উমরী ক্বাযা সালাত এবং ক্বাযা সালাত আদায়ের জরুরী কিছু বিষয়

ক্বাযা উমরী (উমরী ক্বাযা) বলতে কোন সালাত আছে কি? অথবা এই অনাদায়ী সালাতের কোন কাফফারা আছে কি?ক্বাযা সালাত আদায়ের জরুরী কিছু বিষয়ঃ
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
দীর্ঘ দিনের বা সারা জীবনের ক্বাযা সালাতকে ‘উমরী ক্বাযা’ বলা হয়।উমরী ক্বাযা’ অর্থাৎ বিগত বা অতীত জীবনের ক্বাযা সালাত সমূহ বর্তমানে নিয়মিত ফরয সালাতের সাথে যুক্ত করে ক্বাযা হিসাবে আদায় করা সম্পূর্ণরূপে একটি বিদ‘আতী প্রথা’ইসলামী শরীয়তে এর কোন ভিত্তি নেই [আলোচনা দ্রষ্টব্য: আলবানী-মিশকাত হা/৬০৩, টীকা-২]
.
পূর্বের দুটি পর্বে আলোচনা করা হয়েছে যে, ইচ্ছাকৃত সালাত পরিত্যাগ করা নিঃসন্দেহে কুফুরী। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাহাবীগণ আমল সমূহের মধ্যে কোন আমল ছেড়ে দেয়াকে কুফুরী বলতেন না, ছালাত ব্যতীত (তিরমিযী হা/২৬২২, ২/৯০ পৃ.; মিশকাত হা/৫৭৯, পৃ. ৫৯; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৫৩২, ২/১৬৪ পৃ., সনদ সহীহ]
.
ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহঃ) বলেন,এমন ব্যক্তির পক্ষ্য থেকে ক্বাযা নেই। এমনকি সে ক্বাযা করে নিলেও তার পক্ষ্য থেকে ক্বাযা কবুল হবে না।বরং এক্ষেত্রে তার দায়িত্ব হল সে ক্বাযা না করে বেশী বেশী করে নফল সালাত আদায় করবে। [আল-এখতিয়ারাত-৩৪]
.
তাই কেউ ইচ্ছাকৃত দীর্ঘদিন সালাত ত্যাগ করলে সে সালাতের কোন ক্বাযা নেই। কেননা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) ও সাহাবায়ে কেরামের স্বর্ণযুগে উক্ত প্রথার অস্তিত্ব ছিল না তাই নতুন করে উমরী ক্বাযা চালু করা বিদআত। সুতরাং পূর্বের ছুটে যাওয়া সালাতের জন্য আল্লাহর কাছে বেশী বেশী ক্ষমা প্রার্থনা করবে। আল্লাহ চাইলে পূর্বের পাপ সমূহ ক্ষমা করে দিতে পারেন এবং তা নেকীতে পরিণত করতে পারেন [সূরা ফুরক্বান ৭০-৭১; যুমার ৫৩)। তাছাড়া ইসলাম তার পূর্বেকার সবকিছুকে ধসিয়ে দেয়।[মুসলিম হা/৩৩৬, ১/৭৬ পৃঃ, (ইফাবা হা/২২১), ‘ঈমান’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৫৬; মিশকাত হা/২৮, ‘ঈমান’ অধ্যায়।
.
সম্ভবতঃ একাধিক সালাত ক্বাযা হওয়ার কারণেই মহিলাদের মাসিক অবস্থার ছালাত পূরণ করার নির্দেশ দেয়া হয়নি; বরং সিয়াম ক্বাযা করার কথা বলা হয়েছে। [ছহীহ মুসলিম হা/৭৮৯, ১/১৫৩ পৃঃ, (ইফাবা হা/৬৫৪), ‘ঋতু’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১৫; মিশকাত হা/২০৩২, ‘ছিয়াম’ অধ্যায়, ‘ক্বাযা সিয়াম’ অনুচ্ছেদ]
.
সুতরাং ব্যাক্তির জন্য ওয়াজিব এই যে, সে সর্বদা নামায ত্যাগ করার ঐ অবহেলাপূর্ণ পাপ ও ক্ষতির কথা মনে রেখে তার প্রতিকারের উদ্দেশ্যে (নফল ইবাদতের মাধ্যমে) সদা সচেতন থাকবে। সম্ভবত: তার ঐ হারিয়ে দেওয়া দিনের কিছু ক্ষতিপূরণ অর্জন হয়ে যাবে।[আলমুমতে’,শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ২/১৩৫]

