নন মাহরাম থেকে সাবধান

আমাদের এমন কিছু আত্মীয় রয়েছে যাদেরকে আমরা ভুলে হয়তবা মাহরাম মনে করে বসি অথচ শরীয়তী দৃষ্টিতে তারা আমাদের মাহরাম নয়। এমনই কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর আজ আমরা জানার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: প্রথমেই মাহরাম এবং নন মাহারাম কি সেটা জানা উচিত, মাহরাম শব্দটি আরবী হারাম শব্দ থেকে এসেছে মাহরাম বলা হয় ঐ সকল পুরুষ অথবা নারীকে যাদেরকে স্থায়ীভাবে বিবাহ করা হারাম। চাই তা নিকটাত্মীয় হওয়ার কারণে হোক অথবা দুগ্ধপান করার কারণে হোক অথবা বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে হোক। এক নজরে মহিলাদের জন্য মাহরামের অন্তর্ভুক্ত পুরুষগণ হল: পিতা, চাচা, মামা, দাদা, নানা, ভাই, ভাতিজা, ভাগিনা, নাতি (ছেলের ছেলে), নাতি (মেয়ের ছেলে), শশুর, যৌন কামনাহীন পুরুষ এবং নারীর গোপনাঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ শিশু (সূরা আন-নূর, ২৪/৩১)। আর পুরুষদের জন্য মাহরামের অন্তর্ভুক্ত মহিলারা হল: মা, মেয়ে, বোন, ফুফু, খালা, ভাতিজী, ভাগ্নি, দুধ মা, দুধ বোন, শাশুড়ী, ছেলের স্ত্রী, সহোদরা দুই বোনকে একত্রে, স্ত্রীর পূর্ব স্বামীর ঔরসজাত মেয়ে (যারা অভিভাবকত্বে রয়েছে) (সূরা আন-নিসা, ৪/২৩)।
.
মাহরাম বাদে সমস্ত বিশ্বে-মহাবিশ্বের যত পুরুষ আছে সব গায়রে মাহরাম! ইসলামী শরীয়তে গায়রে মাহরাম পুরুষ ও নারীর মধ্যে একে অপরকে পর্দা করা ফরজ। গায়রে মাহরাম অর্থাৎ বেগানা নারীর প্রতি দৃষ্টিপাত করা পুরুষের জন্য হারাম। তেমনি গায়রে মাহরাম পুরুষের প্রতি দৃষ্টিপাত করা নারীর জন্য উচিত নয়। তবে অনিচ্ছায় হঠাৎ যে দৃষ্টি পড়ে যায়, সেটার কথা ভিন্ন। ইচ্ছাকৃতভাবে দৃষ্টিকে দীর্ঘায়িত করা হলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে।(সূরা নূর ২৪/৩০-৩১)
.
▪️নারীদের জন্য নন মাহারাম পুরুষদের তালিকা:
_______________________________________
মায়ের খালাতো/চাচাতো/মামাতো/ফুপাতো ভাই। চাচাতো ভাই, দুলাভাই, বাবার খালাতো/চাচাতো/মামাতো/ফুপাতো ভাই, ফুপুর স্বামী (ফুপা), ফুপাতো ভাই,খালাতো ভাই, মামাতো ভাই, ননদের ছেলে ,শ্বশুর/শাশুড়ির ভাই, দেবর/ভাসুর, ননদের স্বামী,স্বামীর খালাতো/চাচাতো/মামাতো/ফুপাতো ভাই, স্বামীর দুলাভাই, ছেলের শ্যালক, ছেলে/মেয়ের শ্বশুর, খালার স্বামী (খালু) ইত্যাদি সবাই নারীর জন্য নন মাহারাম।এদের সামনে পর্দা করা ফরজ (সূরা নূর,২৪/৩০-৩১) এদের সাথে নির্জনবাস বা কোথাও সফর জায়েয নয়।রাসূল ﷺ বলেছেন, যখনই কোন পুরুষ কোন মহিলার সাথে নির্জনতা অবলম্বন করে, তখনই শয়তান তাদের তৃতীয় জন হিসেবে উপস্থিত হয়। (তিরমিযী ৯৩৪ মিশকাতুল মাসাবীহ ৩১১৮)
.
▪️পুরুষদের জন্য নন মাহারাম নারীর তালিকা:
_______________________________________
মায়ের খালাতো/চাচাতো/মামাতো/ফুফাতো বোন চাচাতো বোন, ভাবী ,বাবার খালাতো/চাচাতো/মামাতো/ফুফাতো বোন, চাচী ফুফাতো বোন, খালাতো বোন, মামাতো বোন, শ্যালক/শ্যালিকার মেয়ে শ্বশুর/শাশুড়ির বোন, শ্যালিকা, মামী, স্ত্রীর খালাতো/চাচাতো/মামাতো/ফুফাতো বোন, স্ত্রীর ভাবী, মেয়ের ননদ, ছেলে/মেয়ের শাশুড়ি ইত্যাদি এরা সবাই পুরুষের জন নন মাহারাম এদের সামনে পর্দা করা ফরজ (সূরা নূর,২৪/৩০-৩১)এদের সাথে নির্জনবাস বা কোথাও সফর জায়েয নয়। রাসূল ﷺ বলেছেন, যখনই কোন পুরুষ কোন মহিলার সাথে নির্জনতা অবলম্বন করে, তখনই শয়তান তাদের তৃতীয় জন হিসেবে উপস্থিত হয় (তিরমিযী ৯৩৪ মিশকাতুল মাসাবীহ ৩১১৮) এবার নন মাহারাম নারী পুরুষ সম্পর্কে একনজরে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর জেনে নিব ইনসাআল্লাহ।

