যাকাতুল ফিতর

যাকাতুল ফিতরের পরিচয়, সংজ্ঞা, উদ্দেশ্য এবং এর বিধান। কার উপর যাকাতুল ফিতর আদায় করা ফরজ। কি পরিমাণ ফিতরা আদায় করতে হবে এবং সেটা কখন আদায় করতে হবে।
▬▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: আমরা আজ শরীয়তের এমন একটি বিধান (যাকাতুল ফিতর) নিয়ে আলোচনা শুরু করছি; যেটি ইসলামের সোনালী যুগ অর্থাৎ রাসূল (ﷺ) এবং তার সাহাবীদের আমলে কোন মতানৈক্য ছিলনা। তারপর দিন যতই এগিয়েছে মতানৈক্য শুরু হয়েছে। তাই এই বিষয়ে দুই তিনটি পর্বে আলোচনা করতে চাই; যেন আমরা সঠিকভাবে যাকাতুল ফিতর বা সাদকাতুল ফিতর প্রদান করতে পারি। আমি তিনটি পর্বে এই মাসয়ালাটি শেষ করার প্রয়াস জানাচ্ছি। আশা করি, মনোযোগ সহকারে পড়লে আপনাদের সকল অজানা প্রশ্ন এবং সংশরের উত্তর পেয়ে যাবেন ইনসাআল্লাহ।
.
▪️যাকাতুল ফিতরের পরিচয় ও সংজ্ঞা:
.
সাদাক্বাতুল ফিতর মূলত দুটি আরবী শব্দের সমষ্টি। একটি হল সাদাক্বা, অন্যটি ফিতর। সাদাক্বা শব্দের আভিধানিক অর্থ হল: যাকাত, দান, খয়রাত এবং ফিতর শব্দের আভিধানিক অর্থ হল; উন্মুক্তকরণ বা সিয়াম ভঙ্গকরণ বা ইফতার করা। ইসলামের বিধান অনুযায়ী রামাদান মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার পর গরীব-মিসকীন এবং উপযুক্ত দরিদ্র ব্যক্তিদের নির্দিষ্ট পরিমাণ নির্ধারিত খাদ্যদ্রব্য বা কোনো জনপদের প্রধান খাদ্যশস্য প্রদান করার নিয়মকে শরীআতের পরিভাষায় সাদাক্বাতুল ফিতর বলা হয়। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম পালন করার পর যেহেতু তা ভঙ্গ করা হয় এবং এ উপলক্ষ্যে শরীআত কর্তৃক আরোপিত এই দান দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করা হয়, তাই একে সাদাক্বাতুল ফিতর বলে আখ্যায়িত করা হয়। (ফিক্বহুল হাদীস খন্ড:১; পৃষ্ঠা:৭০৩; নাসাঈ; পৃষ্ঠা:২৮৭; হা/২৫২১)
.
▪️যাকাতুল ফিতর আদায়ের উদ্দেশ্য কি:
.
শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে এবং হাদীসে নববীর আলোকে সাদাক্বাতুল ফিতর অবধারিত করার দুটি তাৎপর্য স্পষ্ট। সেগুলোর একটি হল: (১). সিয়ামের অপূর্ণতা দূরীকরণ। (২). ঈদের আনন্দে অভাবী ও অসচ্ছল লোকদের অংশীদার করা। মানুষস্বভাবজাত দুর্বলতার কারণে সিয়াম রাখা অবস্থায়ও প্রতিটি ব্যক্তি তার কথায় ও কাজে ভুলভ্রান্তির শিকার হয়ে থাকে। পূর্ণ চেষ্টা করা সত্ত্বেও কোনো না কোনো ত্রুটিবিচ্যুতি হয়ে যায়। সাদাক্বাতুল ফিত্বর ফরজ করার একটি বড় উদ্দেশ্য সেই ত্রুটিবিচ্যুতি ও অপূর্ণতা দূর করা। আর দ্বিতীয় উদ্দেশ্য, ঈদের আনন্দে অভাবী ও অসচ্ছল লোকদের অংশীদার করা। তাদের খাবার বা অন্যান্য প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা করা। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) সিয়াম পালনকারীদের অপ্রয়োজনীয় কার্যকলাপ ও অশ্লীল বাক্যালাপের পাপ থেকে পবিত্রকরণের জন্যে এবং দুঃস্থ মানবতার খাবারের উদ্দেশ্যে যাকাতুল ফিতর ফরয করেছেন। যে ব্যক্তি ঈদের সালাতের পূর্বে আদায় করবে, তা সাদাক্বায়ে ফিতর হিসাবে গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তি সালাতের পরে আদায় করবে, তা সাধারণ সাদাক্বাহ হিসাবে গণ্য হবে। (আবু দাউদ হা/১৬০৯; মিশকাত হা/১৮১৮)
.
