আল্লামা মুহাম্মদ নাসিরুদ্দীন আলবানী রহ. এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

◈ভূমিকা:

إنَّ الْحَمْدَ لِلَّهِ نَحْمَدُهُ وَنَسْتَعِينُهُ وَنَسْتَغْفِرُهُ وَنَعُوذُ بِاللَّهِ مِنْ شُرُورِ أَنْفُسِنَا وَمِنْ سَيِّئَاتِ أَعْمَالِنَا مَنْ يَهْدِهِ اللَّهُ فَلا مُضِلَّ لَهُ وَمَنْ يُضْلِلْ فَلا هَادِيَ لَهُ وَأَشْهَدُ أَنْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَحْدَهُ لا شَرِيكَ لَهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ-أمَّا بَعْدُ

আল্লামা মুহাম্মদ নাসিরুদ্দীন আলবানী রহ.। এক আলোকোজ্জ্বল জীবনের প্রতিবিম্ব। ইলমী জগতে বিংশ শতাব্দীর এক বিস্ময়। আধুনিক যুগে মুসলিম জাহানের একজন স্বনামধন্য আলেমে দ্বীন। প্রবল ইচ্ছা শক্তি, অসীম সাহস, সুদৃঢ় মনোবল আর ইখলাস ভরা প্রত্যয় থাকলে আল্লাহর রহমতে কিভাবে একজন সাধারণ মানুষ ‘শতাব্দীর ‘শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস’ এ পরিণত হতে তার জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছেন আল্লামা আলাবানী।

আধুনিক বিশ্বে শাইখ আলবানীকে ইলমে হাদীসের ক্ষেত্রে বিশেষ করে ইলমুল জারহে ওয়াত তাদীলের[1] ক্ষেত্রে এক স্বতন্ত্র প্রতিভাধারী আলেম হিসেবে গণ্য করা হয়। ইলমে মুস্তালাহুল হাদীসের[2] ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য বক্তিত্ব। তাই তো মুহাদ্দিসগণ বলেছেন, “আল্লামা আলবানী যেন ইবনে হাজার আসকালানী, হাফেয ইবনে কাসীর প্রমুখ ইলমুল জারহে ওয়াত তাদীলের আলেমদের যুগকে আবার ফিরিয়ে এনেছেন!”

তাই আসুন, হাদীসে নববীর এই নিরলস খাদেম, সালফে সালেহীনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি, মুহাদ্দিস, ফকীহ, দাঈ, ইসলামী চিন্তাবিদ, লেখক ও গবেষক আল্লামা মুহাম্মদ নাসিরুদ্দীন আলবানী রহ. এর সাথে পরিচিত হই।

বিনীত-
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়,
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব
২৪/৮/২০১৬ইং

আল্লামা মুহাম্মদ নাসিরুদ্দীন আলবানী রহ.এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
—————
◈ জন্ম ও পরিচয়:

নাম: মুহাম্মদ নাসিরুদ্দীন, পিতার নাম: আলহাজ্ব নূহ। দাদার নাম: নাজাতী। ডাক নাম: আবু আব্দুর রহমান। ইউরোপের মুসলিম অধ্যুষিত দেশ আলবেনিয়ায় তার জন্ম হওয়ায় তাকে আলবানী বলা হয়। তিনি ১৩৩৩ হিজরী মোতাবেক ১৯১৪ খৃষ্টাব্দে আলবেনিয়ার রাজধানী স্কোডার (Shkodër-বর্তমান নাম তিরানা) এ জন্ম গ্রহণ করেন। তার পরিবার ছিল দরিদ্র। কিন্তু দ্বীনদারী ও জ্ঞানার্জন তাদের দরিদ্রতার উপর ছিল বিজয়ী। তার পিতা ছিলেন আলবেনিয়ার একজন বিজ্ঞ আলেম। ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের জন্য মানুষ তার কাছে ছুটে যেত। তিনি সাধ্যানুযায়ী মানুষকে দ্বীনের জ্ঞান দিতেন এবং তাদেরকে দিক নির্দেশনা প্রদান করতেন। তিনি তুরস্কের ইস্তাম্বুলে শরীয়াহ বিষয়ে শিক্ষকতা করেন।

আলবেনিয়ায় প্রেসিডেন্ট আহমদ জাগু পাশ্চাত্য সেকুলার সভ্যতার দিকে ধাবিত হয়ে নারীদের পর্দা নিষিদ্ধ করলে তিনি শিশু আলবানীকে নিয়ে সপরিবারে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে হিজরত করেন।

◈ শিক্ষা জীবন:

দামেস্ক আসার পর আলবানীর বয়স প্রায় নয় বছর হলে তার পিতা তাকে সেখানকার ‘স্কুল অব এইড চ্যারিটি’ নামক একটি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। সেখানেই তিনি কৃতিত্বের সাথে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন।

প্রচলিত একাডেমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় দ্বীন সম্পর্কে ভালো জ্ঞানার্জনের ব্যবস্থা ছিল না। বিধায় তার পিতা এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজ ছেলের পড়া-শোনার ক্ষেত্রে ভিন্ন দৃষ্টি পোষণ করতেন। এ কারণে, তিনি নিজে সন্তানের জন্য স্বতন্ত্র শিক্ষা সিলেবাস তৈরি করে তার মাধ্যমে তাকে আল কুরআনুল কারীম, তাজবীদ, নাহু, সরফ এবং হানাফী ফিকাহ ইত্যাদি বিষয় শিক্ষা দিতে লাগলেন। ফিকাহের মধ্যে হানাফী ফিকাহের অন্যতম কিতাব মুখতাসরুল কুদুরী পড়ান। তিনি তার পিতার কাছেই হাফস বিন আসেম এর রেয়াওয়াত অনুযায়ী কুরআনের হিফয সমাপ্ত করেন।

◈ শায়খ আলবানীর শিক্ষকগণ:

ইমাম আলবানীর শিক্ষকের সংখ্যা ছিল হাতেগণা কয়েকজন। তন্মধ্যে:

১) তার পিতা শায়খ আলহাজ্ব নূহ।

২) তার পিতার বন্ধু বিশিষ্ট আলেম শাইখ সাঈদ আল বুরহানীর নিকট কিশোর আলবানী হানাফী ফিকাহের কিতাব মুরাকিল ফালাহ, নাহুর কিতাব শুযূরুয যাহাব এবং আধুনিক যুগের লিখা আরবী সাহিত্য ও ইলমুল বালাগাহর কিছু কিতাব পড়েন।

