আহলে কুরআন বা হাদীহ অস্বীকারকারীদের কিছু বিভ্রান্তিমূলক সংশয় ও তার নিরসন

আহলে কুরআন বা হাদীস বিরোধীদের বিভ্রান্তিকর হাতিয়ারের নাম হল, অনৈতিক যুক্তি। তারা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত সাধারণ মানুষকে আদর্শচ্যুত করার জন্য তাদের সামনে কিছু উদ্ভট প্রশ্ন ও নীতিহীন যুক্তি পেশ করে থাকে। নিম্নে তাদের কিছু বিভ্রান্তিমূলক তিনটি সংশয় ও তার মোক্ষম জবাব উপস্থাপন করা হল:

▪️প্রথম সংশয়: তারা বলে, আমাদের জন্য আল্লাহ তা‘আলার কিতাব-ই যথেষ্ট। কেননা কুরআনের মধ্যেই সবকিছু বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। কুরআনকে বুঝার জন্য অথবা শরী‘আতের কোন বিধান প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সুন্নাত বা হাদীসের প্রয়োজন নেই।(মাজাল্লাহ্, ইশা‘আতুল কুরআন, পৃ. ৪৯, ৩য় সংখ্যা, ১৯০২ খ্রি. ইশা‘আতুস সুন্নাহ, ১৯তম খ-, পৃ. ২৮৬, ১৯০২)।

▪️তাদের সংশয় নিরসন: এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আল-কুরআনে মূলত শরী‘আতের মূল নীতিমালা বর্ণনা করা হয়েছে এবং কিছু ঐতিহাসিক ঘটনাও বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু নীতিমালা বা বিধি-বিধানের নিয়মনীতি, পদ্ধতি, বৈশিষ্ট্য, আকার-আকৃতি, ধরণ ও প্রকৃতি সম্পর্কে কোন আলোচনা করা হয়নি। যদি তাই হয় তাহলে পাঁচ ওয়াক্ত ফরয সালাতের রাক‘আত সংখ্যা, উট, গরু, ছাগল, স্বর্ণ ও রৌপ্যের যাকাতের নিসাব বা পরিমাণ, সিয়ামের বিধি-বিধান, হজ্জের নিয়ম-কানুন ইত্যাদি কোথায় বলা হয়েছে? যদি রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাত না থাকত, তাহলে আমরা এগুলো কোথায় থেকে জানতে পারতাম। সেই জন্যই ইমাম শাফিঈ (রাহিমাহুল্লাহ) ও ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাত-ই হল, আল্লাহ তা‘আলার কিতাবের ব্যাখ্যাকারী।'(রিসালাতুশ শাফিঈ, ১ম খ-, পৃ. ৭৯; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৯৩১১১)।

আল্লামা বাদরুদ্দীন আল-যারকাশী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ইমাম শাফিঈ (রাহিমাহুল্লাহ) স্বীয় রিসালাতের ‘রাসূল (ﷺ)-এর আনুগত্য করা অপরিহার্য’ নামক অনুচ্ছেদে বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, مَنۡ یُّطِعِ الرَّسُوۡلَ فَقَدۡ اَطَاعَ اللّٰہَ ‘যে রাসূলের আনুগত্য করল, সে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহরই আনুগত্য করল।’ (সূরা আন-নিসা: ৮০)। এমন প্রত্যেকটি বিষয় যা আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় কিতাবে ফরয করেছেন যেমন: সালাত, যাকাত, সিয়াম, হজ্জ ইত্যাদি। যদি রাসূল (ﷺ) এগুলোর নিয়মনীতি, পদ্ধতি, বৈশিষ্ট্য, আকার-আকৃতি, ধরন ও প্রকৃতি সম্পর্কে অবহিত না করতেন, তাহলে আমরা সেগুলো কিভাবে আদায় বা পালন করতাম? তাঁর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ব্যতীত আমাদের পক্ষে কোন ইবাদতই করা সম্ভবপর হত না।’(আল-বাহরুল মুহীত্ব, ৬ষ্ঠ খ-, পৃ. ৭-৮)।

‘ইসলাম ওয়েব’-এর আলিমগণ বলেন, ‘অসংখ্য আয়াত প্রমাণ করে যে- রাসূল (ﷺ) ছিলেন কুরআনুল কারীমের উত্তম ব্যাখ্যাকারী। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন- আর আপনার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি মানুষকে তা স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেন, যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং যাতে তারা চিন্তা-গবেষণা করে।’(সূরা আন-নাহল: ৪৪)। অন্যত্র তিনি বলেন, আমি তো আপনার প্রতি কিতাব এ জন্যই অবতীর্ণ করেছি, যাতে তারা যে বিষয়ে মতভেদ করে, তাদেরকে আপনি তা সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিতে পারেন এবং বিশ্বাসীদের জন্য পথ নির্দেশ ও দয়া স্বরূপ।’(সূরা আন-নাহল: ৬৪)। তিনি আরো বলেন, ‘আর রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা হতে তোমাদেরকে নিষেধ করেন, তা হতে বিরত থাক। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তি দানে কঠোর।’(সূরা আল-হাশর: ৭)।

▪️অতঃপর রাসূল (ﷺ)-এর কর্মসূচক হাদীস এবং সাহাবীদের আমল ও স্বীকারোক্তি থেকে তা আরো পরিস্ফুটিত হয়। কুরআনে এমন শতশত আয়াত আছে, যার বিশুদ্ধ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাত ছাড়া সম্ভব নয়। উদাহরণ স্বরূপ পাঠকদের জন্য এখানে কিছু আয়াত উপস্থাপন করা হলো:
_______________________________________

(১). আল্লামা মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, وَالسَّارِقُ وَالسَّارِقَةُ فَاقْطَعُوا أَيْدِيَهُمَا “পুরুষ চোর ও নারী চোর, তাদের উভয়ের হাত কেটে দাও।”(সূরা আল-মায়িদাহ: ৩৮)। এখানে সাধারণভাবে চুরি করলেই চোরের হাত কাটার কথা বলা হয়েছে। জাহিরিয়্যাহ্ মাযহাবের ফকীহবিদদের মতানুযায়ী চুরির এই বিধান সকল প্রকার চুরির জন্য ব্যাপক, চুরির পরিমাণ অল্প হোক অথবা বেশি, সুরক্ষিত জায়গা থেকে চুরি করা হোক অথবা অরক্ষিত জায়গা থেকে, সর্বাবস্থাতেই চোরের হাত কাটা যাবে। কিন্তু কুরআনের এই আয়াতে কী পরিমাণ সম্পদ চুরি করলে হাত কাটা যাবে এটা বলা হয়নি। কী পরিমাণ হাত কাটতে হবে, কব্জি থেকে না কনুই থেকে? এটাও বলা হয়নি। তাই এক্ষেত্রে হাদীসের সাহায্য নেওয়া বাধ্যতামূলক। তার আগে হাদীস অস্বীকারকারী ভ্রান্ত ফেরকার লোকেরা এই আয়াতের ব্যাখ্যা কিভাবে করবে? কি পরিমান চুরি করলে এবং চোরের হাত কতটুকু কাটবে প্রশ্ন রইল তাদের কাছে। এবার আসুন উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় রাসূল (ﷺ) কি বলেছেন। হাদীসে এসেছে, কেবল ঐ চোরের হাত কাটা যাবে, যে এক দ্বীনারের চার ভাগের এক ভাগ বা এর বেশি চুরি করবে। প্রিয় নবী রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘এক চতুর্থাংশ স্বর্ণমুদ্রা (দীনার) বা ততোধিক চুরি করলে তবেই হাত কাটা যাবে।’(সহীহ বুখারী, হা/৬৭৮৯, ৬৭৯০, ৬৭৯১; সহীহ মুসলিম, হা/১৬৮৪, নাসাঈ, হা/৪৯৪৩)। অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সাহাবীগণের আমল ও অনুমোদন দ্বারা প্রমাণিত যে, তাঁরা চোরের কব্জি পর্যন্ত হাত কাটতেন, যেমনটি হাদীস গ্রন্থে সুপরিচিত বিষয়।

