আক্বীদাহ সংক্রান্ত কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ মাসআলাহ (পর্ব-২)

উত্তরঃ না, আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গায়েবের খবর রাখতেন না। আল্লাহর কথাই এর দলীল। যেমন তিনি বলেন:

﴿قُل لاَّ أَمْلِكُ لِنَفْسِيْ نَفْعًا وَّلاَ ضَرًّا إِلاَّ مَا شَآءَ اللهُ وَلَوْ كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لاَسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوْءُ﴾ (الأعراف:১৮৮)

অর্থঃ :‘(হে মুহাম্মাদ! সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপনি ঘোষণা করে দিন যে, একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া আমার নিজের ভাল-মন্দ, লাভ-লোকসান, কল্যাণ-অকল্যাণ ইত্যাদি বিষয়ে আমার কোনই হাত নেই। আর আমি যদি গায়েবের খবর জানতাম, তাহলে বহু কল্যাণ লাভ করতে পারতাম, আর কোন প্রকার অকল্যাণ আমাকে স্পর্শ করতে পারত না। (আল-আ‘রাফ:১৮৮)

বাস্তবতার আলোকে আমরা একথা বলতে পারি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি গায়েবের খবর জানতেন, তাহলে অবশ্যই তিনি ওহুদের যুদ্ধে, বদরের যুদ্ধে, তায়েফে এবং আরো অন্যান্য অবস্থার পরিপেক্ষিতে কঠিন বিপদের সম্মুখীন হতেন না।

১২.প্রশ্ন: অনেক নামধারী বড় আলেম ও বক্তাগণ বলে থাকেন যে, আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দেহ বা শরীর মুবারক কবরের চারিপার্শ্বে যে সমস্ত মাটি রয়েছে সে সমস্ত মাটির মূল্য বা মর্যাদা অল্লাহর আরশের মূল্য বা মর্যাদার চেয়েও অনেক বেশী। এ কথাটি সঠিক?

উত্তর:  উল্লিখিত কথাটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, বানাওয়াট ও মিথ্যা, কেননা কুরআন ও হাদীছ থেকে এর স্বপক্ষে কোনই প্রমাণ পাওয়া যায় না।

১৩.প্রশ্ন: অনেকেই নামধারি পীর-মুর্শিদ, অলী-আওলিয়াদের এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অসীলা করে আল্লাহর নিকট দু‘আ  করে থাকে। এটা জায়েয কি জায়েয নয়?

উত্তর: উল্লিখিত বিষয়টি জায়েয নয়। কেননা মৃত ব্যক্তির অসীলা করে আল্লাহর কাছে দু‘আ করা নিষেধ বা হারাম। চাই সেই মৃতব্যক্তি কোন নবী বা রাসূল হৌক না কেন।

১৪. প্রশ্ন: ‘মীলাদ মাহফিল কায়েম করা অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্ম বার্ষিকী পালন করা  জায়েয কি জায়েয নয়? যদি জায়েয না হয়, তাহলে আমাদের দেশের অধিকাংশ আলেম-উলামাগণ মীলাদ পড়ান কেন?

উত্তর: ‘মীলাদ মাহফিল কায়েম করা অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম বার্ষিকী পালন করা নি:সন্দেহে না জায়েয। কারণ এর স্বপক্ষে কুরআন মাজীদ ও ছহীহ হাদীছ হতে এবং ছাহাবা কিরামের আমল ও পরবর্তী উলামায়ে মুজতাহিদীনদের তরফ থেকে কোনই প্রমাণ নেই। সেহেতু এটা ইসলামী শরীয়তে নতুন আবিষ্কার তথা বিদ‘আত। যার পরিণাম গোমরাহী, পথভ্রষ্ঠতা ও জাহান্নাম।

১৫.প্রশ্ন: মহান আল্লাহকে পূর্ণভাবে ভালবাসা বা আনুগত্য করার  উত্তম পদ্ধতি কী?

