তাকফির সম্পর্কে বিস্তারিত

প্রশ্ন: তাকফির কী? কোন মুসলিমকে কাফের ফাতাওয়া দেওয়ার হুকুম, শর্তাবলী এবং বাধা সৃষ্টিকারী কারণ সম্পর্কে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মূলনীতি কি?
▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: কোন মুসলিমকে কাফের বলা, তার ব্যাপারে কুফরীর ফাতওয়া দেওয়াকে তাকফীর বলা হয়। একজন মুসলিমকে অপর মুসলিম কর্তৃক কাফির বলা একটি প্রাচীন ফিতনা। যা বর্তমান সময়েও খুবই প্রাসঙ্গিক। এখন পর্যন্ত মুসলিমদেরকে বিশেষ করে মুসলিম শাসকদেরকে কিংবা নিজের মতের বিরুদ্ধে গেলেই কাফির বলা এক শ্রেণির বিদআতি বক্তাদের নিত্যদিনের কর্ম, যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।অথচ তাকফীর একটি সূক্ষ্ম এবং বড় যিম্মাদারীর বিষয়। কখনো কখনো তাকফীর করা জরুরী হয়ে যায়। কিন্তু এটি এত বড় জটিল বিষয় যে, এই ব্যাপারে ব্যক্তিগত স্বার্থ অথবা অসর্তকতা এবং মূর্খতার উপর ভিত্তি করে কৃত ফয়সালা তাকফীরকারীকে (অন্যকে কাফের স্বীকৃতিদানকারীকে) আল্লাহর নিকট অপরাধী করে দেয় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মতে তাহক্বীক্ব ব্যতীত কাউকে কুফরীর ফাতাওয়া দেওয়া হারাম। কারণ এ ব্যাপারে শরীয়তে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। তাই কোন মুসলিম কুফুরী করলে তাকে কাফির সাব্যস্ত করার জন্য তাড়াহুড়া করা যাবে না। হাদীস থেকে দলিল হচ্ছে :
.
আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইকে কাফের বলবে, তাদের দুজনের একজনের উপর তা বর্তাবে। (সহীহ বুখারী, কিতাবুল আদাব হা/৬১০৪; সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, হা/৯১)। আব্দুল্লাহ বিন উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় রয়েছে, إِنْ كَانَ كَمَا قَالَ وَإِلاَّ رَجَعَتْ عَلَيْهِ ‘যাকে কাফের বলা হয়েছে, যদি সে কাফের হয় তো হলোই, নতুবা কথাটি বক্তার উপরই ফিরে আসবে। (সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ঈমান হা/৯২; ইবনু মাজাহ হা/৫২১; আলবানী সিলসিলা সহীহাহ হা/২৮৯১)। আবু সা‘ঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে ইবনু হিব্বানের বর্ণনায় রয়েছে, إَنْ كَانَ كَافِرًا وَإِلَّا كَفَرَ بِتَكْفِيْرِهِ যাকে কাফের বলা হয়েছে, সে যদি কাফের হয় তো হলোই, নতুবা সে এই কাফের বলার কারণে নিজেই কাফের হয়ে যাবে। (সহীহ ইবনু হিব্বান হা/২৪৮; সহীহ আত-তারগীব হা/২৭৭৫; আল আদাবুল মুফরাদ ৬০৪৫; আবু আওয়ানা ১/২৩; ইবনু মাজাহ, আল ঈমান: ৫৯৩; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৫৫২)। হাদীসটিকে আল্লামা শুআইব আল আরনাঊত রহিমাহুল্লাহ সহীহ বলেছেন এবং আল্লামা নাসির উদ্দিন আলবানী রহিমাহুল্লাহও হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। (সিলসিলা সহীহাহ হা/২৮৯১)। সাবিত ইবনুয্ যহহাক (রাঃ) থেকে সহীহ বুখারীর অপর বর্ননায় এসেছে, কোন ব্যক্তি কর্তৃক তার (মুসলিম) ভাইকে কাফের বলাটা তাকে হত্যা করার মত অপরাধ। (সহীহ বুখারী হা/৬০৪৭; সহীহ মুসলিম হা/১১০)
.
