টাকা দিয়ে যাকাতুল ফিতর আদায় করা যাবেনা কেন

টাকা দিয়ে যাকাতুল ফিতর আদায় করা যাবেনা কেন? এ বিষয়ে শরীয়তসম্মত ১০টি কারণ। সাথে রায়পন্থিদের জন্য কিছু এন্টিভেনাম।
▬▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: শরী‘আতের কোন বিধানের কারণ তালাশ করা অন্যায়। বরং নির্বিবাদে মেনে নেওয়ার মধ্যেই মানুষের কল্যাণ নিহিত রয়েছে, মুমিন তো তারাই যারা বলে আমরা শুনেছি ও মেনে নিয়েছি। (সূরা বাকারা: ২/২৮৫) যাইহোক টাকা দিয়ে ফিতরা আদায়ে দলিল খুঁজে না পেয়ে এবার যুক্তিতে নেমেছে রায়পন্থীগণ। কিন্তু আফসোস! একটা কথা মনে হয় সাময়িক সময়ের জন্য ভুলে গেছে যে, সত্য চিরদিনই সত্য। আর মিথ্যা চিরদিনই মিথ্যা। যাকাতুল ফিতর টাকা দিয়ে আদায় করা যাবেনা কেন? চলুন ১০ টি পয়েন্টে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
.
➤ (১). পৃথিবীর সকল ইমাম একমত; যে কোন ইবাদত কবুল হওয়ার মৌলিক শর্ত ২টি। যেমন:

(ক). ইবাদত ইখলাসের সাথে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই হতে হবে। (দেখুন; সূরা কাহফ: ১৮/১১০, সূরা ফুরকান: ২৫/২৩, সহীহ মুসলিম হা/২৯৮৫, তিরমিজি হা/৩১৫৪)
.
(খ). একমাত্র রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর পদ্ধতি মোতাবেক হতে হবে।অর্থাৎ কর্মটি অবশ্যই রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাত, রীতি ও তাঁর শিক্ষা অনুসারে পালিত না হলে যতই ইখলাস, আন্তরিকতা থাকুক না কেন, তা আল্লাহর কাছে কোন অবস্থাতেই গৃহীত বা কবুল হবে না। (দেখুন- সূরা আলে ইমরান; ৩/৩১, সূরা নিসা; ৪/৮০, সূরা হাশর; ৫৯/৭, সহীহ বুখারী হা/৭১৩৭, ৭২৮০, মুসলিম হা/১৮৩৫)
.
এবার উভয় মূলনীতির আলোকে একটি উদাহরণ দিচ্ছি: আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য কে তোমাদের মধ্যে আমলের দিক দিয়ে সর্বোত্তম। (সূরা আল-মুলক: ২)। উক্ত আয়াতের তাফসিরে আল্লামা ইমাম ইবনু কাছীর (৭০১-৭৭৪ হি.) বলেন, ‘(তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম আমলকরী কে?) তথা এখানে বলা হয়নি ‘সর্বাধিক আমলকারী’, বরং ‘সর্বোত্তম আমল’ বলা হয়েছে। আর আমল ততক্ষণ পর্যন্ত সর্বোত্তম হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তা আল্লাহর জন্য খালেছ বা একনিষ্ঠ না হবে এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর শরী‘আত মোতাবেক না হবে। অতঃপর কোন আমলের মধ্যে যদি উক্ত শর্তদ্বয়ের কোন একটি শর্ত না থাকে, তাহলে সে আমল বাতিল ও নষ্ট হিসাবে গণ্য হবে।’ (তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, ৪র্থ খণ্ড, পৃঃ ৩০৮)
.
প্রিয় পাঠক! ইবাদতের মধ্যে উক্ত শর্ত দু’টির কোন একটি বাদ পড়লে তা ইবাদত বলে গণ্য হবে না। প্রথম শর্তে চুল পরিমাণ ব্যতিক্রম হলে ঐ ইবাদত শিরকে পরিণত হতে পারে বা হবে। অনুরূপ দ্বিতীয় শর্তে কোন রকম ব্যতিক্রম হলে বিদ‘আতে পরিণত হবে। উল্লেখ্য যে, দ্বিতীয় শর্ত বা রাসূল (ﷺ)-এর অনুসরণে ইবাদত করার সময় কয়েকটি বিষয় অবশ্যই লক্ষ্যণীয়-
(১). ঐ ইবাদত রাসূল (ﷺ) কোন স্থানে করেছেন ।
(২). কোন সময়ে করেছেন।
(৩). কোন পদ্ধতিতে করেছেন ।
(৪). কী পরিমাণ করেছেন।
(৫). কোন কারণে করেছেন। কোন ইবাদত গ্রহণযোগ্য হতে হলে কমপক্ষে এই ৫ টি শর্তের প্রত্যেকটিই থাকতে হবে অন্যথা শর্ত পূরণ হবে না।
.
এবার খাদ্য দিয়ে ফিতরা আদায়ের একাধিক খাস দলিল থাকা এবং বিপক্ষে ভিন্ন দলিল না থাকা সত্বেও যারা মনগড়া কিয়াস করে টাকা দিয়ে ফিতরা আদায় জায়েজ বলেন তাদের এই ইবাদত কবুল হওয়ার নিশ্চয়তা কি? পাশাপাশি তারকার ন্যায় সুস্পষ্ট দলিল থাকতে সংশয় মূলক ইবাদত করার প্রয়োজন কি? যেখানে রাসূল (ﷺ) বলেছেন; যে কাজে মনে সন্দেহ-সংশয়ের উদ্রেক করে, সে কাজ পরিহার করে সংশয়-সন্দেহহীন কাজ করো। সত্য ও ন্যায়ের মধ্যে প্রশান্তি আছে, আর মিথ্যা ও অন্যায়ের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। (সুনানে নাসায়ী হা/৫৭১১, তিরমিযী হা/২৫১৮, সহীহ ইবনু হিব্বান হা/২৩৪৮, সহীহ আত তারগীব হা/১৭৩৭) সুতরাং সংশয়ে থাকবেন নাকি সুন্নাহর অনুসরণ করবেন সিদ্ধান্ত আপনাদের।
.
➤ (২). ইবাদতের ক্ষেত্রে শরীয়তের উসূল বা মূলনীতি হল, তা দলিলনির্ভর হতে হবে। সুতরাং, কারও জন্য সেই ইবাদত করা জায়েজ নয়, যেই ইবাদত প্রজ্ঞাবান শরিয়তপ্রণেতা রাসূল (ﷺ) থেকে সাব্যস্ত হয়নি। (ইমাম বিন বায মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড: ১৪; পৃষ্ঠা: ২০৮) আর শরিয়তপ্রণেতা কর্তৃক অর্থ দিয়ে ফিতরা আদায় করার বিষয়টি সাব্যস্ত হয়নি। তাছাড়া ইসলামে ইবাদত ও তার নিয়মাবলী আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ (ﷺ) কর্তৃক নির্ধারিত। এতে কোন অস্পষ্টতার চিহ্ন নেই। এর প্রতিটি বিধান মানবতার জন্য অনুসরণীয় ও অনুশীলনযোগ্য। সর্বশেষ নবী ও রাসূল মুহাম্মদ (ﷺ) তাঁর জীবনে যা সম্পূর্ণটাই বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে যা নির্দেশ দিয়েছেন এমন কোন জিনিসই আমি (বর্ণনা করতে) ছাড়িনি। আমি তাঁর হুকুম তোমাদেরকে অবশ্যই দিয়েছি। আর আমি এমন কোন জিনিস ছাড়িনি যা আল্লাহ তা‘আলা নিষেধ করেছেন। অথচ আমি তোমাদের নিষেধ করেনি। (সুনানুল বায়হাকী আল-কুবরা হা/১৩২২১, সিলসিলা সহীহাহ হা/১৮০) অনুরুপ মুহাম্মাদ ﷺ) বিদায় হজ্জের ভাষণে বিশ্ব মানবতার জন্য দু’টি বস্তু রেখে যান, যে দু’টি বস্তুকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলে কেউ কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। একটি কুরআন অপরটি হাদীস। (আল-মুসতাদরাকু আলাস সহীহাইন ৩১৮; সুনানুল বায়হাকী আল-কুবরা, ১০ তম খণ্ড, পৃ. ১১৪, হাদীস নং-২০১২৩, সনদ সহীহ)
.