◾(১) প্রশ্ন: স্বামীর আপন চাচা বা মামা তথা স্ত্রীর চাচা শ্বশুর বা মামা শ্বশুর কি স্ত্রীর মাহরাম হিসাবে গণ্য হবেন?
_______________________________________
উত্তর: স্বামীর আপন চাচা, মামা, খালু স্ত্রীর জন্য মাহরাম নয়। কারণ কুরআনে যে মাহরামদের কথা বলা হয়েছে এরা তাদের মধ্যে নয় (সূরা নিসা ৪/২৪)। এমন প্রত্যেক নারী বা পুরুষ যাদের সঙ্গে জীবনে কোন এক সময়ে বিবাহ বৈধ হতে পারে তারাই গায়ের মাহরামের অন্তর্ভুক্ত। তাই স্ত্রীকে এদের সামনে পরিপূর্ণ ভাবে পর্দা করতে হবে। শুধুমাত্র স্বামীর পিতা ও দাদা স্ত্রীর জন্য মাহরাম (সূরা নূর ২৪/৩১; বিন বায রহ,ফাতাওয়া নূরুন আলাদ-দারব ২০/২৯৩-৯৪; ইবনে উসাইমীন, ফাতাওয়া নূরুন আলাদ-দারব ১৯/০২)।
.
◾(২) প্রশ্ন: স্ত্রীর আপন খালা, ফুফু কি স্বামীর জন্য মাহরাম?
_______________________________________
উত্তর: স্বামীর জন্য স্ত্রীর আপন ফুফু ও খালারা সাময়িক মাহরাম। তবে তাদের সামনেও পর্দা বজায় রাখতে হবে। কারণ স্ত্রী মারা গেলে বা তালাকপ্রাপ্তা অর্থাৎ স্ত্রীকে তালাক দিলে তখন এই স্ত্রীর আপন খালা ও ফুফুকে পূর্বের স্বামীর জন্য বিবাহ করা জায়েয (সহীহ বুখারী হা/৫১০৯; মিশকাত হা/৩১৬০; ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ১৭/৪৩৬)।

◾(৩) প্রশ্ন: মামী শ্বাশুড়ি বা খালা শ্বাশুড়ি কি মাহরামের অন্তর্ভুক্ত?
_______________________________________
উত্তর: মামী শ্বাশুড়ি বা খালা শ্বাশুড়ি মাহরামের অন্তর্ভুক্ত নয়। তাই এদের সাথে নির্জনবাস বা কোথাও সফর জায়েয নয়। তবে স্ত্রী থাকা অবস্থায় তার মামী, খালা বা তার বোনকে বিবাহ করা যাবে না। এক্ষেত্রে তারা সাময়িক মাহরাম। রাসূল( ﷺ) বলেন, তোমরা কোন স্ত্রীলোককে তার ফুফু বা তার ভাইয়ের মেয়ের সাথে একত্রে বিবাহ করবে না। আর কোন স্ত্রীলোককে তার খালার সাথে অথবা খালাকে তার বোনের সাথে একত্রে বিবাহ করবে না। আর তোমরা বড় (বোন) কে, ছোট (বোনের) উপর এবং ছোট (বোন) কে বড় (বোনের) উপর বিবাহ করবে না (অর্থাৎ দুই বোনকে একত্রে বিবাহ করবে না) (সহীহ বুখারী হা/৫১১০; আবুদাউদ হা/২০৬৫)।