৩) এর পাশাপাশি তিনি তখনকার দামেস্কের প্রসিদ্ধ আলেম আল্লামা মুহাম্মদ বাহজা আল বাইতারের বিভিন্ন দারসে অংশ গ্রহণ করতেন।

৪) আলবানী রহ. এর আরেকজন শায়খ হলেন আল্লামা রাবিগ আত ত্বব্বাখ। তিনি সিরিয়ার অত্যন্ত বড়মাপের একজন আলেম ছিলেন। তিনি পরিচিত ছিলেন হালাবের আল্লামা হিসেবে। এই শায়খের নিকট তিনি হাদীস পড়েন। অত:পর তিনি আলবানী রহ. কে হাদীসের ইজাযা প্রদান করেন।

◈ কর্ম জীবন:

তিনি তার পিতার কাছেই ঘড়ি মেরামতের কাজ শিখেন এবং এ ক্ষেত্রে সুখ্যাতি অর্জন করেন। এরপর তিনি ঘড়ি মেরামতকেই জীবীকার পেশা হিসেবে বেছে নেন। এই পেশায় তিনি ব্যক্তিগত পড়া-লেখা ও বিভিন্ন কিতাবাদি অধ্যয়নের পর্যাপ্ত সময় পান। এভাবে সিরিয়ায় হিজরতের মাধ্যমে তার জন্যে আরবী ভাষা ও মূল উৎস থেকে শরীয়তের জ্ঞানার্জনের পথ সুগম হয়।

◈ হাদীস অধ্যয়নের প্রতি মনোনিবেশ

যদিও তার পিতার ঐকান্তিক ইচ্ছা ছিল তার ছেলে যেন হানাফী মাজহাবের তাকলীদ করে। যার কারণে তিনি তাঁকে ইলমে হাদীস চর্চায় মনোনিবেশ করতে সতর্ক করতেন। তথাপি আলবানী ইলমুল হাদীস ও হাদীস চর্চার দিকে ঝুঁকে পড়েন। এ ক্ষেত্রে তাঁকে প্রেরণা যোগায় শাইখ মুহাম্মদ রশীদ রেজা কর্তৃক প্রকাশিত আল মানার নামক একটি মাসিক ম্যাগাজিন। সেখানে হাদীস বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন সন্দর্ভ প্রকাশিত হয় এবং তিনি সেগুলো নিয়মিতভাবে অধ্যয়ন করতে থাকেন। এভাবে ধীরে ধীরে হাদীস চর্চায় মনোনিবেশ করার জন্য তার মন ব্যাকুল হয়ে উঠে। তারপর ব্যাপক আগ্রহ সহকারে হাদীস চর্চা শুরু করেন। ফলে মাত্র বিশ বছর বয়সে তিনি হাদীসের ক্ষেত্রে যথেষ্ট বুৎপত্তি অর্জন করেন।

এবার তিনি হাদীসের সেবায় কলম ধরলেন। সর্ব প্রথম যে কাজটি করলেন তা হল, তিনি হাফেজ ইরাকী রহ. এর লিখা “المغني عن حمل الأسفار في تخريج ما في الإحياء من الأخبار ”নামক কিতাবটি কপি করে তাতে টিকা সংযোজন করলেন।

শাইখের এই কাজটি তার সামনে হাদীস নিয়ে গবেষণার বিশাল দরজা খুলে দেয়। এরপর ইলমে হাদীস নিয়ে গবেষণা করা তার প্রধান কাজে পরিণত নয়। ক্রমেই তিনি দামেস্কের ইলমী জগতে এ বিষয়ে পরিচিতি লাভ করেন।

যার পরিপ্রেক্ষিতে দামেস্কের জাহেরিয়া লাইব্রেরী কর্তৃপক্ষ তার জন্য বিশেষ একটি কক্ষ নির্ধারণ করে দেয়, যেন তিনি সেখানে অবস্থান করে গবেষণা কর্ম চালাতে পারেন। সেই সাথে লাইব্রেরীর একটি চাবিও তাকে দেয়া হয় যেন তিনি যখন খুশি তাতে প্রবেশ করতে পারেন।

তবে বই-পুস্তক লেখা শুরু করেন তার জীবনে দ্বিতীয় স্তরে। এই পর্যায়ে এসে তিনি সর্ব প্রথম যে গ্রন্থটি রচনা করে তা হল: تحذير الساجد من اتخاذ القبور مساجد এটি একটি দলীল নির্ভর তুলনামূলক আলোচনা ভিত্তিক ফিকাহের কিতাব। এটি একাধিক বার মুদ্রিত হয়েছে।

ইলমে হাদীসের রীতি অনুসারে হাদীসের তাখরীজ সংক্রান্ত প্রথম পর্যায়ের অন্যতম একটি গ্রন্থ হল:

الروض النضير في ترتيب و تخريج معجم الطبراني الصغير”

যা এখানো পাণ্ডুলিপি আকারেই রয়েছে।

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীসের সাথে যুক্ত থাকার কারণে শাইখ আলবানীর মধ্যে সালাফী চিন্তা-চেতনার বিকাশ ঘটে। সেই সাথে সালাফী ধারার বিশ্ব বরেণ্য আলেম শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া এবং তার ছাত্র ইবনুল কাইয়েম রহ. রচিত গ্রন্থাদি অধ্যয়ন করার ফলে এই রীতির উপর তার দৃঢ়তা আরও মজবুত হয়।

শাইখ আলবানী এবার সিরিয়ায় তাওহীদ ও সুন্নাহর দিকে দাওয়াতের পতাকা তুলে ধরলেন। ফলে সিরিয়ার অনেক আলেম ওলামা তার সাক্ষাতে আসেন এবং শাইখ ও ঐ সকল আলেমদের মাঝে তাওহীদের বিভিন্ন মাসআলা, কুরআন-সন্নাহর অনুসরণ, মাজহাবী গোঁড়ামি, বিদআত ইত্যাদি অনেক বিষয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা ও তর্ক-বিতর্ক হয়।

