এক নজরে কুরবানী সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ৩২ টি মাসআলা বিস্তারিত বর্ননা সহ

➤(১) কুরবানীর মূল উদ্দেশ্য: কুরবানী করা একটি মহান ইবাদাত।কুরবানীর মূল উদ্দেশ্য আল্লাহভীতি অর্জন করা।কুরবানী হতে হবে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে। কে কত বড় কুরবানী দিল, কার কুরবানী দেখতে কত সুন্দর, কতটা মোটাতাজা, এটা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দেখেন না। বরং তিনি দেখেন মানুষের অন্তর ও তাক্বওয়া।মহান আল্লাহ বলেন, এগুলোর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, কিন্তু তার কাছে পৌঁছে তোমাদের তাক্বওয়া’ (সূরা হজ্জ, ৩৭)। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ(ছা.) বলেছেন,নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের বাহ্যিক গঠন ও বিত্ত-বৈভবের দিকে দেখেন না; বরং তিনি দেখেন তোমাদের অন্তর ও আমল’।(সহীহ মুসলিম, হা/২৫৬৪; মিশকাত, হা/৫৩১৪ ]
.
➤(২) কুরবানীর ক্ষেত্রে সর্বোত্তম কুরবানী হলো পুরো একটি উট কুরবানী দেওয়া, তারপর গরু, তারপর ছাগল, তারপর উট বা গরু ভাগ দেওয়া(ছহীহ বুখারী, হা/৮৮১, ছহীহ মুসলিম, হা/৮৫০)।একটি পরিবারের পক্ষ থেকে একটি কুরবানীই যথেষ্ট। তবে সামর্থ্য অনুপাতে একাধিক পশু কুরবানী করতে পারে। আনাস (রাঃ)হতে বর্ণিত, নবী (সাঃ) শিংওয়ালা সাদা-কালো রঙের দুটি ভেড়া কুরবানী করেছিলেন (ছহীহ বুখারী, হা/৫৫৬৪, ৫৫৬৫)। অপর বর্ণনায় আছে, রাসূল a একসাথে ১০০টি উট কুরবানী করেছেন (ছহীহ মুসলিম, হা/১২১৮; ইবনু মাজাহ, হা/৩০৭৪)।

➤(৩) ভাগে কুরবানী দেয়া যাবে: তবে মুক্বীম অবস্থায় একটি পরিবারের পক্ষ থেকে একটি পশু কুরবানী করাই উত্তম। তবে সামর্থ্য থাকলে একাধিক পশুও যেমন কুরবানী করতে পারবে।আবার একটি পশুতে একাধিক ব্যক্তি অংশগ্রহণ করতে পারেন এটা হোক সফর অথবা মুক্বীম কোনটাই নাজায়েজ নয়।সে হিসাবে গরু, মহিষ ও উটে সর্বোচ্চ সাত ভাগে কুরবানি করা যাবে। এর বেশি করা যাবে না। তবে, সাতের কমে করা যাবে। ছাগল, ভেড়া, দুম্বায় কোনো শরিক রাখা যাবে না। গরু, উট বা মহিষে কুরবানি ২/৩/৪/৫/৬/৭ যে ভাগেই করা হোক, কোনো শরিকই এক-সপ্তমাংশের কম নিতে পারবে না।(সহীহ মুসমি, হা/১৩১৮ তিরমিযী, হা/৯০৫; নাসাঈ, হা/৪৩৯২; ইবনু মাজাহ, হা/৩১৩১)]
.
➤(৪) পোষা বা খরিদ করা কোন পশুকে কুরবানীর জন্য নির্দিষ্ট করলে ও সেই মর্মে ঘোষণা দিলে তা আর বদল করা যাবে না। অবশ্য যদি নির্দিষ্ট না করে থাকেন, তবে তার বদলে উত্তম পশু কুরবানী দেওয়া যাবে। যদি কুরবানীর পশু হারিয়ে যায় বা চুরি হয়ে যায়, তবে তার পরিবর্তে অন্য কুরবানী যরূরী নয়। যদি ঐ পশু ঈদুল আযহার দিন বা পরে পাওয়া যায়, তবে তা তখনই আল্লাহর রাহে যবহ করে দিতে হবে। যদি কুরবানীর পূর্বে কুরবানী দাতা মৃত্যুবরণ করেন এবং তার অবস্থা এমন হয় যে, ঐ পশু বিক্রয়লব্ধ পয়সা ভিন্ন তার ঋণ পরিশোধের আর কোন উপায় নেই, তখন কেবল ঋণ পরিশোধের স্বার্থেই কুরবানীর পশু বিক্রয় করা যাবে।[মির‘আত, ২/৩৬৮-৬৯; ঐ, ৫/১১৭-১২০; কিতাবুল উম্ম ২/২২৫-২৬)।
.
