ইসলামী শরীয়তে আত্মহত্যার বিধান কি

প্রশ্ন: ইসলামী শরীয়তে আত্মহত্যার বিধান কি? কোনো মুসলিম আত্মহত্যা করলে কি চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে? আত্মহত্যাকারীর জন্য জান্নাত হারাম ও চিরস্থায়ী জাহান্নামী হওয়ার সংক্রান্ত হাদীসগুলোর ব্যাখ্যা কি?
কুরআন সুন্নাহর আলোকে বিস্তারিত জানতে চাই।
▬▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: আত্মহত্যা মানে নিজকে নিজেই ধ্বংস করা। নিজ আত্মাকে চরম যন্ত্রণা ও কষ্ট দেয়া। নিজ হাতে নিজের জীবনের সকল কর্মকাণ্ডের পরিসমাপ্তি ঘটানোর নামই আত্মহত্যা।নিঃসন্দেহে এটি মহাপাপ এবং কবিরা গুনাহের মধ্যে অন্যতম, যা মহান আল্লাহর কর্মে হস্তক্ষেপের শামিল।সকল ফিকহবিদ এবং চার মাজহাবের ইমামগন একমত আত্মহত্যা করা হারাম। কারণ,আল্লাহ তা’আলা মানুষকে মরণশীল হিসেবেই সৃষ্টি করেছেন।ধনী-গরীব, বিদ্বান-মূর্খ, রাজা-প্রজা সবাইকে মরতেই হবে।( সূরা আল-আনকাবূত,৫৭ সূরা ইউনুস,৫৬)যেহেতু মানুষের জীবন-মরণের মালিক একমাত্র আল্লাহর তাআলা।কিন্তু কেউ যদি শয়তানের প্ররোচনায় নিজের প্রতি অবিচার ও সীমালঙ্ঘন বশত: নিজেকে মৃত্যুর দিকে ঢেলে দেয় তাহলে সে আল্লাহর কর্মে হস্তক্ষেপ করল। আর যে আল্লাহর কর্মে হস্তক্ষেপ করে আল্লাহ তাআলা তাকে শাস্তি প্রদান করবেন।মহান আল্লাহ বলেন,আর তোমরা নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়ালু। যে কেউ অবিচার ও সীমালঙ্ঘন বশত: আত্মহত্যা করে অবশ্যই আমি তাকে জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করাবো। আল্লাহর পক্ষে তা সহজসাধ্য।(সূরা আন-নিসা,২৯-৩০)
.
আত্মহত্যা করা জঘন্য অপরাধ হ’লেও এর কারণে কোন মুসলিম কাফের হয়ে যায় না, বরং মুসলমানই থাকে।তার জানাযার সালাত পড়া হবে,তার গোসল, কাফন, দাফন করা এবং তার জন্য দুআ করা ও দান সাদাক্বাহ করা জায়েয। তবে বুযর্গ আলেম ও মসজিদের ইমাম তার জানাযার অংশ গ্রহণ করতে পারবেন না। কিন্তু সাধারণ মুসলিমরা পড়বে এবং মুসলিমদের গোরস্থানে তার দাফন করা হবে’।(যাদুল মা‘আদ ১/৪৯৬ নিহায়াতুল মুহতাজ ২/৪৪১) কেননা রাসূল (সাঃ)-এর নিকট জনৈক আত্মহত্যাকারীকে আনা হ’লে তিনি তার জানাযা পড়াননি (মুসলিম হা/৯৭৮; নাসাঈ হা/১৯৬৪)। আর এটি ছিল অন্যদের জন্য শিক্ষাস্বরূপ’ (ইবনু মাজাহ হা/১৫২৬)। যাতে জীবিতরা বুঝতে পারে যে, এরূপ মহাপাপে জড়িয়ে পড়লে আমাদের জানাযাতেও তারা অংশগ্রহণ করবে না (নববী,শরহ মুসলিম ৭/৪৭)।
.
মহান আল্লাহ বলেন,নিশ্চয়ই আল্লাহ ঐ ব্যক্তিকে ক্ষমা করেন না, যে তাঁর সাথে অন্যকে শরীক করে। এতদ্ব্যতীত তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে থাকেন।’(সূরা নিসা ৪/৪৮)।আল্লাহ আরো বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। আল্লাহ যাবতীয় অপরাধ মার্জনা করেন।’ (সূরা যুমার; ৫৩)
.
মওসুআতুল ফিকহিয়্যাহ গ্রন্থে বলা হয়েছে, ইমাম চতুষ্ঠয় কেউই আত্মহত্যাকারী ব্যক্তিকে কাফের বলেনি। এটা মহাপাপ তবে শিরক নয়। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের নিকট সে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবেনা’।[মাওসূ‘আতুল ফিকহিয়্যাহ ৬/২৯১-২৯]

◾এখন যে হাদীসগুলোতে বলা হয়েছে আত্মহত্যাকারীর জন্য জান্নাত হারাম অথবা চিরস্থায়ী জাহান্নামী এই হাদীসগুলোর ব্যাখ্যা কি?