উপরিউক্ত আলোচনায় শরী‘আত যে ‘দু’টি মানদণ্ড’-এর উপর ভিত্তিশীল, তা স্পষ্ট হয়েছে। আর রাসূল (ﷺ) পরিপূর্ণভাবে তার বিস্তারিত বিবরণ বর্ননা করেছেন। সুতরাং এখানে অন্য কোন ইমাম, বুযুর্গানে দ্বীন,আলিম, বক্তা,নেতা ইত্যাদির নতুন করে কিছু সংযোজন ও বিয়োজনের সুযোগ নেই। কেননা ইসলাম পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। তাই সালাত, যাকাত, সিয়াম, হজ্জ, দান-সাদাক্বাহ, কুরবানী, দাওয়াতী কাজ, যিকির-আযকার সহ অন্যান্য ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত ও রাসূল (ﷺ) প্রদর্শিত তথা পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসের নির্দেশনা ব্যতীত অন্য কোন পথ ও পদ্ধতিতে ইবাদত করা নিষিদ্ধ। কেননা এটা ইবাদতে তাওক্বীফী তথা কুরআন-সুন্নাহর অলংঘনীয় অর্থাৎ অনিবার্য দলীল, যা পরিবর্তন করার ক্ষমতা কারো নেই। এজন্য ইবাদতের ক্ষেত্রে উদ্ভাবিত সকল নতুন পথ ও পদ্ধতি এবং কার্যক্রম বিদ‘আত হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। (শাইখ সালিহ আল-ফাওযান আল-ফাওযান, আক্বীদাতুত তাওহীদ,পৃষ্ঠা;৫৮)। তাই ইবাদতের ব্যাপারে মৌলিক নীতিমালা হল দলীল বা প্রমাণ ছাড়া কোন ইবাদতই গৃহীত হবে না। আর শরীয়তের বিধান অনুযায়ী যাকাতুল ফিতর একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরজ/ওয়াজিব ইবাদাত, তা ইচ্ছাকৃত ভাবে যথাসময়ে আদায় না করলে গুনাহ হবে এবং বিলম্বে দান করলে সাধারণ দান হবে মর্মে হাদীস রয়েছে। এমন কি দুই প্রকার খাদ্য (যেমন: চাল, ডাল) দিয়ে এক ‘সা’ নির্ধারণ করা জায়েজ নয় বলে জমহুর আলেমগনের জোরালো ফাতওয়া রয়েছে। সুতরাং শরীয়তের এত সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকার পরেও বিনা দলিলে টাকা দিয়ে ফিতরা আদায় করা যাবে বলা হয় কোন ওহীর ভিত্তিতে?
.
➤ (৩). শরীয়তের হুকুম-আহকামের দলিল প্রদানের ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে—আল্লাহ’র কিতাব এবং রাসূলুল্লাহ এর (ﷺ) সুন্নাহ’য় যা এসেছে প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে তার অনুসরণ করা। ব্যাপকভাবে মুহাজির ও আনসারদের সকল সাহাবী যে মতাদর্শের ওপর ছিলেন তা অনুসরণ করা, আর বিশেষভাবে সুপথপ্রাপ্ত খালীফাহদের অনুসরণ করা। যেহেতু নাবী (ﷺ) এ ব্যাপারে অসিয়ত করে বলেছেন, “তোমরা অবশ্যই আমার সুন্নাত এবং আমার হেদায়াতপ্রাপ্ত খালীফাহগণের সুন্নাত অনুসরণ করবে।” (আবু দাঊদ হা/৪৬০৭; সনদ সহীহ)। তারা আল্লাহ’র কথা এবং রাসূলের কথার ওপর কোনো মানুষের কথাকে প্রাধান্য দেননি। একারণে তাদেরকে আহলুল কিতাবি ওয়াস সুন্নাহ বলা হয়। আল্লাহ’র কিতাব এবং রাসূলের সুন্নাহকে ধারণ করার পর তারা উম্মাতের ‘আলিমগণের ইজমা‘কে (মতৈক্য) ধারণ করে। তারা প্রথম উৎস দুটি তথা কিতাব ও সুন্নাহ’র পর এই তৃতীয় উৎসের (ইজমা) ওপর নির্ভর করে। আর মানুষের মধ্যে যে বিষয়ে ইখতিলাফ (মতভেদ) সৃষ্টি হয়, সে বিষয়কে তারা কিতাব ও সুন্নাহ’র কাছে সোপর্দ করে। যেহেতু মহান আল্লাহ বলেছেন, “যদি কোনো বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটে, তাহলে সেই বিষয়কে আল্লাহ এবং রাসূলের (নির্দেশের) দিকে ফিরিয়ে দাও, যদি তোমরা আল্লাহ এবং আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান এনে থাক; এটাই সবচেয়ে উত্তম পন্থা এবং সুন্দরতম মর্মকথা।” (সূরাহ নিসা: ৫৯)।
.
(উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) এর দিকে প্রত্যাবর্তন করার অর্থ হল, তাঁর কিতাবের দিকে প্রত্যাবর্তন করা। আর রাসূল (ﷺ) এর মৃত্যুর পর তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করার অর্থ হল তাঁর সুন্নাতের দিকে প্রত্যাবর্তন করা। আর এ বিষয়টিকে ঈমানের সাথে সম্পৃক্ত করে বলা হচ্ছে যে,إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِঅর্থাৎ, যদি তোমরা আল্লাহ্‌র প্রতি ঈমান রাখ। তথা দ্বন্দ্ব নিরসনকে কিতাবুলস্নাহ ও সুন্নাতে রাসূলের দিকে প্রত্যাবর্তন করাই হল প্রকৃত ঈমানের পরিচয়। সুতরাং এ থেকে বুঝা যায় যে, যদি কেউ দ্বন্দ্ব নিরসনে কিতাব ও সুন্নাহ ছাড়া অন্যের দিকে প্রত্যাবর্তন করে তাহলে সে ঈমানদার নয়)। তারা অর্থাৎ আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের অনুসারীরা আল্লাহ’র রাসূল (ﷺ) ছাড়া আর কারও নিকট (অনুসরণের) রশি বাঁধে না। তারা কোনো ব্যক্তির রায়ের ব্যাপারে পক্ষপাতিত্ব করে না, যতক্ষণ না সে কথা কিতাব ও সুন্নাহ’র সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। তারা এই বিশ্বাস পোষণ করে যে- মুজতাহিদ ভুল করে, আবার সঠিকও করে। তারা কেবলমাত্র তাকেই ইজতিহাদের অনুমোদন দেয়, যার মধ্যে—আলিমদের মতে—ইজতিহাদের সুবিদিত শর্তসমূহ একত্রিত হয়েছে। গ্রহণযোগ্য ইজতিহাদী মাসআলাহসমূহের ক্ষেত্রে তাদের (মধ্যে) কোনো বিরোধ নেই। (তথ্যসূত্র: ইমাম সালিহ আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ), মিন উসূলি ‘আক্বীদাতি আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত; পৃষ্ঠা: ১৭-৪১)
.
