ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে বিনা ওযরে রামাদানের সিয়াম ত্যাগ করার শাস্তি

ভূমিকা: ইসলাম যে পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত, রামাদ্বন মাসের ‘সাওম’ তার মধ্যে অন্যতম। সিয়াম পালনের মধ্যে মানুষের জন্য বহু কল্যাণ নিহিত রয়েছে। অথচ আমরা সিয়াম পালন না করার জন্য নানা অজুহাত দাঁড় করাই! এ অজুহাতগুলোর মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে- সিয়াম রাখলে স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে যায়, স্বাস্থ্যের জন্য এটি ক্ষতিকর, সিয়াম গ্যাষ্ট্রিক রোগসহ স্বাস্থ্য সংক্রান্ত অনেক জটিলতার সৃষ্টি করে। আমাদের এই সমস্যা সেই সমস্যা ইত্যাদি কত কি! অথচ সালাত যেমন আদায় করা ফরজ ঠিক তেমনি যে ব্যক্তির মধ্যে ৫টি শর্ত পাওয়া যায়; তার উপর সাওম পালন করা ফরজ। যেমন: (১). যদি সে মুসলিম হয়। (২). যদি সে মুকাল্লাফ (যার উপর শারী‘আতের বিধি-বিধান প্রযোজ্য) হয়। (৩). যদি সে সাওম পালন করতে সক্ষম হয়। (৪). যদি সে অবস্থানকারী (মুকিম) হয়। এবং (৫). যদি সাওম পালনে বাধাদানকারী বিষয়সমূহ তার মধ্যে না পাওয়া যায়। এই পাঁচটি শর্ত যে ব্যক্তির মধ্যে পাওয়া যায়; তার উপর সাওম পালন করা ফরজ। (ইসলামী সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-২৬৮১৪)। পক্ষান্তরে উপরোক্ত পাঁচটি শর্ত থাকার পরেও বিনা ওজরে ইচ্ছাকৃত সিয়াম ত্যাগ করা হারাম এবং কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। এখন যে ব্যক্তি বিনা ওজরে রমাদ্বনের সিয়াম ত্যাগ করে শরীয়তের দৃষ্টিতে সে ব্যক্তির দুটি কারণ হতে পারে। যেমন: (১). সিয়াম পালন করা ফরজ কিন্তু ব্যক্তি সেটা ফরজ বলে অস্বীকার করছে এবং তাকে একটি ইবাদত বলে স্বীকৃতি দিচ্ছে না; এটা বড় কুফরি। (২). সিয়াম পালন করা ফরজ ব্যক্তি সেটা জানে এবং মানে কিন্তু অলসতাবশত বিভিন্ন অজুহাতে সিয়াম পালন ত্যাগ করে। এটি ফাসেকী।
.
সুতরাং, প্রথম কারণ অনুযায়ী কোন ব্যক্তি যদি সিয়াম পালন করা ফরয বলে অস্বীকার করে ও বলে যে- সিয়াম শরীয়তে ফরয নয়, তাহলে সে কাফের ও মুরতাদ। কারণ, সে ইসলামের ফরজ পাঁচটি খুঁটির অন্যতম একটি খুঁটি সিয়ামকে অস্বীকার করে; যা আম-খাস সকলের পক্ষে জানা সহজ এবং যা ইসলামের একটি রুকন। আর তার এই মুরতাদ হওয়ার ফলে শরীয়তের বিধান অনুযায়ী একজন মুরতাদের মাল ও পরিবারের ব্যাপারে যা বিধান আছে তা কার্যকর হবে। অর্থাৎ, কোন মুসলিম যদি ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে মুরতাদ তথা নাস্তিক হয় অথবা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সম্পর্কে কটুক্তি করে দ্বীনের কোন বিধি-বিধান অস্বীকার করে উক্ত ব্যক্তি যদি সুস্থ-মস্তিস্ক, বালেগ, স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অধিকারী হয়; তাহলে মুরতাদের সকল শর্ত তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে এবং তার শাস্তি হলো মৃত্যুদন্ড। যেহেতু সে ধর্মত্যাগী কাফের হিসাবে গণ্য হয়েছে। (সূরা তওবাহ: ৬৫-৬৬)। শাইখুল ইসলাম, ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ (মৃ. ৭২৮হি.) বলেন, সাহাবীগণসহ সর্বযুগের ওলামায়ে কেরাম এ ব্যাপারে একমত যে ঐ ব্যক্তি কাফের, মুরতাদ এবং তাকে হত্যা করা ওয়াজিব। (ইবনু তায়মিয়াহ, আছ-সারেমুল মাসলূল ২/১৩-১৬)
.
