জুলুম শব্দের অর্থ এবং কুরআন-সুন্নাহর আলোকে জুলুমের দুনিয়াবি ও পরকালীন শাস্তি

জুলুম (ظلم) শব্দটি আরবী। যার অর্থ: অন্যায়, অবিচার, নিপীড়ন ইত্যাদি। এটা হক বা ন্যায়ের বিপরীত। শরীয়তের পরিভাষায় জুলুম হচ্ছে কোন বস্ত্তকে তার উপযুক্ত স্থান ছেড়ে অনুপযুক্ত স্থানে রাখা। (রাগেব ইছফাহানী, মুফরাদাতু আলফাযিল কুরআন, পৃঃ ৫৩৭)। কেউ কেউ বলেন, জুলুম হচ্ছে অন্যের মালিকানায় হস্তক্ষেপ বা সীমালংঘন করা।(আল-জুরজানী, আত-তা‘রিফাত, পৃঃ ১৮৬)। জুলুমের বিভিন্ন স্তর ও ক্ষেত্র রয়েছে মৌলিক ভাবে কাউকে প্রাপ্য অধিকার না দেওয়াই জুলুম। সেটা আল্লাহর ক্ষেত্রে হতে পারে। যেমন; শিরক করা। আল্লাহর অবাধ্য হওয়া। আবার বান্দার ক্ষেত্রেও হতে পারে। যেমন: কারো অধিকার বা হক নষ্ট করা।
.
জুলুমের কয়েকটি উদাহরণ হল:

(১). অন্যায়ভাবে কারো যে কোন মালামাল দখল করা,

(২). কারো চরিত্র হনন করা,

(৩). কারো অধিকার থেকে বঞ্চিত করা,

(৪). কাউকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করা,

(৫). মিথ্যা সাক্ষ্য প্রমাণের ব্যবস্থা করা, (৬). মিথ্যা মামলা দেয়া,

(৭). কাউকে ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত করা,

(৮). কারো জমি অন্যায় ভাবে দখল করা,

(৯). অন্যায়ভাবে কাউকে চাকরীচ্যুত করা,

(১০). বিনা কারনে কাউকে গালি বা অপবাদ দেয়া,

(১১). গিবত বা অসাক্ষাতে দোষত্রুটি নিয়ে সমালোচনা করা বা অন্য কোনো উপায়ে অন্যায় ভাবে কষ্ট দেয়া,

(১২). অধীনস্তদের কাউকে অধিক কাজের দায়িত্ব দেওয়া।এবং কাউকে ছাড় দেওয়া,

(১৩). কারো দোষ-ত্রুটি এড়িয়ে যাওয়া,

(১৪). কর্মীদের মাঝে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করা ইত্যাদি কাজ যুলুমের অন্তর্ভুক্ত। কারণ, উপরোক্ত কার্যক্রমগুলি মানুষকে কষ্ট দেওয়ার একটি অন্যতম মাধ্যম।
.
জুলুম-পীড়ন বেড়ে গেলে দুনিয়াতেও বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে শাস্তি পেতে হয়। রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘তোমরা পাঁচটি বিষয়ে পরীক্ষার সম্মুখীন হবে:

(১). যখন কোন জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে, তখন সেখানে মহামারী ছড়িয়ে পড়ে। তাছাড়া এমন সব ব্যাধির উদ্ভব হয়, যা পূর্বেকার লোকদের মধ্যে কখনো দেখা যায়নি।

(২). যখন কোন জাতি ওযন ও মাপে কারচুপি করে, তখন তাদের উপর দুর্ভিক্ষ, কঠিন দারিদ্র্য ও শাসকদের নিষ্ঠুর দমন-নিপীড়ন নেমে আসে।

(৩). যখন কোন জাতি তাদের ধন-সম্পদের যাকাত বন্ধ করে, তখন আসমান থেকে বৃষ্টি বন্ধ করে দেওয়া হয়। যদি ভূ-পৃষ্ঠে চতুষ্পদ জন্তু ও নির্বাক প্রাণী না থাকত, তাহলে কখনো বৃষ্টিপাত হতো না।