▪️যাকাতুল ফিতর আদায়ের বিধান কি:
.
মহান আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে যেসব দান বান্দার উপর অপরিহার্য; সাদাক্বাতুল ফিতর তার অন্যতম। আহালুল আলেমগণ একমত যে- সাদাক্বাতুল ফিতর আদায় করা ফরজ/ওয়াজিব। ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন- রাসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রত্যেক গোলাম, আযাদ, পুরুষ, নারী, প্রাপ্ত বয়স্ক, অপ্রাপ্ত বয়স্ক সকল মুসলিমের উপর সাদাকাতুল ফিতর হিসাবে খেজুর হোক অথবা যব হোক এক সা‘ পরিমাণ আদায় করা ফরয করেছেন। (সহীহ বুখারী হা/১৫০৩, ১৫০৪, ১৫০৬, ১৫০৭, ১৫০৮, ১৫১০, ১৫১১, ১৫১২; সহীহ মুসলিম হা/৯৮৪-৯৮৬)। আর্থিক ইবাদত হিসেবে যাকাতের কাছাকাছি পর্যায়ে এর অবস্থান। অধিকাংশ ফিক্বহী গ্রন্থে যাকাত অধ্যায়েই সাদাক্বাতুল ফিততের আলোচনা করা হয়েছে এবং দ্বিতীয় হিজরীতে রামাদানের সিয়াম ফরয করা হয়।
.
▪️একজন ব্যক্তির উপর ফিতরা কখন ফরজ হয়?
.
যাকাতুল ফিতর শরীয়তের একটি অন্যতম ফরয ইবাদত। যা ধনী-গরীব, নারী-পুরুষ, ছোট-বড় সকলের উপরে ফরয করা হয়েছে। মানুষের উপর রামাদানের শেষ দিনের সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে ফিতরার যাকাত ফরজ হয়। এ সময় হলো রামাদানের শেষ রোযাতে ইফতার করার সময়। আর এ সময়ের দিকে সম্বন্ধ করেই তার নাম হয়েছে ‘সাদাক্বাতুল ফিতর’। বলা বাহুল্য, ইফতার করার সময় বাস্তবায়িত হয় ঈদের রাতের সন্ধ্যায় সূর্য ডোবার সাথে সাথে। ফিতরার কোন নিসাব নেই। কারণ, গোলামের উপরও ফিৎরা ফরয করা হয়েছে। (সহীহ বুখারী হা/১৫১১; মিশকাত হা/১৮১৫)। আহালুল আলেমগনের মতে,কোন স্বাধীন মুসলিম ব্যক্তির নিকট যদি তার পরিবার-পরিজনের জন্য একদিনের চেয়ে অধিক পরিমাণ খাদ্য মওজুদ থাকে, তাহলে তার উপর ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব। (ফিক্বহুস সুন্নাহ খন্ড:১ পৃষ্ঠা: ৪১২-১৩)। যথাসময়ে ও সঠিক পদ্ধতিতে ফিতরা প্রদান করা না হলে তা যেমন আদায় হয় না, তেমনি এর দ্বারা পরকালে কোন সওয়াব লাভ করা যাবে না। ইবনু উমার (রা) হতে বর্নিত, রাসূল (ﷺ) যাকাতুল ফিতর ফরয করেছেন প্রত্যেক স্বাধীন বা গোলাম, পুরুষ কিংবা নারী নির্বিশেষে সকল মুসলিমের উপর মাথা পিছু এক সা’ খেজুর বা যব রামাদানের ফিতরা আদায় করা। (সহীহ বুখারী হা/১৫০৩; মুসলিম হা/৯৮৪)। অতএব, এ সময়ে যে শরীয়তের আজ্ঞাপ্রাপ্ত থাকবে কেবল তারই উপর ঐ যাকাত ফরজ এবং তার পরে কেউ আজ্ঞাপ্রাপ্ত হলে তা ফরজ নয়। যেমন; ঈদের রাতের সূর্য ডোবার সামান্যক্ষণ পর যদি