প্রিয় পাঠক! উক্ত হাদীসগুলো থেকে একথা পরিস্কার যে, কাউকেও কাফের বলে ফাতওয়া দিলে ইহা আর ব্যর্থ বা অনর্থ হয় না। সুতরাং যাকে কাফের বলা হয়েছে সে যদি প্রকৃতপক্ষে কাফের হয়, তবে ফাতাওয়া ঠিক। অন্যথায় কাফের বলে যে ফাতাওয়া দিয়েছে ফাতাওয়া তার দিকে ফিরে আসবে। অতএব, যে কোনো মুসলমানকে কাফের হিসেবে ফাতাওয়া দেওয়ার ব্যাপারে আমাদের অবশ্যই অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে, কারণ একজন মুসলমানের জন্য তার অপর মুসলিম ভাইকে কাফের হিসেবে বর্ণনা করা সবচেয়ে বড় পাপের মধ্যে একটি হলো যখন সে তার থেকে নির্দোষ। ইমাম আবু হানীফা (রহিমাহুল্লাহ) বলেন; আমরা কোনো মুসলিমকে কোনো পাপের কারণে কাফির বলি না, যদিও তা কোনো কবীরা গোনাহ হয়, যতক্ষণ না সে সে পাপটিকে হালাল বলে বিশ্বাস করে। আমরা পাপের কারণে কোনো মুসলিমের ‘ঈমান’-এর নাম অপসারণ করি না। বরং আমরা তাকে প্রকৃতই মুমিন বলে আখ্যায়িত করি, সে কাফির না হয়ে একজন পাপী মুমিন হতে পারে। (মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃষ্ঠা: ১১৭)। ইমাম ত্বহাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন; ‘‘আমাদের কিবলাপন্থীদের ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা মু‘মিন বলে আখ্যায়িত করব যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নবী (ﷺ) যা কিছু নিয়ে এসেছেন তা স্বীকার করবে এবং তিনি যা কিছু বলেছেন সব সত্য বলে বিশ্বাস ও গ্রহণ করবে। যেসব বিষয় ঈমানের অন্তর্ভুক্ত, এমন কোনো বিষয় অস্বীকার না করলে, সে ঈমানের গন্ডি হতে বের হয় না। (আবূ জাফর তাহাবী, মাতনুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃষ্ঠা: ১৪, বই কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা)
.
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মতে ঐ ব্যক্তি অপরাধী, যে সত্য স্পষ্ট হওয়ার পরও তা অস্বীকার করে। কখনো কখনো গবেষণা বা বুঝের ভুলের কারণে জ্ঞানী মানুষদের থেকেও এমন কোনো কথা বা কর্ম সংঘটিত হয়ে যায়, যার উপর কুফরীর হুকুম সাব্যস্ত করা যায়। তথাপি তার উপর কুফরীর হুকুম দেওয়া যাবে না। বরং ভুলকারী হিসাবে উল্লেখ করা হবে।
.
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়্যা (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮] বলেন, তাকফীরের ব্যাপারে সঠিক কথা হলো- উম্মাতে মুহাম্মাদীর মধ্য হতে কোনো ব্যক্তি সঠিক বিষয় গবেষণা করতে গিয়ে যদি ভুল করে ফেলে, তাহলে তাকে এই ভুলের কারণে কাফের বলা যাবে না। বরং আল্লাহ তাআলাও তার পাপ ক্ষমা করে দিবেন। পক্ষান্তরে, কোনও ব্যক্তির নিকট রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর কথা এবং হেদায়াত স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরও যদি সে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর বিরোধিতা করে এবং ঈমানদারদের পথ বাদ দিয়ে অন্য পথে চলে, তাহলে এমন ব্যক্তি কাফের হয়ে যায়। আর যে ব্যক্তি নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং সত্য অন্বেষণের ক্ষেত্রে অলসতা প্রদর্শন করে আর অজ্ঞতার কারণে কিছু বলে দেয়; তাহলে এমন ব্যক্তি পাপী হিসাবে গণ্য হবে (কাফের নয়)। (মাজমূঊল ফাতাওয়া ইবনু তাইমিয়্যাহ; খন্ড: ১২ পৃষ্ঠা: ১৮০)
.
