জানাযার সালাতে সূরা-ফাতেহা পাঠ করার বিধান

জানাযার সালাতে সূরা-ফাতেহা পাঠ করার বিধান কি? জানাযার সালাতে সূরা-ফাতেহা পাঠ করা কি ইমাম-মুক্তাদি উভয়ের জন্য কর্তব্য?
▬▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬▬
জানাযার সালাতে সূরা-ফাতেহা পাঠ করার হুকুম সম্পর্কে আহালুল আলেমগণের মধ্যে মতানৈক্য থাকলেও সঠিক কথা হলো, এটা ওয়াজিব। কারণ, সমস্ত উম্মাতের ইজমা বা ঐকমত্য হলো, জানাযার সালাতও সালাতের অন্তর্ভুক্ত। (ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-২০৪৩৫)। আর হাদীসে রাসূল (ﷺ) বলেছেন,”তোমরা আমাকে যেভাবে সালাত আদায় করতে দেখেছ সেভাবে সালাত আদায় কর।”(সহীহ বুখারী হা/৬৩১)। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অপর বর্ণনায় বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা পাঠ করে না তার সালাত হয় না।’(সহীহ বুখারী হা/৭৫৬, সহীহ মুসলিম হা/৯০০, ৯০১, ৯০২, ৯০৪, ৯০৬, ৯০৭, ইফাবা হা/৭৫৮, ৭৫৯, ৭৬০, ৭৬২; মিশকাত হা/৮২২ ও ৮২৩)। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন সালাত আদায় করল অথচ সূরা ফাতিহা পাঠ করল না, তার সালাত অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। এ কথাটি তিনি তিনবার বলেন। তখন আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, আমরা যখন ইমামের পিছনে থাকি? উত্তরে তিনি বললেন, তুমি চুপে চুপে পড়।’ (সহীহ মুসলিম হা/৯০৪, ইফাবা হা/৭৬২; মিশকাত হা/৮২৩)। ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,’প্রত্যেক সালাতে ইমাম-মুক্তাদী উভয়ের জন্য ক্বিরা‘আত (সূরা ফাতিহা) পড়া ওয়াজিব। মুক্বীম অবস্থায় হোক বা সফর অবস্থায় হোক, জেহরী সালাতে হোক বা সের্রী সালাতে হোক। (সহীহ বুখারী, হা/৭৫৬-এর অনুচ্ছেদ দ্রঃ)
.
সুতরাং, জানাযার সালাতও যেহেতু সালাতের অন্তর্ভুক্ত। তাই জানাযার সালাতে ক্বিরাআত (সূরা ফাতেহা) ও দু‘আ ইমাম ও মুক্তাদী সকলকেই পড়তে হবে। অর্থাৎ ইমাম-মুক্তাদী উভয়ই প্রথম তাকবীর দিয়ে বুকে হাত বেঁধে ইমাম আ‘ঊযুবিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ সহ সূরা ফাতিহা ও অন্য একটি সূরা পড়বে। মুক্তাদী শুধু সূরা ফাতেহা পাঠ করবে। অতঃপর ইমাম দ্বিতীয় তাকবীর দিলে উভয়ই দরূদে ইবরাহীম পড়বে। অতঃপর ইমাম তৃতীয় তাকবীর দিলে উভয়ে জানাযার নির্দিষ্ট দু‘আ পড়বে এবং ইমাম চতুর্থ তাকবীর দিলে উভয় ডান ও বাম দিকে সালাম ফিরাবে। (সবকিছু ইমাম আগে করবে মুক্তাদী পরে করবে)। (সহীহ বুখারী, হা/১৩৩৫; নাসাঈ, হা/১৯৮৭, ১৯৮৯; মিশকাত, হা/১৬৫৪; ইরওয়াউল গালীল, হা/৭৩৪, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৮০-১৮১)। উল্লেখ্য যে, জানাযার সালাত সরবে ও নীরবে দু’ভাবেই পড়া যায়। (বুখারী ১/১৭৮, হা/১৩৩৫; মুসলিম হা/৯৬৩; মিশকাত হা/১৬৫৪)। শায়খ ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, অবশ্যই জানাযার ক্বিরাআত ও দু‘আ সবই চুপি চুপি হবে; স্বশব্দে নয়। তবে স্বশব্দে পড়ার কারণে যদি নিকটের লোকজন শুনতে পায়, তাহলে কোন ক্ষতি নেই। (ইবনু বায, ফাতাওয়া নূরুন আলাদ দারব, ১৪/১৫ পৃ.; মাওসূ‘আতুল ফাতাওয়া, মুশাহাদাত নং-৪৯১৪;)। ইমামদের মধ্যে আয়িম্মায়ে সালাসা তথা ইমাম শাফি‘ঈ, আহমাদ, ইসহাকসহ অসংখ্য ইমাম ও ফকীহ এ মতেরই অনুসারী ছিলেন।
.