ফলে মাজহাবের অন্ধভক্ত গোঁড়া আলেম-ওলামা, সুফি, বিদআতী এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন একশ্রেণীর নামধারী আলেমদের পক্ষ থেকে তিনি প্রচণ্ড বিরোধিতার সম্মুখীন হন। এ সকল ব্যক্তিরা সাধারণ অজ্ঞ-মূর্খ লোকদেরকে তার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তোলে। তাকে ‘পথভ্রষ্ট ওহাবী’ বলে অপপ্রচার চালাতে থাকে এবং জনসাধারণকে শাইখ থেকে সর্তক করতে থাকে।

অপরপক্ষে তার দাওয়াতের সাথে ঐকমত্য পোষণ করেন দামেস্কের ইলম ও পরহেজগারীতায় প্রসিদ্ধ স্বনামধন্য আলেম-ওলামাগণ। তারা শাইখকে তার দাওয়াতের পথে দৃঢ় কদমে এগিয়ে যাওয়ার প্রতি উৎসাহিত করেন। সে সকল ওলামাগণের মধ্যে অন্যতম হলেন: বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন আল্লামা বাহজাত আল বাইতার, সিরিয়া মুসলিম যুব সংঘের প্রধান শাইখ আব্দুল ফাত্তাহ আল ইমাম, শাইখ তাওফীক আল বাযারাহ প্রমুখ।

◈ শাইখ আলবানীর দাওয়াহ কার্যক্রম:

তিনি প্রতি সপ্তাহে দুদিন আকীদাহ, ফিকাহ, উসুল এবং ইলমুল হাদীস ইত্যাদি বিষয়ে দারস প্রদান করতেন। এতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণও উপস্থিত হতেন। এতে তিনি যে সকল বইয়ের উপর দারস প্রদান করতেন সেগুলো হল:

১) ফাতহুল মাজীদ, লেখক: আব্দুর রহমান বিন হাসান বিন মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহাব।

فتح المجيد لعبد الرحمن بن حسن بن محمد بن عبد الوهاب

২) আর রওজাতুন নাদিয়াহ শারহুদ দুরারুল বাহিয়্যাহ লিশ শাওকানী শারহু সিদ্দীক হাসান খাঁন।

الروضة الندية شرح الدرر البهية للشوكاني شرح صديق حسن خان.

৩) উসূলুল ফিকাহ, লেখক: আব্দুল ওয়াহাব খাল্লাফ।

أصول الفقه لعبد الوهاب خلاف

৪) আল বায়িসুল হাসীস শারহু ইখতিসারি উলূমিল হাদীস লি ইবনে কাসীর, লেখক: আহমদ শাকের।

الباعث الحثيث شرح اختصار علوم الحديث لابن كثير شرح احمد شاكر

৫) মিনহাজুল ইসলাম ফিল হুকম, লেখক: মুহাম্মদ আসাদ।

منهاج الإسلام في الحكم لمحمد أسد

৬) ফিকহুস সুন্নাহ, লেখক: সাইয়েদ সাবিক।

فقه السنه لسيد سابق

খ) প্রতি মাসে নিয়মিতভাবে তিনি দাওয়াতী সফরে বের হতেন। প্রথম পর্যায়ে তিনি মাসে এক সপ্তাহ দাওয়াতী কাজ করতেন। পরবর্তীতে তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল। তিনি সিরিয়ার বিভিন্ন জেলায় দাওয়াত নিয়ে যেতেন। পাশাপাশি জর্ডানেরবিভিন্ন এলাকায়ও সফর করতেন এবং অবশেষে তিনি জর্ডানের রাজধানী আম্মানে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেছিলেন। এই কারণে তার কিছু দুশমন সিরিয় সরকারের কাছে তার ব্যাপারে চুগলখোরি করলে সরকার তাকে জেলে পাঠায়।

◈ কষ্টে ধৈর্য ধারণ ও হিজরত:

১৯৬০ সালের প্রথম দিকে শাইখ সিরিয়া ক্ষমতাসীনদের নজরদারীতে পড়েন যদিও তিনি রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন। যা তার সামনে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। তিনি দুবার গ্রেফতার হয়েছেন। প্রথমবার ৬৮ সালের আগে দামেস্কের কেল্লা কারাগারে বন্দি ছিলেন একমাসের জন্য। এটা সেই কারাগার যেখানে শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. কে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। ৬৮ সালের যুদ্ধের সময় সিরিয় সরকার সকল রাজবন্দীকে মুক্ত করে দিলে তিনিও মুক্ত হন।

কিন্তু যুদ্ধ আরও কঠিন রূপ ধারণ করলে শাইখকে পুনরায় কারাবরণ করতে হয়। কিন্তু এবার কেল্লা কারাগারে নয় বরং দামেস্কের পূর্ব-উত্তরাঞ্চলের আল হাসাকা কারাগারে। শাইখ এখানে আট মাস অতিবাহিত করেন। কারাগারে অবস্থানের এই আট মাস সময়ে তিনি হাফেয মুনযেরীর লেখা মুখতাসার সহীহ মুসলিম তাহকীক করেন এবং সেখানে অন্যান্য বড় বড় রাজবন্দী ব্যক্তিত্বের সাথে মিলিত হন।

পরবর্তীতে তিনি সিরিয়া ছেড়ে জর্ডানে পাড়ি জমান এবং রাজধানী আম্মানে স্থায়ী ভাবে বসবাস করেন। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন।

◈ কার্যক্রম ও অবদান:

শাইখের অনেক ইলমী অবদান ও খেদমত রয়েছে। তন্মধ্যে:

১) শাইখ দামেস্ক একাডেমীর কতিপয় শিক্ষকদের সাথে আল্লামা বাহজাত আল বাইতারের বিভিন্ন দারসে অংশ গ্রহণ করতেন। সে সকল শিক্ষকদের একজন হলেন ইযযুদ্দীন আত তানূহী রহ.।

২) দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীয়া ফ্যাকাল্টির পক্ষ থেকে তাকে ইসলামী ফিকাহ কোষ এর বুয়ূ বা ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত হাদীসগুলো তাখরীজ করার জন্য মনোনীত করা হয় যা ১৯৫৫ইং সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।

৩) মিসর ও সিরিয়া একীভূত হওয়ার যুগে হাদীসের কিতাব সমূহ তাহকীক ও প্রচার-প্রসারের নিমিত্তে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। শাইখকে এই প্রকল্প তত্ত্বাবধান কমিটির সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দেয়া হয়।