➤(৫) কুরবানী করা গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত যদি কোন ব্যক্তি কুরবানী করার নিয়ত করে এরপর সে নিয়তকে বাতিল করে; এ প্রত্যাবর্তনের কারনে তার উপর কোন কিছু আবশ্যক হবে না। তবে যদি কুরবানীর পশু নির্দিষ্ট করে ফেলে যে, এই বলে যে, “এটাই কুরবানীর পশু” কিংবা অন্য কোনভাবে কুরবানীর পশুটি নির্দিষ্ট করে ফেলে তাহলে ভিন্ন কথা। অর্থাৎ কুরবানীর পশু নির্দিষ্ট করে ফেললে সে পশু জবাই করা অর্থাৎ কুরবানী করা আবশ্যক হবে এবং এর থেকে প্রত্যাবর্তন অর্থাৎ নিয়ত পরিবর্তন করা করা জায়েয হবে না। নির্দিষ্ট করার মাধ্যমে এটি তার মালিকানা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কারণে। যদি কেউ কুরবানী করার নিয়তে কোন পশু ক্রয় করে কিন্তু “এটি কুরবানীর পশু” বলে সেটিকে নির্দিষ্ট না করে সেক্ষেত্রে আলেমগণ সে পশুটি জবাই করা আবশ্যক হবে; না কি হবে না— এ নিয়ে মতভেদ করেছেন। সঠিক মতানুযায়ী আবশ্যক হবে না। যেমনিভাবে কেউ যদি তার বাড়ীটি ওয়াক্‌ফ করার নিয়ত করে এরপর তার নিয়ত থেকে ফিরে আসে তাহলে তার উপর কোন কিছু আবশ্যক হবে না। কুরবানীর হুকুমও অনুরূপ।(বিস্তারিত জানতে দেখুন ইবনে কুদামাহ আল-মুগনী: ৯/৩৫৩), ইমাম নববর আল-মাজমু: ৮/৪০২) ও ইমাম উসাইমীন আল-শারহুল মুমতি ৭/৪৬৬)।
.
➤(৬) যদি একই পরিবারের একাধিক সদস্য থাকে এবং তারা যদি পৃথক পৃথক পরিবার নিয়ে বসবাস করে। এবং তাদের রান্না পৃথকভাবে হয় তাহলে তারা একটি পরিবার হিসেবে একটি পশু কুরবানী দিলে গ্রহনযোগ্য হবেনা এমন পরিবারকে একান্নবর্তী পরিবার বলা হয়না, তাই তাদের সবাইকে সামর্থ্য থাকলে পৃথকভাবে তাদের স্ত্রী সন্তানসহ আলেদা আলেদা একটি পশু অথবা সাত ভাগের এক অংশ করে কুরবানী দিতে হবে (বিন বায,মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১৮/৩৭; ফাতাওয়া লাজনাহ দায়েমাহ ১১/৪০৬)।

➤(৭) ঋণ করে কুরবানী দেওয়া যাবে যদি উক্ত ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা থাকে (ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূউল ফাতাওয়া ২৬/৩০৫; বিন বায, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১/৩৭) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম পরস্পরকে ঋণ দিতেন (বুখারী, মিশকাত হা/২৯০৫; ফিক্বহুস সুন্নাহ ৩/১৮৪ পৃঃ)। তাছাড়া কুরবানীর বিষয়টি সামর্থ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট। যার সামর্থ্য আছে সেই কুরবানী করবে।
.