(৪). যখন কোন জাতি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে কৃত (ঈমানের) অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, তখন আল্লাহ তাদের উপর তাদের বিজাতীয় দুশমনকে ক্ষমতাসীন করে দেন এবং তারা তাদের সহায়-সম্পদ কেড়ে নেয়।

(৫). যখন তোমাদের শাসকবর্গ আল্লাহর কিতাব মোতাবেক ফায়সালা না করে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান ব্যতীত অন্য কোনো বিধান গ্রহণ করে, তখন আল্লাহ তাদের পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে দেন।(ইবনু মাজাহ হা/৪০১৯; সিলসিলা সহীহাহ হা/১০৬)।
.
🔸জুলুমের দুনিয়াবী ও পরকালীন পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ:-
____________________________________
কুরআন-সুন্নাহর প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যায় আল্লাহ যুগে যুগে যালিমদের পাকড়াও করেছেন। পৃথিবীর প্রাচীন ছয়টি জাতি আল্লাহর গযবে ধ্বংস হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে তাদের যুলুমের কারণে। উক্ত ৬টি জাতি হল: (১). কওমে নূহ, (২). আদ, (৩). সামূদ, (৪). কওমে লূত, (৫). মাদইয়ান ও (৬). কওমে ফেরাঊন। উপরোক্ত ৬টি জাতি তারা নিজেদেরকে সর্ব ক্ষমতার অধিকারী ভেবেছিল, ঔদ্ধত্য দেখিয়েছিল ও যুলুম করেছিল। তাদের প্রধান প্রধান পাপগুলি কুরআনে ও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। যাতে উম্মতে মুহাম্মাদী তা থেকে সাবধান হয়। যুলম এমন একটি ভয়ানক বিষয় যে, আল্লাহ তা‘আলা যালেমকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। এটি একটি জঘন্য অপরাধ, মানবতাবিরোধী কাজ, গুরুতর পাপকাজ। কোন ইমানদার ব্যক্তি কারো উপর যুলম করতে পারে না। যুলুমের কারণে দুনিয়া এবং আখেরাতে ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, আমি ধ্বংস করেছি কত জনপদ, যেগুলোর বাসিন্দা ছিল যালেম, এসব জনপদ তাদের ঘরের ছাদসহ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল এবং কত কূপ পরিত্যক্ত হয়েছিল ও কত সুদৃঢ় প্রাসাদও।’ (সূরা হজ্জ; ২২/৪৫)। তিনি আরো বলেন, তুমি কখনও মনে করবে না যে, জালিমরা যা করে, সে বিষয়ে আল্লাহ্‌ গাফিল। তিনি তাদেরকে সে দিন পর্যন্ত অবকাশ দেন, যে দিন তাদের চোখগুলো হবে স্থীর, ভীত বিহবল চিত্তে আকাশের দিকে চেয়ে তারা ছুটাছুটি করবে, নিজেদের প্রতি তাদের দৃষ্টি ফিরবে না এবং তাদের অন্তর হবে শূণ্য। (সূরা ইব্রাহীম; ১৪/৪২-৪৩)। অপর আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, অতঃপর তোমাদের মধ্যে যারা সীমালংঘন/জুলুম করবে, আমরা তাদের বড় শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করাব।’ (সূরা ফুরক্বান; ২৫/১৯)। তিনি আরো বলেন,‘আর যালেমদের কোন বন্ধু নেই বা কোন সাহায্যকারী নেই।’ (সূরা শূরা; ৪২/৮)। যালেমদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেন, “আর যদি তুমি দেখতে, যখন যালিমরা মৃত্যু কষ্টে থাকে, এমতাবস্থায় ফেরেশতারা তাদের হাত প্রসারিত করে আছে (তারা বলে), তোমাদের জান বের কর। আজ তোমাদেরকে প্রতিদান দেয়া হবে লাঞ্ছনার আযাব, কারণ তোমরা আল্লাহর উপর অসত্য বলতে এবং তোমরা তার আয়াতসমূহ সম্পর্কে অহংকার করতে।”(সূরা আল-আন‘আম; ৮/৯৩)। তোমরা অচিরেই জানতে পারবে, কার পরিণাম মঙ্গলময়। যালিমরা কখনও সফল হবে না। (আনআম; ৬/১৩৫)। যারা যুলুম করেছে তারা অচিরেই জানতে পারবে কোন্ পরিণামের দিকে তারা ফিরে যাচ্ছে। (সূরা-শুআরা; ২৬/ ২২৭)
.
হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ বলেন, ‘হে আমার বান্দাগণ! আমি আমার ওপর যুলুম করাকে হারাম করে দিয়েছি। তাই আমি তোমাদের জন্যও যুলুম করা হারাম করে দিলাম। অতএব, তোমরা (পরস্পরের প্রতি) যুলুম করো না।’ (সহীহ মুসলিম হা/২৫৭৭, সহীহুল জামে হা/৪৩৪৫; মিশকাত হা/২৩২৭)। অপর বর্ণনায় রাসূল (ﷺ) আরো বলেছেন, ‘আল্লাহ যালিমদের অবকাশ দিয়ে থাকেন। অবশেষে যখন তাকে ধরেন, তখন আর ছাড়েন না। (রাবী বলেন,) এরপর নবী করীম (ﷺ) এ আয়াত পাঠ করেন, ‘আর এরকমই বটে আপনার রবের পাকড়াও, যখন তিনি কোন জনপদবাসীকে পাকড়াও করেন তাদের যুলুমের দরুন। নিঃসন্দেহে তাঁর পাকড়াও বড় যন্ত্রণাদায়ক, অত্যন্ত কঠিন।’ (সূরা হূদ; ১১/১০২, সহীহ বুখারী হা/৪৬৮৬; মিশকাত হা/৫১২৪; সিলসিলা সহীহাহ হা/৩৫১২)। অপর একটি হাদীসে এসেছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের ওপর যুলুম করেছে সে যেন তার কাছ থেকে ক্ষমা নিয়ে নেয়। তার ভাইয়ের পক্ষে তার নিকট হতে পুণ্য কেটে নেয়ার আগেই। কারণ, সেখানে কোন দীনার বা দিরহাম নেই। তার কাছে যদি পুণ্য না থাকে তবে তার (মাযলূমের) গোনাহ এনে তার উপর চাপিয়ে দেয়া হবে।’ (সহীহ বুখারী হা/৬৫৩৪, ২৪৪৯)। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলা বিচারকের সহযোগিতায়ই থাকেন যতক্ষণ না সে বিচারে কারোর উপর যুলুম করে। তবে যখন সে বিচারে কারোর উপর যুলুম করে বসে তখন আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর সহযোগিতা উঠিয়ে নেন এবং শয়তার তাকে আঁকড়ে ধরে। (সুনানে তিরমিযী ১৩৩০; ইবনু মাজাহ ২৩৪১)। আব্দুল্লাহ্ বিন্ আববাস্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন; কেউ যদি কোন যালিমকে এ ব্যাপারে সহযোগিতা করলো যে, সে তার বাতিল দিয়ে কোন হক্বকে প্রতিহত করবে তখন আল্লাহ্ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যিম্মাদারি তার উপর থেকে উঠিয়ে নেয়া হয়। (সা’হী’হুল জা’মি ৬০৪৮)। সাঈদ ইবনু যায়েদ (রা.) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অত্যাচার করে অর্ধহাত যমীন দখল করেছে, নিশ্চয়ই ক্বিয়ামতের দিন অনুরূপ সাতটি যমীন তার কাঁধে ঝুলিয়ে দেয়া হবে।’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/২৯৩৮)। ইয়া‘লা ইবনু মুররা (রা.) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি, যেকোন ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কারো এক বিগত জমি দখল করে তাকে আল্লাহ্ তা সাত তবকের শেষ পর্যন্ত খুঁড়তে বাধ্য করবেন। অতঃপর তার গলায় তা শিকলরূপে পরিয়ে দেওয়া হবে, যাবৎ না মানুষের বিচার শেষ করা হয়। (মুসনাদে আহমাদ, মিশকাত হা/২৯৬০)।
ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, অবশ্যই যুল্‌ম কিয়ামাত দিবসে ঘোরতর অন্ধকারে পরিণত হবে। (সহীহ মুসলিম হা/৬৪৯১ ই.ফা. ৬৩৪১, ই. সে. ৬৩৯১)
.
ইমাম ইবনুল জাওযী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন; জুলুম বা অত্যাচার প্রধানতঃ দু’টো পাপের সাথে সম্পৃক্ত থাকে। একটি হলো অন্যায়ভাবে কারো সম্পদ আত্মসাৎ করা। আর অপরটি হলো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘লার সাথে বিরুদ্ধাচরণ করা শারী‘আত বহির্ভূত কোন বিষয় নিয়ে। জুলুমের এ পাপটি অন্যান্য পাপের চাইতে মারাত্মক। কারণ, অধিকাংশ সময় জুলুম নামক অন্যায় দুর্বল ব্যক্তিদের সাথেই সংগঠিত হয়ে থাকে। যারা এতে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে না। অক্ষম হওয়ার কারণে তারা পরাজিত হয়। জুলুম অন্তরের অন্ধকার তথা বক্রতা থেকে তৈরি হয়। তবে যদি সেই অন্তর হিদায়াতের আলো দ্বারা আলোকিত হয় তখন তার মর্যাদা অনেক গুণে বেড়ে যায়। সুতরাং, আখিরাতে যেদিন মুত্তাক্বীরা তাকওয়ার প্রতিদান হিসেবে আল্লাহর নূর লাভে ধন্য হবে সেদিন যালিমকে তার জুলুমের অন্ধকার আচ্ছন্ন করবে কিন্তু কোনই সাহায্যকারী থাকবে না। (ফাতহুল বারী ৫ম খন্ড, হা/২৪৪৭; তুহফাতুল আহ্ওয়াযী ৫ম খন্ড, হা/২০৩০)
.
🔸এবার জুলুমের চিত্র এবং জালেমের পরিনতি সম্পর্কে একটি উদাহরণ দেখুন:
____________________________________
ইসলামের ইতিহাসে মহিলাদের মধ্যে সর্বপ্রথম শহীদ সুমাইয়া (রা.)-এর ঘটনাটি কমবেশি সবারই জানা। রাসূল (ﷺ)-এর সাহাবী ইয়াসির (রা:)-এর স্ত্রী সুমাইয়া (রা.) ছিলেন একজন দাসী। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াতে একদম শুরুর দিকেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। এরপর থেকেই শুরু হয় তাঁর উপর অমানুষিক নির্যতন। এমনকি এক পর্যায়ে পাপিষ্ঠ আবু জাহল সুমাইয়া (রা.)-এর লজ্জাস্থানে বর্শা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে অ|ঘাত করে তাঁকে শহীদ করে দেয়। (আল-মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বা হা/৩৪৫৭০; ইমাম বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত ২/২৮২; ইবনে কাসির আল-বিদায়াহ ৩/৫৯)।
.
এবার তার পরিণতি দেখুন: প্রথমে তার সম্পর্কে কিছু জেনে নেওয়া যাক। আবু জাহল কুরাইশ বংশীয় হিসাবে রাসূল (ﷺ)-এর সাথে তার দূরবর্তী সম্পর্ক রয়েছে, নিকটবর্তী কোন সম্পর্ক নেই। রাসূল (ﷺ) আবদু মানাফ গোত্রীয় আর আবু জাহল বানু মাখযূম গোত্রীয়। রাসূল ﷺ) এবং আবূ জাহেল উভয়ের বংশ ‘মুর্রা ইবনু কা‘বে’ গিয়ে মিলিত হয়েছে (সীরাতে ইবনে হিশাম ১/১ ও ১/২৬৫ পৃঃ)। আবু জাহল ছিলো আরবের অন্ধকার যুগে মক্কার মুশরিকদের বড় নেতা বা ইমাম। যার তীব্র বিরোধিতায় ইসলাম প্রচার শুরু থেকেই বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল। আবু জাহলের শত্রুতার কারণে মুহাম্মদ (ﷺ) তাঁর সঙ্গী সাথী নিয়ে মদীনায় হিজরত করতে বাধ্য হন। তার নামে “জাহল “অর্থাৎ মূর্খ যোগ হওয়ার অন্যতম কারণ হলো – সে ইসলামের সবকিছু জেনে বুঝে বিরোধিতা করেছিল। অথচ সে ছিলো ইব্রাহিমী ধর্মের অনুসারী। তার দাবি ছিলো সে এবং তার অনুসারীরা হচ্ছে আল্লাহর সত্যিকারের ইবাদতকারী। অর্থাৎ আল্লাহর একনিষ্ঠ আনুগত্যকারী।আবু জাহলের অভ্যাস ছিল: যখন কোন অভিজাত বংশের লোক ইসলাম কবুল করতেন, তখন সে গিয়ে তাকে গালি-গালাজ করত ও তার ধন-সম্পদের ক্ষতি সাধন করবে বলে হুমকি দিত। নিজ আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে গরীব ও দুর্বল কেউ মুসলমান হয়েছে জানতে পারলে তাকে ধরে নির্দয়ভাবে পিটাতো এবং অন্যকে মারার জন্য প্ররোচিত করত। কোন ব্যবসায়ী ইসলাম কবুল করলে তাকে গিয়ে ধমক দিয়ে বলত, তোমার ব্যবসা বন্ধ করে দেব এবং তোমার মাল-সম্পদ ধ্বংস করে দেব’ (ইবনু হিশাম ১/৩২০)। এইভাবে সম্মানিত ব্যক্তিকে ইসলাম কবুলের অপরাধে অসম্মানিত করা মক্কার নেতাদের নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। আজকের সভ্য যুগেও যা চলছে বরং আরও জোরে-শোরে।
.
এবার তার পরিনতি দেখুন: বদর যুদ্ধে আবু জাহলকে ছোট্ট দুজন কিশোর সাহাবি হত্য করে জাহান্নামে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁদের একজন হলেন মু‘আয ইবনু আফরা, অপরজন মু‘আয ইবনু আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা। অথচ সবার ধারণা ছিলো, আবু জাহলের কাছেও কেউ যেতে পারবে না। (ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ৩১৪১)। আবু জাহল যখন উপর্যুপরি আক্র*মণের ফলে মৃত্যুসহ্যায় কাতরাচ্ছিলো, তখন বিখ্যাত সাহাবি ইবনু মাস‘উদ (রা.) তার গলায় পা চেপে ধরেন। এতে আবু জাহল খুবই মনঃকষ্ট পায়। কারণ ইবনু মাস‘উদ (রা.) একসময় মেষ চড়াতেন। তাই, আবু জাহল সেই সময়ে আফসোস করে বলেছিলো, ‘হে ছোটলোক মেষপালক! তুমি খুবই উঁচু ও সম্মানিত স্থানে ওঠে গেছো!’ এমনকি আবু জাহল মৃত্যুর সময়েও আফসোস করেছে এই বলে যে, ‘হায়! কোনো চাষী যদি আমাকে হত্য! না করতো!’ (অর্থাৎ, যে দুজন কিশোর তাকে হত্য! করেন, তাঁরা ছিলেন মদিনাবাসী আনসার। আর, আনসারদের বড় অংশই চাষাবাদ করতেন। সেজন্য কোনো চাষীর হাতে মৃত্যু হওয়াটা সে মানতে পারছিলো না!)। (ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ৪০২০; ইমাম ইবনু হিশাম, আস-সিরাহ: ২/২২৭)
.
এই হল আল্লাহর বিচার। সে যেভাবে মুসলিম যুবতী দাসী সুমাইয়া (রা.)-এর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাঁকে লজ্জাস্থানে আঘাত করে শহিদ করেছে, তাকেও অতি সাধারণ দুজন কিশোর হত্যা করেছে এবং শেষ পর্যন্ত সাবেক মেষ পালক ইবনু মাসউদ (রা.)-এর হাতে মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে। যাদেরকে সে অতি তুচ্ছজ্ঞান করতো, তাদের হাতেই তার মরণ হয়েছে। এত অভিজাত জীবনটা শেষ হয়েছে তার চোখে অতি ক্ষুদ্র ব্যক্তিদের হাতে! শুধু সুমাইয়া (রা.)