৪) ভারতের ঐতিহ্যবাহী দীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেয়া বেনারসে হাদীসের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার জন্য তার নিকট প্রস্তাব পাঠানো হয়। কিন্তু তৎকালীন সময় ভারত-পাকিস্তানের মাঝে যুদ্ধ চলছিল। তাই স্ত্রী-পরিবার নিয়ে যাওয়া কঠিন হওয়ায় তিনি সেখানে যেতে অপারগতা পেশ করেন।

৫) সৌদি আরবের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী শাইখ হাসান আলুশ শাইখ আব্দুল্লাহ ১৩৮৮ হিজরীতে মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের হায়ার ডিপ্লোমা ইন ইসলামী স্টাডিজ বিভাগের ডিন হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার জন্য তাঁর নিকট আবেদন করেন কিন্তু পরিস্থিতির কারণে তা গ্রহণ করা সম্ভব হয় নি।

৬) ১৩৯৫ হিজরী থেকে ১৩৯৮ হিজরী পর্যন্ত মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেট সদস্য হিসেবে তাকে মনোনীত করা হয়।

৭) স্পেনের মুসলিম স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন এর আহবানে তিনি সেখানে গিয়ে অত্যন্ত সারগর্ভ বক্তব্য প্রদান করেন যা পরবর্তীতে ‘আকীদা ও আহকাম উভয় ক্ষেত্রেই হাদীস স্বয়ং সম্পন্ন প্রমাণ’ এই শিরোনামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।

৮) কাতার সফরে গিয়ে সেখানে বক্তব্য প্রদান করেন। বক্তব্যের বিষয় ছিল: “ইসলামে সন্নাহর মর্যাদা।”

৯) সৌদি আরবের মহামান্য গ্র্যান্ড মুফতী শাইখ আব্দুল্লাহ বিন বায রহ. এর পক্ষ থেকে তিনি মিসর ও মরক্কো এর ফতোয়া ও গবেষণা বোর্ডের প্রধান হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। অনুরূপভাবে ব্রিটেনের তাওহীদ ও কুরআন-সন্নাহর দিকে আহবানের জন্য গঠিত একটি ইসলামী সংগঠনের প্রধান হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন।

১০) তাঁকে দেশে-বিদেশে অনেক সম্মেলনে অতিথি হিসেবে আহবান করা হয়। কিন্তু তিনি তার জ্ঞান-গবেষণার কাজে ব্যস্ততার দরুন অনেক দাওয়াতে সাড়া দিতে পারেন নি।

১১) তিনি কুয়েত ও আরব আমিরাতে সভা-সেমিনারে অনেক বক্তব্য প্রদান করেন। অনুরূপভাবে ইউরোপের কয়েকটি দেশে গমন করে সেখানকার মুসলিম অভিবাসী ও শিক্ষার্থীদের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং অনেক মূল্যবান দারস পেশ করেন। এছাড়াও তিনি ব্রিটেন এবং জার্মানিতে দাওয়াতী উদ্দেশ্যে সফর করেন।

১২) শাইখের নিকট থেকে শিক্ষা অর্জন করে অগণিত ছাত্র বের হয়েছে যারা পরবর্তীতে বড় বড় গবেষক হিসেবে ইসলামে সেবায় আত্ম নিয়োগ করে করেছেন।

◈ ইমাম আলবানীর কতিপয় ছাত্র:

শাইখ আলবানী বিভিন্ন দেশ প্রচুর সফর করতেন। যার কারণে তার ছাত্রের সংখ্যাও প্রচুর যারা তার জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে কতিপয় ছাত্র হল,

১) আলামা ইহসান ইলাহী যহীর
২) ডক্টর বাসিম ফায়সাল আল জাওয়াবিরাহ
৩) শায়খ হুসাইন বিন আউদাহ আল উয়াইশাহ
৪) আল্লামা শায়খ রবী বিন হাদী আল মাদখালী
৫) শায়খ আলী হাসান আল হালাবী
৬) শায়খ মুকবিল বিন হাদী আল ওয়াদাঈ
৭) শায়খ মাশহুর হাসান আলে সালমান
৮) শায়খ জামীল যাইনূ
এছাড়াও অসংখ্য বড় বড় আলেম রয়েছেন যারা শাইখ আলবানী রাহ. এর সান্বিধ্যে থেকে ইলম অর্জন করেছেন।

◈ তাঁর লিখিত কিতাবাদি ও গবেষণা:

শাইখের অনেক মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ বই-পুস্তক ও গবেষণা কর্ম রয়েছে। সেগুলোর সংখ্যা শতাধিক। তন্মধ্যে অনেকগুলোই বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে। কোন কোনটি একাধিকবার মুদ্রিত হয়েছে। সেগুলো থেকে নিম্নে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বইয়ের তালিকা প্রদান করা হল:

১) ইরওয়াউল গালীল ফী তাখরীজি আহাদীসি মানারিস সাবীল। (নয় খণ্ডে সমাপ্ত)

إرواء الغليل في تخريج أحاديث منار السبيل

২) সিলসিলাতুল আহাদীসিস সাহীহাহ। (সহীহ হাদীস সিরিজ এবং সেগুলোর কিছু ব্যাখ্যা ও শিক্ষা।) (সাত খণ্ডে সমাপ্ত)

وسلسلة الأحاديث الصحيحة و شيء من فقهها و فوائدها

৩) সিলসিলাতুল আহাদীসিয যাঈফাহ ওয়া মাযূআহ (দূর্বল ও বানোয়াট হাদীস সিরিজ এবং মুসলিম উম্মাহর মধ্যে তার কুপ্রভাব)। (চৌদ্দ খণ্ডে সমাপ্ত)

سلسلة الأحاديث الضعيفة و الموضوعة و أثرها السيئ في الأمة

৪) সাহীহ ওয়া যাঈফ সুনান আবূ দাউদ (সুনান আবুদাউদের হাদীসগুলো তাখরীজ এবং তাহকীক করে সহীহ ও যঈফ দুভাবে ভাগ করা হয়েছে।) (দশ খণ্ডে সমাপ্ত)

صحيح وضعيف سنن أبي داود

৫) সাহীহ ও যাঈফ সুনান নাসাঈ (সুনান নাসাঈর হাদীসগুলো তাহকীক করে সহীহ ও যঈফ দুভাবে ভাগ করা হয়েছে।) (সাত খণ্ডে সমাপ্ত)

