যমযম কূপ

প্রশ্ন: যমযম কূপের সঠিক ইতিহাস এবং পানি পান করার ফজিলত কি? যমযমের পানি পান করার সুন্নাহ সম্মত নিয়ম কি? উক্ত পানি পান করার সময় কোন দু’আ পড়তে হয়?
▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: যমযম সুপ্রাচীন এক কূপের নাম। নবী ইসমাঈল (আলাইহিস সালাম)-এর স্মৃতিবিজড়িত এই কূপ। পানির পিপাসায় মৃতপ্রায় শিশু ইসমাঈল (আলাইহিস সালাম)-এর জন্য সে সময়ের বিরান মক্কায় হন্যে হয়ে পানির সন্ধান করছিলেন মাতা হাজেরা (আলাইহিস সালাম)। সে সময়ে আল্লাহর আদেশে ফেরেশতা জিব্রাঈল (আলাইহিস সালাম)-এর পায়ের গোড়ালি অথবা ডানার আঘাতের ফলে যমযম কূপের উৎপত্তি হয়।(সহীহ বুখারী হা/৩১২৫ ও ৩৩৬৪-৬৫, আলোচনা দ্রষ্টব্য)। সেখান থেকেই গোড়াপত্তন আজকের মক্কা নগরীর। সেই সময় থেকেই হজযাত্রী ও আল্লাহতে বিশ্বাসী সকল মানুষের নিকট বরকতপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত এই কূপের পানি। যমযমের পানি বরকতময় এবং পৃথিবীর মধ্যে সর্বোত্তম পানি। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, এ পানিতে এমন সব উপাদান রয়েছে, যা মানুষের জন্য খাদ্য ও পানীয় উভয় চাহিদা মেটাতে সক্ষম। পৃথিবীর অন্য কোন পানিতে এ গুণ নেই। দৈনিক লাখ লাখ গ্যালন পানি ব্যয় হওয়া সত্ত্বেও এ পানির কোন ক্ষয় নেই, লয় নেই, কমতি নেই। এর কারণ অনুসন্ধানে বছরের পর বছর চেষ্টা করেও বৈজ্ঞানিকেরা ব্যর্থ হয়েছেন। ফালিল্লা-হিল হাম্দ।
.
যমযমের পানি পানের ফজিলত সম্পর্কে আবু যার রাঃ কর্তৃক বর্ণিত: রাসুল (ﷺ) বলেছেন; পৃথিবীর বুকে সর্বশ্রেষ্ঠ পানি হলো যমযমের পানি। তাতে রয়েছে তৃপ্তিকর খাদ্য এবং ব্যাধির আরোগ্য। (ত্বাবারানীর আওসাত্ব হা/৩৯১২, ৮১২৯; আল-মু‘জামুল কাবীর হা/১১০০৪; সহীহুল জামে হা/৩৩২২)। অপর বর্ণনায় জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর নিকট শুনেছি, তিনি বলেছেন, مَاءُ زَمْزَمَ لِمَا شُرِبَ لَهُ ‘যমযমের পানি যে উদ্দেশ্যে পান করা হবে, সে উদ্দেশ্যই পূরণ হবে। (ইবনে মাজাহ হা/৩০৬২ আলবানী ইরওয়াউল গালীল হা/১১২৩)
.
উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন, যমযমের পানি যে যে উদ্দেশ্যে পান করবে তার জন্য তাই হবে। তুমি যদি তৃষ্ণার্ত এর জন্য পান কর তাহলে তৃষ্ণা দূর হবে। আর যদি ক্ষুধার্তের জন্য পান কর করো তাহলে পরিতৃপ্ত হবে। এমনকি কিছু ওলামা এ হাদীসকে আম হিসেবে গ্রহণ করেছে। নিশ্চয় মানুষ যখন অসুস্থ হয় এবং সে আরোগ্য লাভের জন্য জমজমের পানি পান করে তাহলে সে আরোগ্য লাভ করবে। আর যদি বেশি বেশি ভুল করে এবং স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধির জন্য যমযমের পানি পান করে , তাহলে তার স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পাবে। এবং সে যে কোন উদ্দেশ্যে পান করুক উপকার লাভ করবে। (শারহু রিয়াযুস সলিহিন পৃষ্ঠা: ৬৬২ ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৫০৩৬৮)
.
▪️যমযমের পানি পান করার সুন্নাহ সম্মত নিয়ম কি?