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবন তাইমিয়া আরো বলেন; যারা আমাকে চেনে, তারা অবশ্যই জানে যে, নির্দিষ্টভাবে কাউকে কাফির বা ফাসিক বলা থেকে আমি কঠোরভাবে নিষেধ করে থাকি। তবে যে ব্যক্তি কাফির বা ফাসিক হওয়ার কারণসমূহ সম্পর্কে অবগত আছে, তার কথা ভিন্ন। আমি আবারও বলছি যে, এ উম্মাতের কেউ ভুলক্রমে অন্যায় কাজে লিপ্ত হলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে ক্ষমা করে দিবেন। চাই আকীদার মাসআলায় ভুল করুক কিংবা অন্য কোনো মাসআলায়। সালফে-সালেহীনগণ অনেক মাসআলায় মতভেদ করেছেন। তারপরও কেউ কাউকে কাফির বলেন নি। তাদের থেকেও বর্ণিত আছে যে, যে ব্যক্তি এরূপ কথা বলবে, সে কাফির হয়ে যাবে। এটা ঠিক, কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট কর্মের উপরে হুকুম লাগানো এবং ব্যক্তির ওপর হুকুম লাগানোর মাঝে পার্থক্য রয়েছে। শাইখুল ইসলাম আরো বলেন, কাউকে কাফির বলা অত্যন্ত ভয়ানক বিষয়। এমন ব্যক্তি যে নও মুসলিম অথবা সে আলিম-উলামা থেকে দূরের কোনো জনপদে বসবাস করছে। যার কারণে ইসলামের বিধি-বিধান সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করতে পারেনি। এরূপ ক্ষেত্রে দ্বীনের কোনো বিষয় অস্বীকার করলেই তাকে কাফির বলা যাবে না। যতক্ষণ না তার কাছে হুজ্জত (কুরআন- সুন্নাহর দলীলসমূহ) পেশ করা হবে। এও হতে পারে যে, সে দলীল-প্রমাণ শুনে নি অথবা শুনেছে, কিন্তু বিশুদ্ধ সূত্রে তার কাছে পৌঁছে নি। কখনো এও হতে পারে যে, সে একজন আলিম। তার কাছে দলীল রয়েছে বা দলীলের ব্যাখ্যা রয়েছে। যদিও তা সঠিক নয়।(মাজমূঊল ফাতাওয়া ইবনু তাইমিয়্যাহ; খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ৩৩৯)
.
বুঝা গেল, সত্য ও সঠিক বিষয় স্পষ্ট হওয়ার পরও তা অস্বীকার মানুষকে কাফের বানিয়ে দেয়। সুতরাং এমন ব্যক্তির কুফরী স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর বিশেষ করে যখন সে তার এই কুফরী চিন্তাকে মুসলিম উম্মাহর মাঝে প্রচার করে, তখন তাকে মুসলিম বলা দ্বীন ইসলামের মর্যাদার দুর্বলতা এবং মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ কামনার ক্ষেত্রে দুর্বলতা প্রদর্শনের নামান্তর। মির্জা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর বিষয়টি তার স্পষ্ট উদাহরণ। সুতরাং মনে রাখতে হবে, কোনো ব্যক্তির নিকট দলীল না পৌঁছার কারণে যদি সত্য ও সঠিক বিষয় অস্পষ্ট থেকে যায় অথবা দলীল বুঝার ক্ষেত্রে ভুল হওয়ার কারণে তার বক্তব্য কুরআন ও সুন্নাহর সাথে সাংঘর্ষিক হয়, তাহলে তার সামনে সত্যকে স্পষ্ট না করে তার উপর কাফের ফাতাওয়া দেওয়া কল্যাণ কামনা, দয়া, মহানুভবতা এবং বিচক্ষণতার বহির্ভূত বিষয়। অতএব, আল্লাহর কিতাব, রাসূলের সুন্নাত এবং আলিমদের কথা অনুযায়ী দলীল-প্রমাণ পেশ করা ব্যতীত কাউকে কাফির বলা যাবে না। আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহের দাবীও তাই। তিনি অযুহাত পেশ করার সুযোগ দূর না করে কাউকে শাস্তি দিবেন না। বিবেক দ্বারা মানুষের ওপর আল্লাহর হক সাব্যস্ত করা সম্ভব নয়। যদি তাই হত, তাহলে রাসূল প্রেরণের মাধ্যমে হুজ্জত পেশ করা যথেষ্ট হত না। সুতরাং একজন মুসলিম ততক্ষণ পর্যন্ত মুসলিম হিসেবেই পরিগণিত হবে, যতক্ষণ না শরী‘আতের দলীলের মাধ্যমে তার ইসলাম ভঙ্গ হবে। কাজেই কাফির বলার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ, তা না হলে দু’টি বড় ধরণের ভয়ের কারণ বা আশঙ্কা রয়েছে। যেমন:
.
