়া: নবী করীম (ﷺ) বলেন, জনৈক ব্যবসায়ী লোকদের ঋণ দেয়। কোন অভাবগ্রস্তকে দেখলে সে তার কর্মচারীদের বলত, তাকে ক্ষমা করে দাও। হয়তো আল্লাহ তাআলা আমাদের ক্ষমা করে দিবেন। এর ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে ক্ষমা করে দেন। (বুখারী হা/২০৭৮; আহমাদ হা/৭৫৮২)। হুযাইফাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী করীম (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি, ‘একজন লোক মারা গেল, তাকে জিজ্ঞেস করা হল, তুমি কি করতে? সে বলল, আমি লোকদের সাথে বেচা-কেনা করতাম। ধনীদেরকে অবকাশ (সুযোগ) দিতাম এবং গরীবদেরকে হ্রাস (সহজ) করে দিতাম। কাজেই তাকে মাফ করে দেওয়া হয়।’ (সহীহ বুখারী হা/২৩৯১)

(১৪). মুসাফাহা করা: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, যে দু’জন মুসলিম পরস্পর মিলিত হয়ে মুসাফাহা করে তাদের আলাদা হবার পূর্বেই তাদের (সগীরা) গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।’ (আবু দাউদ হা/৫২১২; তিরমিযী, হা/২৭২৭; ইবনু মাজাহ হা/৩৭০৩; মিশকাত হা/৪৬৭৯, সনদ সহীহ)

(১৫). রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে ফেলা: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, এক ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে চলার সময় কাঁটাদার গাছের একটি ডাল রাস্তায় পেল এবং সেটাকে রাস্তা হতে অপসারণ করল, আল্লাহ তার এ কাজকে কবুল করলেন এবং তাকে মাফ করে দিলেন‌।’ (বুখারী হা/২৪৭২; আবু দাউদ ৫২৪৫; তিরমিজি ২২৫, ১০৬৩)

(১৬). আল্লাহ তাআলার সৃষ্টির প্রতি সদয় হওয়া: রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘একজন লোক রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে তার ভীষণ পিপাসা লাগল। সে কূপে নেমে পানি পান করল। এরপর সে বের হয়ে দেখতে পেল যে, একটা কুকুর হাঁপাচ্ছে এবং পিপাসায় কাতর হয়ে মাটি চাটছে। সে ভাবল কুকুরটারও আমার মতো পিপাসা লেগেছে। সে কূপের মধ্যে নামল এবং নিজের মোজা ভরে পানি নিয়ে মুখ দিয়ে সেটি ধরে উপরে উঠে এসে কুকুরটিকে পানি পান করাল। আল্লাহ তা‘আলা তার আমল কবুল করলেন এবং তার গোনাহ মাফ করে দিলেন। রাসূল (ﷺ) বললেন, প্রত্যেক প্রাণীর উপকার করাতেই নেকী রয়েছে।’ (সহীহ বুখারী হা/২৩৬৩)

(১৭). মন্দ কাজের পরেই ভাল কাজ করা: আল্লাহ তা‘আলা বলেন, إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّئَاتِ ‘নিঃসন্দেহে সৎকার্যাবলী মুছে ফেলে মন্দ কার্য সমূহকে।’ (হূদ: ১১/১১৪)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আবু যারকে বলেন, ‘তুমি যেখানেই থাক আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় কর। মন্দ কাজের পরপরই ভাল কাজ কর, তাতে মন্দ দূরীভূত হয়ে যাবে এবং মানুষের সাথে উত্তম আচরণ কর।’ (সহীহ আত-তিরমিযী হা/১৯৮৭; মিশকাত ৫০৮৩)

(১৮). ধৈর্য ধারণ করা: আল্লাহ তা‘আলা বলেন, إِنَّمَا يُوَفَّى الصَّابِرُوْنَ أَجْرَهُمْ بِغَيْرِ حِسَابٍ ‘ধৈর্যশীলদেরকে অপরিসীম পুরস্কার দেওয়া হবে।’ (সহীহ যুমার ৩৯/১০)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, নিশ্চয়ই বড় পরীক্ষায় বড় পুরস্কার। আল্লাহ তা‘আলা যখন কোন জাতিকে ভালোবাসেন, তখন তাদেরকে পরীক্ষা করেন। যে লোক তাতে সন্তুষ্ট থাকে, তার জন্য (আল্লাহ তা‘আলার) সন্তুষ্টি বিদ্যমান। আর যে লোক তাতে অসন্তুষ্ট হয় তার জন্য (আল্লাহ তা‘আলার) অসন্তুষ্টি বিদ্যমান। (তিরমিযী হা/২৩৯৬; ইবনু মাজাহ হা/৪০৩১, হাদীস হাসান)। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘মুমিন নারী-পুরুষের উপর, তাদের সন্তানের উপর ও তার ধন-সম্পদের উপর অনবরত বিপদাপদ লেগেই থাকে। অবশেষে আল্লাহ তা‘আলার সাথে সে গোনাহ হীন অবস্থায় মিলিত হয়।’ (তিরমিযী হা/২৩৯৯; হাদীস হাসান সহীহ; সহীহাহ হা/২২৮০)

