পৃথিবীর সকল নারীদেরকে কি তাদের স্বামীর পাঁজরের উপরের বাঁকা হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে

পৃথিবীর সকল নারীদেরকে তাদের স্বামীর পাঁজরের বাঁকা হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে এই বক্তব্য সঠিক নয়। কেননা কুরআন-সুন্নাহয় এই মর্মে কোন দলিল পাওয়া যায় না। তাছাড়া এটি বিবেক বিরোধী কথা। কেননা যদি সকল নারীকে তাদের স্বামীর হাড় থেকে সৃষ্টি করা হতো তাহলে যাদের একাধিক বিয়ে হয়েছে অর্থাৎ একবার বিধবা হওয়া বা তালাক প্রাপ্তির পর আবার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন,আবার যারা চিরকুমারী থাকে বা যাদের চেষ্টার পরেও বিবাহ হচ্ছেনা তাদের ক্ষেত্রে এই কথার ব্যাখ্যা কী হবে? মূলত হাদীসটি বুঝার ভুলের কারণেই এমনটি বলা হয়ে থাকে। বরং কুরআন-সুন্নাহ ও সালফে-সালেহীনের বক্তব্য থেকে বুঝা যায় যে,সকল মানুষের উৎস হচ্ছে,আমাদের পিতা আদম (আ.) এবং তাঁকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে। তারপর তাঁর থেকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর স্ত্রী হাওয়া (আ.) কে। তারপর তাঁদের থেকে সৃষ্টি করেছেন গোটা মানবজাতিকে। এর দলিল হলো,মহান আল্লাহ তাআলা বলেন,হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার সঙ্গীনীকে সৃষ্টি করেছেন; আর বিস্তার করেছেন তাদের দু’জন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী। (সূরা নিসা,৪/১)। উক্ত আয়াতের তাফসীরে ইমাম ইবনে কাসীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, এক ব্যক্তি থেকে তিনি হলেন আদম (আ.) তার থেকে তার সঙ্গীনীকে সৃষ্টি করেছেন তিনি হলেন হাওয়া আ.। যাকে সৃষ্টি করা হয়েছে তার পরে তার বাম পাঁজরের হাড় থেকে। তখন তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন। জাগ্রত হয়ে যখন তাকে দেখলেন, তখন বিস্মিত হলেন এবং তার প্রতি প্রীত হলেন। তিনিও আদম আ. এর প্রতি প্রীত হলেন। ইবনে হাতিম তার পিতা থেকে, তিনি মুহাম্মাদ ইবন মুকাতিল থেকে, তিনি অয়াকী থেকে, তিনি আবু হিলাল থেকে, তিনি কাতাদাহ থেকে, তিনি ইবন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণনা করেন, (প্রথম) নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছে পুরুষ থেকে।(তাফসির ইবন কাসীর ২/২০৬)
.
এবার এ প্রসঙ্গে বর্ণীত হাদীসটি দেখি, আবু হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আর তোমরা নারীদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে। কেননা, তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে পাঁজরের হাড় থেকে এবং সবচেয়ে বাঁকা হচ্ছে পাঁজরের ওপরের হাড়। যদি তুমি তা সোজা করতে যাও, তাহলে ভেঙ্গে যাবে। আর যদি তুমি তা যেভাবে আছে সেভাবে রেখে দাও তাহলে বাঁকাই থাকবে। অতএব, তোমাদেরকে ওয়াসিয়ত করা হলো নারীদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করার। (বুখারী পর্ব ৬৭ : /৮০, হাঃ ৫১৮৬; মুসলিম ১৭/১৮, হাঃ ১৪৬৮ আল লু’লু ওয়াল মারজান, ৯৩৪)। শব্দ বিন্যাস বুখারী আর মুসলিম এ আছে আর যদি তোমরা তাদের থেকে ফায়দা উঠাতে চাও তাহলে বাকা থাকা অবস্থায়ই তাদের থেকে উপভোগ নিতে থাকবে। আর যদি সোজা করতে চাও তাহলে তা ভেঙ্গে ফেলবে। আর ভেঙ্গে ফেলার অর্থ তালাক দেয়া।(সহীহ বুখারী ৩৩৩১, ৫১৮৪, ৫১৮৫, ৬০১৮, ৬১৩৮, ৬৪৭৫; মুসলিম ৪৭, ১৪৬৮; তিরমিযী ১১৮৮; আহমাদ ৭৫৭১, ৯২৪০; দারেমী ২২২২)
.
অপর বর্ননায় আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,“নারী হল, পাঁজরের হাড়ের ন্যায়। যদি তোমরা তাকে সোজা করতে যাও তাহলে তাকে ভেঙ্গে ফেলবে। সুতরাং যদি তাদের থেকে লাভবান হতে চাও তাহলে ঐ বাঁকা অবস্থাতেই লাভবান হবে।” [সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) ৫৪/ বিয়ে-শাদি, পরিচ্ছেদ: ২৫০৪।
.