(১). আল্লাহর ওপর মিথ্যাচারিতার অপবাদ। সাথে সাথে যার ওপর কুফরীর হুকুম লাগানো হলো তাকেও এমন দোষে দোষী সাব্যস্ত করা হলো, যা থেকে সে সম্পূর্ণ মুক্ত। আল্লাহর ওপর মিথ্যাচারিতার অপবাদ এভাবে হয় যে, এমন ব্যক্তিকে কাফির বলা হয়েছে, যাকে আল্লাহ কুরআন হাদীসে কাফির বলেন নি। এটি আল্লাহ যা হালাল করেছেন, তা হারাম করার শামিল। কেননা কাউকে কাফির বা ফাসিক তা নির্ধারণ করা আমাদের উপর নির্ভর করে না, বরং এটি শুধুমাত্র আল্লাহ এবং তার রাসূলের অধিকার। যেমনিভাবে কোনো কিছু হারাম করা বা হালাল করার দায়িত্ব আল্লাহর উপরে। যা তিনি কুরআন সুন্নাহ উল্লেখ করেছেন। সুতরাং কুরআন ও সুন্নাহ যাকে কাফের বা ফাসিক বলে নির্দেশ করে তাকে ছাড়া অন্য কাউকে কাফির বা ফাসিক বলে গণ্য করা যাবে না।
.
(২). দ্বিতীয় সমস্যাটি হলো- মুসলিম ব্যক্তি যে অবস্থার ওপর প্রতিষ্ঠিত, তাকে তার বিপরীত অবস্থানে নিয়ে যাওয়া। কেননা যখন কোনো মুসলিমকে লক্ষ্য করে কাফির বলা হবে, তখন সে যদি কাফির না হয়, তাহলে ফাতওয়া দানকারী নিজেই কাফির হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে,যেমনটি প্রথমেই হাদীসগুলো উল্লেখ করা হয়েছে।(নোট: এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় তা হচ্ছে কুফুরী ফাতওয়া নিজের দিকে ফিরে আসে এ কথার অর্থ এই নয় যে সেই ব্যক্তি কাফের ফাতাওয়া দেওয়ার কারণে সাথে সাথে নিজে কাফের হয়ে যাবে, বরং সঠিক কথা হচ্ছে, তার ওপর ও যাবতীয় শর্তাবলি প্রযোজ্য হবে)।
.
▪️একজন মুসলিমকে কুফর বা ফাসেক হুকুম দেওয়ার আগে, তাকে অবশ্যই দুটি বিষয় বিবেচনা করতে হবে। অর্থাৎ,
.
(১). কিতাব বা সুন্নাহর প্রমাণ থাকতে হবে যে এই কথা বা কাজ ব্যক্তিকে কুফুরি কিংবা ফিসকের দিকে নিয়ে যায়।
.
(২). এই বিধানটি একজন নির্দিষ্ট বক্তা বা নির্দিষ্ট কর্তার জন্য প্রযোজ্য হবে, যাতে তার ক্ষেত্রে কুফুরী বা ফিসকের শর্ত পূরণ হয় এবং প্রতিবন্ধকতা বা বাধা দূর হয়।
.
