ভবিষ্যতে কি হবে এই ধরনের কথা বলা কতটুকু শরীয়ত সম্মত

২০২৩ সালে দুর্ভিক্ষ দেখা দিবে, ২০২৪ বা ২০২৭ সালে ইমাম মাহাদী আসবেন, অমুক সালে মালহামা যুদ্ধ শুরু হবে, অমুক সালে ঈসা (আলাইহিস সালাম) আসবেন, দাজ্জাল আত্মপ্রকাশ করেছে কিংবা বস্তুবাদী সভ্যতা হল দাজ্জাল, অমুক সালে কেয়ামত হবে ইত্যাদি কথাগুলো বলা কতটুকু শরীয়ত সম্মত আজ আমরা জানার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: প্রিয় পাঠক, দুঃখজনক হলেও সত্য, গত কয়েক বছর ধরে একটা বিষয় লক্ষ করছি বাংলাদেশে কিছু আলেম বা বক্তা কখনো ওয়াজের ময়দানে কখনো টেলিভিশন চ্যানেলে কখনো বা ইউটিউবে অসংখ্য গায়েবী খবরে নির্দিষ্ট করে সময় বেঁধে দিচ্ছেন। যেমন: তারা বলে বেড়াচ্ছেন অমুক যেমন, (২০২৩-২৪-২৭) সালে ইমাম মাহদী আসবেন, অমুক সালে মালহামা (যুদ্ধ) হবে, অমুক সালে দুর্ভিক্ষ দেখা দিবে, অমুক সালে ঈসা (আলাইহিস সালাম) আসবেন, অমুক সালে কেয়ামত সংঘটিত হবে, আবার এটাও বলে বেড়াচ্ছেন দাজ্জাল আবির্ভাব হয়ে গেছে এখন আত্মপ্রকাশের অপেক্ষায়, কখনোবা বস্তুবাদী সভ্যতাকে দাজ্জাল বলে বেড়াচ্ছেন। (লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ) অথচ এই বক্তব্যগুলো সরাসরি ঈমান আক্বীদা এবং কুরআন সুন্নাহ বিরোধী। কারণ নির্দিষ্ট করে কোন দিন তারিখে ইমাম মাহদী আসবেন বা দাজ্জাল আসবেন, দুর্ভিক্ষ দেখা দিবে, সভ্যতা হলো দাজ্জাল এবং হাদীসে বর্ণিত কেয়ামতের কোন একটি ছোট বা বড় আলামত যদি বর্তমান বাস্তবতার কোন ঘটনার সাথে মিলে যায় আর বলা হয় এটাই হাদীসে বর্ণিত কেয়ামতের সেই আলামত বা নিদর্শনাবলী এসব ভবিষ্যদ্বাণী ও নির্দিষ্টকরণ করা গর্হিত অপরাধ। কেননা এটাই যে হাদীসে বর্ণিত কেয়ামতের আলামত এই নিশ্চয়তা আমাদেরকে দিল কে? আর ভবিষ্যতেও যে এমন আলামত দেখা যাবেনা তারই বা নিশ্চয়তা কি? সুতরাং এবং এই ধরনের নিশ্চিত ভবিষ্যদ্বাণী সরাসরি শরীয়ত বিরোধী।
.