(২). আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে যুল্ম দ্বারা কলুষিত করেনি, নিরাপত্তা তাদেরই জন্য এবং তারাই হিদায়াতপ্রাপ্ত।’ (সূরা আল-আন‘আম: ৮২)। সাহাবীগণ এই আয়াতের ‘যুলম’ শব্দ দ্বারা সাধারণ ছোট-বড় অত্যাচার করা বুঝেছিলেন। এ আয়াত অবতীর্ণ হলে সাহাবীগণ চমকে উঠেন এবং ভীতিকর অবস্থায় জিজ্ঞাসা করেন, ‘ হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে পাপের মাধ্যমে নিজের উপর যুল্ম করেনি? এ আয়াতে শাস্তির কবল থেকে নিরাপদ হওয়ার জন্য ঈমানের সাথে যুল্মকে মিশ্রিত না করার শর্ত বর্ণিত হয়েছে। এমতাবস্থায় আমাদের মুক্তির উপায় কী? রাসূল (ﷺ) উত্তরে বললেন, তোমরা আয়াতের প্রকৃত অর্থ বুঝতে সক্ষম হওনি। আয়াতে যুল্ম বলতে শিরকক বুঝানো হয়েছে। দেখ, অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, اِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيْمٌ ‘নিশ্চিত শিরক বিরাট যুলম।’(সূরা লুক্বমান: ১৩; সহীহ বুখারী, হা/৩২, ৩৩৬০, ৩৪২৮, ৩৪২৯, ৪৬২৯, ৪৭৭৬, ৬৯১৮, ৬৯৩৭; সহীহ মুসলিম, হা/১২৪; তিরমিযী, হা/৩০৬৭) কাজেই আয়াতের অর্থ এই যে, যে ব্যক্তি ঈমান আনে, অতঃপর আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলী এবং তাঁর ইবাদাতে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করে না, সে শাস্তির কবল থেকে নিরাপদ ও সুপথপ্রাপ্ত।

(৩). তায়াম্মুমের আয়াতে হাত মাসাহ করার কথা বলা হয়েছে, فَامْسَحُوا بِوُجُوهِكُمْ وَأَيْدِيكُمْ ‘তোমরা তোমাদের চেহারা ও হাত মাসাহ করো।’(আন-নিসা, ৪/৪৩)। কুরআনের এই আয়াতে হাত ও চেহারা মাসাহ করতে বলা হয়েছে কিন্তু এখানে হাতের কতটুকু অংশ মাসাহ করতে হবে , কব্জি পর্যন্ত না কনুই পর্যন্ত নাকি পুরো হাত? সেটা বলা হয়নি। হাদীস অস্বীকারকারী ভ্রান্ত লোকেরা হাতের কতটুকু অংশ মাসাহ করবে বা এই আয়াতের ব্যাখ্যা কিভাবে করবে? চলুন জেনে নিই, এই আয়াতের ব্যাখ্যা রাসূল (ﷺ) কিভাবে করেছেন, তিনি কতটুকু অংশ মাসাহ করতেন। সুন্নাহতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, এখানে ‘হাত মাসাহ করা’ বলতে হাতের কব্জি পর্যন্ত মাসাহ করা বোঝানো হয়েছে, কনুই পর্যন্ত নয়। আম্মার (ইবনু ইয়াসির) (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, উমার ইবনুল খাত্তাব- এর নিকট এক ব্যক্তি এসে বলল, আমি নাপাক হয়েছি, পানি পেলাম না। আম্মার (রাঃ) উমারকে বললেন, আপনার কি মনে নেই যে, এক সময় আমি ও আপনি উভয়ে (নাপাক) ছিলাম? আপনি (পানি না পাওয়ায়) সালাত আদায় করলেন না, আর আমি মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে সালাত আদায় করলাম। এরপর ব্যাপারটি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -কে বললাম। তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, এটাই তোমার জন্য যথেষ্ট ছিল। এ কথা বলার পর নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর দুই হাত তালু মাটিতে মারলেন এবং দু’হাত (উঠিয়ে) ফুঁ দিলেন। তারপর উভয় হাত দিয়ে নিজের মুখমণ্ডল ও দুই হাত কব্জি পর্যন্ত মাসাহ করলেন। এভাবে ইমাম মুসলিমও বর্ণনা করেছেন, যার শেষে শব্দ গুলি হলো নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ তোমাদের জন্য এটাই যথেস্ট, যে তোমরা হাত মাটিতে মারবে,তারপর হাতে ফুঁ দিবে, অতঃপর মুখমণ্ডল ও হাতের কব্জি পর্যন্ত মাসাহ করবে। (সহীহ বুখারী ৩৩৮, মুসলিম ৩৬৮, আবু দাঊদ ৩২২, নাসায়ী ৩১২, ইবনু মাজাহ্ ৫৬৯, আহমাদ ১৮৩৩২, সহীহ ইবনু হিব্বান ১৩০৬, সহীহ ইবনু খুযাইমাহ্ ২৬৮, মিশকাতুল মাসাবিহ, হা/ ৫২৮)।
সংকলিত।

(৪). তায়াম্মুমের অপর আয়াত আল্লাহ বলেন, فَلَمْ تَجِدُوا مَاءً فَتَيَمَّمُوا صَعِيدًا طَيِّبًا ‘অতঃপর যদি পানি না পাও, তাহ’লে তোমরা পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম কর।’ (সূরা আল-মায়েদাহ: ৫/৬) উক্ত আয়াতে আল্লাহ পরিস্কার করে বলেননি তায়াম্মুম কি শুধু অযুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নাকি অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এমন সংশয়ে সাহাবীরা ও পড়েছিলেন। যখন সূরা মায়েদার উক্ত আয়াত নাযিল হলো তখন সাহাবায়ে কেরাম বুঝতে পারেন নি যে, এটা কেবল ওযুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না ফরয গোসলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ফলে সফর অবস্থায় আম্মার বিন ইয়াসের ও ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) উভয়ের ফরয গোসলের হাজত হলে পানি না পেয়ে ওমর (রাঃ) গোসল করতে না পারায় সালাত আদায় করেন নি। কিন্তু আম্মার স্বীয় ইজতিহাদের ভিত্তিতে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে তায়াম্মুম করেন। ঘটনা জানতে পেরে রাসূল (ﷺ) তায়াম্মুমের নিয়ম শিখিয়ে দিলেন এবং বললেন, তায়াম্মুম হলো ওযূর বিকল্প এবং ওযু ও গোসল উভয় ক্ষেত্রে একই নিয়মে প্রযোজ্য। (বুখারী হা/৩৩৮; মুসলিম হা/৩৬৮; মিশকাত হা/৫২৮)। যদি রাসূল (ﷺ) এখানে তায়াম্মুমের সঠিক অর্থ নির্ধারণ না করে দিতেন, তাহলে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে ভীষণ মতানৈক্যের সৃষ্টি হতো এবং উক্ত বিষয়াদির চূড়ান্ত কোন ফায়সালা কখনোই সম্ভব হতো না।

(৫). আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তোমরা যখন দেশ-বিদেশে সফর করবে, তখন যদি তোমাদের আশংকা হয় যে, কাফিররা তোমাদেরকে বিপদগ্রস্ত করবে, তাহলে সালাত ক্বসর (সংক্ষিপ্ত) করলে তোমাদের কোন দোষ নেই। নিশ্চয় কাফিররা তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’(সূরা আন-নিসা: ১০১)। উপরিউক্ত আয়াত থেকে আপাতদৃষ্টিতে এটাই প্রতিভাত হচ্ছে যে, সফরে ক্বসরের সালাত ভয়-ভীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। সে জন্যই কিছু সাহাবায়ে কিরাম রাসূল (ﷺ)-কে বিস্মৃত হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। যেমন- ইয়ালা ইবনু উমাইয়্যা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহ তা‘আলা যে বলেছেন, ‘যদি তোমাদের আশঙ্কা হয় যে, কাফিররা তোমাদের উপর আক্রমণ করবে, তবে সালাত ক্বসর (সংক্ষিপ্ত) করলে এতে তোমাদের কোন দোষ নেই।’আর মানুষ তো এখন নিরাপদে আছে। (অর্থাৎ তাহলে কি নিরাপদ স্থানে ক্বসর করা যাবে না?)। জবাবে তিনি বলেন, তুমি যে বিষয়ে আশ্চর্যান্বিত হচ্ছো, আমিও সে বিষয়ে আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলাম। তাই আমিও এ বিষয়ে রাসূল (ﷺ)-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘ওটা তো একটি সাদাক্বাহ্ বিশেষ, যা আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের দান করেছেন। কাজেই তোমরা তাঁর সাদাক্বাহ্ গ্রহণ কর।’(সহীহ মুসলিম, হা/৬৮৬; তিরমিযী, হা/৩০৩৪; নাসাঈ, হা/১৪৩৩; আবু দাউদ, হা/১১৯৯; ইবনু মাজাহ, হা/১০৬৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭৫, ২৪৬)।