কেউ ইসলাম কবুল করে অথবা কোন শিশু জন্মগ্রহণ করে অথবা শেষ রামাদানের সূর্য ডোবার সামান্যক্ষণ পূর্বে যদি কেউ মারা যায়, তাহলে উক্ত প্রকার লোকেদের উপর ফিতরা ওয়াজিব নয়। অবশ্য মায়ের গর্ভে ভ্রূণের তরফ থেকে ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব নয় মর্মে আলেমগণের ইজমা (ঐকমত্য) সংঘটিত হয়েছে। তবে তার পক্ষ থেকেও আদায় করা হলে সেটা মুস্তাহাব। কারণ, উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে এ ধরনের আমল সাব্যস্ত আছে। পক্ষান্তরে ঐ দিনের সূর্য ডোবার সামান্যক্ষণ আগে যদি কেউ ইসলামে দীক্ষিত হয় অথবা কোন শিশু জন্মগ্রহণ করে, অথবা সূর্য ডোবার সামান্যক্ষণ পরে যদি কেউ মারা যায়, তাহলে উক্ত প্রকার লোকেদের উপর ফিতরা ওয়াজিব। (ইমাম উসামীন আশ শারহুল মুমতে’ ৬/১৬৬-১৬৭ ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং ৪৯৭৯৩)
.
▪️কি পরিমাণ ফিতরা আদায় করতে হবে ?
.
যাকাতুল ফিতর সিয়াম পালনকারী অথবা সিয়াম ভঙ্গকারী প্রত্যেকের উপর ফরজ। এর পরিমাণ হল প্রত্যেক মাথাপিছু এক সা’ অর্থাৎ প্রায় ৩ কেজি পরিমাণ খাদ্যবস্তু দ্বারা ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখার পর থেকে ঈদুল ফিতরের সালাত আদায়ের আগ পর্যন্ত ফিতরা আদায় করতে হবে এবং এটাই সুন্নাহ। এটাই রাসূল ﷺ তার সাহাবী এবং ইতিহাস বিখ্যাত অধিকাংশ বিদ্বানের বিশুদ্ধ অভিমত। এই মতের পক্ষে কুরআন-সুন্নাহর দলিল- সাহাবীদের আমল, অধিকাংশ তাবেঈ তিন মাজহাবের ইমাম মালিকী,শাফি‘ঈ এবং হাম্বালী মাযহাবের মত। (বিস্তারিত দেখুন, ইমাম ইবনু কুদামাহ রাহিমাহুল্লাহ, আল-মুগনী; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ২৯৫; দারু ‘আলামিল কুতুব, রিয়াদ কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪১৮ হি./১৯৯৮ খ্রি)। ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রত্যেক গোলাম, আযাদ, পুরুষ, নারী, প্রাপ্ত বয়স্ক, অপ্রাপ্ত বয়স্ক সকল মুসলিমের উপর সাদাক্বাতুল ফিতর হিসাবে খেজুর হোক অথবা যব হোক এক সা পরিমাণ আদায় করা ফরয করেছেন। (সহীহ বুখারী, হা/১৫০৩, ১৫০৪, ১৫০৬, ১৫০৭, ১৫০৮, ১৫১০, ১৫১১, ১৫১২; সহীহ মুসলিম, হা/৯৮৪-৯৮৬)। ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, উক্ত হাদীস প্রমাণ করে যে, এক সা পরিমাণ খাদ্য দ্রব্য প্রদান করা ফরয। অর্ধ সা‘ পরিমাণ ফিতরা আদায় করার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে সহীহ সূত্রে কোন তথ্য প্রমাণিত হয়নি।’ (ইমাম নববী আল-মাজমূঊ, ৬/১৪৩ পৃ)
.