আমরা জানি, ইজমা-এর আভিধানিক অর্থ ঐকমত্য, সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত, দৃঢ় সংকল্প ইত্যাদি। পরিভাষায় ইমাম জারকাশী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, هو إتفاق مجتهدي هذه الأمة بعد النبي ﷺ على حكم شرعي ‘ইজমা হলো, রাসূল (ﷺ)-এর জীবদ্দশার পর শারঈ কোন হুকুমের বিষয়ে এ উম্মতের মুজতাহিদগণের ঐকমত্য।’ (আল-বাহরুল মুহীত্ব, ৬/৩৭৯ পৃ.) এখন প্রশ্ন হল; শরীয়তের হুকুম-আহকামের মধ্যে যাকাতুল ফিতর এটিও একটা শারঈ হুকুম। এই বিধানে দলিল প্রদানের ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের মূলনীতি অনুযায়ী যাকাতুল ফিতর টাকা দিয়ে আদায় করা যায়! এই মূলনীতি না কুরআনে আছে, না রাসূল (ﷺ) এর হাদীসে আছে,না সাহাবীদের আমলে আছে, না ইমামগনের মধ্যে ইজমা হয়েছে, কোনটিই নেই। তাহলে যারা শরীয়তের খাস দলিল থাকার পরেও মাজহাব টিকানোর জন্য এক ইমামের অন্ধ তাকলীদ করে গ্রহণযোগ্য কারণ ছাড়া সরাসরি টাকা দিয়ে ফিতরা দেওয়া জায়েজ মনে করেন। তারা নিজেদেরকে কিসের ভিত্তিতে আহলে সুন্নাহর অনুসারী বলে দাবি করেন? জাতি জানতে চায়।
.
➤ (৪). রাসূল (ﷺ)-এর যুগে মুদ্রার প্রচলন ছিল এবং অভাবী ব্যক্তির বিদ্যমানতাও ছিল। তখন স্বাভাবিক ভাবেই অভাবী ব্যক্তিরা অর্থের মুখাপেক্ষী ছিল। এতৎসত্ত্বেও রাসূল (ﷺ) এর যুগে অর্থ দিয়ে ফিতরা আদায় করা হয়নি। আর এটি শরিয়তের একটি সুবিদিত মূলনীতি যে, প্রয়োজনের সময় আলোচনাকে বিলম্ব করা না-জায়েজ। (لا يجوز تأخير البيان عن وقت الحاجة)। অর্থাৎ, প্রয়োজনের সময় হুকুম বর্ণনা করতে দেরি করা জায়েজ নয়। সুতরাং রাসূল (ﷺ) যেহেতু অর্থ দিয়ে ফিতরা আদায় করার বৈধতা বর্ণনা করেননি, সেহেতু অর্থ দিয়ে তা আদায় করা শরিয়তসম্মত হবে না।
.
ইউটিউবে অনেক মাজহাবী বক্তা বলেন; রাসূল (ﷺ)-এর সময়ে দিনার দিরহামের চেয়ে ছোট মুদ্রা ছিলনা। তাই ছােট জিনিসের জন্য দাম হিসাবে সেই ত্বয়াম (খাদ্য) ব্যবহার করা হতো। সুতরাং টাকা দিয়ে ফিতরা দেওয়া জায়েজ। তাদের এই বক্তব্য ভিত্তিহীন। কারণ রাসূল (ﷺ)-এর সময় শুধু দিনার দিরহামই নয়, অন্য মুদ্রাও ছিল প্রমান। আবু হুরাইরাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রসূলুল্লাহ(সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা এমন কোনাে নাবী প্রেরণ করেননি, যিনি ছাগল না চরিয়েছেন। তখন তাঁর সাহাবীগণ বলেন, আপনিও? তিনি বলেন, হ্যা আমি কয়েক কীরাতের (মুদ্রা) বিনিময়ে মক্কাবাসীদের ছাগল চরাতাম। (সহীহ বুখারী হা/২২৬২, ইবনু মাজাহ হা/ ২১৪৯)। উক্ত হাদীসে ক্বীরাত্ব বলতে যা দীনার অথবা দিরহাম-এর অংশ। অর্থাৎ এক কীরাত ছিল এক ‘দানেকের (মুদ্রা) অর্ধেক, এবং এক দিরহামের ১২ ভাগের এক ভাগ । আর এক দীনারের ২৪ ভাগের এক ভাগ। মিশকাতুল মাসাবীহ’র বিখ্যাত ভাষ্যগ্রন্থ মির‘আতুল মাফাতীহ’র সম্মানিত মুসান্নিফ ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, আল-আল্লামাহ, ইমাম উবাইদুল্লাহ বিন আব্দুস সালাম মুবারকপুরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, قراريط শব্দটি قيراط এর বহুবচন, আর তা দানিকের অর্ধেক, আর دانق (দানিক) দিরহামের এক ৬ষ্ঠা অংশ। (ফাতহুল বারী ৪র্থ খন্ড, হা/২২৬২ মিশকাতুল মাসাবীহ হা/২৯৮৩)। মুদ্রা “দানে” এটা ছিল এক দিরহামের ৬ ভাগের এক ভাগ (১/৬)। (বিস্তারিত দেখুন- মুসান্নাফ আব্দির রায্যাক ১০৪১১)
.
অন্ধ অনুসরণকারী মাজহাবী মুকাল্লিদদের বলছি সেই যুগে যদি দিনার দিরহাম এর চেয়ে ছোট মুদ্রা না থাকতো তাহলে আপনাদের দাবী অনুযায়ী সাহাবীরা কিভাবে মুদ্রা দিয়ে ফিতরা আদায় করতো? কারণ আপনাদের যুক্তিতে দিনার-দিরহামের যা মূল্য তার চেয়ে নববী যুগে অনেকের ফিতরার মূল্য কম হওয়া স্বাভাবিক। সুতরাং আপনাদের যুক্তি ধরে নিলে এটা প্রমাণ করে যে; হয় মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ থেকে আপনাদের উল্লেখ করা আসার অর্থাৎ বর্ননাগুলো জাল-জয়ীফ, অথবা মুদ্রা দিয়ে ফিতরা আদায় নববী যুগে ছিলনা। অন্যথায় মেনে নিতে হবে: দিনার-দিরহাম ছাড়াও ক্রয়-বিক্রয় এবং পারিশ্রমিক এর জন্য অনেক ছোট মুদ্রা সে যুগেও প্রচলিত ছিল। এখন কোনটা মানবেন! সিদ্ধান্ত আপনাদের উপর ছেড়ে দিলাম।
.
➤ (৫). মহান আল্লাহ তাআলা কুরআনে যেখানে যেখানে ত্বআম বা এতআম শব্দ ব্যবহার করেছেন; সেখানে ত্বআম তথা খাদ্যই প্রদান করা ওয়াজিব। যেমন:
.
(ক). অতি বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা মানুষ রোজা রাখতে সমর্থ না হলে তার রােযার বিনিময়ে ফিদিয়াহ হিসেবে মিসকীনদের ত্ব‘আম (খাদ্যই) দেয়ার কথা বলা হয়েছে। (সূরা বাকারা: ১৮৪)।

(খ). কসম ভঙ্গকারীর কাফফারা হিসেবে মিসকীনদের কেও ত্ব’আম (খাদ্যই) দেয়ার কথা উল্লেখ হয়েছে। (সূরা মায়েদা: ৮৯)।

(গ). অনুরূপভাবে যাকাতুল ফিতরের ক্ষেত্রে ও ত্বআম (খাদ্য) শব্দ দিয়েই ফিতরা আদায়ের কথা বলা হয়েছে। উল্লেখিত জায়গায় কেউ যদি খাদ্যের বিনিময়ে ১০গুণ টাকাও প্রদান করে তাহলেও সেটা বৈধ হবে না। (ইমাম উসাইমীন মাজমু’ ফাতাওয়া ইবনে উসাইমীন, খন্ড: ১৯ পৃষ্ঠা: ১১৬)
.