(৬). জুম‘আর সালাত সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,إِذَا نُودِيَ لِلصَّلاَةِ مِنْ يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ ‘জুম‘আর দিন সালাতের জন্য আযান দেওয়া হলে আল্লাহর যিকরের দিকে দ্রুত ধাবিত হও।’(সূরা জুম‘আ: ৬২/৯)। উক্ত আয়াতে আল্লাহ পরিস্কার করে বলেননি জুম’আর দিন কোন ওয়াক্তের আযানের কথা বলা হয়েছে। হাদীস বাদ দিলে এ আয়াতের অর্থ নির্ধারণে সমস্যা দেখা দিবে। যেমন: (১) এ নির্দেশ জুম‘আর দিনের কোন সালাতের জন্য? (২) যদি সেটা পৃথক সালাত হয়, তবে তা কখন অনুষ্ঠিত হবে? হয়তোবা মুনকিরে হাদীস পন্ডিতরা বলবেন, এক্ষেত্রে হাদীসের প্রয়োজন নেই। কেননা وَذَرُوا الْبَيْعَ এবং وَابْتَغُوا مِنْ فَضْلِ اللهِ আয়াতের এই দুই অংশ একথার প্রমাণ বহন করে যে, জুম‘আর সালাত যোহরের সময় অনুষ্ঠিত হবে। কেননা বেচা-কেনা এবং রিযিক অনুসন্ধান দুপুরের সময়েই হয়ে থাকে। অথচ এই ব্যাখ্যা কতই না দুর্বল। কেননা দুপুরের খরতাপে মূলতঃ বিশ্রামের সময়। আর বেচা-কেনা ও রিযিক অনুসন্ধান মূলত সকালে ও সন্ধ্যায় হয়ে থাকে। যেমন: রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘হে আল্লাহ তুমি আমার উম্মতের জন্য ভোরের কর্মের মধ্যে বরকত দান করো। বর্ণনাকারী বলেন, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন কোথাও ক্ষুদ্র সেনাদল বা বৃহৎ সৈন্যবাহিনী পাঠাতেন তখন তাদেরকে দিনের প্রথমাংশে পাঠাতেন। রাবী ছাখার আল-গামেদী ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। তিনি তার ব্যবসাদলকে দিনের শুরুতেই পাঠিয়ে দিতেন। ফলে তিনি ধনী হন এবং তার সম্পদ বৃদ্ধি পায়। (আবু দাঊদ হা/২৬০৬; মিশকাত হা/৩৯০৮; সহীহুল জামে‘ হা/১৩০০)। অতএব যদি এক্ষেত্রে সুন্নাহ আমাদেরকে নির্দেশনা না দিত, তাহলে আমরা বিভ্রান্তিতে পড়ে যেতাম। এ কারণেই রাসূল (ﷺ) বলেন বিদায় হজ্জে ঘোষণা করে গেছেন, تَرَكْتُ فِيكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ- ‘আমি তোমাদের মাঝে দু’টি বস্ত্ত রেখে যাচ্ছি। যতদিন তোমরা তা মযবুতভাবে আঁকড়ে থাকবে, ততদিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাহ।’(মুওয়াত্ত্বা হা/৩৩৩৮)। আর একারণেই সাহাবায়ে কেরাম কোন মাসআলা সম্পর্কে রায় প্রদান করার পর রাসূলের কোন হাদীস অবগত হলে সঙ্গে সঙ্গে নিজের রায় পরিত্যগ করতেন। [এ ব্যাপারে জানার জন্য আমাদের ডক্টরেট থিসিস-এর ‘মূলনীতি’ অধ্যায়ের ১মূলনীতি (১৩৩-১৫০ পৃ.) পাঠ করুন।]।

(৭). আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত প্রাণী, রক্ত, শূকরের গোশত।’(সূরা আল-মায়িদাহ: ৩)। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মৃত মাছের বিধান কী হবে? কলিজার বিধান কী হবে? খাওয়া যাবে কী-না? রাসূল (ﷺ)-এর বাণীসূচক হাদীসের আলোকে প্রমাণিত হয় যে, প্রাণীর মধ্যে সমস্ত প্রকারের মৃত মাছ ও মৃত টিড্ডি খাওয়া হালাল, আর রক্তের মধ্যে কলিজা বা লিভার ও প্লীহা খাওয়া হালাল। আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘তোমাদের জন্য দু’প্রকারের মৃতজীব ও দু’ধরনের রক্ত হালাল করা হয়েছে। মৃত জীব দু’টি হলো, মাছ ও টিড্ডি, এবং দু’প্রকারের রক্ত হলো, কলিজা ও প্লীহা।’(ইবনু মাজাহ, হা/৩৩১৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/৫৭২৪; সহীহুল জামি, হা/২১০; সিলসিলা সহীহাহ, হা/১১১৮)। এক্ষেত্রে কিন্তু কেউ কোন দ্বিমত পোষণ করে না, এমনকি যারা নিজেকে আহলে কুরআন বলে দাবী করে তারাও না। তারাও নবী (ﷺ)-এর ব্যাখ্যা অনুযায়ী মজা করে মৃত মাছ ও কলিজা ভক্ষণ করছে।

(৮). আল্লাহ তাআলা বলেন, قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِينَةَ اللَّهِ الَّتِي أَخْرَجَ لِعِبَادِهِ وَالطَّيِّبَاتِ مِنَ الرِّزْقِ ‘বলো, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য যেসব সাজসজ্জা এবং পবিত্র জীবিকা সৃষ্টি করেছেন, তা কে হারাম করেছে?’ (আল-আ‘রাফ, ৭, ৩২)। এই আয়াতের বাহ্যিক অর্থ এটাই যে, আল্লাহ বান্দার জন্য সাজসজ্জা হালাল করেছেন, কোন কোন
সাজসজ্জা হালাল করেছেন সেটা বলেন নি। অথচ হাদীসে এসেছে যে, কিছু শোভা-সৌন্দর্য ও সাজসজ্জার বস্তু আছে, যেটা হারাম। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে প্রমাণিত যে, ‘একদা তিনি বের হলেন, তাঁর এক হাতে রেশম আর অন্য হাতে স্বর্ণ ছিল। তিনি বললেন, এ দুটি জিনিস আমার উম্মতের পুরুষদের জন্য হারাম।’(মুসনাদে আহমাদ, হা/৭৫০; আবূ দাঊদ, হা/৪০৫৭; ইবনু মাজাহ, হা/৩৫৯৫) এই হাদীসটি ইমাম হাকেম বর্ণনা করেছেন এবং হাদীসটি সহীহ বলেছেন। এই বিষয়ে সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ও অন্যান্য গ্রন্থে বহু সহীহ হাদীস রয়েছে।