_______________________________________
যমযমের পানি পান করা মুস্তাহাব। আর এই পানি পান করার সুন্নাহ সম্মত নিয়ম হলো: মানুষ যখন যমযমের পানি পান করবে সে তার প্রয়োজনীয় একটি নিয়ত করবে এবং বসে পান করবে। কারণ হাদীসে দাঁড়িয়ে পান করার ব্যাপারে কঠোর ধমকি এসেছে। (সহীহ মুসলিম হা/২০২৪; মিশকাত হা/৪২৬৬, ৬৭)। তবে বসার জায়গা না থাকলে দাঁড়িয়েও পান করা জায়েজ রয়েছে। কেননা রাসূল (ﷺ) বিদায় হজ্জের সময় (ভিড়ের মধ্যে) যমযমের পানি দাঁড়িয়ে পান করেছেন।আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃতিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট যমযমের পানি পেশ করলাম। তিনি তা দাঁড়িয়ে পান করলেন। (বুখারী পর্ব ২৫ অধ্যায় হা/১৬৩৭; মুসলিম ৩৬/১৫, হা/২০২৭ মুসনাদে আহমাদ হা/ ২২৪৪ ইবনু মাজাহ হা/ ৩৪২২)। এই হাদীসের আলোকে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেন, হজ্জের সময় ভিড়ের কারণে বসার সুযোগ না থাকায় তিনি দাঁড়িয়ে পান করেছিলেন এবং এটাই ছিল তাঁর শেষ আমল। (মাজমূ ফাতাওয়া: খন্ড ৩২, পৃষ্ঠা: ২১০)। ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৫১ হি.] বলেছেন, দাঁড়িয়ে পান থেকে বিরত থাকাই সঠিক। তবে ওযরবশতঃ জায়েয। (যাদুল মা‘আদ ১/১৪৩-৪৪)

▪️যমযমের পানি পান করার সময় কোন দু’আ পড়তে হয়?
_______________________________________
যমযমের পানি পান করার সময় নির্দিষ্টভাবে কোন দু’আ রাসূল (ﷺ) থেকে বর্ণিত হয়নি। তাই স্বাভাবিক ভাবে বিসমিল্লাহ বলে পান করবে। তবে যদি কেউ নির্দিষ্ট দোয়া করে এতে সমস্যা নেই। কেননা এর উপরে আমল করেছে একাধিক সালফে সালেহীন এবং ইমামগণ। যেমন: ইমাম আব্দুর রাজ্জাক এবং অন্যান্যরা বর্ণনা করেন যে নিশ্চয় যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুফাসসিরকুল শিরোমণি, উম্মাহ’র শ্রেষ্ঠ ইলমী ব্যক্তিত্ব, সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) [মৃত: ৬৮ হি.] যমযমের পানি পান করলেন অতঃপর বললেন, اللَّهُمَّ إِنِّيْ أَسْأَلُكَ عِلْمًٍا نَافِعًا ، وَرِزْقًا وَاسِعًا وَشِفَاءً مِنْ كُلِّ دَاءٍ. অর্থ:হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট উপকারী জ্ঞান চাচ্ছি । এবং প্রশস্ত রিজিক ও সকল রোগ থেকে শেফা কামনা করছি। (মুস্তাদরাক হাকেম হা/১৭৩৯; দারাকুৎনী হা/২৭৭১;তারগীব হা/৭৫০; মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক হা/৯১১২, আলবানী ইরওয়া হা/১১২৬ দ্রঃ)। তাহক্বীক: হাদীসটি জয়ীফ। কারণ সনদে হাফস বিন ওমর আল-আদানী নামে একজন রাবী রয়েছে। তার সম্পর্কে ইবনে মাঈন বলেছেন, তিনি বিশ্বস্ত নন। আবু হাতিম বলেছেন, হাফস বিন ওমর আল-আদানী হাদিস সৈথিল্যকারী। বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) কোন মন্তব্য করেননি। (বিস্তারিত দেখুন: যঈফ তারগীব হা/৭৫০ ও ইরওয়াউল গালীল ৪/৩৩ পৃঃ, হা/১১২৬-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য)
.
ইমাম খাত্বীব বাগদাদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৪৬৩ হি.] বলেন, সুয়ায়েদ ইবনে সাঈদ রাঃ বলেছেন; আমি মক্কাতে আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারককে দেখলাম তিনি জমজমের কাছে গেলেন এবং সেখান থেকে পানি পান করলেন। অতঃপর কিবলার দিকে মুখ করলেন এবং বললেন, হে আল্লাহ নিশ্চয় ইবনে আবি আল মুওয়ায়াল আমাদের হাদীস বর্ণনা করেন মুহাম্মদ ইবনে মুনকাদির হতে, তিনি জাবির রাঃ হতে, রাসূল (ﷺ) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন,যমযমের পানি যে যে উদ্দেশ্যে পান করবে তার জন্য তাই হবে। অতঃপর আমি এই যমযমের পানি পান করছি কিয়ামতের পিপাসা হতে বাঁচার জন্য। অতঃপর তিনি পান করলেন। (তারীখু বাগদাদ, খণ্ড: ১০;পৃষ্ঠা: ১৬৬)
.
শাইখুল ইসলাম ইমাম তাক্বিউদ্দীন আবুল আব্বাস আহমাদ বিন আব্দুল হালীম বিন তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেন, জমজমের পানি পান করা হলো মুস্তাহাব। এবং সেখান থেকে দক্ষতা অর্জন করা, এবং পান করার সময় শারয়ী যে কোন দোয়া পাঠ করা ।(মাজমাউল ফাতওয়া খন্ড:২৬ পৃষ্ঠা: ১৪৪)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন, হাজির জন্য মুস্তাহাব হলো সে জমজম থেকে পানি পান করবে এবং সেখান থেকে কল্যাণ অর্জন করবে, এবং উপকারী দোয়া হতে যা সহজ তা পাঠ করবে। কেননা জমজমের পানি যে যে উদ্দেশ্যে পান করবে, তার জন্য তাই হবে। (আত-তাহকীক ওয়াল ইযহ পৃষ্ঠা: ৬৩ এবং ইবনে উসাইমিন এর আল বাবুল মাফতুহ, ১৩/৭৫) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।