সুতরাং, মহান আল্লাহ যেমন বৃদ্ধ ব্যক্তির জন্য সিয়ামের যে ফিদয়ার কথা বলেছেন তা খাবার সংশ্লিষ্ট। প্রতিদিন একজন মিসকিনকে খাওয়ানো। ঠিক তেমনি পূর্ণ সিয়ামের কাফফারা যদি খাবার হয়, তাহলে স্বাভাবিক ভাবে সিয়ামের মধ্যে হওয়া ভুল ত্রুটির কাফফারাও খাবার হবে। এরপরেও যদি ফকীর-মিসকিনের টাকার দরকার বলে মাজহাবীদের মন কাঁদে তাহলে বলব, টাকার জন্য তো আলাদা বিধান যাকাত বা সাধারণ দান-সাদকা আছেই। সেগুলো থেকে দিন। টাকার জন্য এগুলো থাকার পরেও টাকার অজুহাত দেখানো উদ্ভট অজুহাত বৈ কিছুই নয় কি?
.
➤ (৬). রাসূল ﷺ ফিতরা হিসেবে খাদ্যদ্রব্য দিতে বলেছেন। এ ব্যাপারে বর্ণিত বিশুদ্ধ হাদীসগুলোতে স্রেফ খাদ্য দ্রব্যের কথা এসেছে, খাদ্যমূল্য বা অর্থের কথা আসেনি। যেমন: রাসূল (ﷺ) এবং তার সাহাবীদের বক্তব্য থেকে যে হাদীস এসেছে সেখানে তুমাতুল লিল মাসাকিন অর্থাৎ মিসকিনের জন্য খাদ্য বলেছেন, সাদাকাতুল লিল মাসাকিন অর্থাৎ মিসকিনদের জন্য সাদাকা বলেননি। তাহলে আপনি টাকা দিয়ে দেওয়ার কথা বলেন কিভাবে? এখন যদি যুক্তি দিয়ে বলেন ফকীর খাদ্য নিতে চায়না, ওজন হয়, কষ্ট হয়। আমরা বলবো এই সমস্যা তখনি তৈরি হয়েছে যখন আমরা ভেবেছি ফিতরা ফকির-মিসকিন নিতে আসবে। অথচ শরীয়তের বিধান হলো এটা অর্থাৎ যাকাতুল ফিতর আমাদের পৌঁছে দিতে হবে। কারন ফকির মিসকিনদের জন্য ফিতরা খাওয়া ফরজ নয় বরং আমাদের দেওয়া ফরজ। আমরা যদি তাদের বাড়ীতে ফিতরার খাদ্য পৌঁছে দিয়ে আসি তারা কি নিবেনা? সুতরাং নিজেরা সমস্যা তৈরী করব। আবার সেই সমস্যার অজুহাতে রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাতকে বাতিল করব কি অদ্ভুত! (আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাজ্জাক হাফি:)
.
➤ (৬). ফিতরা আদায়ের জন্য যে পরিমাপ খাদ্যের কথা আল্লাহর রাসূল বলেছেন তা ‘সা’। আর টাকার পরিমাণ ‘সা’ হয়না। খাদ্যদ্রব্যের ‘সা’ হয়। সুতরাং শরীয়তের উদ্দেশ্য টাকা নয় খাদ্যদ্রব্য। তাছাড়া “কার উপর ফিতরা আদায় করা ফরয” এই বিষয়েও আহালুল আলেমগণ টাকার নিসাব বলেননি। বরং বলেছেন যার বাড়ীতে একদিনের অতিরিক্ত খাবার আছে তার উপর যাকাতুল ফিতর ফরয। কেউ আবার যুক্তি দিয়ে বলেছেন, সেই যুগে টাকার চেয়ে খাদ্য দ্রব্য দিয়েই বেচাকেনা বেশী হত। রাসূলের এক ‘সা’ দ্বারা খাবার নয় বরং সমপরিমাণ মূল্য উদ্দেশ্য। এবং দলীল হিসেবে মুয়াবিয়া (রাঃ)-এর ইজতিহাদকে পেশ করেন। তিনি গমের মূল্য বেশি দেখে অর্ধ ‘সা’ গম নির্ধারণ করেছিলেন। আমরা তাদের উদেশ্যে বলবো সেটি মুয়াবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর ব্যক্তিগত ইজতিহাদ। তাছাড়া তার এর এই ইজতিহাদ নিয়ে সেই যুগ থেকে সমালোচনা-পর্যালোচনা চলে আসছে। যেমন- আবু সাঈদ খুদরি রাযিয়াল্লাহু আনহুর থেকে হাদীস।
.
আমি সেই দিকে না গিয়ে জাস্ট একটা দিকে ইঙ্গিত করব। সেটা হচ্ছে যদি রাসূলের উদ্দেশ্য ‘সা’ দ্বারা খাদ্য না হয়ে সমপরিমাণ মূল্য হত, তাহলে তিনি হাদীসে যতগুলো খাদ্য দ্রব্যের নাম বলেছেন সবগুলোর ক্ষেত্রে এক ‘সা’ বলতেন না। বরং মূল্য হিসাব করে যেটাতে যত পরিমাণ হয় তত বলতেন। এখন কেউ যদি বলেন রাসূলের মাথায় যে মূল্য ছিল তখন হয়তো সবগুলোর সেই মূ্ল্যে এক ‘সা‘ ছিল। তাহলে বলব- এটা সত্যি বিবেকবিরোধী কথা। কারণ সবগুলোই একই মূল্যের ছিল এটা কল্পনা করাও অসম্ভব। কিছু না কিছু হলেও কম বেশী ছিল।তার পরেও যদি বলেন; সবগুলো খাদ্যের একই মূল্য ছিল। তাহলে বলব- আপনার বক্তব্যের পক্ষে দলিল উপস্থাপন করুন।কারন আল্লাহ বলেছেন, তোমাদের প্রমাণ নিয়ে এসো যদি তোমরা সত্যবাদী হও।’(সূরা নমল,২৭/৬৪) আশা করি কেয়ামত পর্যন্ত পারবেন না ইনশাআল্লাহ । সুতরাং হাদীসে সবগুলো এক ‘সা’ বলা প্রমাণ করে রাসূলের উদ্দেশ্য সমপরিমাণ মূল্য নয়; বরং এক ‘সা’ পরিমাণ খাদ্য দ্রব্য। (নোট: কিছু কথা আমার ভাই আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাজ্জাক (হাফি:) থেকে নেওয়া)
.
➤ (৭). যারা যাকাতুল ফিতর খাদ্যের পরিবর্তে টাকায় প্রদানের স্বপক্ষে, তাদের উদ্দেশ্য কি তা আদৌ বোধগম্য নয়। কেননা সুস্পষ্ট দলিলের ভিত্তিতে যাকাতুল ফিতর হল ফরয।অপরদিকে জমহুর ওলামাদের বিশুদ্ধ মতে কুরবানী হল সুন্নাত। হানাফী মাযহাবের ইমাম আবু ইউসুফ, মালিকী মাযহাবের ইমাম আশহাব এবং অধিকাংশ আলিমের মতে, তা সুন্নাতে মুওয়াক্কাদা। (ফাৎহুল বারী শারহু সহীহিল বুখারী, ১০ম খণ্ড, পৃ.৩)। কারণবশত কোন ব্যক্তি যদি কোন বছর কুরবানী না করে তাহলে তার গুনাহ হবেনা। কেননা ইতিহাস থেকে জানা যায় আবু বকর সিদ্দীক্ব, ওমর ফারূক্ব, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) প্রমুখ সাহাবীগণ কখনো কখনো কুরবানী করতেন না। (বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা, হা/১৯৫০৬-৭, সনদ সহীহ; ইরওয়াউল গালীল, হা/১১৩৯, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৩৫৪, মির‘আত ৫/৭২-৭৩ উসামীমীন মাজমূ‘ ফাতাওয়া খন্ড: ২৫ পৃষ্ঠা: ১০)
.