(৯). সাহাবায়ে কেরাম ভাষাবিদ ও অলংকার শাস্ত্রে পন্ডিত হওয়া সত্ত্বেও কোন কোন আয়াতের অর্থ উদ্ধারে ব্যর্থ হয়ে রাসূল (ﷺ)-এর শরণাপন্ন হতেন। যেমন হজ্জ ফরযের আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ ‘আর আল্লাহর উদ্দেশ্যে এ গৃহের হজ্জ করা ঐ ব্যক্তির উপর ফরয করা হলো, যার এখানে আসার সামর্থ্য রয়েছে।’(আলে-ইমরান:, ৩/৯৭)। উক্ত আয়াতে সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের হজ্জ সম্পাদন করতে বলা হয়েছে। কিন্তু কিভাবে হজ্জ করতে হয় কুরআনে কোথাও পরিপূর্ণ ভাবে বলা হয়নি।তাই তো উক্ত আয়াত নাযিল হলে সাহাবী আক্বরা বিন হাবেস (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এটা কি এ বছরের জন্য, না প্রতি বছরের জন্য? জবাবে রাসূল (ﷺ) বললেন, একজন মুমিনের জীবনে মাত্র একবার ফরয।’(আবু দাঊদ হা/১৭২১; আহমাদ হা/২৩০৪; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা আলে-ইমরান: ৯৭ আয়াত)। হজ্জের একটি ফরজ হচ্ছে ৯ই জিলহজ্জ আরাফায় অবস্থান করা। অথচ কুরআনের কোথাও একথা আসেনি কিন্তু রাসূল (ﷺ) এর হাদীসে এসেছে। আবদুর রহমান ইবনু ইয়া‘মুর আদ্ দায়লী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি আরাফাই হচ্ছে হজ্জ। যে ব্যক্তি ‘আরাফায় মুযদালিফার রাতে (৯ যিলহজ্জ শেষ রাতে) ভোর হবার আগে আরাফাতে পৌঁছতে পেরেছে সে হজ্জ পেয়ে গেছে। মিনায় অবস্থানের সময় হলো তিনদিন। যে দুই দিনে তাড়াতাড়ি মিনা হতে ফিরে আসলো তার গুনাহ হলো না। আর যে (তিনদিন পূর্ণ করে) দেরী করবে তারও গুনাহ হলো না। (আবু দাঊদ ১৯৪৭; নাসায়ী ৩০৪৪, ৩০১৬, তিরমিযী ৮৮৯; ইবনু মাজাহ ৩০১৫; আহমাদ ১৮৭৭৪; দারিমী ১৯২৯; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৯৪৬৭; সহীহ ইবনু হিব্বান ৩৮৯২; মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস নং ২৭১৪)। এজন্য নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, তোমরা আমার নিকট হতে হজ্জের হুকুম-আহকাম শিখে নাও। কারণ এ হজ্জের পর আর আমি হজ্জ করতে পারব কিনা তা জানি না। (সহীহ মুসলিম ১২৯৭; আবূ দাঊদ ১৯৭০; আহমাদ ১৪৪১৯; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৯৫৫২; মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস নং ২৬১৮)

(১০). আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘(হে নবী!) আপনি বলুন, আমার প্রতি যে অহী অবতীর্ণ করা হয়েছে, তাতে আহারকারী যা আহার করে, তার মধ্যে আমি কিছুই নিষিদ্ধ পাই না। তবে মৃতপ্রাণী, বহমান রক্ত ও শূকরের গোশত ব্যতীত, কেননা তা অপবিত্র। অথবা যব্হকালে আল্লাহ ছাড়া অন্যের নাম নেয়ার কারণে যা অবৈধ।’(সূরা আল-আন‘আম: ১৪৫)। এই আয়াতে উল্লেখিত চারটি জিনিস ছাড়া অন্য কোন প্রাণী হারাম নয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কুকুরের বিধান কী হবে? সাপের বিধান কী হবে? ইঁদুরের বিধান কী হবে? শকুনের বিধান কী হবে? খাওয়া যাবে কি-না?! হাদীস অস্বীকারকারী ভ্রান্ত ফেরকার লোকদের কাছে কি এগুলো হালাল? তারা কি এগুলো খাবে? প্রশ্ন রইল তাদের কাছে। এবার দেখুন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উম্মাতের সুবিধার্থে উক্ত আয়াতের পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা পেশ করেন। তিনি একটি উছূল বা মূলনীতি বর্ণনা করেছেন। ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূল (ﷺ) খায়বার যুদ্ধের দিন শিকারী দাঁতযুক্ত যে কোন হিংশ্র জন্তু এবং নখযুক্ত যে কোন শিকারী পাখী আহার করতে নিষেধ করেছেন।(সহীহ বুখারী, হা/৫৫২৭, ৫৫৩০; সহীহ মুসলিম, হা/১৯৩২-১৯৩৪; ইবনু মাজাহ, হা/৩২৩৪; নাসাঈ, হা/৪৩৪৮; আবু দাঊদ, হা/৩৮০৩, ৩৮০৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/ ২১৯৩, ২৭৪২, ৩০১৫, ৩০৬০, ৩১৩১, ৩৫৩৪; ইরওয়াউল গালীল, হা/২৪৮৮)।
অন্য আরেকটি হাদীসে এসেছে যে, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তোমাদেরকে গৃহপালিত গাধার গোশত খেতে নিষেধ করেছেন। কারণ তা নাপাক।’(সহীহ বুখারী, হা/৫৫২৮;সহীহ মুসলিম, হা/১৯৪০)। অন্য আরেকটি বর্ণনায় এভাবে এসেছে, ‘জেনে রেখো, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও কিছু বস্তু হারাম করেছেন, যেমন আল্লাহ তাআলা হারাম করেছেন।’(মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭১৯৪; ইবনু মাজাহ, হা/১২)। এছাড়াও আরো বহু উদাহরণ দেওয়া যায়। যেমন:

(১). কুরআনে কেবল সালাতের হুকুম রয়েছে। কিন্তু তার পদ্ধতি বর্ণিত হয়নি। কুরআন বলেছে,أَقِيمُوا الصَّلاَةَ ‘তোমরা সালাত কায়েম কর।’(সূরা বাক্বারাহ: ২/৪৩)। যদি সুন্নাহ থেকে না নেয়া হয়, তাহলে উক্ত হুকুম প্রতিপালনে এক অদ্ভূত রকমের বিশৃংখলা দেখা দেবে। অনুরূপভাবে وَارْكَعُوا مَعَ الرَّاكِعِينَ (এবং তোমরা রুকূকারীদের সাথে রুকূ কর)-এর অর্থ ও উদ্দেশ্য একেবারে অজানা থেকে যাবে যার বিস্তারিত বিবরণ সুন্নাহ বর্ণনা করেছে। যেমন রাসূল (ﷺ) বললেন, صَلُّوْا كَمَا رَأَيْتُمُوْنِىْ أُصَلِّىْ ‘তোমরা সালাত আদায় কর সেভাবে, যেভাবে আমাকে সালাত আদায় করতে দেখছ’…।(বুখারী হা/৬৩১, ৬০০৮, ৭২৪৬; মিশকাত হা/৬৮৩, সালাত অধ্যায়-৪, অনুচ্ছেদ-৬)।

(২). কুরআন কেবল বিবাহ হালাল ও যেনা হারাম বলেছে। কিন্তু বিবাহের পদ্ধতি বলেনি। সুন্নাহ তা বলে দিয়েছে। কুরআনে আছে আম নির্দেশ, হাদীসে সেটাকে খাছ করেছে। যেমন কার সাথে বিবাহ নিষিদ্ধ আলোচনা পেশ করার পর মহান আল্লাহ বলেন, ‘উল্লিখিত নারীগণ ব্যতীত আর সকলকে বিবাহ করা তোমাদের জন্য বৈধ করা হয়; এই শর্তে যে, তোমরা তাদেরকে নিজ সম্পদের বিনিময়ে বিবাহের মাধ্যমে গ্রহণ করবে, অবৈধ যৌন-সম্পর্কের মাধ্যমে নয়।’(সূরা আন-নিসা: ২৪)। অথচ হাদীসে নিষিদ্ধ করা হয়েছে যে, কেউ যেন ফুফু ও তার ভাতিজীকে এবং খালা ও তার বোনঝিকে একত্রে বিবাহ না করে। (সহীহ বুখারী, হা/৫১০৯)। অথচ কুরআনে তা বলা হয়নি।

(৩). কুরআনে কেবল যাকাত ফরয করা হয়েছে। কিন্তু যাকাতের নিসাব, তা আদায়ের সময়কাল এবং কি কি মালের যাকাত দিতে হবে, সবকিছু সুন্নাহ বলে দিয়েছে।

(৪). কুরআনে কেবল সূদ হারামের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সূদ দ্বারা কি বুঝানো হয়েছে এবং উক্ত নিষিদ্ধ করণের ভিত্তিই বা কিসের উপর তা জানা যায়নি। হাদীস এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছে- সমান ওযনে একই প্রকারের জিনিস নগদে বিক্রয় করা যাবে। অতিরিক্ত লেনদেন সূদ হবে।’(সহীহ মুসলিম হা/১৫৮৭; মিশকাত হা/২৮০৮)