(১৯). খাবার শেষে ও কাপড় পরিধানের পর দোআ পড়া: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি খাবার পর বলবে, ‘সেই আল্লাহর জন্য সকল প্রশংসা, যিনি আমাকে আমার ক্ষমতা ও শক্তি ছাড়াই এই খাবার খাইয়েছেন এবং এই রূযী দান করেছেন, তাহলে তার বিগত সকল গোনাহ মাফ করা হবে।’ (তিরমিযী হা/৩৪৫৮; আবু দাঊদ হা/৪০২৩; মিশকাত হা/৪৩৪৩, সনদ সহীহ)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি কাপড় পরিধানের পর বলবে, যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য। যিনি আমার কোন ক্ষমতা ও শক্তি ছাড়াই আমাকে এই কাপড় পরিধান করিয়েছেন, তাহলে তার আগে-পিছের সকল গোনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (আবূদাঊদ হা/৪০২৩; ছহীহুল জামে‘ হা/৬০৮৬; মিশকাত হা/৪৩৪৩)

(২০). হাট-বাজারে প্রবেশের সময় দোআ করা: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, যে ব্যক্তি বাজারে প্রবেশের সময় বলবে, ‘আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত সত্য কোন মাবুদ নেই, তিনি এক, তাঁর কোন অংশীদার নেই, সকল ক্ষমতা তাঁরই, সমস্ত প্রশংসা তাঁর জন্য, তিনি প্রাণ দান করেন ও মৃত্যু দেন। তিনি চিরজীবি, তিনি কখনো মৃত্যুবরণ করবেন না। তার হাতেই মঙ্গল এবং তিনিই সবসময় প্রত্যেক বস্ত্তর উপর ক্ষমতার অধিকারী, তাহলে তার জন্য আল্লাহ তা‘আলা দশ লক্ষ নেকী বরাদ্দ করেন, তার দশ লক্ষ গোনাহ মাফ করেন এবং তার দশ লক্ষ গুণ সম্মান বৃদ্ধি করেন।’ (তিরমিযী হা/৩৪২৮; ইবনু মাজাহ হা/২২৩৫; মিশকাত হা/২৩১৮, সনদ হাসান)

(২১). সালাতের উদ্দেশ্যে আযান দেওয়া: নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, ‘মুয়াযযিনের কণ্ঠস্বর যতদূর পর্যন্ত যায়, তাকে ততদূর ক্ষমা করে দেয়া হয়। তাজা ও শুষ্ক প্রতিটি (জিনিসই কিয়ামতের দিন) তার জন্য সাক্ষী হয়ে যাবে। আর কেউ জামা‘আতে হাযির হলে তার জন্য পঁচিশ ওয়াক্ত সালাতের সওয়াব লিখা হয় এবং এক সালাত হতে আরেক সালাতের মধ্যবর্তী সময়ের গোনাহ ক্ষমা করা হয়।’ (আবু দাঊদ হা/৫১৫; ইবনু মাজাহ হা/৭২৪; আহমাদ হা/৭৬১১; সহীহুল জামে‘ হা/১৯২৯; মিশকাত হা/৬৬৭)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘ইমাম হচ্ছেন (মুসল্লীদের সালাতের) যামিন এবং মুয়াযযিন হলো (তাদের সালাতের) আমানতদার। হে আল্লাহ! ইমামদের সঠিক পথ প্রদর্শন করুন ও মুয়াযযিনদের ক্ষমা করে দিন।’ (আবু দাঊদ হা/৫১৭; তিরমিযী হা/২০৭; আহমাদ হা/৭১৬৯; ইরওয়া হা/২১৭; মিশকাত হা/৬৬৩)

