বিবাহের শর্ত ও রুকন

প্রশ্ন: বিবাহের শর্ত ও রুকন কতটি ও কি কি? শরীয়তে উকিল বাপের বিধান কি? কুরআন-সুন্নাহর আলোকে বিবাহ পড়ানোর সুন্নাহ সম্মত পদ্ধতি কি?
▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: বিবাহের সকল পূর্ব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে আজ বিবাহের দিন বরপক্ষ যাবে কনের বাড়ি। জেনে রাখা ভাল যে,ইসলাম এক সুশৃঙ্খল জীবন-ব্যবস্থা। বিবাহ কোন খেলা নয়। এটা হল দু’টি জীবনের চির-বন্ধন। তাই এই বন্ধনকে সুশৃঙ্খলিত ও শক্ত করার উদ্দেশ্যে ইসলামে রয়েছে বিভিন্ন নিয়ম-নীতি। ইসলামি শরীয়তের বিধান অনুযায়ী বিবাহের শর্ত হলো চারটি। (১). পরস্পর বিবাহ বৈধ এমন পাত্র-পাত্রী নির্বাচন করা (২).বিবাহে পাত্র-পাত্রী উভয়ের সম্মতি থাকা (বুখারী,মিশকাত হা/৩১২৬)। (৩).মেয়ের ওলী অর্থাৎ অভিভাবক থাকা কেননা বিনা ওলীতে বিবাহ বাতিল। এই ওলী হবে সাবালক, সুস্থমস্তিষ্ক ও সুবোধসম্পন্ন সচেতন মুসলিম পুরুষ। যেমন: পাত্রীর পিতা, তা না হলে দাদা, না হলে চাচা, না হলে সহোদর ভাই, না হলে বৈমাত্রেয় ভাই, না হলে,পিতার বৈমাত্রেয় ভাই,না হলে চাচাতো ভাই অনুরূপ নিকটাত্মীয়।যার ওলী নেই তার ওলী শাসক (সুনানে তিরমিযী, হা/১১০১ মিশকাত হা/৩১৩০)। (৪). দু’জন ন্যায়নিষ্ঠ পুরুষ সাক্ষী থাকা (ত্বাবারাণী, সহীহুল জামে‘ হা/৭৫৫৮)। বিবাহের দু’টি রুকন হলো: (১). ইজাব অর্থাৎ মেয়ের অভিভাবক বা তার প্রতিনিধির পক্ষ থেকে পেশকৃত প্রস্তাবনামূলক বাক্য (২).কবুল অর্থাৎ বর বা বরের প্রতিনিধির পক্ষ থেকে সম্মতিসূচক বাক্য। যেমন- বর বলতে পারেন “আমি গ্রহণ করলাম” অথবা এ ধরনের অন্য কোন কথা। (সূরা নিসা, আয়াত; ১৯)। উপরোক্ত শর্তাবলীর কোন একটি পূরণ না হলে বিবাহ শুদ্ধ হবে না। উল্লেখ্য যে, যে মেয়ের ওলী নেই, তার ওলী হবেন সরকার বা সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি। (তিরমিযী, মিশকাত হা/৩১৩১)। সুতরাং বিবাহ পড়ানোর পূর্বে উপরোক্ত সকল শর্ত পূরণ করে মোহরাদি ধার্য ইত্যাদি হওয়ার পর কাজী বা ইমাম সাহেব সূক্ষ্মভাবে খোঁজ নেবেন যে, অলী কে এবং শরয়ী কিনা? বরের চার স্ত্রীর বর্তমানে এটা পঞ্চম বিবাহ তো নয়? বর মুসলিম তো? পাত্রী ইদ্দতের মধ্যে তো নয়? গর্ভবতী তো নয়? পাত্রের দ্বিতীয় বিবাহ হলে পূর্বের স্ত্রীর বর্তমানে এই পাত্রী তার বোন, ফুফু, বুনঝি বা ভাইঝি তো নয়। এই পাত্রী সধবা হয়ে কারো স্বামীত্বে নেই তো? পাত্রীর দ্বিতীয় বিবাহ হলে তার পূর্ব স্বামী যথারীতি তালাক দিয়েছে তো? পাত্রী রাজী আছে তো? পাত্রীর কোন বৈধ শর্ত তো নেই? দু’জন সঠিক ও উপযুক্ত সাক্ষী আছে কিনা? ইত্যাদি যাচাই-বাছাই করা।
.