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) একদা জানাযায় সূরা ফাতেহা সরবে পাঠ করেন ও সালাত শেষে বলেন, আমি এজন্য এরূপ করলাম যাতে তোমরা অবগত হও যে, এমনটি করা সুন্নাত। (বুখারী হা/১৩৩৫; মিশকাত হা/১৬৫৪)। উক্ত হাদীসে ইবনু ‘আব্বাস-এর কথা- ‘এটা সুন্নাত’, এ সুন্নাহ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চিরাচরিত সুন্নাহ বা নিয়ম। সুন্নাহ মানে ফরজের বিপরীত এমনটি নয়, এটা ইস্তিলাহে উরফী বা স্বভাবসিদ্ধ পরিভাষা। আশরাফ বলেছেন, সুন্নাহ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো যা বিদ‘আতের বিপরীত। আবদুর রহমান মুবারকপূরী বলেনঃ আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস-এর জোরে পড়ার বিষয়টি ছিল শিক্ষার জন্য, জোরে পড়াই যে সুন্নাত এ উদ্দেশ্য নয়। আল্লামা কুসতুলানী বলেন: সুন্নাহ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো এটা শার‘ঈ প্রণেতার পথ ও পন্থা। সুন্নাহ বলা এটা ওয়াজিব হওয়াকে নিষেধ করে না। ইমাম শাফি‘ঈ বলেন: অধিকাংশ আলিমের নিকট কোন সাহাবীর সুন্নাহ দাবী; এটা মারফূ হাদীসের মর্যাদা রাখে। (মিশকাতুল মাসাবিহ, ১৬৫৪ নং হাদীসের ব্যাখ্যা দৃষ্টব্য; ইবনু আব্বাস-এর আরেকটি বর্ণনা মিশকাত, ১৬৭৩ নং হাদীসে দেখুন)
.
ত্বালহা ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আওফ (রাঃ) বলেন, আমি একদা ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর পিছনে জানাযার সালাত আদায় করলাম। তাতে তিনি সূরা ফাতিহা এবং অন্য একটি সূরা পাঠ করলেন। তিনি ক্বিরাআত জোরে পড়ে আমাদের শুনালেন। তিনি যখন সালাত শেষ করলেন, তখন আমি তাকে উক্ত বিষয়ে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, এটা সুন্নাত এবং হক্ব। (নাসাঈ, হা/১৯৮৭; আবু দাঊদ, হা/৩১৯৮)। রাসূল (ﷺ)-এর জনৈক সাহাবী থেকে বর্ণিত আছে যে, নিশ্চয় সুন্নাত হলো- জানাযার সালাতে ইমাম তাকবীর দিবেন এবং প্রথম তাকবীরের পর নীরবে মনে মনে সূরা ফাতিহা পাঠ করবেন। অতঃপর বাকী তাকবীরগুলোতে রাসূল (ﷺ)-এর উপর দরূদ পড়বেন। তারপর মৃত ব্যক্তির জন্য একনিষ্ঠভাবে দু‘আ করবেন। (বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা, হা/৭২০৯)। ইমাম যুহরী (রাঃ)-কে সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যিব-এর নিকট হাদীস বর্ণনা করতে শুনেছি যে, জানাযার সালাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করা সুন্নাত। অতঃপর রাসূল (ﷺ)-এর উপর দরূদ পাঠ করবে। তারপর মাইয়্যেতের জন্য একনিষ্ঠচিত্তে দু‘আ করবে। (মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, হা/১১৪৯৭; ইরওয়াউল গালীল, হা/৭৩৪-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, শ্রেষ্ঠ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন, সূরা ফাতিহা পাঠ জানাযার সালাতের একটি রুকন। কারণ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,‘যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা পাঠ করে না তার সালাত হয় না।’(সহীহ বুখারী হা/৭৫৬)। আর জানাযার সালাতও সালাতের অন্তর্ভুক্ত। কারন মহান আল্লাহ বলেন, আর তাদের (মুনাফিকদের) মধ্যে কারো মৃত্যু হলে আপনি কখনো তার জন্য জানাযার সালাত পড়বেন না এবং তার কবরের পাশে দাঁড়াবেন না। (সূরা তওবা; ৯/৮৪)। আল্লাহ এটাকে সালাত বলেছেন। আর ইবনে আব্বাস (রাঃ) জানাযার নামাযে আল-ফাতিহা পাঠ করলেন এবং বললেন; “যাতে তোমরা জানতে পারবে যে এটা সুন্নত।” (ইবনে উসাইমীন, শারহুল মুমতি‘, ৫/৪০১পৃ. ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৭২২২১)। শাইখ আরো বলেন, জানাযার সালাতের ভিত্তিই হলো সংক্ষিপ্ততা। তাই এতে ছানা পড়া উচিত নয়। (শায়খ উসায়মীন, মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাাইল, ১৭তম খণ্ড, পৃ. ১১৯, অনুবাদক; জুয়েল মাহমুদ সালাফি)।
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.]-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: জানাযার নামাযে আল-ফাতিহা পড়ার হুকুম কি? তিনি জবাব বলেন: এটা ওয়াজিব। যেমন; রাসূল (ﷺ) বলেছেন, “তোমরা আমাকে যেভাবে সালাত আদায় করতে দেখেছ সেভাবে সালাত আদায় কর।”(সহীহ বুখারী হা/৬৩১)। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অপর বর্ননায় বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা পাঠ করে না তার সালাত হয় না।’(সহীহ বুখারী হা/৭৫৬, সহীহ মুসলিম হা/৯০০, মাজমু’ ফাতাওয়া আল-শাইখ ইবনে বায, ১৩/১৪৩; অনুবাদক; জুয়েল মাহমুদ সালাফি)
.
জেনে রাখা ভালো যে, জানাযার সালাতে সানা পড়ার প্রমাণে কোন সহীহ হাদীস পাওয়া যায় না। এজন্য উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, জানাযার সালাতের ভিত্তিই হলো সংক্ষিপ্ততা। তাই এতে ছানা পড়া উচিত নয়। (শায়খ উসাইমিন, মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাাইল, ১৭তম খণ্ড, পৃ. ১১৯)। জানাযার সালাতে সানা পাঠ করার প্রমাণ পাওয়া যায় না বিধায় বিগত শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] এটি বিদ‘আত হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। (আহকামুল জানায়িয- বিদ‘আত নং- ৭৬, পৃষ্ঠা ৩১৬)
.
পরিশেষে প্রিয় পাঠক, উপরোক্ত আলোচনা থেকে দিনের মতো প্রমাণিত হয় যে, জানাযায় সূরা ফাতিহা পড়তে হবে। যদিও একদল লোক বলেন, জানাযায় সালাতে রুকুও নেই, সিজদাও নেই, ফলে তা তাওয়াফের অনুরূপ। তাওয়াফ বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য সূরা আল-ফাতিহা পাঠের প্রয়োজন হয় না, ঠিক তেমনি সালাতে জানাযাও বিশুদ্ধ হবার জন্য সূরা ফাতিহা পাঠের কোন দরকার হয় না। তাদের এই দাবি সুস্পষ্ট সহীহ হাদীসের মোকাবিলায় নিছক মনগড়া কিয়াস-যা সম্পূর্ণ নাজায়িয। তারা জাল, যঈফ হাদীস এবং মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। জানাযার সালাতে সূরা ফাতিহা পড়তে হবে না মর্মে যত বর্ণনা আছে তার সবগুলো জয়ীফ অথবা জাল; একটিও সহীহ নয়। প্রচলিত হানাফীদের মুজতাহিদ মন্ডলীর শিরোমণি শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী লিখেছেন- সালাতে জানাযার বিধানসমূহের মধ্যে সূরা ফাতিহা পাঠও একটি বিধান। যেহেতু সূরা ফাতিহা সর্বাপেক্ষা উত্তম ও সবচাইতে পূর্ণাঙ্গ দু‘আ যা খোদ আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাগণকে স্বীয় পবিত্র কিতাবে শিক্ষাদান করেছেন- (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা- উর্দু অনুবাদ সহ ১২৩ পৃষ্ঠা) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
______________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।