হাদীসে সূদ-এর ব্যাখ্যা পাওয়া গেল। কিন্তু সূদ নিষিদ্ধ করণের উদ্দেশ্য ও অন্যান্য বিষয় বিস্তারিত জানা গেল না। সেকারণ ওমর ফারূক (রাঃ) বলেছিলেন, রাসূল (ﷺ) চলে গেলেন। কিন্তু সূদের রহস্য আমাদের নিকটে পুরোপুরি উদ্ঘাটিত হয়নি।'(ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা বাক্বারাহ, ২/২৭৫)

ফলে মুজতাহিদ বিদ্বানগণ স্ব স্ব ইজতিহাদের আলোকে সূদ হারাম হওয়ার কারণ নির্দিষ্ট করেছেন। এক্ষণে যদি এ হাদীসটি না পাওয়া যেত, তাহলে কিসের ভিত্তিতে ইজতিহাদ করা হতো? অতএব সূদের বিষয়ে কুরআন মূল এবং হাদীসকে তার ব্যাখ্যা গণ্য করেই হুকুম বের করতে হবে।

(৫). কুরআনে একই সাথে দুই বোনকে বিবাহ নিষিদ্ধ করেছে। (সূরা আন-নিসা: ৪/২৩)। কারণ তাতে দুই বোনের মধ্যকার রক্তের সম্পর্ক ছিন্ন হওয়া অপরিহার্য হয়ে পড়বে। যা আল্লাহর নিকটে অত্যন্ত অপছন্দনীয় কাজ। আয়াতের উদ্দেশ্য উপলব্ধি করে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) ভাগিনেয়ী ও খালা এবং ভাইঝি ও ফুফুকে একত্রে বিবাহ নিষিদ্ধ করলেন। কেননা সেক্ষেত্রেও রক্ত সম্পর্ক ছিন্ন হওয়া অপরিহার্য হবে।

(৬). কুরআনে হজ্জ ফরয করা হয়েছে। কিন্তু নিয়ম বলা হয়নি। তাই রাসূল (ﷺ) বললেন, خُذُوا عَنِّى مَنَاسِكَكُمْ ‘হে জনগণ! তোমরা আমার নিকট থেকে হজ্জ ও কুরবানীর নিয়ম-কানূন শিখে নাও’..(আহমাদ হা/১৪৪৫৯, মুসলিম হা/১২৯৭ (৩১০); মিশকাত হা/২৬১৮)। উপরের উদাহরণ গুলি থেকে স্পষ্ট হয়েছে যে, কুরআন ও হাদীস উভয়ের সমন্বয়ে মাসআলা সমূহ বের করতে হবে। এমন নয় যে, সুন্নাহর পৃথক শারঈ মর্যাদা রয়েছে এবং কুরআন থেকে সম্পূর্ণরূপে দৃষ্টি সরিয়ে কেবল সুন্নাহ দ্বারা হুকুম বের করা যেতে পারে। একজন মানুষ কখনোই আল্লাহর কালামের অর্থ সম্বোধনকৃত ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ নির্ধারণ করতে সক্ষম হন না। যেমন অসুস্থ বন্ধুকে কুশল জিজ্ঞেস করলে যদি তিনি উত্তেজিত কণ্ঠে বলেন, ‘ভাল আছি’ তবে তার অর্থ হয় ‘ভাল নেই’। এমনিভাবে দৈনন্দিন জীবনে কোন কোন বাক্যের অর্থ ও উদ্দেশ্য যদি সম্বোধনকৃত ব্যক্তির সাহায্য ব্যতিরেকে আমরা বুঝতে না পারি, তাহলে সুন্নাতের সাহায্য ছাড়া আমরা কিভাবে কুরআন অনুধাবনে সক্ষম হব?

হাদীস অস্বীকারকারীদের দ্বিতীয় সংশয়: মুনকিরুল হাদীস বা হাদীস অস্বীকারকারীরা মনে করে যে, হাদীস আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত অহী নয়, বরং এগুলো তো কথা মাত্র যা আল্লাহর নামে মিথ্যা চালানো হচ্ছে (নাউযুবিল্লাহ)। (আল-মুবাহাছাহ, পৃ. ৮১; ইশা‘আতুস সুন্নাহ, ১৯তম খ-, পৃ. ২৯১; মাজাল্লাহ্, ইশা‘আতুল কুরআন, পৃ. ৩৫; চতুর্থ সংখ্যা, ১৯০৩ খ্রি.)

▪️তাদের সংশয় নিরসন: তাদের এ অভিযোগ ও সন্দেহ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। কাফির-মুশরিকরাও এমন অভিযোগ করেছিল, মহান আল্লাহ তা নাকোচ করে দিয়ে বলেন, مَا کَانَ ہٰذَا الۡقُرۡاٰنُ اَنۡ یُّفۡتَرٰی مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ وَ لٰکِنۡ تَصۡدِیۡقَ الَّذِیۡ بَیۡنَ یَدَیۡہِ وَ تَفۡصِیۡلَ الۡکِتٰبِ لَا رَیۡبَ فِیۡہِ مِنۡ رَّبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿۟۳۷﴾ اَمۡ یَقُوۡلُوۡنَ افۡتَرٰىہُ ؕ قُلۡ فَاۡتُوۡا بِسُوۡرَۃٍ مِّثۡلِہٖ وَ ادۡعُوۡا مَنِ اسۡتَطَعۡتُمۡ مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ

আর এ কুরআন আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্য কারো রচনা হওয়া সম্ভব নয়। বরং এর আগে যা নাযিল হয়েছে এটা তার সত্যায়ন এবং আল কিতাবের বিশদ ব্যাখ্যা। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এটা সৃষ্টিকুলের রবের পক্ষ থেকে নাকি তারা বলে, ‘তিনি এটা রচনা করেছেন?’ বলুন, ‘তবে তোমরা এর অনুরূপ একটি সূরা নিয়ে আস এবং আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্য যাকে পার ডাক, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।’ (সূরা ইউনুস: ৩৭-৩৮)। আল্লাহ তা‘আলা রাসূল (ﷺ) এবং সুন্নাতের স্থান স্পষ্ট করে বলেন, وَ لَوۡ تَقَوَّلَ عَلَیۡنَا بَعۡضَ الۡاَقَاوِیۡلِ- لَاَخَذۡنَا مِنۡہُ بِالۡیَمِیۡنِ- ثُمَّ لَقَطَعۡنَا مِنۡہُ الۡوَتِیۡنَ – فَمَا مِنۡکُمۡ مِّنۡ اَحَدٍ عَنۡہُ حٰجِزِیۡنَ ‘যদি তিনি আমার নামে কিছু রচনা করে চালানোর চেষ্টা করতেন। তবে অবশ্যই আমি তাঁকে ডান হাত দ্বারা পাকড়াও করতাম এবং তাঁর জীবন-ধমনী কেটে দিতাম। অতঃপর তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে তাঁকে রক্ষা করতে পারত।’(সূরা আল-হাক্কাহ: ৪৪-৪৭)। উক্ত আয়াত থেকে প্রতিভাত হয় যে, যদি রাসূল (ﷺ) নিজের পক্ষ থেকে কিছু বানিয়ে বলার চেষ্টা করতেন অথবা এতে কম-বেশি করতেন, তাহলে অবশ্যই আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে পাকড়াও করতেন এবং তাঁকে ঢিল দিতেন না। এখান থেকে প্রমাণিত হয় যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) সত্য রাসূল ছিলেন। যেহেতু তাঁকে আল্লাহ শাস্তি প্রদান করেননি তার মানে এই যে, তিনি নিজের পক্ষ থেকে কোন কিছু বানিয়ে বলেননি।
.
যারা মনে করে কুরআন মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর নিজের রচনা। তা আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ নয়। তাদের এ অভিযোগ ও সন্দেহ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। এর কারণগুলো নিম্নরূপ।

(ক). কুরআন যদি মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর নিজের পক্ষ থেকে লিখিত হতো, তবে তা আল্লাহর দিকে সম্পৃক্ত করার কোন যুক্তি নেই। বরং তিনি তা নিজের বলে দাবী করতে পারতেন। তৎকালীন আরবের সমস্ত পণ্ডিত ও ভাষাবিদগণ কুরআনের অনুরূপ অথবা একটি সূরা অথবা একটি আয়াত আনয়ন করতে অক্ষম ও অপারগ হয়ে পড়ে। তখন তিনি কেন এ কুরআন তার নিজের রচনা নয় বলে উল্লেখ করবেন।