রসূল (ﷺ) বলেন, “কিয়ামতের দিন বান্দার নিকট থেকে তার আমল সমূহের মধ্যে যে আমলের হিসাব সর্বাগ্রে নেওয়া হবে, তা হল নামায। নামায ঠিক হলে সে পরিত্রাণ ও সফলতা লাভ করবে। নচেৎ (নামায ঠিক না হলে) ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সুতরাং (হিসাবের সময়) ফরয নামাযে কোন কমতি দেখা গেলে আল্লাহ তাবারাকা অতাআলা ফিরিশ্‌তাদের উদ্দেশ্যে বলবেন, ‘দেখ, আমার বান্দার কোন নফল (নামায) আছে কি না।’ অতএব তার নফল নামায দ্বারা ফরয নামাযের ঘাটতি পূরণ করা হবে। অতঃপর আরো সকল আমলের হিসাব অনুরুপ গ্রহণ করা হবে।” (আবূদাঊদ, সুনান ৭৭০, তিরমিযী, সুনান ৩৩৭, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ১১৭নং, সহিহ তারগিব ১/১৮৫)

পক্ষান্তরে যে ব্যক্তির নামায অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছুটে যায়, তার জন্য ক্বাযা আছে। আল্লাহ বান্দার অন্তরের খবর রাখেন। তার মনে অবহেলা ও শৈথিল্য না থাকলে তিনি তার ক্বাযা গ্রহণ করবেন। প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন, (এই ক্বাযা আদায় করা ছাড়া) এর জন্য আর অন্য কোন কাফফারা নেই। [সহীহ বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৬০৩]

পক্ষান্তরে ক্বাযা আদায় করার সময় ও সুযোগ না পেলে কোন পাপ হয় না। সুতরাং এ কথা সুস্পষ্ট হয় যে, মরণের সময় অথবা পরে বেনামাযী অথবা কিছু নামায ত্যাগকারীর তরফ থেকে নামায-খন্ডনের উদ্দেশ্যে রাকআত হিসাব করে কাফফারা স্বরুপ কিছু দান-খয়রাত ইত্যাদি করা নিরর্থক ও নিষ্ফল। বরং এই উদ্দেশ্যে পাপ-খন্ডনের ঐ অনুষ্ঠান ও প্রথা এক বিদআত। (ইসলাহুল মাসাজিদ, আল্লামা আলবানীর টীকা সহ্‌ উর্দু তর্জমা মালেক, মুঅত্তা ২৯৬পৃ:, আহ্‌কামুল জানাইয, আলবানী ১৭৪, ২৭৫পৃ:, মু’জামুল বিদা’ ১৬৪পৃ:) বলা বাহুল্য এমন পাপস্খলনের রীতি তো অমুসলিমদের; যারা ইয়া বড় বড় পাপ করে কোন পানিতে ডুব দিলে অথবা কিছু অর্থ ব্যয় করে আসে!

◾পরিশেষে, ক্বাযা সালাত আদায়ের জরুরী কিছু বিষয়ঃ
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
১) ঘুমের কারণে কাযা হলে ঘুম ভাঙ্গার সাথে সাথে পবিত্রতা অর্জন করে আদায় করতে হবে ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্ব করা যাবেনা। [বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৬০৩]

(২) ভুলে আদায় করা না হলে স্মরণ হওয়া মাত্র আদায় করতে হবে।ইচ্ছাকৃতভাবে দেরি করে আদায় করলে সেটি গ্রহণযোগ্য হবে না। [মুহাল্লা, ফিকহুস সুন্নাহ্‌ ১/২৪১-২৪৩, ফিকহুস সুন্নাহ্‌ উর্দু ৭৮পৃ:]

(৩) অজ্ঞান হয়ে পড়লে সে সময়ের বাদ পরা সালাত আর আদায় করা লাগবে না। তবে ইচ্ছাকৃত হলে যেমন: চিকিৎসার জন্য বা অপারেশনের জন্য অজ্ঞান হলে জ্ঞান ফেরার পর কাযা আদায় করতে হবে। [মিশকাত: ৩২৮৭]।

(৪) পরপর একাধিক ওয়াক্ত কাযা সালাত আদায় করতে আযান দিবে মাত্র একবার, কিন্তু ইকামাত দিবে প্রতি সালাতেরই এটাই সুন্নাহ।[বুখারী ৩৪৪, মুসলিম, সহীহ ৬৮০]

(৫) রাতের নামায দিনে কাযা করলে ঐ নামায রাতের মতো স্বশব্দে পড়তে হবে। ঠিক এভাবে দিনের নামায রাতে কাযা করলে দিনের মতোই চুপিসারে তিলাওয়াত করতে হবে। [সহীহ মুসলিম, ৬৮১]

(৬) সফরে থাকার কসরের নামায ক্বাযা হলে বাড়ি ফিরে কসরই পড়বেন এবং বাড়ি থাকা অবস্থার নামায কাযা হলে সফরে গিয়ে পুরা করেই পড়বেন। মোট কথা যেমন নামায তেমন কাযা করবেন। [আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৫১৮]