___________________________________
আত্মহত্যাকারীদের জন্য জান্নাত হারাম এবং চিরস্থায়ী জাহান্নামী উক্ত হাদীসগুলোর ব্যাখ্যায় আহলুল আলেমগণ বলেন,হাদীসে জান্নাত হারাম এবং চিরস্থায়ী জাহান্নামী বলতে অমুসলিমদের বুঝানো হয়েছে। আর মুসলিমদের জন্য এটি ধমকি স্বরূপ বলা হয়েছে। কেননা আত্মহত্যা করা কাবিরাহ গুনাহ আর কাবিরাহ গুনাহের জন্য জান্নাত হারাম হয় না। বরং শিরকে আকবার এবং বড় কুফরী অবস্থায় বিনা তওবায় মারা গেলে জান্নাত হারাম হয়।তাছাড়া বড় শিরক করা ব্যতীত মৃত্যুবরণকারী মুসলিমরা চিরস্থায়ী জাহান্নামী নয়। এটা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আক্বীদা।যেমন একটি হাদীসে এসেছে জাবের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন মদীনায় হিজরত করেন, তখন তুফায়েল বিন আমরের সঙ্গে অন্য আরেকজন লোকও হিজরত করে। মদীনার আবহাওয়া অনুকূলে না হওয়ায় অসহ্য হয়ে লোকটি স্বীয় হাতের আঙ্গুলসমূহের গিরা কেটে ফেলে। ফলে অধিক রক্ত ক্ষরণে সে মৃত্যুবরণ করে। তারপর তুফায়েল বিন আমর একদিন স্বপ্নযোগে লোকটিকে খুব ভাল অবস্থায় দেখেন। কিন্তু তার হাত দু’খানা ছিল আবৃত। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার হাত দু’টি আবৃত কেন? জবাবে সে বলল, মদীনায় হিজরত করার কারণে মহান আল্লাহ হাত দু’টি ছাড়া আমার সবকিছুই ক্ষমা করে দিয়েছেন। অতঃপর তুফায়েল স্বপ্নের ঘটনা নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে বললে তিনি আল্লাহর নিকট দো‘আ করেন। ফলে তার হাত দু’টিও ভাল হয়ে যায়।(সহীহ মুসলিম হা/১১৬; ‘আত্মহত্যাকারী কাফের না হওয়া’ অনুচ্ছেদ; মিশকাত হা/৩৪৫৬)।
.
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোন ধারালো অস্ত্র দ্বারা আত্মহত্যা করবে, জাহান্নামের মধ্যে সে অস্ত্র দ্বারা তাকে শাস্তি প্রদান করা হবে।’ (সহীহ মুসলিম, হা/১০৯)।
.
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামে (অনুরূপভাবে) নিজেকে ফাঁস লাগাতে থাকবে। আর যে ব্যক্তি বর্শার আঘাতে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামে বর্শা বিদ্ধ হতে থাকবে।’ (সহীহ বুখারী, হা/১৩৬৫; মিশকাত, হা/৩৪৫৪)।
.
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের ফক্বীহগণ এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন যে, যে ব্যক্তি আত্মহত্যা করবে, সে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে না। তার উপর সালাত আদায় করা হবে এবং তার পাপ তার উপর বর্তাবে। তাকে মুসলিমদের কবরস্থানে দাফন করা হবে। (ইবনু বাত্তাল, শারহু সহীহিল বুখারী, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৪৯)
.
মুহাল্লিব (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, উপরোক্ত হাদীস গুলোর ব্যাপারে আলেমগণ বলেছেন, ‘আল্লাহ চাইলে তাঁর অঙ্গীকার তথা শাস্তি প্রদান বাস্তবায়ন করতে পারেন। কেননা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদা হল, পাপীদের শাস্তি প্রদান করার ক্ষেত্রে আল্লাহর ইখতিয়ার রয়েছে। আল্লাহ চাইলে তাঁকে ক্ষমা করতে পারেন, আবার শাস্তিও দিতে পারেন। যদি তিনি শাস্তি প্রদান করেন, তাহলে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শাস্তি প্রদান করার পর তাঁর ঈমানের কারণে তাকে জান্নাত দিবেন এবং তার উপর থেকে চিরস্থায়ী জাহান্নামের শাস্তি তুলে নিবেন।(ইবনু বাত্তাল,শারহু সহীহিল বুখারী, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৫০)
.
তাই নির্ধারিত শাস্তিভোগের পর আল্লাহর দয়ায় কালেমা ত্বাইয়েবার বরকতে মুক্তি পাবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করবে। (ইবনু মাজাহ, হা/৬০)।
.
উল্লেখ্য যে,আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত অন্য হাদীসে এসেছে ‘কেউ আত্মহত্যা করলে সে চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামে শাস্তি ভোগ করবে’ (সহীহ মুসলিম হা/১০৯)।উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় সহীহ মুসলিমের ভাষ্যকার ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, এখানে خالدًا مخلدًا এর মর্ম হ’ল সুদীর্ঘকাল ও অধিককাল, চিরস্থায়ী নয় (মুসলিম শরহ নববী ২/১২৫, হা/১১৩-এর ব্যাখ্যা দ্রঃ)। অর্থাৎ দীর্ঘকাল সে জাহান্নামে শাস্তি ভোগ করবে এবং পরে আল্লাহর দয়ায় জান্নাতে যাবে।
.
পরিশেষে বলা যায়,কোন মুসলিম আত্মহত্যাকারী ব্যক্তির আত্মহত্যার সময় যদি তার ঈমানের সাথে থাকে তবে সে এ পাপের শাস্তি ভোগ করার পর জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে। আর যদি সে ঈমান ত্যাগ করে মারা যায় তবে সে চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে।অর্থাৎ চিরস্থায়ী শাস্তি ঐ ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য, যে আত্মহত্যাকে হালাল বলে বিশ্বাস করে। এরূপ বিশ্বাস করার কারণে সে কাফের হয়ে যাবে।কেননা শারী‘আতের একটি হারাম কাজকে হালাল মনে করা ঈমান ভঙ্গের কারন। আর যার ঈমান ভঙ্গ হবে সে কাফের হয়ে যাবে, আর কাফের নিঃসন্দেহে চিরস্থায়ী জাহান্নামী।আশা করি উত্তরটি পেয়েছেন।(বাকিটা আল্লাহ তা‘আলাই সবচেয়ে ভাল যানেন)
_____________________________
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।