▪️এখন প্রশ্ন হলো সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী এর ‘সা’ এর পরিমাণ কতটুকু?
.
হাদীসে বর্ণিত এক ‘সা’ খাদ্যদ্রব্য পরিমান বা ওজনের মাপকাঠিতে ঠিক কতটুকু এটি নিয়ে আহালুল আলেমগণের মধ্যে কিছুটা মতানৈক্য রয়েছে। তবে বিশুদ্ধ কথা হলো ফিতরার পরিমাণ হিসাব করতে হবে কাইল (কাঠা বা পরিমাপের পাত্র) দিয়ে, ওজন দিয়ে নয়। ফিতরা পরিমাপ করা হবে সা‘ দ্বারা, আর সে সা‘ হলো নাবী (ﷺ) এর সা‘। যেমন; আবু সা‘ঈদ খুদরী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেছেন, كُنَّا نُعطِيهَا فِي زَمَانِ النَّبيِّ ﷺ( صَاعًا مِنْ طَعَامٍ). “আমরা নবী (ﷺ) এর যুগে এক সা‘ খাদ্যদ্রব্য দ্বারা ফিতরা আদায় করতাম।” (সাহীহ বুখারী, হা/১৫০৮; সাহীহ মুসলিম, হা/৯৮৫)। ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যাকাতুল ফিতর (ফিতরা) হিসেবে খেজুর হোক অথবা যব হোক এক সা’ পরিমাণ আর গম আধা সা’ পরিমাণ আদায় করা আবশ্যক করেছেন। (আবু দাউদ, আস-সুনান: ১৬২২; নাসায়ি, আস-সুনান: ৫৮০)। বলাই বাহুল্য, সা‘ যে দ্রব্যের দ্বারা পূর্ণ করা হবে, সে দ্রব্য আলাদা হলে ওজনও আলাদা হবে। অর্থাৎ, এক সা‘ খেজুরের ওজন এক সা‘ গম বা এক সা‘ চাউলের চেয়ে আলাদা হবে। সুতরাং, ফিতরাদাতা যখন ওজন দ্বারা ফিতরা আদায় করার ইচ্ছা করবেন, তখন অবশ্যই এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে যে, তিনি যে খাদ্যদ্রব্য দ্বারা ফিতরা আদায় করবেন তা পূর্ণ এক সা‘ এর সমপরিমাণ।

🔸এখানে দুটো জানার বিষয় রয়েছে। যথা:

এক. ফিতরা ওজন দিয়ে পরিমাপ করার চেয়ে কাইল দ্বারা পরিমাপ করাই অধিক সতর্কতামূলক পদ্ধতি। আর হাত দ্বারা পরিমাপ করলেও তা ‘কাইল দ্বারা পরিমাপ’ বলে গণ্য হবে। ইমাম ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, “এক (নাবাউয়ী) সা‘ এর পরিমাণ হচ্ছে মধ্যম আকৃতির দুই হাত দিয়ে ৪ মুঠোর সমপরিমাণ শুকনো খাবার। যেমন: খেজুর, গম প্রভৃতি।… যখন একজন মুসলিম কাইল দিয়ে শুকনো খাবার (ফিতরা হিসেবে) বের করবে—যেমন: শুকনো খেজুর, ভালো গম, চাল, শুকনো কিসমিস, পনির প্রভৃতি—তখন তা ওজন দিয়ে বের করার চেয়ে অধিক সতর্কতামূলক বলে বিবেচিত হবে।” (ইমাম ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ), মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড: ১৪; পৃষ্ঠা: ২০৪-২০৫; দারুল ক্বাসিম, রিয়াদ কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২০ হিজরী; ১ম প্রকাশ)
·
দুই. ওজন (কিলোগ্রাম) হিসেবে মাদীনাহ’য় প্রচলিত এক নাবাউয়ী সা‘ এর পরিমাণ কতটুকু? এক্ষেত্রে আলিমদের প্রস্তুতকৃত হিসাবে সামান্য মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। যেমন:
·
১. ইমাম ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ)’র মতানুযায়ী কিলোগ্রামের হিসাবে এক নাবাউয়ী সা‘ সমান ৩ কেজি। (মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড: ১৪; পৃষ্ঠা: ২০৫)
·
২. ইমাম ইবনু উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ)’র মতানুযায়ী এক সা‘ সমান ভালো মানের গমের ওজন ২ কেজি ৪০ গ্রাম। (আশ-শারহুল মুমতি‘ ‘আলা যাদিল মুস্তাক্বনি‘; খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ১৭৬; দারু ইবনিল জাওযী, দাম্মাম ছাপা; সন: ১৪২৪ হিজরী; ১ম প্রকাশ)
·
৩. ইমাম ইবনু উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) আরও বলেছেন, “এক ভাই একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ ভর্তি করে চাল পাঠিয়েছেন। আমি তা মেপে দেখেছি। এর ওজন ২ কেজি ১০০ গ্রাম। আমি তা নাবাউয়ী সা‘ এর মাপ অনুযায়ীই পেয়েছি।” (মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল; খণ্ড: ১৮; পৃষ্ঠা: ২৭৬; দারুস সুরাইয়্যা, রিয়াদ কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২৩ হি./২০০৩ খ্রি.; ১ম প্রকাশ)
.
জ্ঞাতব্য যে, সৌদি আরবের উনাইযাহ শহরস্থ এক ধ্বংসস্থলে পিতলের তৈরি একটি নাবাউয়ী মুদ আবিষ্কৃত হয়। ইমাম উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) ওই মুদের মালিকের কাছ থেকে তা খুব চড়া দামে ক্রয় করেন। মুদের পাত্রটির গায়ে তার মালিকের নাম সনদ অনুযায়ী খোদাই করা ছিল। এই ক্রমধারা এক প্রখ্যাত সাহাবীর মাধ্যমে নাবী (ﷺ) পর্যন্ত পৌঁছেছে; আর সে সাহাবী হলেন যাইদ বিন সাবিত (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)। আর বলাই বাহুল্য যে, নাবাউয়ী এক সা‘ সমান ৪ মুদ। (বিস্তারিত দ্রষ্টব্য: আশ-শারহুল মুমতি‘ ‘আলা যাদিল মুস্তাক্বনি‘; খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ১৭৭)
·
৪. ইমাম সালিহ আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) বলেছেন, “কিলোগ্রাম হিসেবে সা‘ এর মাপ প্রায় ৩ কেজি।” (দ্র.: ফাওযান ফাতওয়া নং-১৪৯২৭)
·
৫. সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের গবেষণা অনুযায়ী সা‘ এর মাপ ২ কেজি ৬০০ গ্রাম। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ; খণ্ড: ৫৯; পৃষ্ঠা: ১৭৮)
·
৬. সৌদি আরবের ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (সৌদি ফাতাওয়া বোর্ড) ফাতওয়া অনুযায়ী এক সা‘ সমান প্রায় ৩ কেজি। (ফাতাওয়া লাজনাহ দাইমাহ; ফাতওয়া নং: ১২৫৭২)
.