➤(৮) মৃত মানুষের পক্ষ থেকে পৃথকভাবে কুরবানী দেয়া যাবে না,তবে একটি পরিবারের জীবিত মৃত সবার পক্ষ থেকে একটি পশু বা কোন অসিয়ত থাকলে দেওয়া যাবে। কুরবানীর সাথে আক্বীকার নিয়ত করা যাবে না, রাসূল (ﷺ) এর জন্য পৃথকভাবে কুরবানী দেয়া যাবে না কেন না রাসূল সাঃ এবং তার কোন সাহাবী এভাবে কুরবানী করেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। অতএব এসব থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।
.
➤(৯) কুরবানীর পশুর মাংস দ্বারা বিবাহের ওয়ালীমা করা: কুরবানীর গোশত দ্বারা বিবাহের ওয়ালীমা খাওয়ানো যাবে। কেননা কুরবানীর গোশত ঈদের পরে জমা রেখে খাওয়া জায়েয।(ইবনু মাজাহ হা/৩১৫৯, মিশকাত হা/১৭৬২)। তুরতুসী বলেন, কেউ যদি বিবাহের ওয়ালীমায় কুরবানীর গোশত খাওয়ায় সেটিই তার জন্য যথেষ্ট হবে’ (আত-তাজ ওয়াল ইকলীল লি মুখতাছারে খলীল ৪/৩৭৬)।
.
➤(১০) কুরবানীর পশুর রং, বয়স কেমন হওয়া দরকার: কুরবানীর পশুর বয়সঃ যেকোনো রঙের পশু দ্বারা কুরবানী করা বৈধ,তবে কালো রঙ অপেক্ষা ধূসর রঙের পশু কুরবানীর জন্য উত্তম। বয়সের দিক দিয়ে উঁটের পাঁচ বছর,গরুর দুই বছর এবং মেষ ও ছাগলের এক বছর হওয়া জরুরী। অবশ্য অসুবিধার ক্ষেত্রে ছয় মাস বয়সী মেষ কুরবানী করা যায়। গরুর বয়স ২ বছর হওয়াই যথেষ্ট, দাঁত ওঠা জরুরি নয়। তবে, ২ বছরের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে। আর ছাগল কমপক্ষে ১ বছর হতে হবে। [ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ৪৯৭৬; ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ: ১৪৩৪৮]উলামাগণ এ বিষয়ে একমত যে, ছ’মাস বয়সী মেষের কুরবানী সিদ্ধ হবে; তা ছাড়া অন্য পশু পাওয়া যাক অথবা না যাক।(সহীহ বুখারী ২১৭৮, মুসলিম ১৯৬৫)।
.
➤(১১) কোন ধরনের পশু দ্বারা কুরবানী করা জায়েজ নয়: যেসকল পশু দ্বারা কুরবানী করা নাজায়েজ: কুরবানীর পশু সুঠাম, সুন্দর ও নিখুঁত হওয়া চাই। চার ধরনের পশু কুরবানী করা নাজায়েয। যেমন: (১) স্পষ্ট খোঁড়া, (২) স্পষ্ট কানা, (৩) স্পষ্ট রোগী ও জীর্ণশীর্ণ এবং (৪) অর্ধেক কান কাটা বা ছিদ্র করা ও অর্ধেক শিং ভাঙ্গা।[আহমাদ হা/১৮৬৯৭, ১০৪৮, ১০৬১; তিরমিযী হা/১৪৯৭; ইবনু মাজাহ হা/৩১৪৪ প্রভৃতি; মিশকাত হা/১৪৬৫, ১৪৬৩, ১৪৬৪; ফিক্বহুস সুন্নাহ (কায়রো ছাপাঃ ১৪১২/১৯৯২) ২/৩০ পৃ.) উপরে বর্ণিত চার প্রকার পশুর চাইতে নিম্নস্তরের কোন দোষ যেমন অর্ধেক লেজ কাটা ইত্যাদি থাকলে তার দ্বারাও কুরবানী হবে না। তবে নিখুঁত পশু ক্রয়ের পর যদি নতুন করে খুঁৎ হয় বা পুরানো কোন দোষ বেরিয়ে আসে, তাহ’লে ঐ পশু দ্বারাই কুরবানী বৈধ হবে।[মির‘আত ২/৩৬৩; ঐ, ৫/৯৯ পৃ.) উল্লেখ্য যে, খাসি করা কোন খুঁৎ নয়। বরং এতে পাঁঠা ছাগলের দুর্গন্ধ দূর হয় এবং গোশত রুচিকর হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজে দু’টি মোটাতাজা খাসি দিয়ে কুরবানী করেছেন।[ইবনু মাজাহ হা/৩১২২; ইরওয়া হা/১১৩৮, ৪/৩৫১ পৃ.; মিশকাত হা/১৪৬১]
.