অথচ সকল ইমাম একমত ইচ্ছাকৃত যাকাতুল ফিতর আদায় না করলে অথবা যথাসময়ে আদায় না করলে কবিরা গুনাহ হবে এবং এর জন্য তাকে আল্লাহর কাছে তওবা করতে হবে। এখন যদি ফরজ বিধান যাকাতুল ফিতর খাদ্যের পরিবর্তে টাকা দিয়ে পরিবর্তন অথবা পরিমার্জন করা জায়েয হয়, তাহলে সুন্নাত বিধান কুরবানীর পরিবর্তে তার মূল্য প্রদানে বাধা কোথায়? নিয়ত তো বেশ সহীহ। দেখি- একবছর কুরবানী না করে সেই টাকা দান-সদকা করা জায়েজ চার মাজহাবের কোন ইমাম কি এমন ফাতওয়া দিয়েছে? যদি বলেন না দেয়নি; তাহলে বলবো যেহেতু কুরবানীর সমমূল্য সদকা করা জায়েয নয়। সুতরাং,ফিতরার মূল্য প্রদানও জায়েয নয়। এ সম্পর্কে ইবনে তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, ‘যদি কেউ কুরবানীর বদলে তার মূল্য সাদাক্বা করতে চান, তবে তিনি মুহাম্মাদী শরী‘আতের প্রকাশ্য বিরোধিতা করবেন।’ (মাজমূ‘আ ফাতওয়া ইবনে তায়মিয়াহ ২৬/৩০৪; মুগনী ১১/৯৪-৯৫ পৃঃ) সুতরাং আপনারা ফরজ বিধান ফিতরাকে পরিবর্তন পরিমার্জন করে মুহাম্মাদী শরী‘আতের স্পষ্ট বিরোধিতা করেছেন কিনা আর একবার ভেবে দেখার অনুরোধ রইল।
.
➤ (৮). কিছু অন্ধ মুকাল্লিদ (হানাফি) টাকা দিয়ে ফিতরা আদায়ের দলিল খুঁজে না পেয়ে মাজহাব টিকানোর জন্য, নতুন করে টাকা দিয়ে ফিতরা আদায় করা জায়েজ প্রমানে আরেকটি মনগড়া যুক্তি দেয়। তারা বলে হাদীসে ৫ টি খাদ্যের কথা বলা হয়েছে। এর বাহিরে অন্য খাদ্য বা দেশের প্রধান খাদ্য দিয়ে ফিতরা আদায় করা সুন্নাত! পারলে হাদীস দিয়ে প্রমাণ করুন। আমরা অন্ধ মুকাল্লিদদের উদ্দেশ্যে বলবো- দেশের প্রধান খাদ্য দিয়ে ফিতরা আদায় করা সুন্নাত এর মূল নাস যেমন পবিত্র কুরআনে আছে ঠিক তেমনি হাদীসেও আছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যাদের জন্য সিয়াম রাখা কষ্টকর হবে, তাদের কর্তব্য হলো এর পরিবর্তে ফিদিয়া স্বরূপ একজন মিসকীনকে খাদ্য দ্রব্য প্রদান করা। (সূরা আল-বাক্বারাহ; ১৮৪)। উক্ত আয়াতে স্পষ্টভাবে খাদ্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এখন কোন ধরনের খাদ্য সেটা যেমন মহান আল্লাহ নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করেননি; তেমনি রাসূল (ﷺ) নিজেও না। এর পিছনে হিকমা হল পৃথিবীর সকল দেশের প্রধান খাদ্য একরকম নয়। শরীয়ত যদি নিদিষ্ট খাদ্য বাধ্যতামূলক করে দিত তাহলে আদম সন্তানের জন্য সেটা পালন করা কষ্টসাধ্য হয়ে যেত। আল্লাহ এবং তার রাসূল কঠোরতা চাননি সহজ চেয়েছেন এজন্য রাসূল ﷺ বলেছেন,তোমরা সহজ কর, কঠিন করো না এবং (লোকদেরকে) সুসংবাদ দাও। তাদের মধ্যে ঘৃণা সৃষ্টি করো না।’’(সহীহ বুখারি ৬৯, ৬১২৫) এজন্য নবী (ﷺ)-এর একদল সাহাবী এই মর্মে ফাতওয়া দিয়েছেন, যাঁদের মাঝে ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) ও রয়েছেন। সূরা আল-বাক্বারাহ; ১৮৪ আয়াত নাজিল হলে তারা (সাহাবীরা) বলেছেন অক্ষম ব্যক্তির পক্ষ থেকে প্রতিটি সিয়ামের বদলে একজন মিসকীনকে অর্ধ সা বা দেড় (১.৫) কেজি খাবার দিতে হবে। (স্থানীয় খাবার হিসাবে)। (সূরা আল-বাক্বারাহ: ১৮৩-১৮৪; সহীহ বুখারী, হা/৪৫০৫; নাসাঈ, হা/২৩১৭ মাজমূঊ ফাতাওয়া লিইবনি বিন বায, ১৫/২০৪ পৃ.)।
.
এখন যদি বলেন এটা ফিদিয়ার কথা, যাকাতুল ফিতরের নয়। তাহলে আমার প্রশ্ন হল, দেশের প্রধান খাদ্য দিয়ে ফিতরা দিলে কি সুন্নাহ অনুসরণ হবেনা? হাদীসে কি শুধু খেজুর, যব, কিসমিসের কথা আছে? মুকাল্লিদরা কি এই হাদীসগুলো পড়ে নি? যেখানে কোন নাম মেনশন না করে শুধু ( طعام) অর্থাৎ শুধু খাদ্যের কথা রয়েছে। রাসূল (ﷺ) বলেন, أَدُّوْا صَاعًا مِنْ طَعَامٍ فِي الْفِطْرِ ‘তোমরা সাদাক্বাতুল ফিৎর আদায় কর এক ‘সা‘ খাদ্যদ্রব্য দ্বারা। (সহীহুল জামে‘ হা/২৪২; সিলসিলা সহীহাহ হা/১১৭৯)। ইবনু আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্নিত, তিনি বলেন, فَرَضَ رَسُولُ اللهِ (ﷺ) زَكَاةَ الفِطرِ طُهرَةً لِلصَّائِمِ مِنَ اللَّغوِ وَالرَّفَثِ، وَطُعمَةً لِلمَسَاكِينِ. “আল্লাহ’র রাসূল (ﷺ) রোজা অবস্থায় কৃত অনর্থক কথাবার্তা ও অশালীন আচরণ থেকে রোজাদারকে পরিশুদ্ধকারীস্বরূপ এবং মিসকীনদের খাদ্যস্বরূপ ফিতরাকে ফরজ করেছেন। (আবূ দাঊদ, হা/১৬০৯; ইবনু মাজাহ, হা/১৮২৭)। অপর বর্ননায় আবু রাজা (রহঃ) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, আমি ইবন আব্বাস (রাঃ)–কে তোমাদের মিম্বার অর্থাৎ বসবার মিম্বারে দাঁড়িয়ে খুৎবা দানরত অবস্থায় বলতে শুনেছি যে, সাদাকায়ে ফিতরের পরিমান হলো এক “সা” করে খাদ্য দ্রব্য। (সুনানে আন-নাসায়ী হা/২৫১০)।
.