▪️একজন মুসলিমকে কাফের ফাতাওয়া দেওয়ার শর্তাবলী কী?
.
একজন মুসলিম কে তাকফির করা বা তাকে কাফের ফাতাওয়া দেওয়ার বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত রয়েছে, উক্ত শর্ত পূরন না হওয়া পর্যন্ত কাউকে কাফের ঘোষণা করা যাবে না। সুতরাং তাকফীর বা কাউকে কাফির সাব্যস্ত করার জন্য সালাফদের দৃষ্টিতে যে চারটি শর্ত থাকা অতীব জরুরি তা হচ্ছে-
.
(১). প্রথম শর্ত: যার বিরুদ্ধে কুফরির অভিযোগ আনা হবে তার দ্বারা সংঘটিত উক্ত কথা, কর্ম বা আদেশ অমান্য করা যে কুফুরী তা কুরআন এবং রাসূল (ﷺ)-এর সহীহ সুন্নাহর আলোকে স্পষ্ট প্রমাণিত হতে হবে। (দলিল দেখুন, সূরা আল-আ‘রাফ: ৭/৩৩; সূরা বানী ইসরাঈল: ১৭/৩৬)।
.
(২). দ্বিতীয় শর্ত: কাজটি যে মুকাল্লাফ (যাদের উপর শরীয়াতের বিধি-নিষেধ আরোপিত হয়) এমন ব্যক্তি দ্বারা সংঘটিত হয়েছে,তা প্রমাণিত হতে হবে। অপ্রাপ্তবয়স্ক হলে হবেনা।(সূরা বানী ইসরাঈল: ৩৬; সহীহ বুখারী, হা/৬০৪৫; সহীহ মুসলিম, হা/৬০, ৬১, ১১৯)।
.
(৩). তৃতীয় শর্ত: তার উপর হুজ্জাত তথা দলীল বা প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। অর্থাৎ তার সামনে শরীয়ত স্পষ্ট হওয়া এবং তিনি কুফর সম্পর্কে অবগত এমন ব্যক্তি হতে হবে।(দেখুন সূরা আন-নিসা: ১৬৫; সূরা আল-আন‘আম: ১৯; সূরা বানী ইসরাঈল: ১৫; সূরা আল-ক্বাসাস: ৫৯; সহীহ মুসলিম, হা/১৫৩)।
.
(৪). চতুর্থ শর্ত: মানিঊত তাকফীর তথা কাফির সাব্যস্তকরণে বাঁধা সৃষ্টিকারী কারণ উপস্থিত না থাকা।
উক্ত চারটি শর্ত উল্লেখ করেছেন বিগত শতাব্দীর (অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল,খন্ড:৩ পৃষ্ঠা: ৫২-৫৫)
.
▪️উপরোক্ত চারটি শর্তের সাথে মানিঊত তাকফীর তথা কাফির সাব্যস্তকরণে বাঁধা সৃষ্টিকারী ৪ টি কারণসমূহ জানা জরুরি আর তা হচ্ছে:
.
(১). ব্যক্তিকে কুফরি করতে বাধ্য করা হলে। অর্থাৎ যদি তাকে জোরপূর্বক কুফুরী করতে বাধ্য করা হয়, ফলে সে ইচ্ছা ছাড়াই তা নিরুপায় হয়ে করে, সেক্ষেত্রে তার উপর কুফুরীর বিধান প্রযোজ্য হবে না। এই মর্মে দলিল হচ্ছে- মহান আল্লাহ বলেন; তবে তার জন্য নয় যাকে (কুফরীর জন্য) বাধ্য করা হয়, অথচ তার অন্তর ঈমানের উপর অবিচল থাকে।(সূরা আন-নাহল: ১৬/ ১০৬)। হাদীসে আম্মার (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর ঘটনা একটি বড় উদাহরণ:যার চোখের সামনে তাঁর পিতা ও মাতাকে কঠিন শাস্তি দিয়ে দিয়ে শহীদ করা হয়। তারপর তাকে এমন কঠিন অসহনীয় শাস্তি দেয়া হয় যে, শেষ পর্যন্ত নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্য তিনি কাফেরদের চাহিদা মত রাসূল ﷺ গালি দেয়,পরে তিনি রাসূল ﷺ কে সবকিছু খুলে বললে রাসূল ﷺ তাকে জিজ্ঞেস করলেন “তোমার মনের অবস্থা কি?” জবাব দিলেন “ঈমানের ওপর পরিপূর্ণ নিশ্চিত।” একথায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ “যদি তারা আবারো এ ধরনের জুলুম করে তাহলে তুমি তাদেরকে আবারো এসব কথা বলে দিয়ো।” [মুস্তাদরাকে হাকেমঃ ২/৩৫৭, বাইহাকীর আস-সুনানুল কুবরা ২/২০৮-২০৯]।
.
