ইমাম মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহাব রহ. এবং ওয়াহাবি মতবাদ সম্পর্কে একটি ঐতিহাসিক ভুল

ইমাম মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহাব রহ. সম্পর্কে আমাদের দেশের মুসলিমদের কাছে নানা অমূলক ও ভিত্তিহীন কথাবার্তা ছড়িয়ে আছে এবং তার উপর অর্পিত অনেক কঠিন কঠিন অপবাদ ও অভিযোগে বহু মানুষের কান ভারী হয়ে আছে। আর ‘ওয়াহাবি’ শব্দটি তো রীতিমত একটি এলার্জি। এর কারণ একটি ঐতিহাসিক ভুল-যা অধিকাংশ মানুষের নিকট অপরিচিত।
তাই এ বিষয়টি স্পষ্ট করার উদ্দেশ্যে ছোট্ট এ নিবন্ধটির অবতারণা। ওয়া বিল্লাহিত তাওফিক।

❑ ক. ইমাম মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহাব রহ. এবং তার দাওয়াতি ও সংস্কারমূলক কার্যক্রম:

ইমাম মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহাব রহ. [জন্ম: ১১১৫-মৃত্যু: ১২০৬ হিজরি মোতাবেক/১৭০৩ ও ১৭৯১ খৃষ্টাব্দ] ছিলেন এক যুগান্তকারী বিদগ্ধ আলেমে দ্বীন ও দাঈ, শিরক-বিদআতের বিরুদ্ধে এক অকুতোভয় মর্দে মুজাহিদ এবং ইলম ও লিখনির জগতে এর ক্ষুরধার মুসান্নিফ (লেখক)। তার রচিত বহু গ্রন্থ আজও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে। পথহারা মানুষ সেখান থেকে খুঁজে পাচ্ছে মুক্তির ঠিকানা। আল হামদুলিল্লাহ।

ইমাম মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব রহ. আরব উপদ্বীপে ১১০০/১২০০ হিজরিতে যে মহান সংস্কারের ডাক দিয়েছিলেন তার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোটা ছিল জাতিকে তাওহীদ ও সুন্নতের পথে ফিরে আসার এবং সর্বপ্রকার কুসংস্কার, কু প্রথা, অপসংস্কৃতি, শিরক ও বিদআত বর্জনের উদাত্ত আহ্বান।

নির্ভেজাল তাওহীদ ও সুন্নাহর প্রচার-প্রসার এবং তৎকালীন সমগ্র বিশ্বে-বিশেষ করে আরব উপদ্বীপে মুসলিমদের মাঝে জেঁকে বসা শিরক, বিদআত, রসম-রেওয়াজ ও হাজারও কুসংস্কার মূলোৎপাটনে এবং প্রকৃত খাঁটি ইসলামের মর্মবাণীকে সর্বশ্রেণীর মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অপরিসীম ত্যাগ-তিতিক্ষা, খেদমত ও সংস্কার কর্মের কারণে অনেক বিদগ্ধ আলেম তাকে হিজরি ১১ শতাব্দীর ‘মুজাদ্দিদ’ বা সংস্কারক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

উল্লেখ্য যে, ইমাম মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহাব রহ. এর ইলমি দিক নির্দেশনা এবং ইমাম মুহাম্মদ বিন সউদ রহ. এর সামরিক শক্তির সমন্বয়ে ১১৫৭ হিজরিতে আল্লাহর বিধানকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করা এবং আল্লাহর দেয়া আমানতকে মানুষের নিকট পৌঁছে দেয়ার নিমিত্তে ১ম সৌদি আরব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

কিন্তু হীন রাজনৈতিক স্বার্থে ইসলামের দুশমনরা এই মহান আন্দোলনকে কলুষিত করার সকল চক্রান্ত বাস্তবায়ন করেছে। ইসলামের শত্রুদের এহেন চক্রান্ত ও অপপ্রচারের ফলে ইমাম মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব রহ. এর সংস্কার মূলক বিশুদ্ধ তাওহীদী আন্দোলন সম্পর্কে মুসলিমদের এক বিরাট অংশে নানা প্রকার অমূলক, সংশয়, সন্দেহ ও ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়- মুসলিম বিশ্ব আজ পর্যন্ত যার খেসারত দিয়ে চলেছে। তাই তো যখনই তাওহীদ ও সু্ন্নাহ নির্ভর কোন দাওয়াতি কার্যক্রম শুরু করা হয় বা শিরক, বিদআত, কবর পূজা ও সমাজে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কথা বলা হয় তখনই একদল মানুষ ‘ওয়াহাবি’ ‘ওয়াহাবি’ বলে তেড়ে মারতে আসে! যা অত্যন্ত দু:খ জনক!

