দাবা খেলা কেন হারাম

প্রশ্ন: যারা দাবা খেলা হারাম মনে করেন, তাদের কাছে জিজ্ঞাসা; দাবা খেলা কেন হারাম?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: প্রথমত, প্রশ্নকারী ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলতে চাই মুমিনের জন্য মহান আল্লাহর হুকুম এবং তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আদেশ পালন করা ওয়াজিব, যদিও তা তার ইচ্ছা ও পছন্দের বিরুদ্ধে যায়।আল্লাহ তাআলা বলেন: আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন নির্দেশ দিলে কোন মুমিন পুরুষ ও নারীর জন্য নিজদের ব্যাপারে অন্য কিছু এখতিয়ার করার অধিকার থাকে না; আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করল সে স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে। (সূরা আহযাব,৩৩/৩৬) অপর আয়াতে আরো বলেন, মুমিনদেরকে যখন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি এ মর্মে আহবান করা হয় যে, তিনি তাদের মধ্যে বিচার, মীমাংসা করবেন, তাদের কথা তো এই হয় যে, তখন তারা বলে: ‘আমরা শুনলাম ও আনুগত্য করলাম।’ আর তারাই সফলকাম। আর যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহকে ভয় করে এবং তাঁর তাকওয়া অবলম্বন করে, তারাই কৃতকার্য। (সূরা আন-নূর,২৪/ -৫১-৫২) তাছাড়া আল্লাহর প্রতি ঈমানের দাবী হচ্ছে- তাঁর বিধিবিধান ও শরীয়তকে মেনে নেওয়া। কারণ, আল্লাহ তাআলা ভালো জানেন কোনটি মানুষের জন্য কল্যাণকর। তাছাড়া সবার জানা উচিত যে, ইসলামী শরীআতের কোন বিধানের কারণ তালাশ করা অন্যায়। বরং নির্বিবাদে মেনে নেওয়ার মধ্যেই বান্দার কল্যাণ নিহিত রয়েছে, মুমিন তো তারাই যারা বলে আমরা শুনেছি ও মেনে নিয়েছি। (সূরা বাকারা; ২/২৮৫)। সুতরাং প্রত্যেক মুমিনকে এটা বিশ্বাস করতে হবে যে, আল্লাহ তাআলার প্রত্যেকটি কাজে বিরাট হিকমত এবং প্রশংসনীয় উদ্দেশ্য রয়েছে। আর প্রত্যেক মানুষের জন্য তা স্পষ্ট হওয়া জরূরী নয়। এটি এক প্রকার পরীক্ষা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘যাতে তিনি তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে পারেন যে, কে তোমাদের মধ্যে আমলের দিক থেকে উত্তম।’ (সূরা মূলক; ৬৭/২)। কোন কোন শারয়ী হুকুমের রহস্য আমরা বুঝতে পারি। আবার কোন কোন শারয়ী হুকুমের রহস্য আমরা বুঝতে পারি না।
.
দ্বিতীয়ত, স্বাভাবিক ভাবে খেলা-ধুলা মানুষের জন্মগত স্বভাব। এর উদ্দেশ্য সাময়িক শরীর চর্চা। যা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। বয়স ভেদে মানুষের শরীর চর্চার ধরনের পরিবর্তন হয়। খেলাধুলা করা এবং দেখার ক্ষেত্রে ইসলামী বিধান হলো; যে সকল খেলাধুলায় সরাসরি জুয়া নেই, হারাম কোন কর্মকান্ড নেই এবং শারীরিক ব্যায়ামের উদ্দেশ্যে করা হয় সেসকল খেলাধুলা করা যেমন জায়েজ রয়েছে তেমনি শরীয়তের বিধি-বিধান মেনে চাইলে সেগুলো দেখা যেতে পারে। কিন্তু সাময়িক শরীর চর্চার বদলে যদি সে খেলায় সময়ের অপচয় হয়, স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হয়, যদি খেলতে গিয়ে ঐ ব্যক্তি দ্বীন থেকে গাফেল হয়, দায়িত্ব বিস্মৃত হয় বা তাতে জুয়া মিশ্রিত হয়, তখন ঐ খেলা হারামে পরিণত হয়। হাদীসে এসেছে, একদিন দু’জন আনছার সাহাবী তীর নিক্ষেপ প্রতিযোগিতা করছিলেন। হঠাৎ একজন বসে পড়লেন। তখন অপরজন বিস্মিত হয়ে বললেন, কি ব্যাপার। কষ্ট হয়ে গেল নাকি? জবাবে তিনি বললেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি যে, প্রত্যেক বস্ত্ত যা আল্লাহর স্মরণকে ভুলিয়ে দেয়, সেটাই অনর্থক (لَهْو) …(নাসাঈ, সিলসিলা সহীহাহ হা/৩১৫)। এতে বুঝা যায় যে, বৈধ খেলাও যদি আল্লাহর স্মরণকে ভুলিয়ে দেয়, তবে সেটাও জায়েয হবে না। ইমাম বুখারী (রহঃ) অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন, ‘প্রত্যেক খেলা-ধুলা (لَهْو) বাতিল, যদি তা আল্লাহর আনুগত্য থেকে উদাসীন করে দেয়।’ (ফাৎহুল বারী ‘অনুমতি গ্রহণ’ অধ্যায় ৭৯, অনুচ্ছেদ ৫২; ১১/৯৪ পৃঃ)।