(২).অতি আনন্দে বা অতি দুঃখে কুফরি হয় এমন কিছু বলা, অর্থাৎ কারও চিন্তাশক্তি থেমে যাওয়া। এমন হয়ে যাওয়া যে, সে কি বলছে বা না বলছে তা অনুভব করতে পারছে না। এটা হতে পারে সীমাতীত খুশির আতিশায্যে, অথবা প্রচণ্ডভাবে চিন্তাগ্রস্ত বা ভীত হয়ে পড়ার কারণে। যেমন: একটি হাদিসে এসেছে, হারিয়ে যাওয়া বাহন হঠাৎ খুঁজে পেয়ে সে তার লাগাম ধরে খুশীর চোটে বলে ওঠে, ’হে আল্লাহ! তুমি আমার দাস, আর আমি তোমার প্রভু!’ সীমাহীন খুশীর কারণে সে ভুল করে ফেলে। (সহীহ মুসলিম ২৭৪৪)।
.
(৩).অজ্ঞতাপ্রসূত: অর্থাৎ না জেনে ভুলে কিছু বলা। মহান আল্লাহ বলেন: আর এ ব্যাপারে তোমরা কোন অনিচ্ছাকৃত ভুল করলে তোমাদের কোন অপরাধ নেই; কিন্তু তোমাদের অন্তর যা স্বেচ্ছায় করেছে (তা অপরাধ), আর আল্লাহ্ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।(সূরা আহযাব:৩৩/৫) শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ ও তার প্রিয় ছাত্র ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে কাফির সাব্যস্ত করার জন্য, তার কাছে এ সম্পর্কে ইসলামের বাণী পৌঁছানো থাকতে হবে। সে যদি তাকফীর বা কুফরের বিধান সম্পর্কে অবগত না হয়, সেক্ষেত্রে তার উপর কুফরীর বিধান প্রযোজ্য হবে ন। (আল-ইসতিগাসাহ, খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ৩৮১, মাজমূঊল ফাতাওয়া ইবনু তাইমিয়্যাহ, খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ২৩০ ও ৩৫/১৬৪-১৬৫; মাদারিজুস সালিকীন, খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ৩৬৭; ইবনে কুদামাহ আল-মুগনী, খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ২৪৯; ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ২/৯৬-১০০; বিন বায, মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ৫২৮-৫২৯.)।
.
(৪). তা’বীল বা ভুল ব্যাখ্যার কারণে। অর্থাৎ যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহর হুকুমকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করে যা আইনদাতার উদ্দেশ্য নয়, মোটকথা যে ব্যক্তি সত্যকে পাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করল এবং সদিচ্ছা বহন করল, কিন্তু সে ভুল করল, তাহলে তাকে কাফির বলা হবে না। ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইদরীস আশ-শাফি‘ঈ, শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ, হাফিয ইবনু হাজার আসক্বালানী ও ইমাম উসাইমীন (রাহিমাহুমুল্লাহ) বলেন, ভুল বুঝার কারণে বা ভুল ব্যাখ্যার কারণে যদি কোন ব্যক্তি ভুলবশত কুফরের মধ্যে পড়ে যায়, সেক্ষেত্রে তার উপর কুফরীর বিধান সাব্যস্ত করা যায় ন। (আল-উম্ম, খন্ড: ৬ পৃষ্ঠা: ২০৫; মিনহাজুস সুন্নাহ,খন্ড: ৫ পৃষ্ঠা: ২৩৯; আল-ইসতিগাছাহ,খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ২৮২-২৮৩; ফাৎহুল বারী, ১২/৩০৪; উসাইমীন মাজমূঊ ফাতাওয়া; খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ১৩৬)।
.
