খাবারের ছবি ফেসবুকসহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করার বিধান

প্রশ্ন: ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে খাবারের ছবি ফেসবুকসহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করার বিধান কি?
▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: শরীয়তের দৃষ্টিতে এবং নীতিগতভাবে, প্রয়োজনে নিজেদের খাবারের ছবি তার বন্ধু বা আত্মীয়কে পাঠাতে দোষের কিছু নেই। এবং এটিকে সরাসরি হারাম বলা যাবেনা। কিন্তু বিনা প্রয়োজনে ঢালাওভাবে ফেসবুক সহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের খাবারের ছবি পোস্ট করা শরীয়ত সম্মত নয়। কেননা কখনো কখনো এই পোস্ট করা বিষয়গুলো হারামের দিকে বা কবিরা গুনাহের দিকে নিয়ে যায়। কারণ, বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ছবিগুলি পোস্ট এমন একটি বিষয় যা এখন মানুষের মধ্যে এতটাই ব্যাপক হয়ে উঠেছে যে, পরিবারের সবাই মিলে খাওয়ার ছবি, খেলার মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে ড্রিংকসের ছবি, রমজান মাসের ইফতারের ছবি সবই আজকাল শেয়ার হয়! আর বন্ধুদের সঙ্গে রেস্টুরেন্টে খাওয়ার ছবি যদি পোস্ট করা না হয়, তাহলে তো মনে হয় খাওয়া-দাওয়াই বৃথা। অথচ একবারও ভাবি না, আমরা রেস্টুরেন্টে বা বুফেটে বসে যে খাবারের ছবি পোস্ট করছি, সেটা এমন কারো সামনে যেতে পারে যে কোনোভাবেই এ ধরনের খাবারের ব্যবস্থা করতে সক্ষম নয়। প্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে সমাজের একদম রুট লেভেল থেকে এলিট লেভেল পর্যন্ত প্রায় সব শ্রেণির মানুষই এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোতে সক্রিয়। শিশুরাও আজকাল মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ছাড়া কিছু বোঝে না। তাই এমন শিশুর সামনেও পোস্টটি যেতে পারে, যার বাবার সামর্থ্য নেই তাকে ভালো কোনো রেস্টুরেন্টে নিয়ে একবেলা খাওয়ানোর। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এ মানুষগুলোর মানসিক অবস্থাটা একবার চিন্তা করুন! সামান্য একটা ফেসবুক পোস্ট কতগুলো মানুষের হৃদয় ভাঙার কারণ হতে পারে, কত মানুষের কষ্টের কারণ হতে পারে! হতে পারে হিংসা, গর্ব কিংবা অহংকার। খাবারের ছবি পোষ্ট করার জন্য মানুষ আপনাকে হিংসা করতে পারে। কারণ, আল্লাহ আপনাকে নেয়ামত দান করেছেন যেটা তাদের নেই। তাই এই ছবিগুলি ছড়িয়ে দিলে সমাজের অসহায় হতদরিদ্র ও নিঃস্বদের হৃদয় ভেঙে যেতে পারে। পরন্তু, যে ব্যক্তি এই ছবিগুলি ছড়াচ্ছে সে হয়তো গর্ব করতে শুরু করতে পারে [তার খাবারের গুণমান নিয়ে] ফলে তার খাবার হবে দুই প্রতিযোগীর খাবারের ন্যায়। অথচ রাসূল (ﷺ) এমনটি করতে নিষেধ করেছেন। ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দুই প্রতিদ্বন্দী অহংকারকারীর খাদ্য গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন। (আবু দাঊদ ৩৭৫৪; সনদ সহীহ)। যেহেতু তাতে রয়েছে লোকপ্রদর্শন ও পরস্পর গর্ব প্রকাশ করার প্রতিযোগিতা। আল-খাত্তাবি বলেছেন: ”দুই প্রতিযোগী হলেন দুজন ব্যক্তি যারা তাদের অভিনয় দিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এটা বলা হয় যে দুইজন ব্যক্তি একে অপরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে যদি তাদের প্রত্যেকে তার প্রতিপক্ষের মতো একই কাজ করে, কে জিতবে তা দেখার জন্য। এটাকে শরীয়তে অপছন্দ করা হয় কারণ এর সাথে জড়িত প্রদর্শনী এবং অহংকার।(ইসলামওয়েব ফতোয়া নং:৩৯১০৩০) পক্ষান্তরে ইসলাম আমাদেরকে খেতে উৎসাহিত করেছে কিন্তু পানাহারে অপচয় করতে নিষেধ করেছে।মহান আল্লাহ বলেন, তোমরা পানাহার কর, কিন্তু অপচয় করো না। তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না। (সূরা আ’রাফ; ৭/৩১)
.
খাবারের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করার বিধান সম্পর্কে সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে মসজিদে নববীতে দারস প্রদানের সময় জিজ্ঞেস করা হলে,
.