ক্বিয়ামতের দশটি বড় আলামতের অন্যতম আলামত হলো ইমাম মাহদীর আগমন, দাজ্জালের আবির্ভাব, ঈসা (আঃ)-এর আগমন। কিন্তু তারা ক্বিয়ামতের কতদিন পূর্বে আগমন করবেন, সে বিষয়ে নির্দিষ্টভাবে কুরআন-সুন্নাহয় কিছুই বর্ণিত হয়নি। সুতরাং যে সকল বক্তারা নির্দিষ্ট দিন তারিখ বলে দিচ্ছেন অমুক সালে এটা হবে অমুক সালে সেটা হবে ইত্যাদি এই ধরনের ভ্রান্ত বক্তাদের ভ্রান্ত মন্তব্য শুনা থেকে বিরত থাকুন।আক্বীদার অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় ক্বিয়ামাতের আলামত সংক্রান্ত বিষয়ে আমাদের দায়িত্ব কুরআন ও হাদীসের বক্তব্যগুলো সরল অর্থে বিশ্বাস করা। এ বিষয়ে কুরআন ও সহীহ হাদীসে যা কিছু বলা হয়েছে সবই সত্য। এগুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও আবির্ভাবের সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই জানেন। এর সঠিক ব্যাখ্যা উদ্ঘাটনের নামে মানুষকে বিভ্রান্ত করার দায়িত্ব আমাদের দেয়া হয়নি। আমাদের দায়িত্ব সাধ্যানুযায়ী ইহকাল ও পরকালে কাজে লাগার মত প্রয়োজনীয় বিষয়ে জ্ঞানচর্চা ও গবেষণা করা। মানুষের প্রায়োগিক জীবনের সমস্যার সমাধান দেয়ার জন্য কুরআন-হাদীস নিয়ে গবেষণা করা, যে সকল বিষয়ের গবেষণা-অনুসন্ধান মানুষকে একটি নিশ্চিত ফলাফল লাভের পথে নিয়ে যাবে। কিন্তু অদৃশ্যের বিষয় নিয়ে গবেষণার নামে অকারণে তর্ক-বিতর্ক মোটেও কাম্য নয়। কারণ এগুলো আক্বীদার বিষয়। নিজের পক্ষ থেকে কোন কিছু বানিয়ে বলা অথবা জাল, যঈফ ও মুনকার হাদীস বর্ণনা করা রাসূলুল্লহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর মিথ্যা রচনা করার নামান্তর। যার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘আমার প্রতি মিথ্যারোপ করা অন্য কারো প্রতি মিথ্যারোপ করার মত নয়। যে ব্যক্তি আমার প্রতি মিথ্যারোপ করে সে যেন অবশ্যই তার ঠিকানা জাহান্নামে করে নেয়।’(সহীহ বুখারী, হা/১২৯১; সহীহ মুসলিম, হা/৯৩৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৮২৬৫) নিশ্চয় ক্বিয়ামত ও তার নিদর্শনাবলী সম্পর্কে কোন প্রকারের ভবিষ্যদ্বাণী করার অর্থ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্পষ্ট বিরুদ্ধচারণ করা। (সূরা লুক্বমান: ৩৪; সহীহ বুখারী, হা/১০৩৯, ৪৬২৭, ৪৬৯৭, ৪৭৭৮, ৭৩৭৯)
.
যেমন: পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহর নিকটেই রয়েছে ক্বিয়ামত (সংঘটিত হওয়ার) জ্ঞান, তিনি বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং তিনি জানেন জরায়ুতে যা আছে। কেউ জানে না আগামীকাল সে কী উপার্জন করবে এবং কেউ জানে না কোন দেশে তার মৃত্যু ঘটবে। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্ববিষয়ে অবহিত।’ (সূরা লুক্বমান,৩১/ ৩৪)
.
ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘ইলমে গায়েব বা অদৃশ্যের চাবিকাঠি পাঁচটি, যা আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ জানে না। আগামী কাল কী ঘটবে,তা আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ জানে না।’ (সহীহ বুখারী, হা/১০৩৯, ৪৬২৭, ৪৬৯৭, ৪৭৭৮, ৭৩৭৯)
.
ক্বিয়ামতের নিকটবর্তী কিছু নিদর্শন নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, কিন্তু ক্বিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঠিক সময় নিশ্চিতরূপে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই জানেন। এমনকি তা কোন ফিরিশতাও জানেন না এবং কোন প্রেরিত নবী-রাসূলও জানেন না। সেজন্য নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে ক্বিয়ামত সম্পর্কে জিজেস করা হলে উত্তরে তিনি বলতেন, ‏وَيْلَكَ وَمَا أَعْدَدْتَ لَهَا ‘তোমার জন্য আক্ষেপ, তুমি এর জন্য কী প্রস্তুতি গ্রহণ করেছ’? (সহীহ বুখারী, হা/৬১৬৭)
.