উপরোক্ত হাদীসের আলোকে আহালুল আলেমগন থেকে দুই ধরনের মতামত পাওয়া যায়।আহালুল আলেমগন একটি মতে আদম আলাইহিস সালাম এর জীবন সঙ্গিনী আম্মাজান হাওয়া আ. কে শুধুমাত্র আদম আ. এর বাম পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। অন্যকাউকে নয়। ইবনে হাজার রাহিমাহুল্লাহসহ বড় অংশের এই মত (উমদাতুল কারি-বদরুদ্দিন হানাফি রাহ.) অপরদিকে আরেকদল আলেম বলেন পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টির ব্যাপারটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রূপক অর্থ ও উপমা অর্থে বলেছেন। অর্থাৎ নারীদের আচার-আচরণ ও স্বভাব চরিত্রে কিছুটা বক্রতা রয়েছে বিধায় তার উদাহরণ হিসেবে এমনটি বলা হয়েছে। (শরহে মিশকাত ৩/৪৬০)

▪️হাদীসটির ব্যাখ্যায় ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, এ হাদীসে নারীদের প্রতি সহানুভূতি এবং ইহসানের জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে, আর সৃষ্টিগত বক্র স্বভাবের ও অপূর্ণ জ্ঞানের কারণে ধৈর্যধারণের উপদেশ প্রদান করা হয়েছে। আনুগত্যে দৃঢ় না থাকায় অথবা কারণ ছাড়াই তাদের তালাক দেয়াও অপছন্দনীয় কাজ, অতএব তা থেকে বিরত থাকবে। (ফাতহুল বারী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ৩৩৩১; শারহে মুসলিম ৯/১০ খন্ড, হাঃ ১৪৬৮; মিরকাতুল মাফাতীহ)
.
ইমাম ইবনে হাজার (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে ইবন ইসহাক আরো বর্ণনা করেছেন, বাম পাঁজরের হাড় থেকে, জান্নাতে যাওয়ার আগে এবং সেখানে গোশত দ্বারা ভরে দেয়া হয়েছে।(ফাতহুল বারী ৬/৩৬৮)
.
ইবনুল আরাবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, বর্ণিত আছে, আদম (আ.) ঘুমিয়ে ছিলেন। তখন তার বাম পাঁজরের একটি হাড় খুলে নেয়া হলো। তারপর তা দ্বারা হাওয়া (আ.) কে সৃষ্টি করা হয়েছে। যখন তার হুঁশ আসল তখন তাকে তার একপাশে পেলেন। তাকে দেখে তিনি বিব্রত না হয়ে প্রীত হয়েছিলেন। কেননা, তিনি তো তাঁরই অংশ। এজন্য ডান পাঁজরের তুলনায় বাম পাঁজরে একটি হাড় কম আছে। (আ’রিযাতুল আহওয়াযী ৬/৩৬৮)
.
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৫১ হি.] বলেছেন, মহান আল্লাহ তাআলার অন্যতম বিস্ময়কর নেয়ামত এই যে, তিনি পিতা মাতা ছাড়া সৃষ্টি করেছেন মানবকুলের পিতাকে, নারী ছাড়া শুধু পুরুষের পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করেছেন মানবকুলের মাতাকে, পুরুষ ছাড়া শুধু নারী থেকে সৃষ্টি করেছেন ঈসা ইবন মারইয়াম (আঃ) কে। আর পুরুষ ও নারী থেকে সৃষ্টি করেছেন গোটা মানবজাতিকে। যেন বান্দা এর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার নিদর্শনগুলি দেখে এবং তাঁর নেয়ামত ও ক্ষমতার দ্বারা চিনতে পারে এবং যদি তিনি কিছু চান,আর তিনি তো ‘হয়ে যাও’ বললেও হয়ে যায়।(মিফতাহু দারিস সাআ’দাহ ১/২৪২, ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতওয়া নং-১৮৩০৩৯)
.
উল্লেখ যে, অনেক ইসলাম বিরোধী এক্টিভিস্ট অপব্যাখ্যা করে বলতে চায় যে, হাদিসে বলা হয়েছে সব নারীকেই তাদের স্বামীর পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে; এবং এই কথা বলে তারা নবী (ﷺ) এর বহুবিবাহ, পাঁজরের হাড়সংখ্যা ও স্ত্রীদের নিয়ে অসার কথা বলে। আবার কেউ কেউ অবিবাহিত নারী, তালাকপ্রাপ্ত নারী, একাধিক পুরুষের সাথে বিবাহ হওয়া নারীর উদাহরণ দেখিয়ে হাদিসকে ভুল বলতে চায়। কিন্তু তাদের এইসব অভিযোগের মূলেই আছে অসত্য ও অপব্যাখ্যা। আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন। (আল্লাই সবচেয়ে ভাল জানেন)।
_______________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।