▪️বাকি আলোচনা করার আগে একটি বিষয় পরিস্কার করি, অনেক এলাকায় বিবাহের ক্ষেত্রে উকিল বাপ নামে একজন নতুন বাপের উৎপত্তি দেখা যায় প্রশ্ন হলো, উকিল বাপ নামে ইসলামী শরীয়তে কোন বাপ আছে কি?
.
বর্তমানে আমাদের দেশের অনেক এলাকায় বিয়ের ক্ষেত্রে নিজের পিতা থাকার পরেও মধ্যস্থতা সৃষ্টিকারী নন মাহারাম একজন ব্যাক্তিকে উকিল বাপ বানানোর একটি প্রথা পরিলক্ষিত হয়। এই উকিল বাবাকে নিজের বাবার মতো মনে করা হয়। তিনি নিজে গিয়ে পাত্রী দেখে আসেন এবং তার কাছ থেকে বিয়ের অনুমতি এনে বিয়ের মজলিসে কনের পক্ষ হয়ে ওকালতি করেন। পরবর্তীতে তিনি কনের আপন বাবার মর্যাদায় ভূষিত হয়ে তার মাহরামদের অর্ন্তভূক্ত মনে করা হয়। বিভিন্ন উপলক্ষে তিনি কনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন হাদিয়া-তোহফা পেয়ে থাকেন। এবং তিনি নিজেও বিভিন্ন উপলক্ষে ওই মেয়ের খোঁজ খবর নেন এবং মোটা অঙ্কের অর্থ প্রদান করেন। মেয়ের স্বামীকে হাদিয়া তোহফা দেন। তাদের সন্তানাদি হলে খোজখবর নিয়ে উপহার আদান প্রদান করেন।সর্বোপরি, তাদের সাথে এমন এক সম্পর্ক সৃষ্টি হয় যার মধ্যে উকিল হয়ে থাকে বাবার মত। আর উকিলের স্ত্রী হয়ে থাকে মায়ের মত। আর উকিল এর সন্তানাদি হয়ে থাকে ওই মেয়ের ভাই বোন। আর এই জন্যই এই মেয়ে এবং তার আত্মীয় স্বজনদের সাথে উকিল এবং তার আত্মীয়-স্বজনের সম্পর্ক হয় যেন রক্তের সম্পর্কের মত। ফলে তাদের মধ্যে থাকে না কোন পর্দার বিধি- বিধান। থাকে না কোন ইসলামের বিধিনিষেধ মানার প্রতি লক্ষ্য। অথচ এই উকিল বাপের সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি একটি কুপ্রথা। এ কুপ্রথা থেকে বেঁচে থাকা জরুরি। জেনে রাখা ভালো, উকিল বাপ বানানোর দ্বারা কোনো গাইরে মাহরাম পুরুষ উক্ত নারীর পিতা বা মাহরাম পুরুষে রূপান্তরিত হয় না। ননমাহরাম যে ব্যাক্তি মেয়ের উকীল বাপ সেজেছে তাকে শরয়ী কোন বাঁধা না থাকলে বিয়ে করাতে কোন সমস্যা নেই। সুতরাং তিনি সর্বদা গাইরে মাহরাম তার সাথে পর্দা করা ফরজ।( সূরা আহযাব; ৩৩/৫৯, সূরা নূর; ২৪/৩১-৩২)। শরীয়াতের নিয়ম হলো, উকিল অর্থাৎ প্রতিনিধি হবে মেয়ের বাপ নিজেই বা অভিভাবকদের মধ্যে থেকে কোন মাহরাম ব্যক্তি যার সাথে দেখা দেওয়া জায়েজ আছে। ইসলামী বিয়েতে মেয়ের আইনগত অভিভাবকের অনুমতি অবশ্যই প্রয়োজন। যেসব মেয়ের বাবা বর্তমান আছেন তাদের বাবাই প্রতিনিধি,আরবীতে যাকে উকিল বলে। বাবার অবর্তমানে যিনি মেয়ের আইনগত অভিভাবক তিনি হলেন মেয়ের দাদা, চাচা, ভাই, মামা, ইত্যাদি যিনি মেয়ের উকিলের দায়িত্ব পালন করবেন। আইনগত অভিভাবক ছাড়া তৃতীয় কোন ব্যক্তিকে উকিল বানানো যাবেনা।
.