(খ). নবী করীম (ﷺ) একবার অন্ধ সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু উম্মে মাখতূম (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর আহ্বানে সাড়া না দিয়ে কুরাইশ নেতাদের দাওয়াত দানে মনোনিবেশ করেন। মহান আল্লাহ তাঁর এ কাজটি পছন্দ করেননি। মহান আল্লাহ তাঁর সমালোচনা করে বলেন, ‘ভ্রু কুঞ্চিত করল এবং মুখ ফিরিয়ে নিল, কারণ তার নিকট অন্ধ লোকটি এসেছিল। আপনি কী জানেন সে হয়ত পরিশুদ্ধ হত, অথবা উপদেশ গ্রহণ করত, ফলে উপদেশ তার উপকারে আসত। পক্ষান্তরে যে পরওয়া করে না, আপনি তার প্রতি মনোযোগ দিচ্ছেন। অথচ সে নিজে পরিশুদ্ধ না হলে আপনার কোন দায়িত্ব নেই, পক্ষান্তরে যে আপনার নিকট ছুটে আসল, আর সে সশংকচিত্ত (ভীত অবস্থায়) আপনি তাকে অবজ্ঞা করলেন! কখনও নয়, এটা তো উপদেশবাণী।’(সূরা আবাসা: ১-১১)।

(গ). মুহাম্মাদ (ﷺ) বদর যুদ্ধের বন্দীদের নিকট থেকে মুক্তিপণ গ্রহণ করে তাদের মুক্ত করে দেন। মহান আল্লাহর নিকট এ কাজটি অপছন্দ ছিল। ফলে তিনি এ কাজের সমালোচনা করেন এবং তাঁকে সতর্ক করেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘কোন নবীর পক্ষে ততক্ষণ পর্যন্ত বন্দী লোক রাখা শোভা পায় না, যতক্ষণ পর্যন্ত ভূ-পৃষ্ঠ (দেশ) হতে শত্রু বাহিনী নির্মূল না হয়, তোমরা দুনিয়ার সম্পদ কামনা করছ, আর আল্লাহ চান পরকালের কল্যাণ, আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। আল্লাহর লিপি পূর্বে লিখিত না হলে তোমরা যা কিছু গ্রহণ করেছ তজ্জন্যে তোমাদের উপর মহাশাস্তি আপতিত হত।’(সূরা আনফাল: ৬৭-৬৮)।

(ঘ). মুনাফিক্বরা উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর প্রতি অপবাদ আরোপ করে। এতে তাঁর মান-মর্যাদা দারুণভাবে ক্ষুন্ন হয়। নবী করীম (ﷺ) দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় একমাস অতিক্রান্ত হয়। পরিশেষে মহান আল্লাহ আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর পবিত্রতায় কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ করেন। (সূরা আন-নূর: ১১)। কুরআন যদি মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর রচনা হতো তবে এ ষড়যন্ত্রকারীদের অপবাদ নস্যাতের উদ্দেশ্যে কুরআন রচনায় কে তাঁকে বাধা প্রদান করেছিল!

(ঙ). তাবূক যুদ্ধের সময় নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট কয়েকজন ব্যক্তি বিভিন্ন ওযর পেশ করে যুদ্ধে গমন থেকে বিরত থাকার অনুমতি প্রার্থনা করে। নবী করীম (ﷺ) তাদের অনুমতি প্রদান করেন। এদের মধ্যে কয়েকজন মুনাফিক্ব ছিল। তাঁর এ ভুল মতামতের কারণে মহান আল্লাহ তাঁকে সাবধান করে কুরআনের আয়াত অবতরণ করে বলেন, ‘আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করলেন, (কিন্তু) আপনি তাদেরকে (এত শীঘ্র) কেন অনুমতি দিয়েছিলেন (যুদ্ধে অনুপস্থিত থাকার) যে পর্যন্ত না সত্যবাদী লোকেরা আপনার কাছে প্রকাশ হয়ে পড়তো এবং আপনি মিথ্যাবাদীদেরকে জেনে নিতেন।’(সূরা আত-তওবাহ: ৪৩)। কুরআন যদি তাঁর স্বরচিত হত তবে নিজের ভুল সিন্ধান্ত অবগত হওয়ার পরও তিনি খোলাখুলিভাবে নিজের এমন কঠোর সমালোচনা করতেন না।
.
পক্ষান্তরে হাদীসের প্রামাণিকতায় আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর তিনি মনগড়া কোন কথা বলেন না। তা তো অহী, যা তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ হয়।’(সূরা আন-নাজম: ৩-৪)। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম কুরতুবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, এ আয়াত প্রমাণ করে যে, কুরআনের মত সুন্নাতও আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত অহী। (তাফসীরে কুরতুবী, ৭ম খ-, পৃ. ২৬৫৫)

সাইয়িদ রশীদ রেযা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘হাদীসে বর্ণিত বিধানগুলোও আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত অহী। অহী শুধু কুরআনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়।’(তাফসীরুল মানার, ৮ম খ-, পৃ. ৩০৮)

দলীল হল আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বর্ণিত হাদীস। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ওযু করার সময় হাতে এক অঞ্জলি পানি নিতেন। অতঃপর ঐ পানি থুতনির নিচে প্রবেশ করাতেন এবং তার দ্বারা নিজের দাড়ি খিলাল করতেন এবং বলতেন, هَكَذَا أَمَرَنِيْ رَبِّيْ عَزَّ وَجَلَّ ‘আমার মহান প্রতিপালক আমাকে এরূপ করারই নির্দেশ দিয়েছেন।’(আবু দাঊদ, হা/১৪৫; বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা, ১ম খ-, পৃ. ৫৪; হাকিম, ১ম খ-, পৃ. ১৪৯; ইরওয়াউল গালীল, ১ম খ-, পৃ. ১৩০)। উপরিউক্ত বর্ণনাটি বর্ণিত হয়েছে হাদীসের মধ্যে, অথচ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, আমাকে আমার প্রতিপালক এমনই করতে বলেছেন। তার মানে বুঝা যাচ্ছে হাদীসও আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত অহী। তবে হ্যাঁ, কুরআন ও সহীহ হাদীসের মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। যেমন:

(ক). আল-কুরআন অহী মাতলু আর হাদীস অহীয়ে গায়রে মাতলু।

(খ). আল-কুরআন মু‘জিযাসমূহের মধ্যে একটি, কিন্তু হাদীস তা নয়।

(গ). আল-কুরআনের শব্দ ও অর্থ দু’টিই আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে জিব্রীল (আলাইহিস সালাম)-এর মাধ্যমে নাযিলকৃত। পক্ষান্তরে হাদীসের অর্থ আল্লাহর কিন্তু শব্দ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর।

(ঘ). আল-কুরআন ইসলামী শরী‘আতের প্রথম উৎস, আর সহীহ হাদীস ইসলামী শরী‘আতের দ্বিতীয় উৎস।

(ঙ). আল-কুরআন সালাতের মধ্যে তেলাওয়াত করা হয়, কিন্তু হাদীসে সালাতে তেলাওয়াত করা হয় না।

(চ). আল-কুরআন তেলাওয়াত করলে প্রতিটি অক্ষরে দশ-দশ সওয়াব পাওয়া যায়, কিন্তু হাদীস পাঠে কোন নির্ধারিত সওয়াব পাওয়া যায় না।

(ছ). আল-কুরআন তেলাওয়াতের জন্য পবিত্রতা একটি প্রাথমিক শর্ত, কিন্তু হাদীস পাঠের জন্য পবিত্রতা শর্ত নয়। (ক্বাওয়াঈদুত তাহদীছ, পৃ. ৬৪; উছূলুল হাদীস, পৃ. ২৯; ইসলাম ওয়েব, ফৎওয়া নং-৬৮৮০৫, ৭২৭৯৮; আল-কুরআনিয়্যীন, ১ম খ-, পৃ. ২১৫-২১৭)