উপরোক্ত তিন হাদীসে তুমাতুল লিল মাসাকিন অর্থাৎ মিসকিনের জন্য খাদ্য এসেছে, নির্দিষ্ট কোন খাদ্যের নাম আসেনি। আর রাসূল ﷺ নিজেও এই পাঁচটি খাদ্য দিয়ে ফিতরা দেওয়া বাধ্যতামূলক করেন নি। তাছাড়া চার মাজহাবের কোনো ইমাম কি এই ফাতওয়া দিয়েছেন যে,হাদীসে বর্নিত এই পাঁচটি খাদ্য ছাড়া অন্য খাদ্য দিয়ে ফিতরা দেওয়া জায়েজ নয়? দেশের প্রধান খাদ্য দিয়ে ফিতরা আদায় সুন্নাহ মর্মে আর একটি দলিল দেখুন; আবু সা‘ঈদ খুদরী (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, كُنَّا نُخرِجُ فِي عَهدِ رَسُولِ اللهِ ﷺ يَومَ الفِطرِ صَاعًا مِن طَعَامٍ. وَقَالَ أبُو سَعيدٍ: وَكَانَ طَعَامُنَا الشَّعِيرُ وَالزَّبِيبُ وَالأقِطُ وَالتَّمرُ. “আমরা আল্লাহ’র রাসূল (ﷺ)-এর যুগে ঈদের দিন এক সা‘ পরিমাণ খাদ্য ফিতরা হিসেবে আদায় করতাম। আবু সা‘ঈদ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, তখন ‘‘আমাদের খাদ্যদ্রব্য ছিল: যব, কিসমিস, পনির ও খেজুর’।” (সহীহ বুখারী, হা/১৫১০)। এই হাদীসে সাহাবীর শেষের কথার মৌলিক বা সরল অর্থ হল যব, কিসমিস, পনির ও খেজুর ছিল তাদের প্রধান খাদ্য। ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম (রহঃ) ‘ইলামুল মুওয়াক্কিয়ীন’ গ্রন্থে বলেন: “মদিনাতে এগুলো ছিল তাদের প্রধান খাদ্য। পক্ষান্তরে, কোনো দেশের কিংবা এলাকার প্রধান খাদ্য যদি অন্য কিছু হয় তাহলে তাদের উপর তাদের খাদ্য দিয়ে ফিতরা আদায় করা ফরয। (মুওয়াক্কিয়ীন’ ৩/১২)।
.
উপরোক্ত হাদীসগুলোর উপর আমল করে যদি কাউকে বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য চাউল দিয়ে ফিতরা দিতে বলা হয়, সেটাও সুন্নাহ হবে ইনশাআল্লাহ। কেননা হাদীসে বর্নিত শব্দ طعام অর্থ খাদ্য আর আমরা চাউল কে খাদ্য মনে করি। আপনারা যদি ভিন্ন কিছুকে যেমন: ‘সা’ বা টাকা অথবা শুধুমাত্র ৫ টি খাদ্যকেই খাদ্য মনে করেন তাহলে সেটা আপনাদের বুঝের সমস্যা,আমাদের নয়। সূতরাং নিজেদের সমস্যা অন্যের উপর চাপানো গর্হিত কাজ। প্রচলিত আইনেও দণ্ডনীয় অপরাধ। তাই অনুরোধ রইল আগে নিজেদের বুঝ সংশোধন করুন তারপর বক্তব্য দিতে আসুন। অকী‘ (রহঃ) বলেন, যে ব্যক্তি হাদীস যেভাবে এসেছে সেভাবে অন্বেষণ করে, তাহ’লে জানবে সে সুন্নাতের অনুসারী। আর যে ব্যক্তি হাদীছ অন্বেষণ করবে তার রায়কে (মতকে) শক্তিশালী করার জন্য তাহ’লে জানবে সে বিদ‘আতী। (আল-হারুবী, যাম্মুল কালাম ওয়া আহলিহি, ২/২৬৯-৭০) সাবধান! হে রায়পন্থীরা।
.
➤ (৯). হানাফীগণ ফিতরায় খাদ্যদ্রব্যের বদলে মূল্য প্রদানের দলিল একটি কিয়াসের মাধ্যমে উল্লেখ করেছেন তা হল: উটের যাকাতে জাযয়া ও মুসান্নাহর ক্ষেত্রে দুটি ছাগল গ্রহণ করা। যদি তা নির্দিষ্ট প্রাপ্য হতে কম হয় তাহলে এর সাথে দুটি ছাগল প্রদান করবে। আর ছাগল না পেলে বিশটি দিরহাম তার সাথে প্রদান করবে। কিন্তু এখানে উটের বাচ্চার পরিবর্তে শুধু ছাগল বা শুধু দিরহাম প্রদান করতে হাদীসে বলা হয়নি।(হাদীসটি দেখুন সহীহ বুখারী হা/১৪৫৩, মিশকাত হা/১৭৯৬)। আল্লামা শানকিতি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, যাকাত হচ্ছে ব্যাপক, যাতে মাল ও মুদ্রা উভয়টিই প্রযোজ্য হয়ে থাকে; আর ফিতরা হচ্ছে নির্দিষ্ট একটি বস্তু, আর তা হলাে শুধুমাত্র ঈদের দিন দরিদ্র অসহায়দের ভক্ষণের ব্যবস্থা; সেহেতু এটাকে যাকাতের সাথে কিয়াস বা তুলনা করা ঠিক নয়।
.
অতএব আমরা বলবো যাকাতুল ফিতর টাকা দিয়ে আদায় করা যাবে এটা তাঁদের ইজতিহাদ ও গবেষণামূলক ফাতওয়া। আর ইজতিহাদগত ফাতওয়া ভুল ও সঠিক উভয়ই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পক্ষান্তরে খাদ্য দ্বারা আদায় করা হলে ভুল হওয়ার আশংকা থাকে না। তাছাড়া ফিকহের একটি উসূল বা মূলনীতি হচ্ছে যে- কোনো মাসআলায় যদি ইখতিলাফ ছাড়া আমল করা সম্ভব হয়, তাহলে তাকওয়ার দাবি ও সতর্কতা হচ্ছে ইখতিলাফ মুক্ত হয়ে আমল করা।

আর কেবল খাদ্য দ্বারা আদায় করলেই ইখতিলাফ থেকে মুক্ত থাকার সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি রায়পন্থীদের মনগড়া ফাতওয়ার জন্য খাদ্য দ্বারা ফিতরা আদায় করার সুন্নাতটি আমাদের সমাজ থেকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এমন হাজারো মানুষ রয়েছে যারা জানেনা খাদ্য দিয়ে ফিতরা দেওয়া ওয়াজিব। তাই খাদ্য দ্বারা ফিতরা আদায় করে মৃত সুন্নাত প্রতিষ্ঠা করা ঈমান ও সময়ের দাবি। পাশাপাশি উম্মতের পতন অবস্থায় কোন সুন্নাতকে দৃঢ়ভাবে ধারণকারী ব্যক্তি পঞ্চাশ জন শহীদের সমান নেকী পাবে বলে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। যেমন রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘তোমাদের পরে এমন একটা কঠিন সময় আসছে, যখন কোন সুন্নাতকে দৃঢ়ভাবে ধারণকারী ব্যক্তি তোমাদের মধ্যকার পঞ্চাশ জন শহীদের সমান নেকী পাবে’ (ত্বাবারাণী কাবীর হা/১০২৪০;সহীহুল জামে হা/২২৩৪)
.