-কেই নয়, তাঁর আদরের সন্তান আম্মার (রা.)-কেও সে এবং অন্যান্য কাফিররা এভাবে নির্য|তন করতো। আম্মার (রা.)-এর সামাজিক মর্যাদা বলতে কিছুই ছিলো না। কিন্তু ইসলাম তাঁকে মহান করেছে। তাকে নবিজি (ﷺ) খুবই ভালোবাসতেন। একবার আলি (রা.) নবিজির পাশে ছিলেন। তখন আম্মার (রা.) ভেতরে প্রবেশের অনুমতি চাইলে নবিজি বলেন, ‘‘তাকে ভেতরে আসতে দাও। পবিত্র সত্তা ও পবিত্র স্বভাবের ব্যক্তিকে স্বাগতম!’’ (ইমাম তিরমিযি, আস-সুনান: ৩৭৯৮; ইমাম ইবনু মাজাহ, আস-সুনান: ১৪৬; হাদিসটি সহিহ)। নবিজি তাঁর প্রশংসা করে বলেছেন, ‘‘আম্মারের অস্থিমজ্জা ঈমানে পরিপূর্ণ।’’ (ইমাম নাসায়ি, আস-সুনান: ৫০০৭; হাদিসটি সহিহ)। নবিজির ইন্তিকালের পরও তাঁর সম্মান কমেনি। উমার (রা.) খলিফা নিযুক্ত হলে, তিনি তাকে কুফার শাসক নিযুক্ত করেছিলেন। (ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ৭৫৫)। এবার চিন্তা করুন, যে আম্মার ছিলেন দাস, যাকে অকথ্য নির্য|তন করা হতো, বিশাল পৃথিবীটা যার জন্য ছিলো কুয়ার মতো সংকোচিত, তাঁকে আল্লাহ সময়ের ব্যবধানে কোথায় নিয়ে গেলেন! আবার যে আবু জাহল ছিলো আরবের অন্যতম জ্ঞানী, অভিজাত ও সম্মানিত ব্যক্তি, তার কী পরিণাম হলো! আবু জাহল প্রথমে সমাজে পরিচিত ছিলো ‘আবুল হিকাম’ নামে। এর অর্থ হলো, জ্ঞানের পিতা। এরপর সে হয়ে গেলো ‘আবু জাহল’ (মূর্খতার পিতা)। নিশ্চয়ই এ ধরনের ঘটনাগুলোতে আমাদের জন্য অনেক কিছু শেখার আছে।
.
পরিশেষে, প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত আলোচনা থেকে এ কথা প্রতীয়মান হয় যে, যুলুম একটি পাপকাজ এবং এর জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে সবাইকে জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাড়াতে হবে। তাই আমাদেরকে মাযলুমের পক্ষাবলম্বন করে যালিমের বিপক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমার ভাই যালিমকে (যুলুম করা থেকে বিরত রাখার মাধ্যমে) সাহায্য কর এবং মাযলুমকে (যুলুমের হাত থেকে বাঁচানো মাধ্যমে) সাহায্য কর।(সহীহ বুখারী, হা/২৪৪৩)। যুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়ে মানুষ অনেক সময় প্রভাবশালী ব্যক্তিকে কিছু বলতে পারে না, তার প্রতি কৃত যুলুমের প্রতিকার করতে পারে না, নিতে পারে না প্রতিশোধ। পেশী শক্তি, বাহুবল, জনবল ও অর্থ-বিত্তের প্রভাবে অনেক মানুষ নীরবে অশ্রু ঝরায়, কেঁদে-কেটে ন্যায়বিচারক মহান আল্লাহর কাছে তার মনের আকুতি পেশ করে ও বিচার দায়ের করে। আল্লাহও তার দো‘আ কবুল করেন। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, আর মাযলুমের বদদো‘আ থেকে বেঁচে থাকবে। কেননা তার (বদদো‘আ) এবং আল্লাহর মাঝে কোন পর্দা থাকে না। (মুসলিম হা/১০২; আবূদাঊদ হা/৪৩৫২; তিরমিযী হা/১৩১৫; ইবনু মাজাহ হা/২২২৪; মিশকাত হা/২৮৬০) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
_______________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।