◾(৪) প্রশ্ন: নানীর আপন ভাইয়ের মেয়ে মাহরাম নাকি নন মাহরাম?
_______________________________________
উত্তর: নানীর আপন ভাইয়ের মেয়ে পুরুষের জন্য নন মাহরাম। অর্থাৎ তাদের সাথে বিয়ে জায়েয, পরস্পর দেখা-সাক্ষাৎ করা যাবে না। কারণ যাদের সাথে বিবাহ নাজায়েয বা দেখা করা জায়েয তাদের তালিকায় নানীর ভাই-ই পড়ে না। সুতরাং তার সন্তান অবশ্য গায়রে মাহরাম (সূরা আন-নূর: ৩১; সূরা আন-নিসা:২৩)।

◾(৫) প্রশ্ন: কোন ব্যক্তির জন্য তার আপন চাচি-মামি বা দূর সম্পর্কের চাচি-মামি (আন্টি) কে বিয়ে করা যাবে কি?
_______________________________________
উত্তর: আপন চাচার স্ত্রী (চাচি) এবং মামার স্ত্রী (মামি) আপনার জন্য মাহরাম নয়। অর্থাৎ চাচা/মামা যদি মারা যায় বা তাদেরকে তালাক দেয় তাহলে উক্ত চাচি/মামিকে বিয়ে করা জায়েজ।কারন কারণ কুরআনে যে মাহরামদের কথা বলা হয়েছে এরা তাদের মধ্যে নয় (সূরা নিসা ৪/২৪) সুতরাং এমন প্রত্যেক নারী বা পুরুষ যাদের সঙ্গে জীবনে কোন এক সময়ে বিবাহ বৈধ হতে পারে তারাই গায়ের মাহরামের অন্তর্ভুক্ত।অতএব সর্বাবস্থায় চাচি ও মামির সাথে পর্দা রক্ষা করা ফরজ। এদের সাথে নির্জনবাস বা কোথাও সফর জায়েয নয়।রাসূল ﷺ বলেছেন, যখনই কোন পুরুষ কোন মহিলার সাথে নির্জনতা অবলম্বন করে, তখনই শয়তান তাদের তৃতীয় সাথী (কোটনা) হয়। (তিরমিযী ৯৩৪; মিশকাতুল মাসাবীহ ৩১১৮) আর যেহেতু আপন চাচি মামি মাহরাম নয় সেক্ষেত্রে দূর সম্পর্কের চাচি/মামি তো কোন ভাবেই মাহরাম নয়। (সূরা নিসা ৪/২৩) সুতরাং আপনার আপন চাচি, মামি বা দূর সম্পর্কীয় আন্টিকে যদি তার স্বামী তালাক দেয় অথবা তার স্বামী মারা যায় তাহলে আপনি চাইলে তাকে ইদ্দত পালনের পর ইসলামী শরীয়ত সম্মত উপায় বিয়ে করা জায়েজ।

◾(৬) প্রশ্ন: মায়ের চাচাতো বোন কি আমার জন্য মাহারাম?
_______________________________________
উত্তর: মায়ের চাচাতো বোন মাহরাম নয়। সেজন্য তাকে বিবাহ করায় শরী‘আতে কোন বাধা নেই। আল্লাহ তা‘আলা যে সকল নারীকে মাহরাম হিসাবে বর্ণনা করেছেন তাদের মধ্যে মায়ের চাচাতো বোন নেই (সূরা নিসা ৪/২৩)। এর পরই আল্লাহ বলেন, এদের ব্যতীত তোমাদের জন্য সকল নারী হালাল করা হয়েছে এই শর্তে যে, তোমরা তাদেরকে মালের বিনিময়ে কামনা করবে বিবাহের উদ্দেশ্যে, ব্যভিচারের উদ্দেশ্যে নয় (নিসা ৪/২৪)। শায়খ উসাইমীন (রহঃ) বলেন, পিতা-মাতার চাচাতো বোনেরা ব্যক্তির চাচাতো বোনের ন্যায়। সুতরাং আপন চাচাতো বা মামাতো বোনকে বিবাহে যেমন কোন বাধা নেই, তেমনি পিতা-মাতার চাচাতো বা মামাতো বোনকেও বিবাহে কোন দোষ নেই (মুহাম্মাদ বিন আব্দুল আযীয, ফাতাওয়া ইসলামিয়া ৩/১৩১; আমীন বিন ইয়াহ্ইয়া,
আল-ফাতাওয়াল জামে‘আহ লিল মারা’তিল মুসলিমাহ ২/৫৯৬)।