তবে জেনে রাখা ভালো যে, কোন ব্যক্তি যদি মুরতাদ হয় তাহলে তাকে সাথে সাথে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে না, বিশেষ করে যদি তার ধর্মত্যাগ কিছু সন্দেহের কারণে ঘটে থাকে। বরং তাকে তওবা করতে বলা উচিত এবং তাকে ইসলামে ফিরে আসার সুযোগ দেওয়া উচিত। ফলে দ্বীনত্যাগে যদি তার কোন সন্দেহ থাকে তবে তার সন্দেহ দূর হবে। ইমাম ইবনে কুদামাহ আল-মুগনি বলেছেন: মুরতাদকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উচিত নয় যতক্ষণ না তাকে তিনবার তওবা করতে বলা হয়। এটি উমর, আলী, আতা, আল-নাখাই, মালিক, আল-সাওরী, আল-আওজায়ী, ইসহাক এবং অন্যান্য সহ অধিকাংশ আলেমদের অভিমত। কারণ, ধর্মভ্রষ্টতা সংশয়ের কারণে ঘটে এবং তা মুহূর্তের মধ্যে দূর করা যায় না।ব্যক্তিকে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার জন্য সময় দেওয়া উচিত এবং সর্বোত্তম সময় হলো তিন দিন। (ইবনে কুদামাহ আল-মুগনি; ৯/১৮)। অএতব, ধর্মত্যাগী ব্যক্তিকে ইসলামী শাসক তিনদিন সময় দিবেন এবং তাকে তওবা করতে আহ্বান করবে। যদি সে তওবা করে তাহলে তাকে মুক্তি দেওয়া হবে। কিন্তু যদি সে তওবা করতে অস্বীকৃতি জানায়; তাহলে তার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হবে। হত্যার পর তাকে গোসল করানো হবে না, তার জানাযা-নামায পড়ানো হবেনা এবং তাকে মুসলমানদের গোরস্থানে দাফন করা হবে না। মুরতাদকে হত্যা করার দলিল হচ্ছে- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, مَنْ بَدَّلَ دِينَهُ فَاقْتُلُوهُ “কেউ যদি দ্বীন পরিত্যাগ করে মুরতাদ হয়ে যায়, তবে তোমরা তাকে হত্যা করবে।” (সহীহ বুখারী, ইবনু মাজাহ, হা/২৫৩৫; নাসাঈ, হা/৪০৫৯, সনদ সহীহ)। উক্ত হাদীসে দ্বীন দ্বারা উদ্দেশ্য ইসলাম। আর এই শাস্তি বাস্তবায়ন করার অধিকার একমাত্র দেশের মুসলিম শাসকের। অর্থাৎ ইসলামের সব ধরনের হুদুদ কায়েম বা ফৌজদারি দণ্ডবিধি (যথা: মৃত্যুদণ্ড, বেত্রাঘাত, জেল, জরিমানা বা অন্যান্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ) বাস্তবায়ন করার একমাত্র অধিকারী সরকার বা তার স্থলাভিষিক্ত, সাধারণ কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নয়। তবে অবশ্য ইসলামী আইন চালু আছে এরূপ ইসলামী রাষ্ট্রের শুধুমাত্র ইসলামী আদালতের মাধ্যমেই কেবল এই শাস্তি বাস্তবায়ন করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ”তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আনুগত্য কর তাঁর রাসূলের ও তোমাদের মধ্যকার শাসন কর্তৃপক্ষের।”…(সূরা নিসা; ৪/৫৯)। তবে জেনে রাখা ভালো যে- শরীয়তে শাস্তি (হুদুদ) অপ্রাপ্ত বয়স্কদের কার্যকর করা হয়না। কারণ, তাদের ওপর এখনও শরীয়তের বিধি বিধান পালন আবশ্যক হয়নি। কিন্তু যারা প্রাপ্তবয়স্ক হবে তাদের ক্ষেত্রে শাস্তি (হাদ্দ) প্রযোজ্য হবে এতে কোন সন্দেহ নেই।
.