উত্তর: মহান আল্লাহকে পূর্ণভাবে ভালবাসার উত্তম পদ্ধতি হলো: খালেছ অন্তরে আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য করা, আর দ্বিধাহীন চিত্তে তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসরণ করা। মহান আল্লাহর কথাই এর দলীল। যেমন তিনি বলেন,

﴿قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّوْنَ اللهَ فَاتَّبِعُوْنِيْ يُحْبِبْكُمُ اللهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوْبَكُمْ وَاللهُ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ ﴾ ( آل عمران:৩১)

অর্থ:‘(হে রাসূল! সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপনার উম্মাতদেরকে) আপনি বলেদিন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালবাসতে চাও, তাহলে তোমরা আমারই অনুসরণ কর। তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন, আর তোমাদের পাপও ক্ষমা করে দেবেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাকারী দয়ালু।  (আলু-ইমরান: ৩১)

১৬.প্রশ্ন: আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে পূর্ণভাবে ভালবাসা বা অনুসরণ করার  উত্তম পদ্ধতি কী?

উত্তর: আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে পূর্ণভাবে ভালবাসার উত্তম পদ্ধতি হলো: রাসূল্লুাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রত্যেকটা নির্দেশ ও নিষেধকে মনে-প্রাণে মেনে নেওয়া। মোট কথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাতের উপর যথাযথভাবে আমল করার মাধ্যমে তাঁর সুন্নাতকে জীবিত রাখা। মহান আল্লাহর কথাই এর দলীল। যেমন তিনি বলেন:

﴿فَلاَ وَرَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُوْنَ حَتَّىَ يُحَكِّمُوْكَ فِيْمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لاَ يَجِدُوْا فِيْ أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوْا تَسْلِيْمًا﴾

অর্থ:‘অতএব (হে মুহাম্মাদ! সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপনার প্রতিপালকের কসম, তারা কখনই ঈমানদার হতে পারবে না। যতক্ষণ না তাদের মাঝে সৃষ্ট কোন ঝগড়া বা বিবাদের ব্যাপারে আপনাকে ন্যায় বিচারক হিসাবে মেনে না নিবে। অত:পর তারা আপনার ফায়ছালার ব্যাপারে নিজেদের মনে কোনরূপ সংকীর্ণতা বোধ না করে তা শান্তিপূর্ণভাবে কবূল করে নিবে। (আন-নিসা: ৬৫)

এ মর্মে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

“مَنْ عَمِلَ بِسُنَّتِي فَقَدْ أَحَبَّنِي وَمَنْ أَحَبَّنِي كَانَ مَعِيَ فِي الْجنَّة” (ذم الكلام وأهله)

অর্থ:‘যে ব্যক্তি আমার সুন্নাত অনুযায়ী আমল করল, সে আমাকে ভাল বাসল, আর যে আমাকে ভাল বাসল সে এর বিনিময়ে জান্নাতে আমার সাথে অবস্থান করবে। তিনি আরো বলেছেন:

“مَنْ أَحْيَا سُنَّتِيْ فَقَدْ أَحَبَّنِيْ، وَمَنْ أَحَبَّنِيْ كَانَ مَعِيَ فِي الْجَنَّةِ” (الاعتصام: حَدِيثٌ حَسَنٌ)

অর্থ:‘যে ব্যক্তি আমার সুন্নাতকে জীবিত রাখল সে যেন  আমাকে ভাল বাসল, আর যে ব্যক্তি আমাকে ভাল বাসল সে এর বিনিময়ে জান্নাতে আমার সাথে অবস্থান করবে। (আল-ই‘তেছাম: হাদীছ হাসান)।

১৭. প্রশ্ন: বিদআতের অর্থ কি? বা বিদআত কাকে বলা হয় ?

উত্তর: পারিভাষিক অর্থে সুন্নাতের বিপরিত বিষয়কে ‘বিদআত বলা হয়। আর শারঈ অর্থে বিদআত হলো: ‘আল্লাহর নৈকট্য হাছিলের উদ্দেশ্যে ধর্মের নামে নতুন কোন প্রথা চালু করা, যা শরীয়তের কোন ছহীহ দলীলের উপরে ভিত্তিশীল নয় (আল-ইতিছাম ১/৩৭পৃঃ)।

১৮. প্রশ্ন: বিদআতী কাজের পরিণতি কী কী?