صحيح وضعيف سنن النسائي

৬) সাহীহ ওয়া যাঈফ সুনান তিরমিযী (সুনান তিরমিযীর হাদীসগুলো তাহকীক করে সহীহ ও যঈফ দুভাবে ভাগ করা হয়েছে।)(সাত খণ্ডে সমাপ্ত)

صحيح وضعيف سننالترمذي

৭) সাহীহ ওয়া যাঈফ সুনান ইবনে মাজাহ (সুনান ইবনে মাজার হাদীসগুলো তাহকীক করে সহীহ ও যঈফ দুভাবে ভাগ করা হয়েছে।) (ছয় খণ্ডে সমাপ্ত)

صحيح وضعيف سننابن ماجه

৮) সহীহ ওয়া যঈফুত তারগীব ওয়াত তারহীব। (তারগীব ওয়াত্ তারহীব কিতাবের হাদীসগুলো তাহকীক করে সহীহ ও যঈফ দুভাবে ভাগ করা হয়েছে।) (পাঁচ খণ্ডে সমাপ্ত)

صحيح وضعيف الترغيب والترهيب

৯) তাববীব ওয়া তারতীবু আহাদীসিল জামে’ আসসাগীর।

تبويب وترتيب أحاديث الجامع الصغير وزياداته على أبواب الفقه

১০) সহীহ ওয়া যাঈফুল জামে’ আস সাগীর ওয়া যিয়াদাহিহী।

صحيح وضعيف الجامع الصغير وزياداته

১১) আত তা’লীকাতুল হিসান আলা সাহীহ ইবনে হিব্বান।

التعليقات الحسان على صحيح ابن حبان

১২) সহীহুল আদাবুল মুফরাদ। (এই গ্রন্থে ইমাম বুখারী রহ. রচিত আল আদাবুল মুফরাদ কিতাবের সহীহ হাদীসগুলো তাহকীক করে পৃথক করা হয়েছে।)

صحيح الأدب المفرد

১৩) যঈফুল আদাবুল মুফরাদ। (এই গ্রন্থে ইমাম বুখারী রহ. রচিত আল আদাবুল মুফরাদ কিতাবের দূর্বল হাদীসগুলো তাহকীক করে পৃথক করা হয়েছে।)

ضعيف الأدب المفرد

১৪) তামামুল মিন্নাহ ফীত্ তা’লীক আলা ফিকহিস সুন্নাহ। (আল্লামা সাইয়েদ সাবিকের লেখা ফিকহুস সুন্নাহ গ্রন্থের তাহকীক ও তাতে টিকা সংযোজন।)

تمام المنة في التعليق على فقه السنة

১৫) তাহকীক মিশকাতিল মাসাবীহ লিত তিবরীযী। (মিশকাতুল মাসাবীহের তাহকীক)

تحقيق كتاب مشكاة المصباح للتبريزي

১৬) আস সুমুরুল মুসতাত্বাব ফী ফিকহিস সুন্নাহ ওয়া কিতাব।

الثمر المستطاب في فقه السنة والكتاب

১৭) আত তাওহীদ আওয়ালান ইয়া দুআতাল ইসলাম। (হে ইসলাম প্রচারকগণ,সর্বপ্রথম তাওহীদের দাওয়াত দিন)

التوحيد أولاً يا دعاة الإسلام

১৮) ফাযলুস সালাতি ‘আলান্নাবী। (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর দুরুদ পাঠের ফযীলত)

فضل الصلاة على النبي صلى الله عليه وسلم

১৯) ফিতনাতুত তাকফীর। (মুসলমানকে কাফির বলার ফিতনা)

فتنة التكفير

২০) তাহযীরুস সাজিদ মিন ইত্তিখাযিল কুবূরি মাসাজিদ। (কবরকে মসজিদ বানানোর ব্যাপারে সতর্কতা)

تحذير الساجد من اتخاذ القبور مساجد

২১) শারহুল আকীদাহ আত ত্বহাবীয়্যাহ। (আকীদা ত্বহাবিয়ার ব্যাখ্যা)

شرح العقيدة الطحاوية

২২) তাহকীক মুখতাসারুর উলূ’ লিল আলিয়্যিল গাফফার (ইমাম যাহাবীর লেখামুখতাসার আল ঊলূ কিতাবের তাহকীক)

تحقيق مختصر العلو للعلي الغفار لمحمد بن أحمد بن عثمان الذهبي

২৩) কিতাবুল ঈমান (ইমাম ইবনে তাইমিয়া রচিত কিতাবুল ঈমানের তাহকীক ও তাখরীজ)

تحقيق و تخريج كتاب الإيمان لابن تيمية

২৪) জিলবাবুল মারআতিল মুসলিমাহ (মুসলিম নারীর পর্দা)

جلباب المرأة المسلمة

২৫) হিজাবুল মারআহ ও লিবাসুহা ফিস সালাহ (শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. রচিত নামাযে নারীর পর্দা ও পোশাক শীর্ষক কিতাবের তাহকীক ও তাতে টিকা সংযোজন)

حجاب المرأة ولباسها في الصلاة تأليف: شيخ الإسلام ابن تيمية

২৬) আর রাদ্দুল মুফহিম (যারা নারীদেরমুখ ও হস্তদ্বয় ঢাকাকে ওয়াজিব বলে তাদের প্রতিবাদ)

الرد المفحم، على من خالف العلماء وتشدد وتعصب، وألزم المرأة بستر وجهها وكفيها وأوجب، ولم يقتنع بقولهم: إنه سنة ومستحب

২৭) তাহরীমু আলাতিত ত্বরব। (বাদ্য যন্ত্র হারাম)

تحريم آلات الطرب

২৮) ওসীলা গ্রহণ: প্রকার ও বিধিবিধান

التوسل أنواعه وأحكامه

২৯) আহকামুল জানাইয (জানাযার বিধান ও বিদআত সমূহ)

أحكام الجنائز وبدعها

৩০) যিলালুল জান্নাহ ফী তাখরীজিস সুন্নাহ

ظلال الجنة في تخريج السنة لابن أبي عاصم

৩১) আদাবুয যুফাফ (সুন্নাহর আলোকে বাসর শয্যার আদব)