অপরদিকে যারা টাকা দিয়ে ফিতরা আদায় করাকে উমার বিন আবদুল আযীয, আবু ইসহাক, আতা, হাসান বসরী প্রমুখ তাবিঈনদের আমল মনে করে বৈধ বলে স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন,তাদের প্রতিউত্তর নিম্নরূপ: তাবিঈনদের আমল দলিল হওয়ার মূলনীতি হল; সরাসরি রাসূল (ﷺ) ও সাহাবায়ে কেরাম থেকে সুস্পষ্ট কোন আমল না পাওয়ার প্রেক্ষিতেই কেবলমাত্র তাবিঈনদের আমল দলিল হতে পারে, অন্যথায় নয়। তাই ফিতরার বস্তুর ক্ষেত্রে রাসূল ও সাহাবায়ে কেরাম কর্তৃক দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট ও বিশুদ্ধ একাধিক হাদীস বিদ্যমান। সুতরাং, এখানে তাবিঈনদের আমল কিভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে? আল্লামা শানকিতি বলেন, মূল্য দ্বারা ফিতরা আদায় করলে ইসলামী দুটি মূলনীতির বিরোধী হয়ে যায়। যথা:

(১). রাসূল (ﷺ) যখন বিভিন্ন প্রকার খাদ্য বস্তু দ্বারা ফিতরা প্রদানের কথা বলেছেন, তখন উহার মূল্যের কথা বলেননি। যদি বৈধ হত তাহলে অবশ্যই বলতেন, যেরূপ উটের যাকাতের ক্ষেত্রে তার বিকল্প হিসাবে মূল্যের কথা হাদীসে বলেছেন।

(২). শরীয়তের একটি সাধারণ মূলনীতি হল- কোন আসল বস্তু উপস্থিত থাকলে শাখা বস্তুর দিকে উহা স্থানান্তর হয় না; হ্যা যদি আসল না থাকে তখন শাখা তার স্থান দখল করে; মূল বস্তুর উপস্থিতিতে শাখা আসলের স্থান দখল করার শামিল, আর তা অবৈধ। তদ্রুপ ফিতরার ক্ষেত্রে শাখা হচ্ছে মূল্য (টাকা-পয়সা) আর আসল বস্তু হচ্ছে খাদ্য, ঐ আসল পরিত্যাগ করে শাখা প্রাধান্য দেয়া যেরূপ অবৈধ, খাদ্য দ্বারা ফিতরা আদায় না করে মূল্য দিয়ে আদায় করাও তদ্রুপ অবৈধ। অনেক মনীষীগণ বলেছেন যে, হানাফী গণ হজ্জের সময় মিনাতে জানোয়ার কুরবানী করা কষ্ট ভেবে উহার মূল্য দান করা বৈধ মনে করেন না; কারণ কুরবানী একটা ইবাদাত; তাহলে এক্ষেত্রে কেন মূল্য বৈধ করে থাকেন? অথচ এটাও একটি ইবাদাত। অতএব, ফিতরা আদায়ের ক্ষেত্রে খাদ্যবস্তুর পরিবর্তে তার মূল্য প্রদান করা সরাসরি রাসূল (ﷺ)-এর উক্তি ও কর্মের বিরোধিতা করা; আর তিনি (ﷺ) বলেছেন, যে ব্যক্তি এমন কাজ করলো যার প্রতি আমার উক্তি নেই তা পরিত্যাজ্য। (সহীহ মুসলিম হা/১৭১৮)
.
কতই না চমৎকার জবাব দিয়েছেন ইমামু আহলিস সুন্নাহ আবূ ‘আব্দুল্লাহ আহমাদ বিন মুহাম্মাদ বিন হাম্বাল আশ-শাইবানী আল-বাগদাদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ২৪১ হি.] তিনি বলেছেন,ফিতরার খাদ্যমূল্য প্রদান করবে না।” তখন তাঁকে বলা হল, “তারা বলে, ‘উমার বিন ‘আব্দুল ‘আযীয খাদ্যমূল্য গ্রহণ করতেন।” তখন তিনি (ইমাম আহমাদ) বললেন, “তারা আল্লাহ’র রাসূলের ﷺ কথা পরিত্যাগ করছে, আর বলছে, অমুক এটা বলেছেন?! ইবনু ‘উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) বলেছেন, “রাসূলুল্লাহ ﷺ (ফিতরা) ফরজ করেছেন।” আর আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা আল্লাহ’র আনুগত্য করো এবং রাসূলের আনুগত্য করো।”(সূরা নিসা:৪/৫৯) অথচ একদল লোক সুন্নাহকে প্রত্যাখ্যান করে বলছে, অমুক বলেছেন, আর তমুক বলেছেন! (ইমাম ইবনু কুদামাহ (রাহিমাহুল্লাহ), আল-মুগনী; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ২৯৫ অনুবাদ আব্দুল্লাহ মৃধা হাফিঃ)
.
➤ (১০). সর্বশেষ এতগুলো মূলনীতি উল্লেখ করার পর, তবুও যদি মাজহাবী ভাইয়েরা বলেন টাকার মধ্যেই দরিদ্র ব্যক্তির উপকার রয়েছে। তাহলে মাইন্ড না করলে একটু শক্ত কথা বলবো। মহান আল্লাহ এবং তার রাসূল (ﷺ) এবং খোলাফায়ে রাশেদীন ও তিন ইমাম বুঝলেন না কিসের মধ্যে দরিদ্র ব্যক্তির কল্যাণ রয়েছে। আর আপনারা এসেছেন বড়ই কল্যাণকামী হতে! তাও আবার ১১৫ টাকা ফিতরা নির্ধারণ করে? জেনে রাখুন; টাকা দিয়ে ফিতরা আদায় করলে উম্মতের জন্য কিছুটা হলেও সহজ হয়। এ কথা বলা, উম্মতের সবচেয়ে কল্যাণকামী মানুষ প্রিয় নবী (ﷺ) থেকে একলাইন বেশি বুঝা ও আগ বাড়িয়ে সিদ্ধান্ত ও মতামত দেওয়ার নামান্তর। যা মহান আল্লাহ সরাসরি নিষেধ করেছেন। একটি বাস্তব উদহারণ (দেখুন: সূরা হুজুরাতের আয়াত নং ১)। মূলত নবী (ﷺ) আল্লাহর নির্দেশ ব্যতিরেকে এই হুকুম দেননি। টাকার মধ্যেই যদি কল্যাণ বেশি থাকতো, তাহলে আল্লাহ ওহির মারফতে তিনি অবশ্যই সেই নির্দেশ দিতেন- যে মহান আল্লাহ মানুষের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে অবগত। সূরা নমল: ২৭/৬৫,৭৭; সূরা আনআম: ৬/৫৯) অতএব পরিষ্কার ভাবে জেনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সকল দ্বীনের উপর বিজয়ী করার জন্য সত্য দ্বীন ও হেদায়াত সহকারে প্রেরণ করেছেন। আর এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার সাক্ষ্যই যথেষ্ট। এর সাথে আরো জেনে রাখতে হবে যে, তিনি তাঁর এবং তাঁর উম্মতের জন্য দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। যেমন: আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম। তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম।’ (সূরা আল-মায়িদাহ:৫/৩)।
.
মনে রাখতে হবে, যে আমলকে মানুষ আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম মনে করে, কিন্তু আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) তাকে শরী‘আত হিসাবে গণ্য করেননি। তখন ধরে নিতে হবে যে, সে আমলের উপকারের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণই বেশি। অন্যথা যদি ক্ষতির চেয়ে লাভের পরিমাণ বেশি হতো, তাহলে শরী‘আত প্রণেতা সেটাকে ছেড়ে দিতেন না। কেননা নবী করীম(ﷺ) ছিলেন বিজ্ঞ ব্যক্তি, তিনি দ্বীনের কল্যাণ কখনো ছেড়ে দিতেন না। আর আপনি নরমালি টাকা দিয়ে ফিতরা দেওয়া জায়েয বলেন ভাল কথা। কিন্তু এই জাতীয় অপযুক্তি দিয়ে মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে নিজের অজান্তেই অপমান করছেন কিনা ভেবে দেখবেন!