(৭) এক সঙ্গে কয়েক ওয়াক্ত নামায বাদ পড়ে গেলে ঐ কাযা নামাযগুলো ধারাবাহিকভাবে পড়বে। যেমন: ফজর, যোহর, আসর, মাগরিব এ সিরিয়ালে।ক্রমধারা ভঙ্গ করা যাবে না। [ছহীহ বুখারী হা/৫৯৬ ও ৫৯৮]

(৮) কেউ যদি যোহর না পড়ে আসরের ওয়াক্তে পৌঁছে যায় তাহলে আগে যোহর কাযা পড়বে, এরপর আসর পড়বে। [ছহীহ বুখারী হা/৫৯৬ ও ৫৯৮]

(৯) কেউ যদি মসজিদে গিয়ে দেখে আসরের জামাআত চলছে, অথচ তার যোহর পড়া হয় নাই, তাহলে আসরের জামাআতেই শরীক হবে। কিন্তু সে নিয়ত করবে যোহরের নামাযের। এরপর সে আবার আসর পড়বে একাকী। তবু ক্রমধারা ভঙ্গ করা যাবে না। যোহরের আগে আসর পড়া যাবে না। ইমাম ও মুক্তাদীর নিয়ত ভিন্ন ভিন্ন হলেও নামায শুদ্ধ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। [ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩১০]

(১২) একান্ত অপারগতায় ক্রমধারা লঙ্ঘন করা বৈধ। যেমন: পূর্ববর্তী সালাত এশা পড়ে নাই, আবার ফজরের সময়ও প্রায় চলে যাচ্ছে- এমতাবস্থায় ফজর পড়েও এশা পড়া যাবে।[আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ২/১৪০-১৪১, তুহ্‌ফাতুল ইখওয়ান, ইবনে বায ৬৬পৃ:]

(১০) নফল-সুন্নাতের জামাআতের পেছনে ফরয সালাত এবং ফরয সালাতের জামাআতের পেছনে সুন্নাত নফল সালাত পড়া জায়েয আছে। রাসূল (স.) এর যামানায় এ ধরনের দৃষ্টান্ত রয়েছে।

(১১) একই নামায দু’বারও পড়া যায়। মুয়ায ইবনে জাবাল (রাঃ) মসজিদে নববীতে নামায পড়ে নিজ গোত্রে ফিরে গিয়ে একই নামায আবার পড়েছেন ইমাম হয়ে।এক্ষেত্রে প্রথমটি ফরজ এবং দ্বিতীয়টির নফল হিসেবে গণ্য হবে।[বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১১৫০]

(১২) ফরজ সালাতের পাশাপাশি তাহিয়্যাতুল মসজিদ তওয়াফ শেষে মাক্বামে ইবরাহীমের পিছনে দুই রাকা’আত সালাত, সূর্য গ্রহণ ও চন্দ্র গ্রহণের সালাত, জানাযার সালাত ইত্যাদি ৫ টি নিষিদ্ধ সময় এর অন্তর্ভুক্ত নয় এটিই বিশুদ্ধ মত।

(১৩) যেকোন সুন্নাত সালাত ছুটে গেলে তা পরে ক্বাযা আদায় করা যায়। [সহীহ বুখারী, হা/১২৩৩] বরং যারা নিয়মিত এ ছালাতগুলো আদায় করে তাদের ছুটে গেলে বা ব্যস্ততায় সময় না পেলে আদায় করে নেয়া মুস্তাহাব। ইমাম শাফেঈ (রাহিমাহুল্লাহ) ও আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) এর মতে পড়াই উত্তম। (মাজমূ‘ঊল ফাতাওয়া, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৪৩]

(১৪) সুন্নত সালাতের কাযা আদায়ের ক্ষেত্রে কেউ যদি মনে করে এমন অবস্থায় কোন্ সালাত আগে আদায় করব? পূর্বেরটা প্রথমে না-কি যোহরের পরেরটাই প্রথমে? এক্ষেত্রে স্বাধীনতা রয়েছে সে যেকোন একটি আগে আদায় করতে পারে। [উন্মুক্ত সাক্ষাৎ, ইবনু উছায়মীন, বৈঠক নং ৭৪, প্রশ্ন নং ১৮; ইমাম শাওকানী, নায়লুল আওতার, ২য় খণ্ড, পৃ. ৫]

(১৫) উমরী ক্বাযা সালাত বলতে ইসলামি শরীয়তে কোন সালাত নেই তাই এই ধরনের নিয়ম চালু করা বিদআত।

মহান আল্লাহ সবাইকে কুরআন সুন্নাহর আলোকে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করার তৌফিক দান করুন। আমীন। (আল্লাহ্‌ই অধিক জ্ঞাত আছেন)।
▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।