(৫). উপরোক্ত বিষয়গুলোর পাশাপাশি একদল আলেম আরো একটি বিষয় উল্লেখ করে থাকেন আর তা হচ্ছে,নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তির ওপর কুফরীর বিধি-বিধান সাব্যস্ত হলে তাকে কাফের ফতোয়া দেওয়ার দায়িত্ব মুসলিম দেশের বিচার বিভাগ অর্থাৎ ইসলামি আদালতের অথবা তাকওয়াবান মুত্তাকী আলেমদের। এক্ষেত্র সাধারণ মানুষ বিনা দলিলে কাউকে কাফির ফতোয়া দেবে না।কারণ সাধারণ মানুষের কাছে শরয়ি ইলম নেই, সে নিঃস্ব। অতএব উপরোক্ত শর্তগুলো পূরণ ও বাঁধাগুলো দূরীকরণ হলেই কেবল কোনো মুসলিম ব্যক্তিকে কাফির বলা যাবে এর আগে নয়। ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:”একজন ব্যক্তির জন্য এই বিষয়ে সর্বশক্তিমান আল্লাহকে ভয় করা ওয়াজিব, এবং কুরআন ও সুন্নাহ যাকে ধর্ম অবমাননা হিসাবে নির্দেশ করে তাদেরকে ব্যতীত তাকফির বা কাফের ঘোষণা না করা।(ফাতাওয়া নূর ‘আলা আদ-দারব: ৬/২)
.
জেনে রাখা ভালো যে, কুরআন-সুন্নাহয় যাদেরকে কাফের-মুশরি|ক বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে তাদেরকে কাফের বলা অপরিহার্য। যেমন; ফেরাউন, হামান, কারুন, নমরুদ,আবু জাহল, আবু তালিব,উতবা বিন রবিয়া, শাইবা বিন রবিয়া ইত্যাদি প্রমুখকে। তাদেরকে কাফির ফতোয়া দেওয়ার দলিল হচ্ছে তারা কুফরের অবস্থায় মারা গিয়েছে।অনুরূপভাবে কুরআন হাদীসে আমভাবে যে বিষয়গুলো কুফরি বলে উল্লেখ রয়েছে সেগুলোতে লিপ্ত হলে তাদেরকে অনির্দিষ্ট করে কাফের বলা যাবে। যেমন: ইচ্ছেকৃত সালাত ত্যাগ করা,বিশুদ্ধ হাদিস অস্বীকারকারী কাফের ইত্যাদি। এক্ষেত্রে কোন শর্তাবলির প্রয়োজন নেই। এছাড়াও যারা নিজেকে মুসলিম দাবি করে আক্বীদাগত কোন বিষয় জেনে বুঝে প্রকাশ্যে অস্বীকার করলে সে কাফির হয়ে যাবে এবং তাওবাহ না করা পর্যন্ত তাকে কাফির বলা যাবে। যেমন: জেনে বুঝে প্রকাশ্যে আল্লাহর সাথে শিরক করা, প্রকাশ্যে কোন শরীয়তের কোন ফরয বিধান সালাত, সিয়াম, যাকাত, হজ্জ ইত্যাদি ফরযিয়তকে অস্বীকার করা, সুস্পষ্ট কোন হারামকে হালাল মনে করা, মহান আল্লাহ এবং রাসূল কিংবা তার দ্বীনকে গালি দেয়া। এই মর্মে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) ঐ সমস্ত ব্যক্তিদের কাফির বলেছেন, ‘যারা বলে যে, কুরআন পরিবর্তিত হয়েছে, অথবা যারা বলে কুরআনের কিছু অংশ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। (আস-সারিমূল মাসলুল, খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ৫৯০)। শাইখুল ইসলাম তিনি আরো বলেছেন, “নবীদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- যে ব্যক্তি কোন একজন নবীকে গালি দিবে ইমামদের সর্বসম্মতিক্রমে তাকে মুরতাদ হিসেবে হত্যা করা হবে। যেমনিভাবে কোন নবীকে অস্বীকার করলে ও তিনি যা নিয়ে এসেছেন সেটাকে অস্বীকার করলে যে কেউ মুরতাদ হয়ে যায়। কারণ কারো ঈমান পরিপূর্ণ হবে না যতক্ষণ না সে আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাগণের প্রতি, তাঁর গ্রন্থাবলীর প্রতি ও তাঁর রাসূলগণের প্রতি ঈমান না আনবে। (সাফাদিয়্যা, খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ২৬২, ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৫৯৬৬৪)
.