آداب الزفاف في السنة المطهرة

৩২) মানাসিকুল হাজ্জ ওয়াল উমরাহ (হজ্জ ও উমরার বিধিবিধান)

مناسك الحج والعمرة في الكتاب والسنة وآثار السلف وسرد ما ألحق الناس بها من البدع

৩৩) কিয়ামু রামাযান (রামাযান মাসে তারাবীহর নামাযের ফযীলত, নিয়ম-কানুন, জামায়াতে আদায়ের বৈধতা এবং ইতেকাফ সংক্রান্ত আলোচনা)

قيام رمضان

৩৪) সালাতুত তারাবীহ (তারাবীহর সালাত)

صلاة التراويح

৩৫) সহীহু সীরাতিন নববিয়্যাহ (বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়া সাল্লামের জীবনী)

صحيح السيرة النبوية

৩৬) সালাতুল ঈদাইন ফিল মুসাল্লা (ঈদগাহে ঈদের নামায পড়া সুন্নত)

صلاة العيدين في المصلى هي السنة

৩৭) তাহকীক ফিকহিস সীরাহ (মুহাম্মদ গাযালী রচিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবনী বিষয়ক গ্রন্থের তাহকীক)

تحقيق فقه السيرة لمحمد الغزالي

৩৮) ইমাম নাসাঈ রচিত কিতাবুল ইলম গ্রন্থের তাহকীক, তাখরীজ ও তাতে টিকা সংযোজন)

تحقيق و تخريج كتاب العلم للحافظ أبي خيثمة زهير بن حرب النسائي

৩৯) হাফেয ইবনে রজব হাম্বলী রহ. রচিত কালিমাতুল ইখলাস কিতাবের তাহকীক, তাখরীজ ও তাতে টিকা সংযোজন)

كلمة الإخلاص وتحقيق معناها للحافظ ابن رجب الحنبلي

৪০) মুখতাসারুশ শামাইলিল মুহাম্মাদিয়্যাহ। (ইমাম তিরমিযী রচিত শামাইলে মুহাম্মাদিয়া বা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর স্বভাব-চরিত্র ও দেহাবয়ব বিষয়ক কিতাবের তাহকীক ও সংক্ষিপ্ত করণ)

مختصر الشمائل المحمدية للإمام أبي عيسى محمد بن سورة الترمذي صاحب السنن

৪১) সালাতুর রাগাইব তথা রজব মাসের বিদআত সালাতুর রাগাইব প্রসঙ্গে দু মহামান্য ইমাম আল ইয ইবনু আব্দিস সালাম ও ইবনুস সালাহ এর মাঝে সংঘটিত মুনাযারা)

مساجلة علمية بين الإمامين الجليلين العز بن عبد السلام و ابن الصلاح حول صلاة الرغائب المبتدعة

৪৩) নাসবুল মাজানীক (গারানিকের ঘটনা প্রসঙ্গে বিভ্রান্তির জবাব)

نصب المجانيق لنسف قصة الغرانيق

৪৪) কিসসাতুল মাসীহিদ দাজ্জাল ও নুযুলি ঈসা আলাইহিস সালাম (দাজ্জাদ ও ঈসা আলাইহিস সালাম এর অবতরণ প্রসঙ্গ)

قصة المسيح الدجال ونزول عيسى عليه الصلاة و السلام وقتله إياه على سياق رواية أبي أمامة رضي الله عنه مضافا إليه ما صح عن غيره من الصحابة رضي الله عنهم

৪৫) ফিকহুল ওয়াকি (দাওয়াহর ক্ষেত্রে বাস্তব পরিস্থিতির জ্ঞান থাকা প্রসঙ্গে একটি গবেষণা মূলক বই)

حول فقه الواقع

৪৬) সিফাতুল ফাতওয়া (ইমাম আহমাদ বিন হামদান রচিত ফতোয়া, মুফতী এবং ফতোয়া প্রার্থীর বিবরণ শীর্ষক কিতাবের তাহকীক)

تحقيق صفة الفتوى والمفتي والمستفتي للإمام أحمد بن حمدان الحراني الحنبلي

৪৭) হুকুকুন নিসা (মুহাম্মদ রশীদ রেযা কর্তৃক রচিত ইসলামে নারী অধিকার শীর্ষক কিতাবের তাহকীক ও তাতে টিকা সংযোজন)

حقوق النساء في الإسلام وحظهن من الإصلاح المحمدي لمحمد رشيد رضا

৪৮) হুকমু তারিকিস সালাহ (সালাত পরিত্যাগ কারীর বিধান)।

حكم تارك الصلاة

৪৯) সিফাতুস সালাহ (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সালাত -তাকবীর থেকে সালাম পর্যন্ত যেন আপনি তাঁকে দেখছেন)।

صفة صلاة النبي صلى الله عليه وسلم من التكبير إلى التسليم كأنك تراها

৫০) তারাজুতুশ শাইখ আল আলবানী (আল্লামা আলবানী রহ. যে সকল হাদীসের উপর সহীহ কিংবা যঈফ হুকুম প্রদানের ক্ষেত্রে মত পরিবর্তন করেছেন)

تراجعات الشيخ الألباني في بعض أحكامه الحديثية

এছাড়াও আল্লামা আলবানী রহ. এর লিখিত হাদীসের খেদমতে এবং ইসলামে বিভিন্ন বিষয় প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত অনেক গ্রন্থ রয়েছে। লেখার কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় সেগুলো এখানে উল্লেখ করা হল না।

◈ আন্তর্জাতিক বাদশাহ ফায়সাল পুরস্কার:

ইসলামী জ্ঞান-গবেষণা ও ইসলামী শিক্ষার প্রচারে অবদানের জন্য তাকে ১৪১৯ হিজরী মোতাবেক ১৯৯৯ ইং সনে আন্তর্জাতিক বাদশাহ ফায়সাল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। তার পুরস্কারের শিরোনাম ছিল: “প্রায় একশ’র অধিক পুস্তক রচনার মধ্য দিয়ে হাদীসের তাহকীক, তাখরীজ ও গবেষণা ইত্যাদি ক্ষেত্রে হাদীসের সেবায় বিশেষ অবদানের জন্য সিরিয় নাগরিক সম্মানিত শাইখ মুহাম্মদ নাসিরুদ্দীন আলবানীকে এ পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হল।”

◈ তাঁর ব্যাপারে আলেমগণের ভূয়সী প্রশংসা:

১) শাইখ মুহাম্মদ বিন ইবরাহীম রহ.বলেন:
“তিনি ছিলেন সুন্নতের অনুসারী, হকের সাহায্যকারী এবং বাতিল পন্থীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী।”

২) শাইখ আব্দুল্লাহ বিন বায রহ. বলেন:

“বর্তমান বিশ্বে আসমানের নিচে আল্লামা মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানীর মত এত বড় হাদীসের আলেম আমি দেখি নি।”

শাইখ বিন বায রহ. এর নিকট এই হাদীসটি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। যে হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “আল্লাহ তায়ালা প্রতি একশ বছরের মাথায় এই উম্মতের জন্য এমন একজনকে পাঠাবেন যিনি দ্বীন-ইসলামকে সংস্কার করবেন।” তিনি বলেন: আমার ধারণা, শাইখ মুহাম্মদ নাসিরুদ্দীন আলবানী হলেন এ যুগের মুজাদ্দিদ বা সংস্কারক। আল্লাহ সব চেয়ে ভাল জানেন।

৩) আল্লামা শাইখ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমীন রহ. বলেন:

“শাইখের সাথে বৈঠকাদীতে বসার পর (যদিও তা কম) যা বুঝতে পেরেছি তা হল: তিনি সন্নাহর প্রতি আমল এবং আমল-আকীদা উভয় ক্ষেত্রেই বিদয়াত উৎখাতে খুবই আগ্রহী। আর তার লিখিত বই-পুস্তক পড়ে তার ব্যাপারে জানতে পারলাম যে, তিনি হাদীসের সনদ ও মতন উভয় ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অধিকারী। এ সকল বই-পুস্তক দ্বারা আল্লাহ তায়ালা অনেক মানুষকে উপকৃত করেছেন-যেভাবে জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে তারা লাভবান হয়েছে তদ্রূপ নীতি নির্ধারণ এবং ইলমে হাদীসের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির ক্ষেত্রেও তারা লাভবান হয়েছেন। এটি মুসলমানদের জন্য বড় একটি বড় প্রাপ্তি। আল হামদুলিল্লাহ। আর ইলমে হাদীসের ক্ষেত্রে তার জ্ঞানগর্ভ গবেষণা সত্যি চমৎকৃত হওয়ার মত।”

৪) খ্যাতনামা মুফাসসির আল্লামা শাইখ মুহাম্মদ আল আমীন আশ শানকীতী:

শাইখ আব্দুল আজীজ আল হাদ্দাহ বলেন: আল্লামা শানকীতী শাইখ আলবানীকে বিষ্ময়করভাবে সম্মান করতেন। তিনি মদীনার মসজিদে হারামে দারস প্রদান করার সময় যদি শাইখ আলবানীকে হেঁটে যেতে দেখতে তিনি তার সম্মানে দাঁড়িয়ে যেতেন এবং সালাম প্রদান করতেন।

৫) শাইখ মুকবিল আল ওয়াদাঈ:

“আমি যে আকীদা পোষণ করি এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে দ্বীন হিসেবে মনে করি তা হল, শাইখ মুহাম্মদ নাসিরুদ্দীন আলবানী হলেন সে সকল মুজাদ্দিদগণের অন্তর্ভুক্ত যাদের ব্যাপারে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই হাদীসটি প্রযোজ্য: “আল্লাহ তায়ালা প্রতি একশ বছরের মাথায় এই উম্মতের জন্য এমন একজনকে পাঠাবেন যিনি দ্বীন-ইসলামকে সংস্কার করবেন।”

◈ শাইখের স্ত্রী-পরিবার:

ইমাম আলবানী রহ. মোট চার জন বিবাহ করেছিলেন। এদের মধ্যে ৩ স্ত্রীর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা তাকে ১২ জন সন্তান দান করেছিলেন। বয়স অনুপাতে তাদের নাম:

১ম স্ত্রী থেকে:

১) আব্দুর রহমান
২) আব্দুল লতীফ
৩) আব্দুর রাযযাক
দ্বিতীয় স্ত্রী থেকে:

৪) আব্দুল মুসাব্বির
৫) আব্দুল আ‘’লা
৬) মুহাম্মদ
৭) আব্দুল মুহাইমিন
৮) আনীসা
৯) আসিয়া
৯) সুলামা
১০) হাসসানাহ
১১) সাকীনাহ
তৃতীয় স্ত্রী থেকে-

১২) হেবাতুল্লাহ
চতুর্থ স্ত্রী থেকে কোন সন্তান জন্ম গ্রহণ করে নি।

◈ আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী রহ. এর অন্তিম ওসিয়ত:

প্রথমত: আমি আমার স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, বন্ধু-বান্ধব ও যারা আমাকে ভালবাসে তাদের নিকট এই ওসিয়ত করছি, যখন তাদের কাছে আমার মৃত্যু সংবাদ পৌছবে তারা যেন আমার জন্য আল্লাহর নিকট রহমত ও মাগফিরাত কামনা করে দুয়া করে এবং আমার মৃত্যুতে কেউ যেন নিয়াহা বা উচ্চ আওয়াজে ক্রন্দন না করে।

দ্বিতীয়ত: যেন অনতি বিলম্বে আমাকে দাফন করা হয় এবং প্রয়োজনীয় কাফন-দাফনের প্রস্তুতির জন্য যাদেরকে না হলেই নয় তাদেরকে ছাড়া নিকটাত্মীয় বা বন্ধু-বান্ধবকে মৃত্যুর সংবাদ দিতে গিয়ে যেন দাফন কর্ম বিলম্ব না করে। আমাকে গোসল দেয়ার দায়িত্ব পালন করবে আবু আব্দুল্লাহ ইজ্জত খাযার এবং তিনি যাকে এ কাজে সহযোগিতার জন্য পছন্দ করবেন। তিনি আমার প্রতিবেশী এবং একান্ত অন্তরঙ্গ বন্ধু।

তৃতীয়: তিনি মৃত্যুর আগেই তার বাড়ির অদূরেই কবরের জন্য জায়গা নির্ধারণ করে দেন। যেন গাড়িতে উঠিয়ে তার লাশ বহন করে দূরে নিতে না হয় কিংবা কবর দিতে আসা লোকজনকে গাড়িতে চড়ে লাশের সাথে যেতে না হয়। সেই সাথে এমন পুরনো গোরস্থানে যেন তাকে কবর দেয়া হয় যেটার ব্যাপারে আশা করা যায় যে, সেটা আর খুঁড়া-খুঁড়ি করা হবে না।