তৃতীয় সংশয়: এই নির্বোধেরা বলে থাকে যে, রাসূল (ﷺ)-এর আদেশ মানা যাবে না, কেননা এটি শিরক। যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, اِنِ الۡحُکۡمُ اِلَّا لِلّٰہِ ‘হুকুম কেবল আল্লাহর কাছেই।’(সূরা আল-আন‘আম: ৫৭)। তাই আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নির্দেশ মান্য করা যাবে না। (আল-মুবাহাছাহ, পৃ. ৪২)

তাদের সংশয় নিরসন: এ কথা ঠিক যে আদেশ কেবল আল্লাহ তা‘আলারই মানতে হবে। কিন্তু সেই আল্লাহ তা‘আলাই তো রাসূল (ﷺ)-এর আদেশ মানার নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেছেন, فَلَا وَ رَبِّکَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ حَتّٰی یُحَکِّمُوۡکَ فِیۡمَا شَجَرَ بَیۡنَہُمۡ ثُمَّ لَا یَجِدُوۡا فِیۡۤ اَنۡفُسِہِمۡ حَرَجًا مِّمَّا قَضَیۡتَ وَ یُسَلِّمُوۡا تَسۡلِیۡمًا ‘কিন্তু না, আপনার প্রতিপালকের শপথ! তারা ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার ভার আপনার উপর অর্পণ না করে, অতঃপর আপনার মীমাংসা সম্পর্কে তাদের অন্তরে কোন দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তকরণে তা মেনে নেয়।’(সূরা আন-নিসা: ৬৫)। উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা নিজের সত্তার শপথ করে বলেন, রাসূল (ﷺ)-এর আদেশ মেনে না নেয়া পর্যন্ত কেউ প্রকৃত ঈমানদার হতে পারবে না। অতএব প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আদেশ মানাটাই হল আল্লাহর আদেশ মানা। (আল-কুরআনিয়্যীন, ১ম খ-, পৃ. ২২০) অন্যত্র তিনি বলেন, ‘যখন মুমিনদেরকে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেয়ার জন্য আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের দিকে আহ্বান করা হয়, তখন তারা তো কেবল এ কথাই বলে, আমরা শ্রবণ করলাম ও মান্য করলাম। আর ওরাই হল সফলকাম।’ (সূরা আন-নূর: ৫১)। তাহলে বুঝা যাচ্ছে যে, ‘আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো বিধান মানা যাবে না।’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে এই বিধানের গন্ডির বাইরে রাখা হয়েছে। বরং এটি রাসূল (ﷺ) ছাড়া অন্যদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আর একারণেই আল্লাহ বলেন, مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ ‘যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করল, সে আল্লাহর আনুগত্য করল।’(সূরা নিসা: ৪/৮০)।
.
এখন যদি কোন হাদীস অস্বীকারকারী ব্যক্তি বলে যে, কুরআনের উপরে আমল করার অর্থই হলো আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ঈমান আনয়নের শামিল। তবে তার জবাবে বলা হবে যে, মুমিনদের উপর অনুগ্রহের কথা বলতে গিয়ে আল্লাহ তা‘আলা পরিষ্কারভাবে বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ তোমাদের নিকট কিতাব ও হিকমত (সুন্নাহ) সহ এসেছেন। لَقَدْ مَنَّ اللهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولاً مِنْ أَنْفُسِهِمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ ‘বিশ্বাসীদের উপর আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন যখন তিনি তাদের নিকট তাদের মধ্য থেকে একজনকে রাসূল হিসাবে প্রেরণ করেছেন। যিনি তাদের নিকট তাঁর আয়াত সমূহ পাঠ করেন ও তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত (কুরআন ও সুন্নাহ) শিক্ষা দেন।’(সূরা আলে- ইমরান: ৩/১৬৪)।

এখানে كتاب-এর উপরে حكمة-এর عطف দ্বারা عطف بيان বুঝানো হয়নি। কেননা অলংকার শাস্ত্রবিদগণ জানেন যে, এটি عطف بيان-এর স্থানই নয়। কারণ এখানে আল্লাহর ইহসান ও তাঁর রাসূলের বিভিন্ন গুণাবলী বর্ণনা করাই মুখ্য উদ্দেশ্য। যদি কিতাব ও হিকমত দ্বারা একই বস্ত্ত বুঝানো হয়, তাহলে রাসূলের গুণাবলীর মধ্যে একটির অভাব পরিলক্ষিত হবে। আর যদি হিকমত দ্বারা আল্লাহর কিতাব ছাড়া অন্য কিছু বুঝানো হয়। তাহলে রাসূলের গুণাবলীর মধ্যে একটির অভাব পরিলক্ষিত হবে। আর যদি হিকমত দ্বারা আল্লাহর কিতাব ছাড়া অন্য কিছু বুঝানো হয়, তবে রাসূল (ﷺ)-এর কথা ও কর্ম ব্যতীত অন্য কি বস্ত্ত হতে পারে? অন্যত্র বলা হয়েছে, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর এবং আনুগত্য কর রাসূলের ও তোমাদের নেতৃবৃন্দের।’(সূরা আন-নিসা: ৪/৫৯)।

অত্র আয়াতে আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের জন্য পৃথক পৃথকভাবে أَطِيعُوا শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু أُولِي الْأَمْرِ-এর জন্য পৃথকভাবে أَطِيعُوا শব্দ ব্যবহৃত হয়নি। বরং তাকে রাসূলের উপরে عطف করা হয়েছে। এর মধ্যে বিশেষ রহস্য নিহিত রয়েছে। এখানে একটি أَطِيعُوا শব্দ ব্যবহার করে রাসূল ও উলিল আমরকে তার উপরে عطف করা যেত। অথবা প্রত্যেকের জন্য পৃথক পৃথক তিনটি أَطِيعُوا ব্যবহার করা যেত। তা না করে আল্লাহ ও রাসূলের জন্য পৃথক দু’টি أَطِيعُوا বলার উদ্দেশ্য হলো দু’টি আইন সমষ্টির দিকে ইঙ্গিত করা। যার একটি আল্লাহর সাথে সরাসরি সম্পর্কিত হয়ে ‘কিতাবুল্লাহ’ এবং অপরটি রাসূলের সাথে সম্পর্কিত হয়ে ‘সুন্নাতে রাসূলিল্লাহ’। আর যেহেতু উলুল আমরের জন্য পৃথক কোন আইন সমষ্টি নেই, বরং তারা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যশীল, সেহেতু তাদের জন্য পৃথকভাবে أَطِيعُوا শব্দ ব্যবহার করা হয়নি। এ থেকে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, আমাদের জন্য গ্রহণযোগ্য দলীল মাত্র দু’টি: কুরআন ও সুন্নাহ।