উত্তর: বিদআতী কাজের পরিণতি হলো ৩ টি।

  • ১. ঐ বিদআতী কাজ আল্লাহর দরবারে গৃহীত হবেনা।
  • ২. বিদআতী কাজের ফলে মুসলিম সমাজে গোমরাহীর ব্যাপকতা লাভ করে।
  • ৩. আর এই গোমরাহীর ফলে বিদআতীকে জাহান্নাম ভোগ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

“مَنْ أَحْدَثَ فِيْ أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ ” (متفق عليه)

অর্থ: ‘যে ব্যক্তি আমাদের শরীয়তে এমন কিছু নতুন সৃষ্টি করল, যা তার মধ্যে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত। (বুখারী ও মুসলিম) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামআরো বলেছেন:

“وَإِيِّاكُمْ وَ مُحْدَثَاتِ الأُمُوْرِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٍ وَ كُلَّ ضَلاَلَةٍ فِيْ النَّارِ”

অর্থ: ‘আর তোমরা দ্বীনের মধ্যে নতুন সৃষ্টি করা হতে সাবধান থাক! নিশ্চয় প্রত্যেক নতুন সৃষ্টিই বিদআত, আর প্রত্যেক বিদ‘আতই হলো গোমরাহী, আর প্রত্যেক গোমরাহীর পরিণাম হলো জাহান্নাম। (আহমাদ, আবূদাঊদ, তিরমিযী)

১৯. প্রশ্নঃ আমাদের দেশে প্রচলিত কয়েকটি বড় ধরনের বিদআতী কাজ উল্লেখ করুন।

উত্তরঃ

  •  ১. ‘মীলাদ মাহফিলের অনুষ্ঠান করা।
  • ২. ‘শবে-বরাত পালন করা।
  • ৩. ‘শবে-মেরাজ পালন করা।
  • ৪. মৃতব্যক্তির কাযা বা ছুটে যাওয়া নামায সমূহের কাফ্ফারা আদায় করা।
  • ৫. মৃত্যুর পর ৭ম, ১০ম, অথবা ৪০তম দিনে মানুষদেরকে খাওয়ানো বা দুআর অনুষ্ঠান করা।
  • ৬. ‘ইছালে ছাওয়াব বা ছাওয়াব রেসানী বা ছাওয়াব বখশে দেওয়ার অনুষ্ঠান করা।
  • ৭. মৃতব্যক্তির রূহের মাগফিরাতের জন্য অথবা কোন বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে খতমে কুরআন অথবা খতমে জালালীর অনুষ্ঠান করা ইত্যাদি।
  • ৮. জোরে জোরে চিল্লিয়ে যিকর করা।
  • ৯. হালকায়ে যিকরের অনুষ্ঠান করা।
  • ১০. পীর সাহেবের কাছে মুরীদ হওয়।
  • ১১. মা-বোন ও স্ত্রীকে পীর সাহেবের কাছে মুরীদ হওয়ার জন্য এবং তাদের খেদমত করার জন্য পাঠানো।
  • ১২. ফরয, সুন্নাত, ও নফল তথা বিভিন্ন ধরনের নামায শুরু করার পূর্বে মুখে উচ্চারণ করে নিয়াত পড়া বিদ‘আত।
  • ১৩. পেশাব করার পরে পানি থাকা সত্বেও অধিকতর পবিত্রতা অর্জনের উদ্দেশ্যে কুলুখ নিয়ে ২০, ৪০,৭০ কদম হাটাহাটি করা, জোরে জোরে কাশি দেয়া, হেলা দুলা করা, পায়ে পায়ে কাচি দেয়া এসবই বেহায়াপনা কাজ ও স্পষ্ট বিদ‘আত।
  • ১৪. অনেকে ধারণা করেন যে, তাবলীগ জাম‘আতের সাথে যেয়ে ৩টা অথবা ৭টা চিল্লা দিলে ১হজের সওয়াব হয়। এ সমস্ত কথা সবই বানাওয়াট ও মিথ্যা, তথা বিদ‘আত।

২০.প্রশ্ন: যদি কোন ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নামে মিথ্যা হাদীছ তৈরি করে অর্থাৎ বানাওয়াট ও মনগড়া কথা মানুষের সামনে বর্ণনা করে বা বই পুস্তকে লিখে প্রচার করে, তাহলে তার পরিণতি কী হবে ?

