আযান সম্পর্কে বিস্তারিত

প্রশ্ন: আযানের সংজ্ঞা কি? আযানের প্রারম্ভিক ইতিহাস ও ফজিলত কি? আযানের শব্দাবলী কয়টি ও কি কি?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: আযান অর্থ আহবান করা, ঘোষণা করা।পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের জন্য নির্দিষ্ট সময়ে শরীআত সম্মত উপায়ে উচ্চৈঃস্বরে সালাতের ঘোষণা প্রদানকে আযান বলা হয়। ১ম হিজরী সনে আযানের প্রচলন হয়। (মির‘আত ২/৩৪৪-৩৪৫)। আযানের নাম এ জন্য আযান হয়েছে, যেহেতু মুয়াজ্জিন‎ সাহেব মানুষদেরকে সালাতের সময় জানিয়ে দেন ও তার ঘোষণা প্রদান করেন। আযানের আরেক নাম হচ্ছে ‘নিদা’ অর্থাৎ আহ্বান। কারণ, মুয়াজ্জিন‎ সাহেব লোকদেরকে ডাকেন ও তাদেরকে সালাতের দিকে আহ্বান করেন। (শারহুল উমদাহ লি ইবন তাইমিয়া: (২/৯২)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,“আর যখন তোমরা সালাতের দিকে ডাক, তখন ‎তারা একে উপহাস ও খেল-তামাশারূপে গ্রহণ ‎করে। তা এই কারণে যে, তারা এমন কওম, যারা ‎বুঝে না”। (সুরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ৫৮)।

তিনি আরো বলেন,“যখন জুমু‘আর দিনে সালাতের জন্য আহ্বান করা হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের দিকে ধাবিত হও”।‎ (সূরা আল-জুমু‘আ, আয়াত: ৯)।
.
পাঁচ ওয়াক্ত ও জুমু‘আর সালাত আদায়ের জন্য আযান ও ইকামত দেওয়া পুরুষদের ওপর ফরযে কিফায়া, নারীদের ওপর নয়।সালাতের প্রত্যেক ওয়াক্তের জন্য পৃথকভাবে আযান দিতে হবে। ক্যাসেট বা সিডিতে আযান সংরক্ষণ করে সেটি প্রতি ওয়াক্তে শ্রবণ করানোর দ্বারা আযান প্রদান করা হলে তা বাতিল হবে। কেননা আযান দেওয়া ইবাদত।আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেন, “নামাযের সময় উপস্থিত হলে তোমাদের একজন আযান দেবে এবং তোমাদের মধ্যে যে বড় সে ইমামতি করবে।” (সহীহ বুখারী ৬২৮ মুসলিম, নাসাঈ)।

আযান ইসলামের অন্যতম নিদর্শন ও প্রতীক। কোন গ্রাম বা শহরবাসী তা ত্যাগ করলে ইমাম (রাষ্ট্রপ্রধান) তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করবেন।যেমন-মহানবী (ﷺ) অভিযানে গেলে কোন জনপদ থেকে আযানের ধ্বনি শুনলে তাদের উপর আক্রমণ করতেন না। (বুখারী ৬১০ নং, মুসলিম, সহীহ)।

সফরে একা থাকলে অথবা মসজিদ খুবই দূর হলে এবং আযান শুনতে না পাওয়া গেলে একাই আযান ও ইকামত দিয়ে নামায পড়া সুন্নত। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৫৫)।

আযানের ইতিহাস: ওমর ফারুক (রাঃ) সহ একদল সাহাবী একই রাতে আযানের একই স্বপ্ন দেখেন ও পরদিন সকালে ‘অহি’ দ্বারা প্রত্যাদিষ্ট হলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তা সত্যায়ন করেন এবং বেলাল (রাঃ) কে সেই মর্মে ‘আযান’ দিতে বলেন। (আবুদাঊদ হা/৪৯৯, ‘আওনুল মা‘বূদ হা/৪৯৪-৪৯৫, ২/১৬৫-৭৫; আবুদাঊদ, দারেমী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৬৫০)।

সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন যায়েদ (রাঃ) সর্বপ্রথম পূর্বরাতে স্বপ্নে দেখা আযানের কালেমা সমূহ সকালে এসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকটে বর্ণনা করেন। পরে বেলালের কণ্ঠে একই আযান ধ্বনি শুনে হযরত ওমর (রাঃ) বাড়ী থেকে বেরিয়ে চাদর ঘেঁষতে ঘেঁষতে ছুটে এসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলেন, ‘যিনি আপনাকে ‘সত্য’ সহকারে প্রেরণ করেছেন,তাঁর কসম করে বলছি আমিও অনুরূপ স্বপ্ন দেখেছি’। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ‘ফালিল্লা-হিল হাম্দ’ বলে আল্লাহর প্রশংসা করেন।’ (আবুদাঊদ, (আওনুল মা‘বূদ সহ) হা/৪৯৫; মিশকাত হা/৬৫০)। একটি বর্ণনা মতে ঐ রাতে ১১ জন সাহাবী একই আযানের স্বপ্ন দেখেন।’ (মিরক্বাত শরহ মিশকাত ‘আযান’ অনুচ্ছেদ ২/১৪৯ পৃঃ)।

উল্লেখ্য যে, ওমর ফারূক (রাঃ) ২০ দিন পূর্বে উক্ত স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু আব্দুল্লাহ বিন যায়েদ আগেই বলেছে দেখে লজ্জায় তিনি নিজের কথা প্রকাশ করেননি। [আবুদাঊদ (আওনুল মা‘বূদ সহ) হা/৪৯৪ ‘আযানের সূচনা’ অনুচ্ছেদ]।

আযান প্রদানের ফজিলত: নি:সন্দেহে আজান ইসলামের এক বিরাট নিদর্শন।মুওয়াযযিনের মর্যাদা সম্পর্কে বহু বর্ননা রয়েছে। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, “সে ব্যক্তি অপেক্ষা আর কার কথা উৎকৃষ্ট,যে ব্যক্তি আল্লাহর দিকে মানুষকে আহ্বান করে, সৎকাজ করে এবং বলে আমি একজন ‘মুসলিম’ (আত্মসমর্পণ কারী)?” (কুরআন মাজীদ ৪১/৩৩)।

প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন, “লোকে যদি আযান ও প্রথম কাতারের মাহাত্ম জানত, অতঃপর তা লাভের জন্য লটারি করা ছাড়া আর অন্য কোন উপায় না পেত, তাহলে তারা লটারিই করত।” (বুখারী ৬১৫, মুসলিম, সহীহ ৪৩৭)।আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেন, মুওয়াযযিনের আযানের আওয়ায যত দূর যাবে তত দূর পর্যন্ত সকল মানুষ, জিন এবং সমুদয় বস্ত্ত তার জন্য ক্বিয়ামতের দিন সাক্ষ্য দিবে। [সহীহ বুখারী হা/৬০৯; মিশকাত হা/৬৫৬]। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেন যে, মুওয়াযযিনদের গর্দান ক্বিয়ামতের দিনে সর্বাধিক দীর্ঘ হবে। [সহীহ বুখারী হা/৬০৯; মিশকাত হা/৬৫৬]।

মুওয়ায্যিনের আযান ধ্বনির শেষ সীমা পর্যন্ত সজীব ও নির্জীব সকল বস্ত্ত তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে ও সাক্ষ্য প্রদান করে। ঐ আযান শুনে যে ব্যক্তি সালাতে যোগ দিবে, সে ২৫ সালাতের সমপরিমাণ নেকী পাবে। মুওয়ায্যিনও উক্ত মুছল্লীর সমপরিমাণ নেকী পাবে এবং তার দুই আযানের মধ্যবর্তী সকল (সগীরা) গুনাহ মাফ করা হবে।’ (নাসাঈ, আহমাদ, মিশকাত হা/৬৬৭)।