আমি যদি দেশের বাইরে মারা যাই তবে আমার দাফন কর্ম সমাধান করার আগে যেন দেশে আমারসন্তান সন্তান-সন্ততি বা অন্য লোকজনকে খবর না দেয়া হয়। অন্যথায় তারা আবেগের বশবর্তী হয়ে হয়ত এমন কিছু করবে যার কারণে আমার দাফন কর্ম বিলম্ব হয়ে যাবে।

আল্লাহর নিকট প্রার্থনা, আমি যেন তার সাথে এমন অবস্থায় সাক্ষাৎ করি যে, তিনিমৃত্যুর আগেই আমার পূর্বাপর সকল গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন।

চতুর্থ: আর আমার লাইব্রেরীর ব্যাপারে ওসিওয়ত হল, লাইব্রেরীর প্রকাশিত, অপ্রকাশিত, পাণ্ডুলিপি, আমার লেখা বা অন্যের লেখা সকল বই-পুস্তক মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ওয়াকফ করছি। যেন কুরআন-সুন্নাহ ও সালফে-সালেহীনের মানহাজের দিকে দাওয়াতের পথে এগুলো স্মৃতি হিসেবে অবশিষ্ট থেকে যায়। কারণ, আমি এককালে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলাম। আল্লাহর নিকট আশা করি, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক থাকা অবস্থায় তিনি যেভাবে আমার মাধ্যমে ছাত্রদের উপকার করেছেন ঠিক সেই ভাবে আমার লাইব্রেরীতে যে সকল মানুষ জ্ঞানার্জনের জন্য আসবে তারাও যেন এগুলো থেকে উপকৃত হয়। আর আমি নিজেও যেন তাদের দুয়ার মাধ্যমে লাভবান হই।

رب أوزعني أن أشكر نعمتك التي أنعمت علي و على والدي و أن أعمل صالحاً ترضاه و أصلح لي في ذريتي إني تبت إليك و إني من المسلمين

“হে প্রভু, তুমি আমাকে এবং আমার পিতা-মাতাকে যে নেয়ামত দিয়েছ তার শুকরিয়া আদায়ের তাওফীক দান কর। আরও তাওফীক দান কর এমন নেক আমল করার যাতে তুমি সন্তুষ্ট হও। আমার উপকারের জন্যে আমার সন্তান-সন্ততিকে পরিশুদ্ধ করে দাও। আমি তোমার নিকট তওবা করলাম। নিশ্চয় আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত।”
২৭ জুমাদাল আওয়াল ১৪১০ হিজরী।

◈ আখিরাতের পথে যাত্রা:

আল্লামা আলবানী রহ. এই নশ্বর জগত ছেড়ে আখিরাতের পথে যাত্রা করেন শনিবার, ২২ জুমাদাল আখেরা, ১৪২০ হিজরী, মোতাবেক ২ অক্টোবর, ১৯৯৯ খৃষ্টাব্দ।

মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল প্রায় ৮৮ বছর।

যে দিন মারা যান সে দিনই ইশার সালাতের পরে তাকে দাফন দেয়া হয়।

তার নামাযে জানাযার ইমামতি করেন তার ছাত্র শাইখ ইবরাহীম শাকরাহ। জানাযায় তার ছেলেরা, আত্মীয়-স্বজন, ছাত্র, বন্ধু-বান্ধব ও সাধারণ মানুষ সহ প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ অংশ গ্রহণ করেন।

লাশ দাফন করা হয় উমানের রাজধানী আল হামলান নামীয় পাহাড়ে নিজ বাড়ি সংলগ্ন পারিবারিক গোরস্থানে।

(আল্লাহ তাআলা শাইখ আলবানীকে অবরিত রহমত বর্ষণে সিক্ত করুন। আমীন)

দুটি কারণে শাইখের দাফন তাড়াতাড়ি দেয়া হয়:

প্রথমত: তার ওসিয়ত বাস্তবায়ন।
দ্বিতীয়ত: শাইখের মৃত্যুর সময়কালটা ছিল খুব গরম। তাই যেন দাফন দিতে আসা লোকজনের কষ্ট না হয়ে যায় ।
যদিও শাইখের মৃত্যুর সংবাদ নিকটাত্মীয় ও কাফন-দাফনে সহযোগিতা করার জন্য বিশেষ কিছু লোককে ছাড়া অন্য কাউকে দেয়া হয় নি এবং মৃত্যু বরণের পর দাফন করতে তেমন বিলম্বও করা হয় নি তথাপি তারা জানাজায় প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের সমাগম হয়। কারণ,যে ব্যক্তিই তার মৃত্যুর খবর জানতে পেরেছে সেই অন্য ভাইকে এই খবর পৌঁছিয়ে দিয়েছে।

পরিশেষে দুয়া করি, ইলমে হাদীসের এই মহান খাদেমকে আল্লাহ তায়ালা যেন মুসলিম উম্মাহর পক্ষ থেকে উত্তম প্রতিদানে ভূষিত করেন। আমীন।
▬▬▬◆◯◆▬▬▬
অনুবাদ ও গ্রন্থনা:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
(লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদী আরব)
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদী আরব
প্রথম প্রকাশ: ২ জুন, ২০১২ ইং
২য় সংস্করণ: জুলাই২০১৬ ইং

(ترجمة مختصرة للشيخ العلامة محمد ناصر الدين الألباني رحمه الله (باللغة البنغالية
قام بترجمتها و ترتيبها الداعية/عبد الله الهادي بن عبد الله الجليل
টিকা:

[1] ১) হাদীস বর্ণনাকারীদের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কিত অবস্থা পর্যালোচনা মূলক জ্ঞানকে ইলমুল জারহে ওয়াত তাদীল বলা হয়।
[2] ২) যে ইলমের মাধ্যমে গ্রহণীয় বা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার দিক দিয়ে বর্ণনাকারী ও বর্ণিত হাদীস বিষয়ে পর্যালোচনা করা হয় তাকে ইলমে মুস্তালাহুল হাদীস বলা হয়।
————-
উৎস:
http://www.alalbany.net
http://www.alukah.net/authors/view/home/926/