(২২). আল্লাহর পথে জিহাদ করা: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেন, يُغْفَرُ لِلشَّهِيْدِ كُلُّ ذَنْبٍ إِلاَّ الدَّيْنَ ‘শহীদের সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয় ঋণ ব্যতীত।’ (মুসলিম হা/১৮৮৬; আহমাদ হা/২২৫৮৫; তিরমিযী হা/১৬৪০; ইরওয়া হা/১১৯৬; মিশকাত হা/৩৮০৬)। তিনি আরো বলেন, ‘আল্লাহর নিকট শহীদের জন্য ছয়টি বিশেষ পুরস্কার রয়েছে। তা হল: ১. তার রক্তবিন্দু মাটিতে পড়ার সাথে সাথেই তাকে ক্ষমা করে দেয়া হয় এবং জান বের হওয়ার প্রাক্কালেই জান্নাতে তার বাসস্থানটি দেখানো হয়। ২. তাকে কবরের আযাব থেকে রক্ষা করা হয়। ৩. ক্বিয়ামত দিবসের ভয়াবহতা হতে তাকে নিরাপদে রাখা হয়। ৪. সেদিন তার মাথায় সম্মানের মুকুট পরানো হবে, যার একটি মুক্তা দুনিয়া ও তার মধ্যকার সবকিছু থেকে উত্তম। ৫. তাকে ৭২ জন সুন্দর চক্ষু বিশিষ্ট হূরের সাথে বিয়ে দেওয়া হবে। ৬. তার ৭০ জন নিকটাত্মীয়ের জন্য তার সুপারিশ কবুল হবে।’ (তিরমিযী হা/১৬৬৩; ইবনু মাজাহ হা/২৭৯৯; মিশকাত হা/৩৮৩৪, সনদ ছহীহ)

(২৩). আল্লাহর নৈকট্য লাভের নিয়তে যিকির ও দ্বীনী আলোচনার বৈঠকে হাযির হওয়া: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, মানুষের আমল লিপিবদ্ধকারী ফেরেশতাগণ ছাড়া আল্লাহ তা‘আলার আরও কিছু ফেরেশতা আছেন যারা দুনিয়াতে ঘুরে বেড়ান। তারা আল্লাহ তা‘আলার যিকিরে মশগুল ব্যক্তিদের পেয়ে গেলে একে অন্যকে ডেকে বলেন, নিজেদের উদ্দেশ্যে তোমরা এদিকে চলে এসো। অতএব তারা সেদিকেই ছুটে আসেন এবং যিকিরে রত লোকদের পৃথিবীর নিকটবর্তী আকাশ পর্যন্ত পরিবেষ্টন করে রাখেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তোমাদেরকে আমি সাক্ষী রেখে বলছি যে, আমি তাদেরকে ক্ষমা করে দিলাম। তখন ফেরেশতারা বলেন, তাদের মাঝে এমন এক লোক আছে যে, তাদের সঙ্গে একত্র হওয়ার জন্য আসেনি, বরং ভিন্ন কোন দরকারে এসেছে। সে সময় আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তারা এরূপ একদল ব্যক্তি যে, তাদের সাথে উপবেশনকারীও বঞ্চিত হয় না। (সহীহ বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী হা/৩৬০০)

(২৪). তওবা করা: আল্লাহর ক্ষমা লাভের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে পাপ করার পরই তাঁর নিকটে অনুতপ্ত হয়ে তওবা করা। আল্লাহ বলেন,وَهُوَ الَّذِيْ يَقْبَلُ التَّوْبَةَ عَنْ عِبَادِهِ وَيَعْفُو عَنِ السَّيِّئَاتِ- ‘তিনিই তাঁর বান্দাদের তওবা কবুল করেন ও পাপ মোচন করেন’ (শূরা: ৪২/২৫)। তিনি আরো বলেন,أَفَلاَ يَتُوْبُوْنَ إِلَى اللهِ وَيَسْتَغْفِرُوْنَهُ وَاللهُ غَفُوْرٌ رَحِيْمٌ ‘এরপরেও কি তারা আল্লাহর দিকে ফিরে আসবে না (অর্থাৎ তওবা করবে না) ও তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে না? অথচ আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (মায়েদাহ: ৫/৭৪)।

রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘যখন বান্দা গোনাহ স্বীকার করে এবং অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে ক্ষমা চায় আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন এবং তাকে ক্ষমা করে দেন’ (সহীহ বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ২৩৩০)
.
পরিশেষে বলব, পরিশেষে বলব, আল্লাহ তা‘আলা অত্যন্ত ক্ষমাশীল। মানুষ পাপ করার পর তাঁর নিকটে ক্ষমা চাইলে তিনি ক্ষমা করে দেন। আর এ ক্ষমা জান্নাতে যাওয়ার মাধ্যম। অতএব প্রিয় পাঠক! আসুন, উপরোক্ত আমল সমূহ যথাযথভাবে সম্পাদনের মাধ্যমে আমরা পাপ মোচনের জন্য চেষ্টা করি। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের প্রত্যেক মুমিন নারী-পুরুষের ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে দিন। অধিক হারে নেকী অর্জনের তাওফীক দিন এবং জান্নাতুল ফিরদাউসের পথ সহজ করে দিন। আমীন।সংকলিত। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
___________________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।