উত্তর:  যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নামে মিথ্যা হাদীছ রচনা করে মানুষের কাছে বর্ণনা করে তার পরিণতি হবে জাহান্নাম। রাসূলের কথাই এর দলীল, যেমন তিনি বলেন:

“مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ”

অর্থ: যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার উপর মিথ্যা আরোপ করল, এর বিনিময়ে সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে বানিয়ে নিল।

আরও পড়ুন: আক্বীদাহ সংক্রান্ত কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ মাসআলাহ (পর্ব-১)

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

১১. প্রশ্নঃ আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি গায়েব বা অদৃশ্যের খবর জানতেন?১১. প্রশ্নঃ আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি গায়েব বা অদৃশ্যের খবর জানতেন?উত্তরঃ না, আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গায়েবের খবর রাখতেন না। আল্লাহর কথাই এর দলীল। যেমন তিনি বলেন:

﴿قُل لاَّ أَمْلِكُ لِنَفْسِيْ نَفْعًا وَّلاَ ضَرًّا إِلاَّ مَا شَآءَ اللهُ وَلَوْ كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لاَسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوْءُ﴾ (الأعراف:১৮৮)

অর্থঃ :‘(হে মুহাম্মাদ! সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপনি ঘোষণা করে দিন যে, একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া আমার নিজের ভাল-মন্দ, লাভ-লোকসান, কল্যাণ-অকল্যাণ ইত্যাদি বিষয়ে আমার কোনই হাত নেই। আর আমি যদি গায়েবের খবর জানতাম, তাহলে বহু কল্যাণ লাভ করতে পারতাম, আর কোন প্রকার অকল্যাণ আমাকে স্পর্শ করতে পারত না। (আল-আ‘রাফ:১৮৮)

বাস্তবতার আলোকে আমরা একথা বলতে পারি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি গায়েবের খবর জানতেন, তাহলে অবশ্যই তিনি ওহুদের যুদ্ধে, বদরের যুদ্ধে, তায়েফে এবং আরো অন্যান্য অবস্থার পরিপেক্ষিতে কঠিন বিপদের সম্মুখীন হতেন না।

১২.প্রশ্ন: অনেক নামধারী বড় আলেম ও বক্তাগণ বলে থাকেন যে, আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দেহ বা শরীর মুবারক কবরের চারিপার্শ্বে যে সমস্ত মাটি রয়েছে সে সমস্ত মাটির মূল্য বা মর্যাদা অল্লাহর আরশের মূল্য বা মর্যাদার চেয়েও অনেক বেশী। এ কথাটি সঠিক?

উত্তর:  উল্লিখিত কথাটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, বানাওয়াট ও মিথ্যা, কেননা কুরআন ও হাদীছ থেকে এর স্বপক্ষে কোনই প্রমাণ পাওয়া যায় না।

১৩.প্রশ্ন: অনেকেই নামধারি পীর-মুর্শিদ, অলী-আওলিয়াদের এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অসীলা করে আল্লাহর নিকট দু‘আ  করে থাকে। এটা জায়েয কি জায়েয নয়?

উত্তর: উল্লিখিত বিষয়টি জায়েয নয়। কেননা মৃত ব্যক্তির অসীলা করে আল্লাহর কাছে দু‘আ করা নিষেধ বা হারাম। চাই সেই মৃতব্যক্তি কোন নবী বা রাসূল হৌক না কেন।

১৪. প্রশ্ন: ‘মীলাদ মাহফিল কায়েম করা অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্ম বার্ষিকী পালন করা  জায়েয কি জায়েয নয়? যদি জায়েয না হয়, তাহলে আমাদের দেশের অধিকাংশ আলেম-উলামাগণ মীলাদ পড়ান কেন?

উত্তর: ‘মীলাদ মাহফিল কায়েম করা অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম বার্ষিকী পালন করা নি:সন্দেহে না জায়েয। কারণ এর স্বপক্ষে কুরআন মাজীদ ও ছহীহ হাদীছ হতে এবং ছাহাবা কিরামের আমল ও পরবর্তী উলামায়ে মুজতাহিদীনদের তরফ থেকে কোনই প্রমাণ নেই। সেহেতু এটা ইসলামী শরীয়তে নতুন আবিষ্কার তথা বিদ‘আত। যার পরিণাম গোমরাহী, পথভ্রষ্ঠতা ও জাহান্নাম।

১৫.প্রশ্ন: মহান আল্লাহকে পূর্ণভাবে ভালবাসা বা আনুগত্য করার  উত্তম পদ্ধতি কী?