পক্ষান্তরে দ্বিতীয় কারণ অনুযায়ী যদি কেউ আলসেমি করে সিয়াম পালন না করে, তাহলে তার জন্য ভয়ানক কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে। আবু উমামা বাহেলী (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা রাসূল (ﷺ) ফজরের সালাতের সময় আমাদের নিকটে এসে বললেন, গতরাতে আমি একটি সত্য স্বপ্ন দেখেছি। তোমরা তা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ কর। আমার নিকট দু’জন লোক এসে আমার দু’হাত ধরে এক দুর্গম পাহাড়ের কাছে নিয়ে গিয়ে বলল, এতে আরোহণ করুন! আমি বললাম, আমি পর্বতারোহণে সক্ষম নই। তারা বললেন, আমরা শীঘ্রই আপনার জন্য তা সুগম করে দিব। আমি যখনই পা উঠাচ্ছিলাম তখনই সিঁড়িতে পা রাখছিলাম। অবশেষে পর্বতের সমতল ভূমিতে পৌঁছে গেলাম। হঠাৎ বিকট শব্দ শুনে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কিসের শব্দ? তারা বললেন, এটি জাহান্নামীদের আর্তনাদ। আমরা সামনের দিকে অগ্রসর হতেই সেখানে দেখলাম, একদল নারী ও পুরুষের পায়ের গোছায় রশি বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, চোয়াল ফাড়া আছে এবং তা থেকে রক্ত বেরুচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? তারা বললেন, এরা ঐ সকল লোক যারা সময়ের পূর্বে ইফতার করত।…….(মু‘জামুল কাবীর হা/৭৬৬৭; সহীহ ইবনে খুযায়মাহ হা/১৯৮৬; হাকেম হা/২৮৩৭; সহীহ আত তারগীব হা/২৩৯৩; সিলসিলা সহীহাহ হা/৩৯৫১; সনদ সহীহ)। উক্ত হাদীসে বর্ণিত ওরা হলো তারা যারা নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে ইফতার করত।
.
প্রিয় পাঠক একটু চিন্তা করুন; সিয়ান রাখার পরেও যদি এতো বড় শাস্তি হয়, তাহলে যারা সিয়াম পালন করে না তাদের কিরূপ শাস্তি হবে তা সহজেই অনুমেয়! মুস্তাফা মুহাম্মাদ আম্মারাহ তাঁর তারগীবের টীকায় বলেন, “উক্ত হাদীসের ভাবার্থ এই যে, মহান আল্লাহ তাঁর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-কে রোযা ভঙ্গকারীদের আযাব সম্বন্ধে ওয়াকেফহাল করেছেন। তিনি দেখেছেন, তাদের সেই দুরবস্থা; তাদের আকার-আকৃতি ছিল বড় মর্মান্তিক ও নিকৃষ্ট। কঠিন যন্ত্রণায় তারা কুকুর ও নেকড়ের মত চিৎকার করছে। তারা সাহায্য প্রার্থনা করছে অথচ কোন সাহায্যকারী নেই। তাদের পায়ের শেষ প্রান্তে (গোড়ালির উপর মোটা শিরায়) জাহান্নামের আঁকুশি দিয়ে কসাইখানার যবাই করা ছাগলের মত তাদেরকে নিম্নমুখে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আর তাদের কশ বেয়ে মুখভর্তি রক্ত ঝরছে! আশা করি নাফরমান বেরোযাদার মুসলিম সম্প্রদায় এই আযাবের কথা জেনে আল্লাহর নিকট তওবা করবে এবং তাঁর সেই আযাবকে ভয় করে যথানিয়মে রোযা পালন করবে।” (সহীহ তারগীব, টিকা ২/১০৯)। ইমাম যাহাবী (রঃ) বলেন, “মুমিনদের নিকটে এ কথা স্থির-সিদ্ধান্ত যে- যে ব্যক্তি কোন রোগ ও ওজর না থাকা সত্ত্বেও রমাযানের রোযা ত্যাগ করে, সে ব্যক্তি একজন ব্যভিচারী ও মদ্যপায়ী থেকেও নিকৃষ্ট। বরং মুসলিমরা তার ইসলামে সন্দেহ পোষণ করে এবং ধারণা করে যে, সে একজন নাস্তিক ও নৈতিক শৈথিল্যপূর্ণ মানুষ। (ইবনে তাইমিয়া মাজমূ’ ফাতাওয়া খন্ড:২৫ পৃষ্ঠা :২২৫ আল-কাবায়ের, ইমাম যাহাবী পৃষ্ঠা: ৪৯; ফিকহুস সুন্নাহ খন্ড:১ পৃষ্ঠা: ৩৮৪)। মহান আল্লাহ সবাইকে রমাদ্বন মাসের সিয়াম পালন করার তৌফিক দান করুক,,,আমীন।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।