আর সৌদি আরবে ইমাম ইবনু বায এবং স্থায়ী কমিটির ফাতওয়ার ওপরই আমলের প্রচলন রয়েছে। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইলমিয়্যাহ; খণ্ড: ৫৯; পৃষ্ঠা: ১৭৯)
·
আমাদের দেশে সাধারণত আড়াই কেজি চাল দিয়ে ফিতরা দেওয়া হয়। যেহেতু ওজনের ব্যাপারে আলিমদের মতভেদ আছে, সেহেতু সরাসরি কাইল দিয়ে ফিতরা আদায় করাই অধিক সতর্কতামূলক পদ্ধতি। আর ওজন দিয়ে করলে সবচেয়ে বেশি ওজনের মত তথা ৩ কেজি’র মত অনুসরণ করা ভাল। যারা সমাজভুক্ত হয়ে একত্রে জমা করে ফিতরা আদায় ও বণ্টন করেন, তারা যদি সেখানে আড়াই কেজির বেশি দেন, তাহলে কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু কম দিলে সমস্যা হতে পারে। সেহেতু সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করে হয় তিন কেজি দিন, আর না হয় আড়াই কেজি দিন। আর আল্লাহই সর্বাধিক অবগত। (নোট; মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ মৃধা থেকে)
.
এখানে একটি বিষয় জেনে রাখা ভাল যে, গম দ্বারা অর্ধ সা‘ ফিতরা দেওয়া যাবেনা। কারণ, প্রথমত এই মর্মে যে হাদীস বর্ণিত হয়েছে; তা সহীহ নয়, যঈফ। (যঈফ আবু দাঊদ, হা/১৬১৭)। দ্বিতীয়ত: এটি মু‘আবিয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এর ব্যক্তিগত ইজতিহাদ। যার সমালোচনা সাহাবীদের যুগ থেকেই চলে এসেছে। রাসূল (ﷺ) এক ‘সা’ পরিমাণ ফিত্বরা অবশ্যক করেছেন। কিন্তু নবী (ﷺ) ও চার খলীফার ইন্তেকালের পর যখন মুআবিয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ইসলামী রাষ্ট্রের খলীফা নির্বাচিত হন এবং ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী মদীনা হতে দামেস্কে স্থানান্তরিত হয়, তখন তারা গমের সাথে পরিচিতি লাভ করেন। সে যুগে সিরিয়ায় গমের মূল্য খেজুরের মূল্যের দ্বিগুণ ছিল। তাই খলীফা মুআবিয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহু) একদা হজ্জ বা উমরা করার সময় মদীনায় আসলে মিম্বারে আরোহণ করে বলেন, আমি অর্ধ ‘সা’ গমকে এক সা‘ খেজুরের সমতুল্য মনে করি। লোকেরা তার এই কথা মেনে নেয়। এরপর থেকে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে অর্ধ ‘সা’ ফিত্বরার প্রচলন শুরু হয়। গমে অর্ধ সা‘ ফিতরা দেয়ার মত প্রকাশ করলে সাহাবী আবু সাঈদ খুদরীসহ অন্যান্য সাহাবী মু‘আবিয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)-এর এই ইজতিহাদী সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নির্দেশ ও প্রথম যুগের আমলের উপরেই কায়েম থাকেন। বর্ণনাটি এভাবে এসেছে- আবু সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ)-এর জীবদ্দশায় আমরা ছোট, বড়, স্বাধীন, ক্রীতদাস প্রত্যেকের পক্ষ থেকে এক ‘সা’ খাদ্য অর্থাৎ গম বা এক ‘সা‘ পনির বা এক ‘সা’ যব বা এক ‘সা’ খেজুর বা এক ‘সা‘ কিশমিশ ফিত্বরা হিসেবে বের করতাম। আমরা এভাবেই ফিত্বরা আদায় করে আসছিলাম। শেষ পর্যন্ত যখন মুআবিয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হজ্জ বা