উপরোক্ত কার্যাবলি সম্পাদনের পর বিবাহ পড়ানোর পূর্বে প্রথমে সহীহ হাদীসসম্মত খুৎবা পাঠ করবেন এটাই সুন্নাত। (ইবনে কুদামা আল-মুগনী; ৭/৬২)। কোন বিয়েতে খুৎবা পূর্বে পাঠ করা না হলে ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল (রহঃ) সে বিবাহ অনুষ্ঠান ত্যাগ করতেন। (আবুন নাজা, আল-ইক্বনা‘ ৩/১৬২; বাহূতী, কাশশাফুল কেনা‘ ৫/২১)। খুতবায় উল্লেখিত আয়াত-আদির অনুবাদ পাত্রকে বুঝিয়ে দেওয়া উত্তম। প্রকাশ যে, এ খুৎবা আক্দের জন্য জরুরী বা বাধ্যতামূলক নয়, বরং সুন্নত এবং উত্তম। বিবাহের খুৎবা চাইলে বর নিজেই পড়তে পারে,অথবা কোন আলেম। বিবাহের খুৎবা বসে দিবেন। ইবনু হাবীব বলেন; তারা উত্তম মনে করতেন যে, বর প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা ও রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি দরূদ পাঠ করবে (খুৎবা পাঠ করবে)। অতঃপর কনেকে বিবাহের প্রস্তাব দিবে। (ইবনু বাত্ত্বাল, শারহুল বুখারী; ১৩/২৬০)। ইবনু কুদামা (রহঃ) বলেন, উত্তম হলো ঈজাব-কবুলের পূর্বে বর বা অন্য কেউ খুৎবা পাঠ করবে। এরপর বিবাহ সংঘটিত হবে (আল-মুগনী; ৭/৬২)। বিয়ের খুৎবা নিম্নরূপ: إِنَّ الْحَمْدَ لِلهِ نَحْمَدُهُ وَنَسْتَعِيْنُهُ وَنَسْتَغْفِرُهُ وَنَعُوْذُ بِاللهِ مِنْ شُرُوْرِ أَنْفُسِنَا وَمِنْ سَيِّآتِ أَعْمَالِنَا مَنْ يَهْدِهِ اللهُ فَلاَ مُضِلَّ لَهُ وَمَنْ يُضْلِلْ فَلاَ هَادِىَ لَهُ وَأَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا اتَّقُوْا اللهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلاَ تَمُوْتُنَّ إِلاَّ وَأَنْتُمْ مُسْلِمُوْنَ. يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوْا رَبَّكُمُ الَّذِىْ خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالاً كَثِيْراً وَنِسَاءً وَاتَّقُوْا اللهَ الَّذِىْ تَسَاءَلُوْنَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيْباً. يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا اتَّقُوْا اللهَ وَقُوْلُوْا قَوْلاً سَدِيْدًا يُصْلِحْ لَكُمْ أَعْمَالَكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوْبَكُمْ وَمَنْ يُطِعْ اللهَ وَرَسُوْلَهُ فَقَدْ فَازَ فَوْزًا عَظِيْمًا

অনুবাদ: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। আমরা তাঁর প্রশংসা করি, তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করি, তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি। আমরা আমাদের প্রবৃত্তির অনিষ্ট ও আমাদের কাজের নিকৃষ্টতা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই। আল্লাহ যাকে সৎপথে পরিচালিত করেন তাকে কেউ পথভ্রষ্ট করতে পারে না এবং যাকে পথভ্রষ্ট করেন তার কোন পথপ্রদর্শক নাই। আমি সাক্ষ্য দেই যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাই, তিনি এক এবং তার কোন শরীক নাই। আমি আরো সাক্ষ্য দেই যে, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার বান্দা ও রাসূল।” এরপর তোমরা তোমাদের খুতবার সাথে কুরআনের এ তিনটি আয়াত যোগ করবেঃ“হে ঈমানদারগণ। আল্লাহকে যেরূপ ভয় করা উচিত তোমরা তাকে তদ্রুপ ভয় করো এবং মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।” (সূরা আল ইমরান; ১০২)। হে ইমানদারগন! তোমরা তোমাদের রবের তাকওয়া অবলম্বন কর যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন ও তার থেকে তার স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের দুজন থেকে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দেন; আর তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর যাঁর নামে তোমরা একে অপরের কাছে নিজ নিজ হক্‌ দাবী কর এবং তাকওয়া অবলম্বন কর রক্ত-সম্পর্কিত আত্মীয়ের ব্যাপারেও। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর পর্যবেক্ষক” (সূরা নিসা; ০১)।“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলো। তিনি তোমাদের কার্যাবলি সংশোধন করে দিবেন এবং তোমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করবেন। যে কেউ আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করে সে অবশ্যই মহাসাফল্য অর্জন করবে।”(সূরা আহ্‌যাবঃ ৭০-৭১)। (তিরমিযী ১১০৫, ১৪০৪, আবু দাউদ ২১১৮, আহমাদ ৪১০৪, দারেমী ২২০২, মিশকাত ৩১৪৯, সহিহাহ ১৪৮৩, খুতবাতুল হাজাহ ১৯-২৯, আল-কালিমুত তাইয়্যিব ২০৫,সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ১৮৯২)
.
খুৎবা পড়ার পর মেয়ের পিতা বা অভিভাবক বা তাদের উপস্থিতিতে অন্য কেউ বরের সামনে দুজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে বলবেন, আমার মেয়ে ওমুক (নাম স্পষ্ট করে) এতো নগদ ও এতো বাকী মোহরের বিনিময়ে তোমার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে রাযী তুমি তাকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করো। তখন সে (বর) মেয়ের ওলী ও দুজন সাক্ষীকে শুনিয়ে বলবে, ‘ক্বাবিলতু’ (আমি গ্রহণ করলাম)। বা আমি এই বিবাহ কবুল করছি।’ এরূপ তিনবার বলা ভালো। কারণ রাসূল (ﷺ) গুরুত্বপূর্ণ কথা তিনবার বলতেন। (সহীহ বুখারী, মিশকাত, হা/৩০৮)। এরপর সকলে বরের উদ্দেশ্যে একাকী এই দুআ করবে, আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন; রাসূল (ﷺ) কোনো ব্যক্তির বিবাহ সম্পাদন কালে বলতেন, بَارَكَ اللهُ لَكَ وَبَارَكَ عَلَيْكَ وَجَمَعَ بَيَنَكُمَا فِىْ خَيْرٍ، উচ্চারণ : বা-রাকাল্লুহ লাকা ওয়া বা-রাকা আলাইকুমা ওয়া জামাআ বায়নাকুমা ফী খয়রিন। অর্থ: ‘আল্লাহ তোমাকে বরকত দান করুন ও তোমাদের উভয়কে বরকত দান করুন। তিনি তোমাদের উভয়ের মাঝে দাম্পত্য মিলন কল্যাণমণ্ডিত করুন।’ (মুসনাদে আহমাদ, হা/৮৯৫৭; তিরমিযী, হা/১০৯১)। তারপর খেজুর দিয়ে সবাই মিষ্টিমুখ করবে। এইখানেই বিবাহের আসল কার্যক্রম শেষ। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
_______________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।