আযান ও এক্বামতের ধ্বনি শুনলে শয়তান ছুটে পালিয়ে যায় ও পরে ফিরে আসে।’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৬৫৫)। যে ব্যক্তি বার বছর যাবৎ আযান দিল, তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে গেল। তার প্রতি আযানের জন্য ৬০ নেকী ও এক্বামতের জন্য ৩০ নেকী লেখা হয়’। (ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৬৭৮)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ইমাম হ’ল (মুসল্লীদের সালাতের) যামিন ও মুওয়ায্যিন হ’ল (তাদের সালাতের) আমানতদার।
অতঃপর তিনি তাদের জন্য দো‘আ করে বলেন, হে আল্লাহ! তুমি ইমামদের সুপথ প্রদর্শন কর ও মুওয়ায্যিনদের ক্ষমা কর। (আহমাদ,আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৬৬৩)। তবে ৭ বছর আযান দিলে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে মর্মে বর্ণিত হাদীসটি যঈফ। (তিরমিযী হা/২০৬, মিশকাত হা/৬৬৪)।

আযানের শব্দাবলী: মহানবী (ﷺ) এর মুআযযিন ছিল মোট ৪ জন। মদ্বীনায় ২ জন; বিলাল বিন রাবাহ্‌ ও আমর বিন উম্মে মাকতূম কুরাশী। আম্‌র ছিলেন অন্ধ।আর কুবায় ছিলেন সা’দ আল-কুর্য। মক্কায় আবু মাহ্‌যূরাহ্‌ আওস বিন মুগীরাহ্‌ জুমাহী। (যাদুল মাআদ, ইবনুল কাইয়েম ১/১২৪)। আব্দুল্লাহ বিন যায়দ (রাঃ) এর বর্ণিত বিলাল (রাঃ) এর আযান ছিল নিম্নরুপ:-

১. আল্লা-হু আকবার (অর্থ : আল্লাহ সবার চেয়ে বড়) اللهُ أَكْبَرُ ….৪ বার

২. আশহাদু আল লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ أَشْهَدُ أَن لاَّ إلَهَ إِلاَّ اللهُ ….২ বার

(আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই)

৩. আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ أَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا رَّسُوْلُ اللهِ ….২ বার

(আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল)

৪. হাইয়া ‘আলাছ ছালা-হ (ছালাতের জন্য এসো) حَيَّ عَلَى الصَّلاَةِ …২ বার

৫. হাইয়া ‘আলাল ফালা-হ (কল্যাণের জন্য এসো) حَيَّ عَلَى الْفَلاَحِ ….২বার

৬. আল্লা-হু আকবার (আল্লাহ সবার চেয়ে বড়) اللهُ أَكْبَرُ ….২ বার

৭. লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ (আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই) لآ إلَهَ إِلاَّ اللهُ১ বার মোট= ১৫ বার। (আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৬৫০; আবুদাঊদ হা/৪৯৯, ‘কিভাবে আযান দিতে হয়’ অনুচ্ছেদ-২৮; মির‘আত হা/৬৫৫, ২/৩৪৪-৩৪৫)।

ফজরের আযানের সময় হাইয়া ‘আলাল ফালা-হ এর পরে اَلصَّلاَةُ خَيْرٌ مِّنَ النَّوْمِ আসসালা-তু খায়রুম মিনান নাঊম’ (নিদ্রা হতে সালাত উত্তম) ২ বার বলবে। (আবুদাঊদ হা/৫০০-০১, ৫০৪; ‘আওনুল মা‘বূদ, আবু মাহ্যূরাহ হ’তে, হা/৪৯৬; মিশকাত হা/৬৪৫)। ইবনু রাসলান,আমীরুল ইয়ামানী ও শায়খ আলবানী একে তাহাজ্জুদের আযানের সাথে যুক্ত বলেন।(সুবুলুস সালাম হা/১৬৭-এর ব্যাখ্যা, ১/২৫০; তামামুল মিন্নাহ ১৪৭ পৃঃ)। আবদুর রহমান মুবারকপুরী বলেন, বরং ফজরের আযানের সাথে হওয়াটাই ‘হক’ (حق) এবং এটাই ব্যাপকভাবে গৃহীত মাযহাব।’ [তুহফা ১/৫৯৩, হা/১৯৮-এর ব্যাখ্যা দ্রঃ); রিয়াদ, লাজনা দায়েমাহ ফৎওয়া নং ১৩৯৬]। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬💠💠💠▬▬▬
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।