শায়খ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন, ‘এমন প্রত্যেক ব্যক্তি যে, ক্বিয়ামত সংঘটিত হওয়ার সময়কে নির্দিষ্ট করে বর্ণনা করে, সে বড় মিথ্যুক ও বিশৃঙ্খলাকারী। ক্বিয়ামত ঐ সময় যার সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তারা আপনাকে ক্বিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে বলে, ‘তা কখন সংঘটিত হবে?’ (হে নবী!) আপনি বলুন, এ বিষয়ের জ্ঞান শুধু আমার প্রতিপালকের নিকটেই রয়েছে। কেবল তিনিই নির্ধারিত সময়ে তা প্রকাশ করবেন। তা হবে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে একটি ভয়ংকর ঘটনা। আকস্মিকভাবেই তা তোমাদের নিকট আসবে। আপনি এ বিষয়ে সবিশেষ অবহিত মনে করেই তারা আপনাকে প্রশ্ন করে। আপনি বলুন, ‘এ সম্পর্কীয় জ্ঞান আমার প্রতিপালকের নিকটেই আছে। কিন্তু অধিকাংশ লোকই তা জানে না।’ (সূরা আল-আ‘রাফ: ১৮৭; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৮৩৯৮)।
.
পরিশেষে, প্রিয় পাঠক! ক্বিয়ামত আসন্ন- এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। মুসলিম উম্মাহর সময়কাল শেষের পথে সে ব্যাপারেও কোন বিতর্ক নেই। বরং ক্বিয়ামতকে নিকটবর্তী মনে করা সাহাবীগণের আদর্শ। কারণ তারা সূর্য গ্রহণ হলে ক্বিয়ামতের আশঙ্কা করতেন। (সহীহ বুখারী হা/১০৫৯; মুসলিম হা/৯১২; মিশকাত হা/১৪৮৪)। আবার অনেক সাহাবী ইবনু সাইয়াদকে নিশ্চিত দাজ্জাল মনে করতেন। (সহীহ বুখারী হা/৭৩৫৫; আবুদাউদ হা/৪৩৩১)। যদিও দাজ্জাল এখনো আসেনি। কিন্তু তাই বলে ক্বিয়ামতের জন্য সময়সীমা নির্ধারণ করা মোটেও জায়েয হবে না। আর এটা এজন্যই যে, আল্লাহ তা‘আলা এই জ্ঞান নিজের কাছে রেখেছেন। যাতে করে প্রত্যেক ব্যক্তি আমলের প্রতি ধাবিত হয় এবং আল্লাহ তার প্রতিদান দিতে পারেন। (সূরা ত্ব-হা ২০/১৫)। পাশাপাশি মনে রাখা ভাল যে, পৃথিবী ধ্বংস হওয়া এবং ইমাম মাহদী সম্পর্কে অতি বাড়াবাড়ি এবং বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারণা বর্তমান যুগে ফিতনা এবং পথভ্রষ্টতার অন্যতম কারণ। শী‘আরা সহ কাদিয়ানী, বাহাই, জঙ্গীবাদী দায়েশ এবং বাংলাদেশের বায়েজীদ খান পন্নী ও তার হিযবুত তাওহীদ, তুরস্কের আদনান ওকতার ওরফে হারূন ইয়াহইয়া ইত্যাদি যত বিভ্রান্ত দল ও ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটেছে বর্তমান যুগে, তারা সকলেই ইমাম মাহদী সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর আক্বীদার শিকার। এদের অনেকে আবার নিজেকেই ইমাম মাহদী বলে দাবী করেন। তাছাড়া ইসলামী খেলাফতের অবর্তমানে এবং বিশ্ব রাজনীতিতে মুসলমানদের দুর্বল অবস্থানের প্রেক্ষাপটে একদল মুসলমান পরাজিত মানসিকতা সম্পন্ন ও হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। সেই প্রেক্ষাপট থেকে তারা ইমাম মাহদীতেই সমাধান খুঁজছে এবং তাঁর অপেক্ষাতে দিন অতিবাহিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সুতরাং এই বিষয়ে কোন প্রকার বাড়াবাড়ি ও হঠকারিতা যেন আমাদের ঈমান-আক্বীদাকে ধ্বংস না করে ফেলে, সে ব্যাপারে হকপন্থী মুসলিম সমাজকে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। সালফে সালেহীনের মানহাজের আঁকড়ে ধরতে হবে। আল্লাহ আমাদেরকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন এবং সঠিক আমল করার তাওফীক দান করুন আমীন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
_______________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।