উত্তর: মহান আল্লাহকে পূর্ণভাবে ভালবাসার উত্তম পদ্ধতি হলো: খালেছ অন্তরে আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য করা, আর দ্বিধাহীন চিত্তে তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসরণ করা। মহান আল্লাহর কথাই এর দলীল। যেমন তিনি বলেন,

﴿قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّوْنَ اللهَ فَاتَّبِعُوْنِيْ يُحْبِبْكُمُ اللهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوْبَكُمْ وَاللهُ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ ﴾ ( آل عمران:৩১)

অর্থ:‘(হে রাসূল! সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপনার উম্মাতদেরকে) আপনি বলেদিন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালবাসতে চাও, তাহলে তোমরা আমারই অনুসরণ কর। তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন, আর তোমাদের পাপও ক্ষমা করে দেবেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাকারী দয়ালু।  (আলু-ইমরান: ৩১)

১৬.প্রশ্ন: আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে পূর্ণভাবে ভালবাসা বা অনুসরণ করার  উত্তম পদ্ধতি কী?

উত্তর: আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে পূর্ণভাবে ভালবাসার উত্তম পদ্ধতি হলো: রাসূল্লুাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রত্যেকটা নির্দেশ ও নিষেধকে মনে-প্রাণে মেনে নেওয়া। মোট কথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাতের উপর যথাযথভাবে আমল করার মাধ্যমে তাঁর সুন্নাতকে জীবিত রাখা। মহান আল্লাহর কথাই এর দলীল। যেমন তিনি বলেন:

﴿فَلاَ وَرَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُوْنَ حَتَّىَ يُحَكِّمُوْكَ فِيْمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لاَ يَجِدُوْا فِيْ أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوْا تَسْلِيْمًا﴾

অর্থ:‘অতএব (হে মুহাম্মাদ! সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপনার প্রতিপালকের কসম, তারা কখনই ঈমানদার হতে পারবে না। যতক্ষণ না তাদের মাঝে সৃষ্ট কোন ঝগড়া বা বিবাদের ব্যাপারে আপনাকে ন্যায় বিচারক হিসাবে মেনে না নিবে। অত:পর তারা আপনার ফায়ছালার ব্যাপারে নিজেদের মনে কোনরূপ সংকীর্ণতা বোধ না করে তা শান্তিপূর্ণভাবে কবূল করে নিবে। (আন-নিসা: ৬৫)

এ মর্মে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

“مَنْ عَمِلَ بِسُنَّتِي فَقَدْ أَحَبَّنِي وَمَنْ أَحَبَّنِي كَانَ مَعِيَ فِي الْجنَّة” (ذم الكلام وأهله)

অর্থ:‘যে ব্যক্তি আমার সুন্নাত অনুযায়ী আমল করল, সে আমাকে ভাল বাসল, আর যে আমাকে ভাল বাসল সে এর বিনিময়ে জান্নাতে আমার সাথে অবস্থান করবে। তিনি আরো বলেছেন:

“مَنْ أَحْيَا سُنَّتِيْ فَقَدْ أَحَبَّنِيْ، وَمَنْ أَحَبَّنِيْ كَانَ مَعِيَ فِي الْجَنَّةِ” (الاعتصام: حَدِيثٌ حَسَنٌ)

অর্থ:‘যে ব্যক্তি আমার সুন্নাতকে জীবিত রাখল সে যেন  আমাকে ভাল বাসল, আর যে ব্যক্তি আমাকে ভাল বাসল সে এর বিনিময়ে জান্নাতে আমার সাথে অবস্থান করবে। (আল-ই‘তেছাম: হাদীছ হাসান)।

১৭. প্রশ্ন: বিদআতের অর্থ কি? বা বিদআত কাকে বলা হয় ?

উত্তর: পারিভাষিক অর্থে সুন্নাতের বিপরিত বিষয়কে ‘বিদআত বলা হয়। আর শারঈ অর্থে বিদআত হলো: ‘আল্লাহর নৈকট্য হাছিলের উদ্দেশ্যে ধর্মের নামে নতুন কোন প্রথা চালু করা, যা শরীয়তের কোন ছহীহ দলীলের উপরে ভিত্তিশীল নয় (আল-ইতিছাম ১/৩৭পৃঃ)।

১৮. প্রশ্ন: বিদআতী কাজের পরিণতি কী কী?