➤(১২) কুরবানীর পশু ক্রয়ের কয়েকদিন পর কোন ত্রুটি প্রকাশ পেলে তা দ্বারা কুরবানী করা: কোন পশুকে কুরবানীর জন্য নির্দিষ্ট করা বা ক্রয় করার পর যদি কোন ত্রুটি প্রকাশ পায়, তাহ’লে তা দ্বারা কুরবানী করা যাবে। আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়ের (রাঃ)-এর নিকট হজ্জের হাদী সমূহ আনা হ’লে তার মধ্যে একটি এক চক্ষুহীন ট্যারা উট পাওয়া যায়। তখন তিনি বলেন, ক্রয়ের পর এরূপ হ’লে এটা দিয়েই কাজ সম্পন্ন কর। আর ক্রয়ের পূর্বে এরূপ পেলে তা পাল্টে নাও।(বায়হাক্বী হা/১০৫৪৬; নববী, আল-মাজমূ‘ ৮/৩৬৩, সনদ ছহীহ; ইবনু তায়মিয়াহ মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২৬/৩০৪; মির‘আত ৫/৯৯)।

➤(১৩) খাসীকৃত প্রাণী দ্বারা কুরবানী কিভাবে জায়েয: এরূপ পশু কুরবানী করা জায়েয।খাসীকৃত প্রাণী ত্রুটিপূর্ণ নয়। কারণ এটি ছাগলের কোন রোগ নয়। বরং খাসীর গোশত তুলনামূলক পবিত্র, দুর্গন্ধমুক্ত ও সুস্বাদু হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজে সর্বদা দু’টি করে ‘খাসী’ (خَصِيَّيْنِ- مَوْجُوْئَيْنِ) কুরবানী দিতেন (হাকেম হা/৭৫৪৭; আহমাদ হা/২৩৯১১; ইরওয়া হা/১১৪৭,সহীহ বুখারীর ভাষ্যকার ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, ‘খাসী’ করার কারণে কেউ কেউ এটাকে খুঁৎওয়ালা পশু বলে অপসন্দ করেছেন। কিন্তু মূলতঃ এটি কোন খুঁৎ নয়। বরং এর ফলে গোশত রুচিকর ও সুস্বাদু হয় এবং দুর্গন্ধ দূরীভূত হয় (ইবনু হাজার আসক্বালানী, ফাৎহুল বারী শরহ ছহীহুল বুখারী ১০/১২)। ইবনু কুদামা বলেন, খাসীই কুরবানীর জন্য যথেষ্ট। কেন না রাসূল ﷺ দু’টি খাসী দিয়েই কুরবানী করতেন(মির‘আত ৫/৯১)।
.
➤(১৪) কুরবানী মোট কয়দিন করা যায় :কুরবানী সর্বমোট ৪ দিন করা যায় ১০, ১১, ১২,১৩ যিলহাজ্জ চারদিনের রাত-দিন যে কোন সময় কুরবানী করা যাবে।(মুওয়াত্ত্বা, মিশকাত হা/১৪৭৩; ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/৩০ পৃ. নায়লুল আওত্বার ৬/২৫৩ ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী, মির‘আতুল মাফাতীহ শরহ মিশকাতুল মাদাবীহ ৫/১০৬-০৯ পৃষ্ঠা)।
.