◾(৭) প্রশ্ন: স্ত্রীর উপস্থিতিতে তার আপন ভাগ্নীকে বিয়ে করা যাবে কি?
_______________________________________
উত্তর: স্ত্রীর উপস্থিতিতে তার ভাগ্নী বা বোনের মেয়েকে বিবাহ করা যাবে না। কারণ রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘কোন নারীকে তার ফুফু বা খালার সাথে বিবাহে একত্রিত করা যাবে না’ (বুখারী হা/৫১৯০; মুসলিম হা/১৪০৮; মিশকাত হা/৩১৬০)। অন্যত্র তিনি বলেন, ভাতিজীর সাথে তার ফুফুকে বিবাহ করা যাবে না। অনুরূপভাবে খালার সাথে ভাগ্নিকে বিবাহ করা যাবে না (সহীহ মুসলিম হা/১৪০৮ (৩৫)। অতএব দুই মাহরামকে একত্রে স্ত্রী হিসাবে রাখা যাবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তোমাদের জন্য হারাম করা হল: তোমাদের দুধ মাতা ও দুধ বোন’ (নিসা ৪/২৩)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘বংশগত কারণে যা হারাম হয়, দুধ পানের সম্পর্কের কারণেও তা হারাম হয়’ (সহীহ বুখারী হা/২৬৪৫; সহীহ মুসলিম হা/১৪৪৫)

◾(৭) প্রশ্ন: বৈমাত্রেয় বোনের নাতনীকে বিবাহ করা যাবে কি?
_______________________________________
উত্তর: প্রথমেই জেনে রাখা ভাল, বৈমাত্রেয় বলতে কি বুঝায় সহজে বলতে গেলে যাদের বাবা একজন কিন্তু মা দুইজন। যথা একজন পুরুষের এক স্ত্রীর ছেলে মেয়ে, এবং আরেক স্ত্রীর ছেলেমেয়ে পরস্পর বৈমাত্রেয় ভাইবোন।তেমনি এক মহিলার প্রথম বিয়ের ছেলেমেয়ে আর দ্বিতীয় বিয়ের পর তার গর্ভ থেকে প্রসব হওয়া ছেলেমেয়ে পরস্পর বৈপিত্রেয় ভাইবোন। যেহেতু বৈমাত্রেয় ভাই বোনের বাবা একজন আর বৈপিত্রেয় ভাইবোনের মা একজন। তাই তাদের মাঝে পরস্পর যেমন বিবাহ জায়েজ নয়। তেমনি বৈমাত্রেয় বোনের নাতনীকে বিবাহ করাও জায়েজ নয় বরং হারাম। কারণ সে মাহরামের অন্তর্ভুক্ত (সূরা নিসা ৪/২৩)। এছাড়া সহোদরা, বৈমাত্রেয় ও বৈপিত্রেয় বোন, তাদের কন্যা এবং এ ধারাগুলি যত নিম্নের হউক না কেন তাদের বিয়ে করা হারাম (তাফসীর ফৎহুল ক্বাদীর ১/৪৪৫; কুরতুবী ৫-৬/৭১; ফৎহুল বারী ৯/১৯২)। অজ্ঞতাবশতঃ এরূপ করে থাকলে উক্ত বিবাহ বিচ্ছেদ হবে। এ ক্ষেত্রে মেয়েটি মোহর পাবে। মহান আল্লাহ সবাইকে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে জীবন পরিচালিত করার তৌফিক দান করুন। আমীন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
_____________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।