উমরার উদ্দেশ্যে আমাদের মাঝে আগমন করলেন, তিনি লোকদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিলেন এবং বললেন, আমি জানি যে, সিরিয়ার দুই মুদ্দ লাল গম এক সা’ খেজুরের সমান। সুতরাং, লোকেরা তার এ অভিমত গ্রহণ করল। আবু সাঈদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, কিন্তু আমি যতদিন জীবিত থাকব, ততদিন পূর্বের ন্যায় সেই পরিমাণে ও যে নিয়মে দিচ্ছিলাম সেভাবেই দিতে থাকব। (সহীহ মুসলিম, হা/২১৭৪)। ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, গমের অর্ধ সা‘ ফিৎরা দেয়া সংক্রান্ত মু‘আবিয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বক্তব্য গ্রহণ করার মধ্যে ত্রুটি রয়েছে। কারণ এটি একজন সাহাবীর আমল, যার বিরোধিতা করেছেন আবু সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) সহ অন্যান্য সাহাবী, যারা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে তার চেয়ে বেশী দিন অবস্থান করেছেন এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অবস্থা সম্পর্কে তারা বেশী জানতেন। (ফাৎহুল বারী, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৩৭৮, হা/১৫০৮-এর ইমাম শারহু মুসলিম, ৩/৪৪৭, হা/৩৮৪-এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য,)। তাই ইরাকী সা’ অনুযায়ী গমের অর্ধ সা‘ ফিৎরা দেয়া যাবে না।
.
▪️এক্ষণে প্রশ্ন হল, নবী (ﷺ) কর্তৃক নির্ধারিত এক সা‘ ফিত্বরার পরিমাণ সাহাবী মুআবিয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর রায়ের কারণে রহিত হয়ে যাবে কি? কিংবা কোনো সাহাবীর সিদ্ধান্তের কারণে নবী (ﷺ)-এর সুন্নাত ছেড়ে দিতে হবে কি?
.
এসব কারণে সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী রাযিয়াল্লাহু আনহু) এই মতের জোরালো বিরোধিতা করেছেন এবং বলেছেন; আমি সারা জীবন সেই পরিমাণেই ফিত্বরা বের করব, যে পরিমাণ নবী (ﷺ)-এর যুগে বের করতাম। মনে রাখতে হবে, আবু সাঈদ খুদরী -সহ অনেক সাহাবী রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাহর বিপরীতে মুআবিয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর রায়কে প্রত্যাখ্যান করেছেন। আর এটাই রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাতের প্রতি ভালোবাসা। সহীহ বুখারীর ভাষ্যকার হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী বলেন, وَفِيْ صَنِيْعِ مُعَاوِيَةَ وَمُوَافَقَةِ النَّاسِ لَهُ دَلَالَةٌ عَلَى جَوَازِ الِاجْتِهَادِ وَهُوَ مَحْمُوْدٌ لَكِنَّهُ مَعَ وُجُوْدِ النَّصِّ فَاسد الإِعْتِبَارِ ‘মুআবিয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর ইজতিহাদ এবং মানুষের তা গ্রহণ করার মাধ্যমে ইজতিহাদের বৈধতা প্রমাণিত হয়, যা প্রশংসনীয়। কিন্তু যেখানে দলীল উপস্থিত, সেখানে ইজতিহাদ গ্রহণযোগ্য নয়।’ (ফাতহুল বারী, ৩/৩৭৪, হা/১৫০৮-এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য
.
▪️যাকাতুল ফিতর কখন আদায় করতে হবে ?
.