.
আমাদের সমাজে প্রচলিত তিনটি খেলার নাম দাবা, লুডু ও ক্যারাম। তিনটিই গুটি দিয়ে খেলা হয়। পাশাপাশি তাশ কেসিনো এবং পাশা এগুলোর পাশারই সমগোত্রীয় খেলা। এসকল খেলাগুলোর উৎপত্তি ভারতীয় উপমহাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ায়। এ জাতীয় খেলাগুলো সম্পূর্ণ হারাম। চাই তা জুয়ার মাধ্যমে খেলা হোক কিংবা জুয়া ছাড়া এমনিই হোক না কেন। সর্বাবস্থায় হারাম। কেননা আহালুল আলেমগন বলেন, পাশা বা দাবার ন্যায় এমন প্রত্যেক খেলা যা গুটি দিয়ে খেলা হয় তা হারাম।’(আল-মুগনী, ১৩তম খণ্ড, পৃ. ১৫৪-১৫৫; আল-ইনছাফ, ১২তম খণ্ড, পৃ. ৫২-৫৩)। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,‘ইমাম আবু হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ) ও ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘দাবা বা পাশা খেলোয়াড়কে সালাম দিবে না। কেননা সে প্রকাশ্যে জঘন্য পাপে লিপ্ত।’ (মাজমূঊল ফাতাওয়া, ৩২ তম খণ্ড, পৃ. ২৪৫)।
.
হাদীসেও কঠোরভাবে এ খেলাগুলো থেকে বিরত থাকার নির্দেশ এসেছে, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, مَنْ لَعِبَ بِالنَّرْدَشِيْرِ فَكَأَنَّمَا صَبَغَ يَدَهُ فِيْ لَحْمِ خِنْزِيْرٍ وَدَمِهِ ‘যে ব্যক্তি পাশা খেলল, সে যেন তার হাত শূকরের গোশতে ও রক্তে রঙিন করে তুলল।’ (সহীহ মুসলিম, হা/২২৬০; আবু দাঊদ, হা/৪৯৩৯; ইবনু মাজাহ, হা/৩৭৬৩)। অপর বর্ণনায় আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যে ব্যক্তি দাবা খেলা খেললো, সে আল্লাহ্ ও আল্লাহ্‌র রাসূলের নাফরমানী করল (অবাধ্য হলো)। (আবু দাঊদ ৪৯৩৮, ইবনু মাজাহ ৩৭৬২,সহীহ আল জামে ৬৫২৯; সনদ হাসান)।একদা আলী (রাঃ) একদল ব্যক্তিকে শতরঞ্জ খেলতে দেখে বললেন, এসব মূর্তি নিয়ে তোমরা মত্ত হয়ে উঠেছ কেন? (মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বা হা/২৬৬৮২; বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৬০৯৭, সনদ হাসান; ইবনু হাযম, মুহাল্লা ৬/৬৩)।
.
এই খেলাগুলো হারাম হওয়ার কারণ সম্পর্কে আবুল ওয়ালীদ আল-বাজী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,এসব খেলা মানুষকে প্রায়শই আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল রাখে। এতে দ্বীন ও দুনিয়ার কোন উপকারিতা নেই; বরং এর পরিণামে মানুষ জুয়া খেলা, মিথ্যা শপথ এবং সালাত পরিত্যাগে অভ্যস্ত হয়, পরস্পরের মধ্যে শত্রু“তাও পয়দা হয়। এতে মত্ত হয়ে আল্লাহকে ভুলে যায়, নামায কাযা হয়ে যায় এবং আরও নানা রকমের পাপাচারে লিপ্ত হয়।(আল-মুনতাক্বা শারহুল মুওয়াত্ত্বা ৭/২৭৮) সুতরাং ঈমানদারের জন্য এ জাতীয় সময় অপচয়কারী এবং আল্লাহ থেকে বিমুখকারী খেলা হ’তে বিরত থাকা আবশ্যক (শাওকানী, নায়লুল আওত্বার ‘জুয়া ও নারদাশীর খেলা হারাম’ অনুচ্ছেদ ৮/১০৮)। মোটকথা নিম্নোক্ত কারণ থাকলে যেকোন খেলা হারাম।

(১) যে খেলা মানুষের মধ্যে সালাত,আল্লাহর যিকির ও দ্বীন সম্পর্কে উদাসীনতা তৈরি করে (সূরা আন-নূর: ৩৭; আবূ দাঊদ, হা/৫৫০; ইবনু মাজাহ, হা/৭৭৭, সনদ সহীহ)।

(২) এমন খেলা, যাতে শারীরিক কোন উপকার নেই,শুধু সময়ের অপচয় হয় (তিরমিযী, হা/২৪১৬-৭) মহান আল্লাহ আমাদেরকে সকল প্রকার নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ড থেকে হেফাজত থাকার তৌফিক দান করুন। আমীন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
______________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।