➤(১৫) কেউ যদি আইয়ামে তাশরীকের শেষ দিনে কুরবানী করতে চায়, তবে সে ঈদের দিন নখ-চুল কর্তন করতে পারবে না বরং যেদিন কুরবানী করবে সেদিনই নখ ও চুল কাটাবে।(সহীহমুসলিম হা/১৯৭৭; মিশখাত হা/১৪৫৯)। অত্র হাদীছে কুরবানী করাকে শেষ সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে (উসাইমীন শারহু রিয়াযিছ সালেহীন হা/১৭০৬-এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)।
.
➤(১৬) সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যারা কুরবানী করেনি, তাদেরকে গোশত দেওয়া যাব, কেননা সামর্থ্য থাকলেই কুরবানী করা বাধ্যতামূলক নয়। বরং কুরবানী একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। কোনো সময় কেউ ছেড়ে দিলে গোনাহগার হবে না। আবূ বকর ও উমার (রা:) সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কখনো কখনো কুরবানী করেননি (ইরওয়াউল গালীল, হা/১১৩৯, ৪/৩৫৪; ফিক্বহুস সুন্নাহ, ৪/১৭৭)। আবূ মাসঊদ আনছারী বলেছেন, ‘সামর্থ্য থাকার পরও আমি কুরবানী দিই না এই আশঙ্কায় যে, আমার প্রতিবেশীগণ হয়ত মনে করবে কুরবানী দেওয়া আমার জন্য জরুরী।(ইরওয়াউল গালীল, ৪/৩৫৫)। তাই তাদেরকে হাদিয়াস্বরূপ কুরবানীর গোশত দেওয়াতে কোনো বাধা নেই।

➤(১৭) কুরবানীর বদলে তার মূল্য সাদাক্বা করা নাজায়েয। আল্লাহর রাহে রক্ত প্রবাহিত করাই এখানে মূল ইবাদত। যদি কেউ কুরবানীর বদলে তার মূল্য সাদাক্বা করতে চান, তবে তিনি মুহাম্মাদী শরী‘আতের প্রকাশ্য বিরোধিতা করবেন।(মাজমূ‘ ফাতাওয়া ইবনে তায়মিয়াহ, ২৬/৩০৪; মুগনী, ১১/৯৪-৯৫ পৃ.) ইমাম আহমাদ (রহঃ) বলেন, কুরবানী সাদাক্বার চাইতে উত্তম, যেমন ঈদের সালাত অন্য সকল নফল সালাতের চাইতে উত্তম।(তাফসীরে কুরতুবী (সূরা সাফফাত ৩৭/১০২), ১৫/১০৮ পৃষ্ঠা মির‘আত ২/৩৬৮-৬৯; ঐ, ৫/১১৭-১২০; কিতাবুল উম্ম ২/২২৫-২৬)।
.
➤(১৮) কুরবানীর পশু ক্রয় করার পর যদি তার বাচ্চা হয়, তাহলে মায়ের সাথে তাকেও কুরবানী করতে হবে। এর পূর্বে ঐ পশুর দুধ খাওয়া যাবে; তবে শর্ত হল, যেন ঐ বাচ্চা ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত হয়।(বাইহাকী ৯/২৮৮,শারহুল মুমতে ৭/৫১০)।
.
➤(১৯) মহিলারা কুরবানীর পশু সহ যেকোন পশু যবেহ করতে পারে। কা‘ব ইবনু মালিক (রাঃ) বলেন, তার একটি ছাগল ‘সালআ’ নামক চারণক্ষেত্রে ছিল। তাঁর এক দাসী ছাগলটিকে মরণাপন্ন দেখে পাথর দ্বারা যবেহ করে দেয়। বিষয়টি তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলে তিনি ছাগলটি খাওয়ার নির্দেশ দেন।(সহীহ বুখারী, মিশকাত হা/৪০৭২)।
.
➤(২০) একাকী বা একটি পরিবারের পক্ষ থেকে একটি পশু কুরবানী দেয়া উত্তম তবে শরিকানা কুরবানি দিলে মাংস,হাড্ডি ইত্যাদি সবকিছু দাঁড়িপাল্লা দিয়ে ওজন করে সমানভাবে ভাগ করতে হবে; অনুমান করে বণ্টন করা যাবে না।(ইমাম ইবনু আবিদিন, রাদ্দুল মুহতার: ৬/৩১৭)।
.