অনুরূপভাবে শাইখুল ইসলাম হুজ্জাতুল উম্মাহ ইমামু দারিল হিজরাহ আবু আব্দুল্লাহ মালিক বিন আনাস আল-আসবাহী আল-মাদানী (রাহিমাহুল্লাহ) [জন্ন: ৯৩ হি: মৃত: ১৭৯ হি.] এবং শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) রাফিযী- শী‘আদের সম্পর্কে বলেন, যারা আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা)-এর নির্দোষিতা ও পবিত্রতা সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করে অথবা তাঁকে গালিগালাজ করে আলেমদের ইজমা তথা ঐক্যমত অনুযায়ী তারা কাফির। (তাফসীরে কুরতুবী, খন্ড: ১২ পৃষ্ঠা: ২০৫; নববী শারহুল মুসলিম, খন্ড: ১৭ পৃষ্ঠা: ১১৭, ইমাম উসাইমীন আল-ক্বাওলুল মুফীদ ‘আলা কিতাবিত তাওহীদ’ দ্রষ্টব্য )। শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ (রাহিমাহুল্লাহ) শী‘আ-রাফেযীদের সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, ‘তাদের কুফরী
ইহু|দী-খ্রিষ্টা|নদের চেয়েও ভয়ানক। কারণ ইহু|দী-খ্রিষ্টা|নরা হলো সত্ত্বাগত কাফির। পক্ষান্তরে তারা (রাফেযীরা) হুল দ্বীন থেকে বের হয়ে যাওয়া মুরতাদ। আর মুরতাদ হওয়ার কুফর ঐকমত্যের ভিত্তিতে সত্ত্বাগত কুফরের চেয়েও গুরুতর। এ জন্যই তারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে (মুসলিম জনপদে গণহত্যা পরিচালনাকারী) তাতার সম্প্রদায়কে সহযোগিতা করছে। (ইবনে তাইমিয়া মাজমূঊ ফাতাওয়া, খন্ড: ৬ পৃষ্ঠা: ৪২১)।
.
পরিশেষে, প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে, কাফের একটি শারঈ পরিভাষা। তাই এর যথার্থ বিধি-বিধান জেনে প্রয়োগ করা অপরিহার্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি বর্তমানে একশ্রেণীর ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে অন্য মুসলিম সুস্পষ্ট দলিল-প্রমাণ বিহীন কাফের আখ্যাদানে খুব উৎসাহী দেখা যায়। অথচ এটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতে’র নীতি বিরোধী এবং পথভ্রষ্ট ভ্রান্ত ফের্কা খারেজীদের চরমপন্থী আক্বীদার অনুরূপ। সুতরাং কাউকে ‘তাকফীর’ করার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অবলম্বন করা আবশ্যক। আমরা মহান আল্লাহ তাআলার নিকট দুআ করি, তিনি যেন আমাদের প্রজ্ঞা এবং ন্যায়-নিষ্ঠার সাথে বিচার করার তাওফীক্ব দান করেন। তিনি আমাদের দূরদর্শিতা সম্পন্ন জ্ঞানী করেন এবং ঈমান ও আমলের উপর অটল রাখেন। আল্লাহ আমাদের সিরাতে মুস্তাক্বীম তথা সঠিক পথের উপর মৃত্যু দান করুন। আমীন (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
______________________
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: শাইখ আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলিল আল মাদানী। দাঈ জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার। সৌদি আরব।