.
আমাদের কারো অজানা নয় যে, ইবাদত হল, توقيفية বা কুরআন ও সুন্নাহর দলিল নির্ভর; কারো ব্যক্তিগত ফতোয়া, মতামত বা ইজতিহাদ নির্ভর নয়। ইসলামের কোন কাজের ব্যাপরে আলেমগণের মাঝে যদি এ মর্মে মতবিরোধ হয় যে, তন্মধ্যে কেউ বলছে তা বিদ‘আত আবার কেউ বলছে বিদ‘আত নয়। সুতরাং মতবিরোধের কারণে ঐ কাজটি অনুমোদনযোগ্য নয়। বরং তন্মধ্যে যার বক্তব্য সুদূঢ় প্রমাণ ও দলীলাদির ভিত্তিতে হবে সেটা গ্রহণ করা হবে। আর অন্যটা পরিত্যাগ করতে হবে। কেননা ইবাদত দলীল ছাড়া সাব্যস্ত হয় না। এ প্রসঙ্গে শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, বিতর্কিত মাস’আলায় কারো পক্ষাবলম্বন করা কারো জন্য উচিত নয়। আর শরী‘আতের কোন মাস’আলা সুদৃঢ় প্রমাণাদী, ইজমা ও দলীল থেকে উদ্ভাবিত হয় এবং তা শরী‘আতের সুস্পষ্ট দলীলের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়, আলিমগণের কোন কথার মাধ্যমে নয়। যদিও শরী‘আতের দলীলের ভিত্তিতে আলিমগণের বক্তব্যসমূহ সমর্থনযোগ্য। (ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমূঊল ফাতাওয়া, ২৬ তম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২০২; মিন উছূলিল ফিক্বহি ‘আলা মানহাজি আহলিল হাদীস, পৃ. ২০৩)। সুতরাং দলীল নেই এমন কথা প্রচার করা এবং আমল করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।ইমাম তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,ইবাদত হচ্ছে একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে যা কিছু এসেছে সে অনুযায়ী বিনীত হয়ে আমল করা। আর স্বভাবের মূল হচ্ছে আল্লাহ যা নিষিদ্ধ করেছেন একমাত্র তাই ক্ষতিকর মনে করা।(মাজমূ‘উ ফাতাওয়া খন্ড: ৪ পৃষ্ঠা: ১৯৬)
.
পরিশেষে, সবার উদ্দেশ্যে বলবো, হে আমার ভাই-বোন! নিজে খাদ্যদ্রব্য দিয়েই ফিতরা আদায় করুন। মানুষকে সুন্নাহর দিকে উদ্বুদ্ধ করুন এবং মানুষের ব্যক্তিগত ইজতিহাদ বা দলিল বিহীন কিয়াস পরিহার করুন। মাজহাব টিকাতে গিয়ে আল্লাহ এবং তার রাসূল (ﷺ)-এর বিরোধিতা করবেন না। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, যে আমার আনুগত্য করল সে অবশ্যই আল্লাহর আনুগত্য করল। আর যে আমার অবাধ্য হলো সে আল্লাহর অবাধ্য হলো। (সহীহ বুখারী হা/২৯৫৭, সহীহ মুসলিম হা/১৮৩৫)। তিনি আরো বলেছেন, আমার উম্মতের সকল লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে। কিন্তু যে অস্বীকার করেছে (সে জান্নাতবাসী হতে পারবে না)। জিজ্ঞাসা করা হল: কে অস্বীকার করেছে, হে রাসূল! উত্তরে বললেন; যে আমার অনুসরণ করল সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি আমার অনুসরণ করল না, সে অস্বীকার করল। (সহীহ বুখারী হা/৭২৮০)। উমর ইবনুল খাত্তাব (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) এক বক্তব্যে বলেন, اِتَّقُوا الرَّأْيَ فِيْ دِيْنِكُمْ তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে রায়কে (দলীল বিহীন সিদ্ধান্ত) ভয় কর।( ইমাম বায়হাক্বী (৩৮৪-৪৫৮ হিঃ), আল-মাদখাল হা/২১০; সনদ হাসান, ঈক্বাযু হিমাম, পৃঃ ১১৭)। খ্যাতনামা তাবেঈ ইমাম শা‘বী (২২-১০৪ হি.) বলেন,مَا حَدَّثُوْكَ عَنْ أَصْحَابِ رَسُوْلِ اللهِ فَخُذْ بِهِ وَمَا قَالُوْا فِيْهِ بِرَأْيِهِمْ فَبُلْ عَلَيْهِ. ‘তোমার কাছে তারা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবীদের থেকে যা বর্ণনা করে, সেটাকে তুমি আঁকড়ে ধর। আর তারা যদি তাদের কথায় রায় (দলীল ছাড়া কোন সিদ্ধান্ত) পেশ করে, তাহলে তার উপর পেশাব কর।’ (আব্দুর রাযযাক (১২৬-২১১ হিঃ), আল-মুসান্নাফ হা/২০৪৭৬; আবু নু‘আইম আল-আসবাহানী ৩৩৭-৪৩০হিঃ/৯৪৮-১০৩৮ খৃঃ, হিলইয়াতুল আওলিয়া ওয়া ত্বাবাক্বাতিল আছফিইয়া ৪/৩১৯ পৃঃ; ইবনু আব্দিল বার্র, জামিউ বায়ানিল ইলম ওয়া ফাযলিহি হা/১৪৩৮ ও ১০৬৬; সনদ সহীহ,তাহক্বীক্ব ঈক্বাযু হিমাম, পৃষ্ঠা: ১২৪ আসার দুটিসহ পুরা আর্টিকেলে ৪,৫ টি তথ্য আল ইখলাস থেকে সংগ্রহীত)।
.
আমার সর্বশেষ দলিল মহান আল্লাহ বলেন, অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। তাদের জন্য যারা আল্লাহ ও পরকাল প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে। (সূরা আহযাব,
৩৩/২১) এ আয়াত দ্বারা রাসূল (ﷺ) বাণীসমূহ ও কার্যাবলী উভয়ই অনুসরণের হুকুম রয়েছে বলে প্রমাণিত হয়। এবং এই আয়াত থেকে পরিষ্কার হয়ে গেল যে, রাসূল (ﷺ) -এর আদর্শে ঐ ব্যক্তি আদর্শবান হবে, যে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সাথে সাক্ষাতে বিশ্বাসী এবং যে বেশি বেশি আল্লাহকে স্মরণ করে থাকে। বর্তমানে অধিকাংশ মুসলমান উক্ত দুই গুণ থেকে বঞ্চিত। যার ফলে তাদের অন্তরে রাসূল (ﷺ)-এর আদর্শের কোন গুরুত্ব নেই। এদের মধ্যে যারা দ্বীনদার তাদের আদর্শ হল: মাজহাব, পীর ও বুযুর্গরা। আর যারা দুনিয়াদার বা রাজনৈতিক তাদের আদর্শ ও পথপ্রদর্শক হল পাশ্চাত্যের নেতারা। রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসার কথা এরা মুখে খুব দাবী করে, কিন্তু কার্যতঃ রাসূল (ﷺ)- কে নিজেদের আদর্শ, নেতা ও পথপ্রদর্শক মানার ব্যাপারে অধিকাংশই পিছনে। সুতরাং এ বিচার আল্লাহই করবেন। আল্লাহ সকলকে বুঝার তৌফিক দান করুন আমিন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পদনায়: শাইখ আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল। দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।
লিসান্স: মদিনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়।