➤(২১) কুরবানির মাংসের তিন ভাগের এক ভাগ গরিবদের দান করা, এক ভাগ আত্মীয়দের দেওয়া এবং একভাগ নিজেরা খাওয়া মুস্তাহাব (উত্তম), তবে বাধ্যতামূলক নয়। আত্মীয়-স্বজনের মাঝে গরিব থাকলে তাদেরকে অগ্রাধিকার দিন। একসাথে দুটো নেকি হবে: আত্মীয়তার হক আদায় এবং গরিবকে সাহায্য করা। পরিবারের লোকসংখ্যা বেশি হলে নিজেদের জন্য বেশি পরিমাণে রেখে কম পরিমাণ দান করলেও দোষের কিছু নেই।(ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ৫৫৬৯; ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ৪৯৯৭ ও ৪৯৯৮; ইমাম ইবনু কুদামা, আল-মুগনি: ১৩/৩৭৯)।
.
➤(২২) কুরবানির মাংস কাটার জন্য নিয়োজিত শ্রমিককে কুরবানির মাংস থেকে বিনিময় দেওয়া যাবে না। তাকে টাকা বা অন্য কোনো কিছু দিয়ে বিনিময় দিতে হবে। তবে পূর্ণ বিনিময় বা পারিশ্রমিক দেওয়ার পর চাইলে মাংস দান করতে পারবে। কাউকে দিয়ে নাড়ি-ভুড়ি পরিষ্কার করালে কুরবানির পশু থেকে বিনিময় বা পারিশ্রমিক দেওয়া যাবে না। তাছাড়া, কুরবানির পশুর চর্বি বা নাড়ি-ভুড়ি বিক্রি করা যাবে না। নিজেরা খেতে না পারলে দান করে দিতে হবে।(সহীহ মুসলিম হা/১৩১৭; বুখারী হা/১৭১৭; মিশকাত হা/২৬৩৮)অবশ্য ঐ ব্যক্তি দরিদ্র হ’লে হাদিয়া স্বরূপ তাকে কিছু দেওয়ায় দোষ নেই।(বুঃ মুঃ মিশকাত হা/২৬৩৮; মির‘আত হা/২৬৬২-এর আলোচনা, ৯/২৩০ পৃ.ইমাম কাসানি, বাদায়িউস সনায়ি’: ৪/২২৫)।
.
➤(২৩) কুরবানীর পশু জবাই করার সময় শরিকদের নাম বলার প্রয়োজন নেই; মহান আল্লাহর নাম নিয়ে জবাইকারী সবার পক্ষ থেকে জবাই করছে, এটা অন্তরে থাকলেই যথেষ্ট।(সহীহ বুখারী, ১ মিশকাত, ১)।
.
➤(২৪) পশুর মাথা দক্ষিণ দিকে, সিনা কিবলামুখী করে এবং পা পশ্চিম দিকে রেখে জবাই করা উত্তম। এর ব্যতিক্রম হলেও জবাই সহিহ হবে, তবে ইচ্ছা করে এমনটি করা উচিত নয়।(ইমাম ইবনু হাজার, ফাতহুল বারি: ১০/২১; ইমাম আইনি, উমদাতুল কারি: ২১/১৫৭)।

➤(২৫) পশুর মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তার চামড়া ওঠানো যাবে না। জবাইয়ের সময় খাদ্যনালী, শ্বাসনালী কাটতে হবে এবং এ দুটোর উভয় পাশের দুটো রক্তনালী থেকে কমপক্ষে একটি কাটতে হবে।(ইমাম সারাখসি, আল-মাবসুত)।
.
➤(২৬) কুরবানীর পশু জবাইকারী মুসলিম হতে হবে। ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে জবাই করতে হবে। কুরবানির পশু নিজ হাতে জবাই করা উত্তম।রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হাতে জবাই করতেন।(ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান: ২৭৯৪; ইমাম বুখারি আস-সহিহ: ৫৫৬৫)।
.