উত্তর: বিদআতী কাজের পরিণতি হলো ৩ টি।

  • ১. ঐ বিদআতী কাজ আল্লাহর দরবারে গৃহীত হবেনা।
  • ২. বিদআতী কাজের ফলে মুসলিম সমাজে গোমরাহীর ব্যাপকতা লাভ করে।
  • ৩. আর এই গোমরাহীর ফলে বিদআতীকে জাহান্নাম ভোগ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

“مَنْ أَحْدَثَ فِيْ أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ ” (متفق عليه)

অর্থ: ‘যে ব্যক্তি আমাদের শরীয়তে এমন কিছু নতুন সৃষ্টি করল, যা তার মধ্যে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত। (বুখারী ও মুসলিম) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামআরো বলেছেন:

“وَإِيِّاكُمْ وَ مُحْدَثَاتِ الأُمُوْرِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٍ وَ كُلَّ ضَلاَلَةٍ فِيْ النَّارِ”

অর্থ: ‘আর তোমরা দ্বীনের মধ্যে নতুন সৃষ্টি করা হতে সাবধান থাক! নিশ্চয় প্রত্যেক নতুন সৃষ্টিই বিদআত, আর প্রত্যেক বিদ‘আতই হলো গোমরাহী, আর প্রত্যেক গোমরাহীর পরিণাম হলো জাহান্নাম। (আহমাদ, আবূদাঊদ, তিরমিযী)

১৯. প্রশ্নঃ আমাদের দেশে প্রচলিত কয়েকটি বড় ধরনের বিদআতী কাজ উল্লেখ করুন।

উত্তরঃ

  •  ১. ‘মীলাদ মাহফিলের অনুষ্ঠান করা।
  • ২. ‘শবে-বরাত পালন করা।
  • ৩. ‘শবে-মেরাজ পালন করা।
  • ৪. মৃতব্যক্তির কাযা বা ছুটে যাওয়া নামায সমূহের কাফ্ফারা আদায় করা।
  • ৫. মৃত্যুর পর ৭ম, ১০ম, অথবা ৪০তম দিনে মানুষদেরকে খাওয়ানো বা দুআর অনুষ্ঠান করা।
  • ৬. ‘ইছালে ছাওয়াব বা ছাওয়াব রেসানী বা ছাওয়াব বখশে দেওয়ার অনুষ্ঠান করা।
  • ৭. মৃতব্যক্তির রূহের মাগফিরাতের জন্য অথবা কোন বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে খতমে কুরআন অথবা খতমে জালালীর অনুষ্ঠান করা ইত্যাদি।
  • ৮. জোরে জোরে চিল্লিয়ে যিকর করা।
  • ৯. হালকায়ে যিকরের অনুষ্ঠান করা।
  • ১০. পীর সাহেবের কাছে মুরীদ হওয়।
  • ১১. মা-বোন ও স্ত্রীকে পীর সাহেবের কাছে মুরীদ হওয়ার জন্য এবং তাদের খেদমত করার জন্য পাঠানো।
  • ১২. ফরয, সুন্নাত, ও নফল তথা বিভিন্ন ধরনের নামায শুরু করার পূর্বে মুখে উচ্চারণ করে নিয়াত পড়া বিদ‘আত।
  • ১৩. পেশাব করার পরে পানি থাকা সত্বেও অধিকতর পবিত্রতা অর্জনের উদ্দেশ্যে কুলুখ নিয়ে ২০, ৪০,৭০ কদম হাটাহাটি করা, জোরে জোরে কাশি দেয়া, হেলা দুলা করা, পায়ে পায়ে কাচি দেয়া এসবই বেহায়াপনা কাজ ও স্পষ্ট বিদ‘আত।
  • ১৪. অনেকে ধারণা করেন যে, তাবলীগ জাম‘আতের সাথে যেয়ে ৩টা অথবা ৭টা চিল্লা দিলে ১হজের সওয়াব হয়। এ সমস্ত কথা সবই বানাওয়াট ও মিথ্যা, তথা বিদ‘আত।

২০.প্রশ্ন: যদি কোন ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নামে মিথ্যা হাদীছ তৈরি করে অর্থাৎ বানাওয়াট ও মনগড়া কথা মানুষের সামনে বর্ণনা করে বা বই পুস্তকে লিখে প্রচার করে, তাহলে তার পরিণতি কী হবে ?

উত্তর:  যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নামে মিথ্যা হাদীছ রচনা করে মানুষের কাছে বর্ণনা করে তার পরিণতি হবে জাহান্নাম। রাসূলের কথাই এর দলীল, যেমন তিনি বলেন:

“مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ”

অর্থ: যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার উপর মিথ্যা আরোপ করল, এর বিনিময়ে সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে বানিয়ে নিল।