❑ খ. ওয়াহাবি মতবাদ সম্পর্কে একটি চরম ঐতিহাসিক ভুল:

আমাদের জানা প্রয়োজন যে, হিজরি ২য় শতাব্দীতে উত্তর আফ্রিকায় জনৈক আব্দুল ওয়াহাব ইবনে রুস্তম নামক একজন ইবাজী-খারেজীর মাধ্যমে আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আকিদা পরিপন্থী একটি চরম উগ্রপন্থী ভ্রান্ত ফিরকার আবির্ভাব ঘটে। যেটিকে তৎকালীন হক পন্থী আলেমগণ ‘ওয়াহাবি ফিরকা’ বা ‘ওয়াহাবি মতবাদ’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন এবং তার ভয়াবহতা সম্পর্কে জাতিকে সতর্ক করেছিলেন।

কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত: সাম্রাজ্যবাদী ইহুদী-খ্রিস্টানরা তাদের হীন চক্রান্ত চরিতার্থ করার স্বার্থে সেই উত্তর আফ্রিকার ওয়াহাবি ফিরকার নামটি সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে আরবের ইমাম আব্দুল ওয়াহাবের দাওয়াতি ও ইসলাহি (সংস্কার মূলক) আন্দোলনের উপর চাপিয়ে দেয়-যা ঐতিহাসিক ভুল ছাড়া অন্য কিছু নয়।

➧ আফ্রিকায় প্রচারিত ‘ওয়াহাবি মতবাদ’ সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন,

“ঠিক ১০০ হিজরিতে এই খারেজি-ইবাজি ওয়াহাবি মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল ওয়াহাব বিন আব্দুর রহমান বিন রুস্তম [জন্ম: ৭৮৪ ও মৃত্যু: ৮৩২ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ১৯৭ হিজরি] উত্তর আফ্রিকায় হজ্জ বাতিল করে এবং শরিয়তের বিধিবিধান কে অকার্যকর বলে ঘোষণা দেয়। যার প্রেক্ষিতে তার মাঝে এবং আলজেরিয়ার আলেমদের মাঝে একাধিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। অবশেষে ৮৩২ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ১৯৭ হিজরিতে সে মৃত্যু মুখে পতিত হয়।” আলহামদুলিল্লাহ।

[তথ্যসূত্র: সাইদুল ফাওয়ায়েদ ওয়েবসাইটে প্রকাশিত تصحيح خطأ تاريخي حول الوهابية “ওয়াহাবি মতবাদ সম্পর্কে একটি ঐতিহাসিক ভ্রান্তি নিরসন” শীর্ষক প্রবন্ধ। আরবি উইকিপিডিয়া সাহায্যে প্রাপ্ত]

এ ঐতিহাসিক ভুল সংশোধনী সম্পর্কে আরবি ভাষায় বেশ কিছু বই লেখা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বই হল: “সংস্কার ধর্মী ওয়াহাবী আন্দোলন সম্পর্কিত এক ঐতিহাসিক ভ্রান্তি নিরসন।”
মূল লেখক: ড: মোহাম্মাদ বিন সা’দ শুয়াইইর, উপদেষ্টা, সউদি আরবের প্রধান মুফতি এবং সম্পাদক, আল বুহুস আল ইসলামিয়া (ইসলামী গবেষণা) ম্যাগাজিন।
ভাষান্তর: মোহাম্মাদ রকীবুদ্দীন আহমাদ হুসাইন
মুদ্রণ ও প্রকাশনা: ইসলামী গবেষণা ও ফতোয়া বিষয়ক প্রধান কার্যালয়, রিয়াদ, সউদি আরব।
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ২৬২, প্রথম সংস্করণ: ২০০৩
➧ বইটি ডাউন লোড করুন মিডিয়া ফায়ার থেকে [PDF-52.6 MB]
http://www.mediafire.com/…/wahabi_andolon_niye_bhul_dh…/file
▬▬▬◆◯◆▬▬▬
লেখক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড সেন্টার, সৌদি আরব।