➤(২৭) পশুর সামনে অস্ত্র ধার না দেওয়া। জীবিত পশুর সামনে আরেক পশুকে জবাই করতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন। এতে তারা কষ্ট পায়। ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করবে, যাতে পশুর বেশি কষ্ট না হয়। জবাই এর সময় নির্দয় হওয়া উচিত নয়।(ইমাম ইবনু মাজাহ, আস-সুনান: ৩১৭০; হাদিসটি সহিহ)।
.
➤(২৮) মাংস ভবিষ্যতের জন্য ফ্রিজে রাখা জায়েয। তবে সব মাংস জমা না করে যথাসাধ্য গরিব-মিসকিনদের দেওয়া উচিত। অন্তত ঈদের দিনগুলোতে তারা সুস্বাদু খাবারের স্বাদ নিক।(ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ৫৫৬৭)।
.
➤(২৯) কুরবানীর পশুর চামড়া নিজেরাও ব্যবহার করতে পারবে আবার দানও করতে পারবে। তবে, উত্তম হবে এটি গরিবদের দান করা। কুরবানির চামড়ার টাকা মসজিদে দান করা যাবে না। কারণ, চামড়ার মূল্য গরিবের হক। [ইমাম আইনি, শারহুল কানয: ২/২০৬; ইমাম ইবনুল হুমাম, ফাতহুল কাদির: ৮/৪৩৮]।
.
➤(৩০) কুরবানির মাংস মুসলিম- অমুসলিম সবাইকেই দেওয়া জায়েয। বিশেষ করে মুসলিমদের ক্ষতি করেনি। (ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ১১/৪২৪)। কেন না এটি যাকাত বহির্ভূত নফল সাদাক্বার অন্তর্ভুক্ত (আল-মুগনী ৩/৫৮৩, ৯/৪৫০)। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ) তাঁর ইহূদী প্রতিবেশীকে দিয়েই গোশত বণ্টন শুরু করেছিলেন (বুখারী, তিরমিযী হা/১৯৪৩; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/১২৮, সনদ সহীহ, ‘ইহূদী প্রতিবেশী’ অনুচ্ছেদ)। তবে, যুদ্ধরত কাফির সম্প্রদায়কে দেওয়া যাবে না। কুরবানির মাংস দিয়ে বিবাহের ওলিমা করা জায়েয। তবে, যদি কুরবানির মূল উদ্দেশ্যকে সামনে না রেখে কেবল ওলিমাকে টার্গেট করেই কুরবানি করা হয়, তবে তার কুরবানি জায়েয হবে না।(ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ৫/৩০০; আল-বাহরুর রায়িক: ৩/৭১)।
.
➤(৩১) যবেহ করার সময় পশুর মাথা যাতে বিচ্ছিন্ন না হয় তার খেয়াল রাখা উচিত। তা সত্ত্বেও যদি কেটে বিচ্ছিন্ন হয়েই যায়, তাহলে তা হালাল হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।যবাই করে ছেড়ে দেওয়ার পর (অসম্পূর্ণ হওয়ার ফলে) কোন পশু উঠে পালিয়ে গেলে তাকে ধরে পুনরায় যবাই করা যায়। নতুবা কিছু পরেই সে এমনিতেই মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়ে। আর তা হালাল।

(৩২) সমাজে প্রচলিত আছে হালাল পশুর যে ৭টি অঙ্গ হারাম সেগুলো হলো-১- প্রবাহিত রক্ত। ২- নর প্রাণীর পুং লিঙ্গ। ৩- অন্ডকোষ। ৪- মাদী প্রাণীর স্ত্রী লিঙ্গ। ৫- মাংসগ্রন্থি। ৬- মুত্রথলি। ৭- পিত্ত উক্ত বক্তব্য ভিত্তিহীন যার কোন দলিল নেই হালাল পশুর শুধু মাএ রক্ত ছাড়া বাকি সব হালাল সুতরাং যেকোন হালাল প্রাণী যবেহকালে আল্লাহর নাম নিয়ে যবাই করা (‘বিসমিল্লাহ’ বলা) ওয়াজিব। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘‘যদি তোমরা তাঁর নিদর্শনসমূহের বিশ্বাসী হও তবে যাতে (যে পশুর যবেহ করার সময়) আল্লাহর নাম নেওয়া হয়েছে তা আহার কর।’’ (সূরা আনআম ৬/১১৮) আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
__________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।