যাকাতুল ফিতর আদায়ের দুটি নিয়ম রয়েছে। যেমন; (১). সুন্নাহ সম্মত সময় (২). বৈধ বা জায়েজ সময়। সুন্নাহসম্মত সময় হলো শেষ রমাদানে ইফতারের পর থেকে ঈদের সালাতের জন্য ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। ইবনে উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) ঈদের সালাতের জন্য বের হওয়ার পূর্বে সাদাক্বাতুল ফিত্বর আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। (সহীহ বুখারী, হা/১৪৩২; সহীহ মুসলিম, হা/২৩৩৫)। অপরদিকে বৈধ সময় হলো দুই একদিন আগে দেওয়া। যেমন; আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ঈদের এক দিন বা দুই দিন আগে সদাক্বাতুল ফিত্বর আদায় করতেন। (সহীহ বুখারী, হা/১৪১০)। তবে কোন অবস্থাতেই ইচ্ছাকৃতভাবে ঈদের সালাতের পর ফিতরা আদায় করা যাবেনা। কেউ করলে তা আদায় হবে না; বরং সাধারণ সাদাক্বা হিসেবে গণ্য হবে। এ প্রসঙ্গে আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত আছে যে- রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈদের সালাতের পূর্বে ফিত্বরা আদায় করবে, তার দান ফিত্বরারূপেই গৃহীত হবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ঈদের সালাতের পর ফিত্বরা আদায় করবে, তার দান সাধারণ সাদাক্বার পর্যায়ভুক্ত হবে। (আবু দাঊদ, হা/১৬১১; দারাকুত্বনী, ইবনু মাজাহ, হা/১৮২৭)। ইমাম ইবনু উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, “ফিতরা আদায় করার দুটো সময় রয়েছে। যথা: (১) বৈধ সময়: আর তা হলো ঈদের এক দিন বা দুই দিন আগে, (২) উত্তম সময়: আর তা হলো ঈদের দিন ঈদুল ফিতরের নামাজের পূর্বে।” (ইমাম ইবনু উসাইমীন রাহিমাহুল্লাহ, মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল; খণ্ড: ১৮; পৃষ্ঠা: ২৬৬; দারুস সুরাইয়্যা, রিয়াদ কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২৩ হি./২০০৩ খ্রি.; ১ম প্রকাশ)। সুতরাং বুঝা গেল যে, ফিতরা আদায় করার দুটো সময় আছে। এর পূর্বে আদায় করা জায়েজ নয়।
.
বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন,ঈদের এক দিন বা দুই দিন পূর্বে ফিতরা আদায় করা জায়েজ। এরচেয়ে বেশি পূর্বে আদায় করা জায়েজ নয়। কেননা এটাকে যাকাতুল ফিত্বর বা রোযা ভাঙার যাকাত বলা হয়, আর তা ফিত্বর তথা রোযা ভাঙার দিকে সম্বন্ধিত করে বলা হয়। আমরা যদি রমজান মাস প্রবেশ করা মাত্র ফিতরা বের করা জায়েজ বলি, তাহলে এর নাম ‘যাকাতুস সিয়াম’ তথা ‘রোজার যাকাত’ (রাখাই সার্থক) হতো।” [ইমাম ইবনু ‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ), মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল; খণ্ড: ১৮; পৃষ্ঠা: ২৭০ অনুবাদক আব্দুল্লাহ মৃধা হাফিঃ)

পরিশেষে উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হলো যে, ফিতরা দেয়ার উত্তম সময় হলো রমাদানের শেষ দিন ইফতারের পর থেকে ঈদের সালাতের পূর্ব পর্যন্ত এবং ঈদের এক দিন বা দুই দিন আগে ফিতরা দেওয়া জায়েজ আছে। তবে ঈদের দুই দিনের চেয়ে বেশি আগে ফিতরা আদায় করা জায়েজ নয়। আর আল্লাহই সর্বাধিক অবগত। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক বিষয় জানার এবং তা মানার তাওফীক্ব দান করুন,,,আমীন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।