জবাবে শাইখ বলেন, যুবায়র ইবনুল আওওয়াম (রাঃ) থেকে বর্ণিত। মহান আল্লাহ বলেন, “এরপর অবশ্যই সেদিন তোমাদেরকে নিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।” (সূরা তাকাসুর: ১০২/৮)। যখন উক্ত শীর্ষক আয়াত নাযিল হলো, তখন যুবাইর (রাঃ) বলেন, আমাদের নিকট এমন কী নিআমাত আছে যে সম্পর্কে আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে? আমাদের নিকট দু’টি কালো জিনিস অর্থাৎ খেজুর ও পানি আছে। তিনি বলেন: তা অচিরেই (তোমাদের হস্তগত) হবে। (তিরমিয়ী: ৫/৪৪৮, হা/৩৩৫৮ ইবনে মাজাহ হা/৪১৫৮, মুসনাদে আহমাদ: ৩/২৪; সনদ হাসান)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, একবার রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ক্ষুধায় কাতর হয়ে বের হলেন, পথে আবু বকর ও উমরও বের হলেন, তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কেন বের হয়েছ? তারা বলল, ক্ষুধা। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, যার হাতে আমার নফস তার শপথ, আমিও সেকারণেই বের হয়েছি। তারপর তিনি বললেন, চল। তারা সবাই এক আনসারীর বাড়ীতে আগমন করলেন। আনসারী লোকটির স্ত্রী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সঙ্গিদ্বয়কে দেখে যার-পর-নাই খুশী হয়ে শুভেচ্ছা ও স্বাগতম জানানোর মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানালেন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, অমুক কোথায়? স্ত্রী জানালো যে, সে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে গেছে। ইত্যবসরে আনসারী লোকটি এসে তাদেরকে সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ! আজি কেউ আমার মত মেহমান পাবে না। তারা বসলে তিনি তাদের জন্য এক কাঁদি খেজুর নিয়ে আসলেন যাতে কাঁচা-পাকা, আধাপাকা, ভাল-মন্দ সবধরনের খেজুর ছিল। তারপর আনসারী লোকটি ছুরি নিয়ে দৌড়াল। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সাবধান! দুধ দেয় এমন ছাগল যবাই করো না। আনসারী তাদের জন্য যবাই করলে তারা ছাগলের গোস্ত খেল, খেজুর গ্রহণ করল, পানি পান করল। তারপর যখন তৃপ্ত হলো। তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকর ও উমরকে বললেন,“তোমরা কিয়ামতের দিন এ সমস্ত নেয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। তোমাদেরকে ক্ষুধা তোমাদের ঘর থেকে বের করল, তারপর তোমরা এমন নেয়ামত ভোগ করার পর ফিরে গেলে।” (সহীহ মুসলিম হা/২০৩৮)। উপরোক্ত দুটি হাদীস উল্লেখ করে শাইখ বলেন,সহজ ব্যাপার যে মানুষ আজ দিন দিন বিপুল প্রাচুর্য এবং বৈচিত্রময় খাদ্য ও পানীয় নিয়ে পড়ে আছে এবং কীভাবে এটি নিয়ে প্রতিযোগিতা করছে। যে ব্যক্তি এই হাদিস দুটি হৃদয় দিয়ে চিন্তা করবে, এটি তাকে পার্থিব জিনিসের কম আকাঙ্খা করাবে এবং খাদ্য ও পানীয়ের অতিরিক্ত কামনা করাবে না। যদি এমন হয় যে, হাশরের দিন বান্দাকে পানি, খেজুর এবং আনন্দ থেকে শুরু করে সাধারণ জিনিস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। তাহলে আজকালকার মানুষের অবস্থা কী হবে যেখানে তারা বিপুল বৈচিত্র্যময় খাবার এবং পানীয়ের আনন্দ উপভোগ করেছে? আর যখন তারা সেগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় পাঠিয়ে, নাম উল্লেখ করে এবং গণনা করে গর্ব করে তখন তাদের অবস্থা কী? যেটা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিচ্ছে তা হলো, তারা এই অনুগ্রহ (প্রাচুর্য ) প্রকাশ করে বেড়াচ্ছে, আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে ভুলে গিয়ে এবং নিঃস্বদের প্রতি সহানুভূতি ভুলে গিয়ে। আর যে ব্যক্তি প্রজ্ঞার অধিকারী, আল্লাহ যখন তাকে কোন অনুগ্রহ দান করেন, তখন তিনি তা বৈধভাবে উপভোগ করেন। এবং জায়েয ও নাজায়েজ বিষয়ের ব্যাপারে প্রাপ্ত হুকুম থেকে নিঃস্বদের নিরাশ করার ব্যাপারে সতর্ক হওয়া। এবং এই ব্যাপারটি নষ্ট হয়ে গেছে, বিশেষ করে সেই নারীদের ব্যাপারে যারা বিভিন্ন ধরনের খাবার ও পানীয়ের পাশাপাশি পোশাক নিয়ে গর্ব করতে পছন্দ করে। এবং তারা এটি ছড়িয়ে দেয় সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে । একইভাবে, অনেক পুরুষও এতে অংশ নেয়। তাই এটি উক্ত ব্যক্তির মনে রাখা আবশ্যক যখন তিনি এই ছবিগুলি প্রদর্শনে রাখছেন তখন; তাকে বিচার দিবসে আল্লাহর সামনে এই সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। তাই আমরা আল্লাহর কাছে তার অনুগ্রহের জন্য আমাদের কৃতজ্ঞতা দান করার জন্য এবং এটি নিয়ে অহংকার না করার জন্য প্রার্থনা করি। (শাইখের বক্তব্যের মূল ভিডিও লিংক: https://youtu.be/1gbK6WBKgd4, অনুবাদক: জুয়েল মাহমুদ সালাফি)

পরিশেষে, প্রিয় পাঠক! একদা এক কবি বলেছেন, নিজের খাবার বিলিয়ে দেব অনাহারীর মুখে।’ আসুন, নিজের খাবার বিলিয়ে দিতে না পারলেও, আমার খাবার যেন অন্তত কারো কষ্টের কারণ না হয়, সে ব্যাপারে সচেতন হই। আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
___________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।