যদি বলা হয় রাসূলের হুকুম মূলতঃ আল্লাহর হুকুম, তাহলে প্রশ্ন থেকে যায় যে, আল্লাহর সাথে রাসূলের উল্লেখের কারণ কি? দেখুন অন্যত্র কেবল রাসূলের আনুগত্য এবং তার নির্দেশাবলী প্রতিপালনের কঠোর নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলেন, فَلاَ وَرَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لاَ يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا ‘অতএব তোমার পালনকর্তার শপথ! তারা কখনো (পূর্ণ) মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না তারা তাদের বিবাদীয় বিষয়ে তোমাকে ফায়সালা দানকারী হিসাবে মেনে নিবে। অতঃপর তোমার দেওয়া ফায়সালার ব্যাপারে তাদের অন্তরে কোনরূপ দ্বিধা-সংকোচ না রাখবে এবং সর্বান্তঃকরণে তা মেনে নিবে।’(সূরা আন-নিসা ৪/৬৫)। এ আয়াতে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, রাসূলের নির্দেশাবলীর উপর আমল করা ঠিক অনুরূপ অপরিহার্য, যেরূপ কুরআনের উপর আমল করা অপরিহার্য। পার্থক্য কেবল এতটুকু যে, কুরআন অত্যন্ত বিশ্বস্ত সূত্রে আমাদের নিকটে পৌঁছেছে। এদিক থেকে কুরআন চূড়ান্ত দলীল হিসাবে স্বীকৃত। কিন্তু হাদীসের মর্যাদা অনুরূপ নয়। কারণ অনেক কম সংখ্যক হাদীস এমন আছে যা মুতাওয়াতির বলে পরিগণিত। এ পার্থক্য কেবল সবল ও দুর্বল বর্ণনার প্রেক্ষিতে পরিদৃষ্ট হয়। অন্যথায় কোন হাদীছ যদি সহীহ প্রমাণিত হয়, তবে তা অবশ্য পালনীয় হওয়ার ব্যাপারে উক্ত হাদীস ও কুরআনের আয়াতের মধ্যে কোন পার্থক্য হবে না। কেননা হাদীস সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى- إِنْ هُوَ إِلاَّ وَحْيٌ يُوحَى ‘রাসূল কোন মনগড়া কথা বলেন না, যা বলেন তা অহী ব্যতীত নয়।’(সূরা নাজম: ৫৩/৩-৪)। আর একারণেই আল্লাহ বলেন, مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ ‘যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করল, সে আল্লাহর আনুগত্য করল।’(সূরা আন-নিসা: ৪/৮০)।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজে শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছিলেন এবং তিনি কুরআন ও সুন্নাহর মাধ্যমে মানুষকে পরিশুদ্ধ করেন। (সূরা আলে-ইমরান: ৩/১৬৪)। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (ﷺ) আমাদেরকে তাশাহহুদ শিক্ষা দিতেন, যেভাবে তিনি আমাদেরকে কুরআনের একেকটি সূরা শিখাতেন।’(সহীহ মুসলিম হা/৪০৩)। একবার তিনি চারজন সাহাবীর নাম করে বললেন, তোমরা আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ, সালেম, মু‘আয বিন জাবাল ও উবাই বিন কা‘ব-এর নিকট থেকে কুরআন গ্রহণ কর।’(বুখারী হা/৪৯৯৯)। সালেম ছিলেন সাহাবী আবু হুযায়ফার গোলাম। (ঐ, ফাৎহুল বারী)। মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী বনু সুলায়েম গোত্রের রে‘ল ও যাকওয়ান শাখার আমন্ত্রণে তাদেরকে কুরআন ও সুন্নাহ শিখানোর জন্য রাসূল (ﷺ) আনসারদের মধ্য হতে ৭০ জন শ্রেষ্ঠ ক্বারী সাহাবীকে প্রেরণ করেন। যাদেরকে তারা বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে হত্যা করে। (মুসলিম হা/৬৭৭, ১৪৭)। যা বি’রে মা‘ঊনার ঘটনা হিসাবে প্রসিদ্ধ। যাদের বিরুদ্ধে রাসূল (ﷺ) ফজর সালাতে মাসব্যাপী কুনূতে নাযেলাহ পাঠ করেন। (সহীহ বুখারী হা/৪০৮৮)। সাহাবী আবুদ্দারদা (রাঃ) বলেন, তুমি কখনোই আলেম হতে পারবে না, যতক্ষণ না তুমি ছাত্র হবে। আর তুমি কখনোই আলেম হতে পারবে না, যতক্ষণ না তুমি ইলম অনুযায়ী আমল করবে।’(দারেমী হা/২৯৩, সনদ হাসান)।
.
ইবনু আবী হাতেম হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদের একটি উক্তি নকল করেন। তিনি বলেন, এমন কোন বস্ত্ত নেই যার উল্লেখ কুরআনে নেই। কিন্তু আমাদের অনুভূতি তা অনুধাবনে অক্ষম। সেকারণ তা ব্যাখ্যাদানের জন্য আল্লাহ তাঁর রাসূলকে সম্বোধন করে বলেন, وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ ‘আর আমরা তোমার নিকটে নাযিল করেছি কুরআন, যাতে তুমি মানুষকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে দাও যা তাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে।’(সূরা নাহল ১৬/৪৪)।

ইমাম শাফেঈ বলেন, সহীহ সুন্নাহ কখনোই কুরআনের পরিপন্থী নয়। বরং তার পরিপূরক। কেননা কোন ব্যক্তিই রাসূলের ন্যায় কুরআন বুঝতে সক্ষম নয়। ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ)-এর একটি বৃহৎ গ্রন্থ রয়েছে যার নামই হলো موافقه صحيح المنقول لصريح المعقول (‘বিশুদ্ধ হাদীস সর্বদা বিশুদ্ধ জ্ঞানের অনুকূল হওয়া’)। যা বৈরূত ছাপায় (১৯৮৫) দুই খন্ডে ৪৪৬+৪৮৭=৯৩৩ পৃষ্ঠায় সমাপ্ত। মাকহূল বলেন, الْقُرْآنُ أَحْوَجُ إِلَى السُّنَّةِ مِنَ السُّنَّةِ إِلَى الْقُرْآنِ- ‘সুন্নাহর জন্য কুরআনের প্রয়োজনীয়তার চাইতে কুরআনের জন্য সুন্নাহর প্রয়োজনীয়তা অধিক।’ ইয়াহইয়া ইবনে কাছীর বলেন, السُّنَّةُ قَاضِيَةٌ عَلَى الْكِتَابِ، وَلَيْسَ الْكِتَابُ بِقَاضٍ عَلَى السُّنَّةِ- ‘সুন্নাহ কুরআনের উপর ফায়সালাকারী, কিন্তু কুরআন সুন্নাহর উপর ফায়সালাকারী নয়।’ইমাম আহমাদ (রহঃ)-কে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, مَا أَجْسُرُ عَلَى هَذَا أَنْ أَقُولَهُ، وَلَكِنِّي أَقُولُ: إِنَّ السُّنَّةَ تُفَسِّرُ الْكِتَابَ وَتُبَيِّنُهُ- ‘আমি এটা বলতে দুঃসাহস করি না। তবে আমি বলব যে, সুন্নাহ কিতাবকে ব্যাখ্যা করে ও তার মর্মকে স্পষ্ট করে।’(ইমাম কুরতুবী)। ইবনু আব্দিল বার্র বলেন, এর দ্বারা তাঁদের উদ্দেশ্য হল সুন্নাহ আল্লাহর কিতাবের জন্য ব্যাখ্যা স্বরূপ।

ইমাম আওযাঈ (মৃ. ১৫৭ হি.) জ্যেষ্ঠ তাবেঈ হাসসান বিন আত্বিয়াহ (মৃ. ১২০ হি.) থেকে বর্ণনা করেন তিনি বলেছেন, كَانَ الْوَحْيُ يَنْزِلُ عَلَى رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَيَحْضُرُهُ جِبْرِيلُ بِالسُّنَّةِ الَّتِي تُفَسِّرُ ذَلِكَ- ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপরে (কুরআনের) অহি নাযিল হতো এবং তাঁর নিকটে জিব্রীল সুন্নাহ নিয়ে হাযির হতেন, যা সেটিকে ব্যাখ্যা করে দিত।’(তাফসিরে কুরতুবী)। এক্ষণে যারা সুন্নাহ থেকে মুখ ফিরিয়ে ইবাদতের সময় ও পদ্ধতি সমূহ কেবলমাত্র কুরআন থেকে নেওয়ার চেষ্টা করেন, তারা এক হাস্যকর তাবীলের আশ্রয় নিবেন।

উপসংহার: পরিশেষে উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমাদের সম্মুখে ইসলামী আইন প্রণয়নে এবং কুরআনের সঠিক ব্যাখ্যা বুঝার ক্ষেত্রে সুন্নাতের গুরুত্ব ও মর্যাদা সূর্যালোকের ন্যায় পরিস্ফুটিত হয়। যদি আমরা উপরিউক্ত উদাহরণগুলো এবং সেই সাথে সংক্ষিপ্ত করণের উদ্দেশ্যে যেগুলোকে আমরা এখানে উল্লেখ করিনি সেগুলোকেও একটু গভীরভাবে বিবেচনা করি, তাহলেই আমরা নিশ্চিত হয়ে যাব যে, সুন্নাতের সাহায্য ছাড়া কুরআনুল কারীমকে পূর্নাঙ্গরূপে বুঝার এবং তার উপর আমল করার কোন উপায় নেয়।(মানযিলাতুস সুন্নাহ ফিল ইসলাম, পৃ. ৪-১২)। আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদের সকলকে সালফে-সালেহীনের মানহাজ অনুযায়ী কুরআনুল কারীমকে বুঝার ও মানার তাওফীক্ব দান করুন। আমিন! (সংকলিত)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।

_____________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।